author
stringclasses
33 values
text
stringlengths
86
1.25M
জীবনানন্দ দাশ
পৃথিবীতে জীবনানন্দ দাশ শস্যের ভিতরে রৌদ্রে পৃথিবীর সকালবেলায় কোনো এক কবি ব’সে আছে; অথবা সে কারাগারে ক্যাম্পে অন্ধকারে; তবুও সে প্রীত অবহিত হ’য়ে আছে এই পৃথিবীর রোদে— এখানে রাত্রির গন্ধে— নক্ষত্রের তরে তাই সে এখানকার ক্লান্ত মানবীয় পরিবেশ সুস্থ ক’রে নিতে চায় পরিচ্ছন্ন মানুষের মতো, সব ভবিতব্যতার অন্ধকারে দেশ মিশে গেলে; জীবনকে সকলের তরে ভালো ক’রে পেতে হ’লে এই অবসন্ন ম্লান পৃথিবীর মতো অম্লান, অক্লান্ত হ’য়ে বেঁচে থাকা চাই। একদিন স্বর্গে যেতে হ’তো।
জীবনানন্দ দাশ
বিভিন্ন কোরাস জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীতে ঢের দিন বেঁচে থেকে আমাদের আয়ু এখন মৃত্যুর শব্দ শোনে দিনমান। হৃদয়কে চোখঠার দিয়ে ঘুমে রেখে হয়তো দুর্যোগে তৃপ্তি পেতে পারে কান; এ-রকম একদিন মনে হয়েছিলো; অনেক নিকটে তবু সেই ঘোর ঘনায়েছে আজ; আমাদের উঁচু-নিচু দেয়ালের ভিতরে খোড়লে ততোধিক গুনাগার আপনার কাজ ক’রে যায়; ঘরের ভিতর থেকে খ’সে গিয়ে সন্ততির মন বিভীষণ, নৃসিংহের আবেদন পরিপাক ক’রে ভোরের ভিতর থেকে বিকেলের দিকে চ’লৈ যায়, রাতকে উপেক্ষা ক’রে পুনরায় ভোরে ফিরে আসে; তবুও তাদের কোনো বাসস্থান নেই, যদিও বিশ্বাসে চোখ বুজে ঘর করেছি নির্মাণ ঢের আগে একদিন; গ্রাসাচ্ছাদন নেই তবুও তাদের, যদিও মাটির দিকে মুখ রেখে পৃথিবীর ধান রুয়ে গেছি একদিন; অন্য সব জিনিস হারায়ে, সমস্ত চিন্তার দেশ ঘুরে তবু তাহাদের মন অলোকসামান্যভাবে সুচিন্তাকে সুচিন্তাকে অধিকার ক’রে কোথাও সম্মুখে পথ, পশ্চাদ্‌গমন হারায়েছে— উতরোল নীরবতা আমাদের ঘরে। আমরা তো বহুদিন লক্ষ্য চেয়ে নগরীর পথে হেঁটে গেছি; কাজ ক’রে চলে গেছি অর্থভোগ ক’রে; ভোট দিয়ে মিশে গেছি জনমতামতে। গ্রন্থকে বিশ্বাস ক’রে প’ড়ে গেছি; সহধর্মীদের সাথে জীবনের আখড়াই, স্বাক্ষরের অক্ষরের কথা মনে ক’রে নিয়ে ঢের পাপ ক’রে, পাপকথা উচ্চারণ ক’রে, তবুও বিশ্বাসভ্রষ্ট হ’য়ে গিয়ে জীবনের যৌন একাগ্রতা হারাইনি; তবুও কোথাও কোনো প্রীতি নেই এতদিন পরে। নগরীর রাজপথে মোড়ে-মোড়ে চিহ্ন প’ড়ে আছে; একটি মৃতের দেহ অপরের শবকে জড়ায়ে তবুও আতঙ্কে হিম— হয়তো দ্বিতীয় কোনো মরণের কাছে। আমাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, নারী, হেমন্তের হলুদ ফসল ইতস্তত চ’লে যায় যে যাহার স্বর্গের সন্ধানে; কারু মুখে তবুও দ্বিরুক্তি নেই— পথ নেই ব’লে, যথাস্থান থেকে খ’সে তবুও সকলি যথাস্থানে র’য়ে যায়; শতাব্দীর শেষ হ’লে এ-রকম আবিষ্ট নিয়ম নেমে আসে; বিকেলের বারান্দার থেকে সব জীর্ণ নরনারী চেয়ে আছে পড়ন্ত রোদের পারে সূর্যের দিকে: খণ্ডহীন মণ্ডলের মতো বেলোয়ারি। ২ নিকটে মরুর মতো মহাদেশ ছড়ায়ে রয়েছে: যতদূর চোখ যায়— অনুভব করি; তবু তাকে সমুদ্রের তিতীর্ষু আলোর মতো মনে ক’রে নিয়ে আমাদের জানালায় অনেক মানুষ, চেয়ে আছে দিনমান হেঁয়ালির দিকে। তাদের মুখের পানে চেয়ে মনে হয় হয়তো বা সমুদ্রের সুর শোনে তা’রা, ভীত মুখশ্রীর সাথে এ-রকম অনন্য বিস্ময় মিশে আছে; তাহারা অনেক কাল আমাদের দেশে ঘুরে-ফিরে বেড়িয়েছে শারীরিক জিনিসের মতো; পুরুষের পরাজয় দেখে গেছে বাস্তব দৈবের সাথে রণে; হয়তো বস্তুর বল জিতে গেছে প্রজ্ঞাবশত; হয়তে বা দৈবের অজেয় ক্ষমতা— নিজের ক্ষমতা তার এত বেশি ব’লে শুনে গেছে ঢের দিন আমাদের মুখের ভণিতা; তবুও বক্তৃতা শেষ হ’য়ে যায় বেশি করতালি শুরু হ’লে। এরা তাহা জানে সব। আমাদের অন্ধকারে পরিত্যক্ত খেতের ফসল ঝাড়ে-গোছে অপরূপ হ’য়ে উঠে তবু বিচিত্র ছবির মায়াবল। ঢের দূরে নগরীর নাভির ভিতরে আজ ভোরে যাহারা কিছুই সৃষ্টি করে নাই তাহাদের অবিকার মন শৃঙ্খলায় জেগে উঠে কাজ করে— রাত্রে ঘুমায় পরিচিত স্মৃতির মতন। সেই থেকে কলরব, কাড়াকাড়ি, অপমৃত্যু, ভ্রাতৃবিরোধ, অন্ধকার সংস্কার, ব্যাজস্তুতি, ভয়, নিরাশার জন্ম হয়। সমুদ্রের পরপর থেকে তাই স্মিতচক্ষু নাবিকেরা আসে; ঈশ্বরের চেয়ে স্পর্শময় আক্ষেপে প্রস্তুত হ’য়ে অর্ধনারীশ্বর তরাইয়ের থেকে লুব্ধ বঙ্গোপসাগরে সুকুমার ছায়া ফেলে সূর্যিমামার নাবিকের লিবিডোকে উদ্বোধিত করে। ৩ ঘাসের উপর দিয়ে ভেসে যায় সবুজ বাতাস। অথবা সবুজ বুঝি ঘাস। অথবা নদীর নাম মনে ক’রে নিতে গেলে চারিদিকে প্রতিভাত হ’য়ে উঠে নদী দেখা দেয় বিকেল অবধি; অসংখ্য সূর্যের চোখে তরঙ্গের আনন্দে গড়ায়ে ডাইনে আর বাঁয়ে চেয়ে দ্যাখে মানুষের দুঃখ, ক্লান্তি, দীপ্তি, অধঃপতনের সীমা; উনিশশো বেয়াল্লিশ সালে ঠেকে পুনরায় নতুন গরিমা পেতে চায় ধোঁয়া, রক্ত, অন্ধ আধারের খাত বেয়ে; ঘাসের চেয়েও বেশি মেয়ে; নদীর চেয়েও বেশি উনিশশো তেতাল্লিশ, চুয়াল্লিশ, উৎক্রান্ত পুরুষের হাল; কামানের ঊর্ধ্বে রৌদ্রে নীলাকাশে অমল মরাল ভারতসাগর ছেড়ে উড়ে যায় অন্য এক সমুদ্রের পানে— মেঘের ফোঁটার মতো স্বচ্ছ, গড়ানে; সুবাতাস কেটে তা’রা পালকের পাখি তবু; ওরা এলে সহসা রোদের পথে অনন্ত পারুলে ইস্পাতের সূচীমুখ ফুটে ওঠে ওদের কাঁধের ’পরে, নীলিমার তলে; অবশেযে জাগরূক জনসাধারণ আজ চলে? রিরংসা, অন্যায়, রক্ত, উৎকোচ, কানাযুষো, ভয় চেয়েছে ভাবের ঘরে চুরি বিনে জ্ঞান ও প্রণয়? মহাসাগরের জল কখনো কি সৎবিজ্ঞাতার মতো হয়েছিলো স্থির— নিজের জলের ফেনশির নীড়কে কি চিনেছিলো তনুবাত নীলিমার নিচে? না হ’লে উচ্ছল সিন্ধু মিছে? তবুও মিথ্যা নয়: সাগরের বালি পাতালের কালি ঠেলে সময়সুখ্যাত গুণে অন্ধ হ’য়ে, পরে আলোকিত হ’য়ে গেলে
জীবনানন্দ দাশ
মানুষের মৃত্যু হ’লে জীবনানন্দ দাশ মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে। আজকের আগে যেই জীবনের ভিড় জমেছিলো তা’রা ম’রে গেছে; প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে অন্ধকারে হারায়েছে; তবু তা’রা আজকের আলোর ভিতরে সঞ্চারিত হ’য়ে উঠে আজকের মানুষের সুরে যথন প্রেমের কথা বলে অথবা জ্ঞানের কথা— অনন্ত যাত্রার কথা মনে হয় সে-সময় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের; চলেছে— চলেছে— একদিন বুদ্ধকে সে চেয়েছিলো ব’লে ভেবেছিলো। একদিন ধূসর পাতায় যেই জ্ঞান থাকে— তাকে। একদিন নগরীর ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে বিজ্ঞানে প্রবীণ হ’য়ে— তবু— কেন অম্বাপালীকে চেয়েছিলো প্রণয়ে নিবিড় হ’য়ে উঠে! চেয়েছিলো— পেয়েছিলো শ্রীমতীকে কম্প্র প্রাসাদে: সেই সিঁড়ি ঘুরে প্রায় নীলিমার গায়ে গিয়ে লাগে; সিঁড়ি উদ্ভাসিত ক’রে রোদ; সিঁড়ি ধ’রে ওপরে ওঠার পথে আরেক রকম বাতাস ও আলোকের আসা-যাওয়া স্থির ক’রে কি অসাধারণ প্রেমের প্রয়াণ? তবু— এই শেষ অনিমেষ পথে দেখেছে সে কোনো এক মহীয়সী আর তার শিশু; দু-জনেই মৃত। অথবা কেউ কি নেই! ওইখানে কেউ নেই। মৃত্যু আজ নারীনর্দামার ক্বাথে; অন্তহীন শিশুফুটপাতে; আর সেই শিশুদের জনিতার কিউক্লীবতায়। সকল রৌদ্রের মতো ব্যাপ্ত আশা যদি গোলকধাঁধায় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিলো? সূর্য যদি কেবলি দিনের জন্ম দিয়ে যায়, রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের, মানুষ কেবলি যদি সমাজের জন্ম দেয়, সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের, বিপ্লব নির্মম আবেশের, তা হ’লে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিলো? নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আছে; অথচ নগরী মৃত। সে-সিঁড়ির আশ্চর্য নির্জন দিগন্তরে এক মহীয়সী, আর তার শিশু; তবু কেউ নেই। ঢের ভারতীয় কাল— পৃথিবীর আয়ু— শেষ ক’রে জীবনের বঙ্গাব্দ পর্বের প্রান্তে ঠেকে, পুনরুদ্‌যাপনের মতন আরেকবার এই তেরোশো পঞ্চাশ সাল থেকে শুরু ক’রে ঢের দিন আমারো হৃদয় এই সব কথা ভেবে সৃষ্টির উৎস আর উৎসারিত মানুষকে তবু ধন্যবাদ দিয়ে যায়। কেননা সৃষ্টির নিহিত ছলনা ছেলে-ভুলোবার মতো তবু নয়; মানুষও ঘুমের আগে কথা ভেবে সব সমাধান ক’রে নিতে চায়; কথা ভেবে হৃদয় শুকায় জেনে কাজ করে। সময় এখনো শাদা জলের বদলে বোনভায়ের নিয়ত বিপন্ন রক্ত রোজ মানুষকে দিয়ে যায়; ফসলের পরিবর্তে মানুষের শরীরে মানুষ গোলাবাড়ি উঁচু ক’রে রেখে নিয়তির অন্ধকারে অমানব; তবুও গ্লানির মতো মানুষের মনের ভিতরে এই সব জেগে থাকে ব’লে শতকের আয়ু— আধো আয়ু— আজ ফুরিয়ে গেলেও এই শতাব্দীকে তা’রা কঠিন নিস্পৃহভাবে আলোচন ক’রে আশায় উজ্জ্বল রাখে; না হ’লে এ ছাড়া কোথাও অন্য কোনো প্রীতি নেই। মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে আরো ভালো— আরো স্থির দিকনির্ণয়ের মতো চেতনার পরিমাপে নিয়ন্ত্রিত কাজ কতো দূর অগ্রসর হ’য়ে গেল জেনে নিতে আসে।
জীবনানন্দ দাশ
যাত্রী জীবনানন্দ দাশ মনে হয় প্রাণ এক দূর স্বচ্ছ সাগরের কূলে জন্ম নিয়েছিলো কবে; পিছে মৃত্যুহীন জন্মহীন চিহ্নহীন কুয়াশার যে-ইঙ্গিত ছিলো— সেই সব ধীরে-ধীরে ভুলে গিয়ে অন্য এক মানে পেয়েছিলো এখানে ভূমিষ্ঠ হ’য়ে— আলো জল আকাশের টানে; কেন যেন কাকে ভালোবেসে। মৃত্যু আর জীবনের কালো আর শাদা হৃদয়ে জড়িয়ে নিয়ে যাত্রী মানুষ এসেছে এ-পৃথিবীর দেশে; কঙ্কাল অঙ্গার কালি— চারিদিকে রক্তের ভিতরে অন্তহীন করুণ ইচ্ছার চিহ্ন দেখে পথ চিনে এ-ধুলোয় নিজের জন্মের চিহ্ন চেনাতে এলাম; কাকে তবু? পৃথিবীকে? আকাশকে? আকাশে যে-সূর্য জ্বলে তাকে? ধুলোর কণিকা অণুপরমাণু ছায়া বৃষ্টি জলকণিকাকে? নগর বন্দর রাষ্ট্র জ্ঞান অজ্ঞানের পৃথিবীকে? যেই কুজ্ঝটিকা ছিলো জন্মসৃষ্টির আগে, আর যে-সব কুয়াশা রবে শেষে একদিন তার অন্ধকার অণজ আলোর বলয়ে এসে পড়ে পলে-পলে; নীলিমার দিকে মন যেতে চায় প্রেমে; সনাতন কালো মহাসাগরের দিকে যেতে বলে। তবু আলো পৃথিবীর দিকে সূর্য রোজ সঙ্গে ক’রে আনে যেই ঋতু যেই তিথি যে-জীবন যেই মৃত্যুরীতি মহাইতিহাস এসে এখনও জানেনি যার মানে; সেদিকে যেতেছে লোক গ্লানি প্রেম ক্ষয় নিত্য পদচিহ্নের মতো সঙ্গে ক’রে; নদী আর মানুষের ধাবমান ধূসর হৃদয় রাত্রি পোহালো ভোরে— কাহিনীর কতো শত ভোরে নব সূর্য নব পাখি নব চিহ্ন নগরে নিবাসে; নব-নব যাত্রীদের সাথে মিশে যায় প্রাণলোকযাত্রীদের ভিড়; হৃদয়ে চলার গতি গান আলো রয়েছে, অকূলে মানুষের পটভূমি হয়তো বা শাশ্বত যাত্রীর।
জীবনানন্দ দাশ
রাত্রি হাইড্র্যাণ্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল; অথবা সে-হাইড্র্যাণ্ট হয়তো বা গিয়েছিলো ফেঁসে এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে। একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে অস্থির পেট্রল ঝেড়ে; সতত সতর্ক থেকে তবু কেউ যেন ভয়াবহভাবে প’ড়ে গেছে জলে। তিনটি রিক্‌শ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাসল্যাম্পে মায়াবীর মতো জাদুবলে। আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে— হঠকারিতায় মাইল-মাইল পথ হেঁটে— দেয়ালের পাশে দাঁড়ালাম বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে— টেরিটিবাজারে; চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে। মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে। কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ ডাইনামোর গুঞ্জনের সাথে মিশে গিয়ে ধনুকের ছিলা রাখে টান। টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পুথিবীকে। টান রাথে জীবনের ধনুকের ছিলা। শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে; রাজ্য জয় ক’রে গেছে অমর আত্তিলা। নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে গান গায় অধো জেগে ইহুদী রমণী; পিতৃলোক হেসে ভাবে, কাকে বলে গান— আর কাকে সোনা, তেল, কাগজের খনি। ফিরিঙ্গি যুবক কটি চ’লে যায় ছিমছাম। থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে; হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার ক’রে বুড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে। নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো। তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব— অতিবৈতনিক, বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত।
জীবনানন্দ দাশ
লঘু মুহূর্ত জীবনানন্দ দাশ এখন দিনের শেষে তিনজন আধো আইবুড়ো ভিখিরীর অত্যন্ত প্রশান্ত হ’লো মন; ধূসর বাতাস খেয়ে এক গাল— রাস্তার পাশে ধূসর বাতাস দিয়ে ক’রে নিলো মুখ আচমন। কেননা এখন তা’রা যেই দেশে যাবে তাকে রাঙা নদী বলে; সেইখানে ধোপা আর গাধা এসে জলে মুখ দেখে পরস্পরের পিঠে চড়ে জাদুবলে তবুও যাবার আগে তিনটি ভিখিরী মিলে গিয়ে গোল হ’য়ে ব’সে গেল তিন মগ চায়ে; একটি উজির, রাজা, বাকিটি কোটাল, পরস্পরকে তা’রা নিলো বাৎলায়ে। তবু এক ভিথিরিনী তিনজন খোঁড়া, খুড়ো, বেয়াইয়ের টানে— অথবা চায়ের মগে কুটুম হয়েছে এই জ্ঞানে মিলে মিশে গেল তা’রা চার জোড়া কানে। হাইড্র্যাণ্ট থেকে কিছু জল ঢেলে চায়ের ভিতরে জীবনকে আরো স্থির, সাধুভাবে তা’রা ব্যবহার ক’রে নিতে গেল সোঁদা ফুটপাতে ব’সে; মাথা নেড়ে দুঃখ ক’রে ব’লে গেল: ‘জলিফলি ছাড়া চেৎলার হাট থেকে টালার জলের কল আজ এমন কি হ’তো জাঁহাবাজ? ভিখিরীকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্র-বৌ সকলে নারাজ।’ ব’লে তা’রা রামছাগলের মতো রুখু দাড়ি নেড়ে একবার চোখ ফেলে মেয়েটির দিকে অনুভব ক’রে নিলো এইখানে চায়ের আমেজে নামায়েছে তা’রা এক শাঁকচুন্নীকে। এ-মেয়েটি হাঁস ছিলো একদিন হয়তো বা, এখন হয়েছে হাঁসহাঁস। দেখে তা’রা তুড়ি দিয়ে বার ক’রে দিলো তাকে আরেক গেলাস: ‘আমাদের সোনা রুপো নেই, তবু আমরা কে কার ক্রীতদাস?’ এ-সব সফেন কথা শুনে এক রাতচরা ডাঁশ লাফায়ে-লাফায়ে যায় তাহাদের নাকের ডগায়; নদীর জলের পারে ব’সে যেন, বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে তাহারা গণনা ক’রে গেল এই পৃথিবীর ন্যায় অন্যায়; চুলের এঁটিলি মেরে গুনে গেল অন্যায় ন্যায়; কোথায় ব্যয়িত হয়— কারা করে ব্যয়; কি কি দেয়া-থোয়া হয়— কারা কাকে দেয়; কি ক’রে ধর্মের কল ন’ড়ে যায় মিহিন বাতাসে; মানুষটা ম’রে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি কেউ দ্যায়— বিনি দামে— তবে কার লাভ— এই নিয়ে চারজনে ক’রে গেল ভীষণ সালিশী। কেননা এখন তা’রা যেই দেশে যাবে তাকে উড়ো নদী বলে সেইখানে হাড়হাভাতে ও হাড় এসে জলে মুখ দ্যাথে— যতদিন মুখ দেখা চলে।
জীবনানন্দ দাশ
লোকেন বোসের জর্নাল জীবনানন্দ দাশ সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি— এখনো কি ভালোবাসি? সেটা অবসরে ভাববার কথা, অবসর তবু নেই; তবু একদিন হেমন্ত এলে অবকাশ পাওয়া যাবে; এখন শেল্‌ফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভ্‌লভ্ ভাবে সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না। পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে: সুজাতা লিখেছে আমার কাছে, বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা; ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ; নাড়বো না আমি, নেড়ে কার কি সে লাভ; মনে হয় যেন অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব, সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে মানে এই— এই অমিতা বলছি যাকে— কিন্তু কথাটা থাক; কিন্তু তবুও— আজকে হৃদয় পথিক নয় তো আর, নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো— তবে এখন কি ক’রে মন কারাভান হবে। প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি সেই সব মৃগতৃষ্ণিকাতালে ঈষৎ সিমুমে হয়তো কখনো বৈতাল মরুভূমি, হৃদয়, হৃদয় তুমি! তারপর তুমি নিজের ভিতরে ফিরে এসে তবু চুপে মরীচিকা জয় করেছো বিনয়ী যে ভীষণ নামরূপে— সেখানে বালির সৎ নীরবতা ধুধু প্রেম নয় তবু প্রেমেরই মতন শুধু। অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে? অমিতা নিজে কি তাকে? অবসর মতো কথা ভাবা যাবে, ঢের অবসর চাই; দূর ব্রহ্মাণ্ডকে তিলে টেনে এনে সমাহিত হওয়া চাই; এখুনি টেনিসে যেতে হবে তবু, ফিরে এসে রাতে ক্লবে; কখন সময় হবে। হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে— হৃদয় কেন যে কাঁপে, ‘ভালোবাসতাম’— স্মৃতি— অঙ্গার— পাপে তর্কিত কেন রয়েছে বর্তমান। সে-ও কি আমায়— সুজাতা আমায় ভালোবেসে ফেলেছিলো? আজো ভালোবাসে না কি? ইলেক্‌ট্রনেরা নিজ দোষগুণে বলয়িত হ’য়ে রবে; কোনো অন্তিম ক্ষালিত আকাশে এর উত্তর হবে? সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে; অমিতা কি মিহিজামে? বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে— সবই। ঘাসের ভিতরে নীল শাদা ফুল ফোটে হেমন্তরাগে; সময়ের এই স্থির এক দিক, তবু স্থিরতর নয়; প্রতিটি দিনের নতুন জীবাণু আবার স্থাপিত হয়।
জীবনানন্দ দাশ
সময়ের কাছে জীবনানন্দ দাশ সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ’লে যেতে হয় কি কাজ করেছি আর কি কথা ভেবেছি। সেই সব একদিন হয়তো বা কোনো এক সমুদ্রের পারে আজকের পরিচিত কোনো নীল আভার পাহাড়ে অন্ধকারে হাড়কঙ্করের মতো শুয়ে নিজের আয়ুর দিন তবুও গণনা ক’রে যায় চিরদিন; নীলিমার থেকে ঢের দূরে স’রে গিয়ে, সূর্যের আলোর থেকে অন্তর্হিত হ’য়ে: পেপিরাসে— সেদিন প্রিণ্টিং প্রেসে কিছু নেই আর; প্রাচীন চীনের শেষে নবতম শতাব্দীর চীন সেদিন হারিয়ে গেছে। আজকে মানুষ আমি তবুও তো— সৃষ্টির হৃদয়ে হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল; আর এই মানবের আগামী কঙ্কাল; আর নব— নব-নব মানবের তরে কেবলি অপেক্ষাতুর হ’য়ে পথ চিনে নেওয়া— চিনে নিতে চাওয়া; আর সে-চলার পথে বাধা দিয়ে অন্নের সমাপ্তিহীন ক্ষুধা; (কেন এই ক্ষুধা— কেনই সমাপ্তিহীন!) যারা সব পেয়ে গেছে তাদের উচ্ছিষ্ট, যারা কিছু পায় নাই তাদের জঞ্জাল; আমি এই সব। সময়ের সমুদ্রের পারে কালকের ভোরে আর আজকের এই অন্ধকারে সাগরের বড়ো শাদা পাখির মতন দুইটি ছড়ানো ডানা বুক নিয়ে কেউ কোথাও উচ্ছল প্রাণশিখা জ্বালায়ে সাহস সাধ স্বপ্ন আছে— ভাবে। ভেবে নিক— যৌবনের জীবন্ত প্রতীক: তার জয়! প্রৌঢ়তার দিকে তবু পৃথিবীর জ্ঞানের বয়স অগ্রসর হ’য়ে কোন্ আলোকের পাখিকে দেখেছে? জয়, তার জয়, যুগে-যুগে তার জয়! ডোডো পাখি নয়। মানুষেরা বার-বার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে; নব-নব ইতিহাস-সৈকতে ভিড়েছে; তবুও কোথাও সেই অনির্বচনীয় স্বপনের সফলতা— নবীনতা— শুভ্র মানবিকতার ভোর? নচিকেতা জরাথুস্ট্র লাওৎ-সে এঞ্জেলো রুশো লেনিনের মনের পৃথিবী হানা দিয়ে আমাদের স্মরণীয় শতক এনেছে? অন্ধকারে ইতিহাসপুরুষের সপ্রতিভ আঘাতের মতো মনে হয় যতই শান্তিতে স্থির হ’য়ে যেতে চাই; কোথাও আঘাত ছাড়া— তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই। হে কালপুরুষ তারা, অনন্ত দ্বন্দ্বের কোলে উঠে যেতে হবে কেবলি গতির গুণগান গেয়ে— সৈকত ছেড়েছি এই স্বচ্ছন্দ উৎসবে; নতুন তরঙ্গে রৌদ্রে বিপ্লবে মিলনসূর্যে মানবিক রণ ক্রমেই নিস্তেজ হয়, ক্রমেই গভীর হয় মানবিক জাতীয় মিলন? নব-নব মৃত্যুশব্দ রক্তশব্দ ভীতিশব্দ জয় ক’রে মানুষের চেতনার দিন অমেয় চিন্তায় খ্যাত হ’য়ে তবু ইতিহাসভুবনে নবীন হবে না কি মানবকে চিনে— তবু প্রতিটি ব্যক্তির ষাট বসন্তের তরে! সেই সব সুনিবিড় উদ্বোধনে— ‘আছে আছে আছে’ এই বোধির ভিতরে চলেছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের বিষয় হৃদয়; জয় অস্তসূর্য, জয়, অলখ অরুণোদয়, জয়।
জীবনানন্দ দাশ
সমারূঢ় জীবনানন্দ দাশ ‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা—’ বলিলাম ম্লান হেসে; ছায়াপিণ্ড দিলো না উত্তর; বুঝিলাম সে তো কবি নয়— সে যে আরূঢ় ভণিতা: পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর ব’সে আছে সিংহাসনে— কবি নয়— অজর, অক্ষর অধ্যাপক; দাঁত নেই— চোখে তার অক্ষম পিঁচুটি; বেতন হাজার টাকা মাসে— আর হাজার দেড়েক পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি; যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক চেয়েছিলো— হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।
জীবনানন্দ দাশ
সূর্যতামসী জীবনানন্দ দাশ কোথাও পাখির শব্দ শুনি; কোনো দিকে সমুদ্রের সুর; কোথাও ভোরের বেলা র’য়ে গেছে— তবে। অগণন মানুষের মৃত্যু হ’লে— অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয় বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে; এ কোন্ সিন্ধুর স্বর: মরণের— জীবনের? এ কি ভোর? অনন্ত রাত্রির মতো মনে হয় তবু। একটি রাত্রির ব্যথা স’য়ে— সময় কি অবশেষে এ-রকম ভোরবেলা হ’য়ে আগামী রাতের কালপুরুষের শস্য বুকে ক’রে জেগে ওঠে। কোথাও ডানার শব্দ শুনি; কোনো দিকে সমুদ্রের সুর— দক্ষিণের দিকে, উত্তরের দিকে, পশ্চিমের পানে। সৃজনের ভয়াবহ মানে; তবু জীবনের বসন্তের মতন কল্যাণে সূর্যালোকিত সব সিন্ধু-পাখিদের শব্দ শুনি; ভোরের বদলে তবু সেইখানে রাত্রি-করোজ্জ্বল হ্বিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ— তুমি? সার্থবাহ, সার্থবাহ, ওই দিকে নীল সমুদ্রের পরিবর্তে আটলাণ্টিক চার্টার নিখিল মরুভূমি! বিলীন হয় না মায়ামৃগ— নিত্য দিকদৰ্শিন; অনুভব ক’রে নিয়ে মানুষের ক্লান্ত ইতিহাস যা জেনেছে— যা শেখেনি— সেই মহাশ্মশানের গর্ভাঙ্কে ধূপের মতো জ্ব’লে জাগে না কি হে জীবন— হে সাগর— শকুন্ত-ক্রান্তির কলরোলে।
জীবনানন্দ দাশ
সৃষ্টির তীরে জীবনানন্দ দাশ বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে নিভে যায়— তবু ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হ’য়ে গেছে: হরিণ খেয়েছে তার আমিষাশী শিকারীর হৃদয়কে ছিঁড়ে; সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে; সচ্ছল কঙ্কাল হ’য়ে গেছে তারপর; বিলোচন গিয়েছিলো বিবাহ-ব্যাপারে; প্রেমিকেরা সারাদিন কাটায়েছে গণিকার বারে; সভাকবি দিয়ে গেছে বাক্‌বিভূতিকে গালাগাল। সমস্ত আচ্ছন্ন সুর একটি ওঙ্কার তুলে বিস্মৃতির দিকে উড়ে যায়। এ-বিকেল মানুষ না মাছিদের গুঞ্জরণময়! যুগে-যুগে মানুষের অধ্যবসায় অপরের সুযোগের মতো মনে হয়। কুইসলিং বানালো কি নিজ নাম— হিটলার সাত কানাকড়ি দিয়ে তাহা কিনে নিয়ে হ’য়ে গেল লাল: মানুষেরই হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল; পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি। এ কেমন পরিবেশে র’য়ে গেছি সবে— বাক্‌পতি জন্ম নিয়েছিলো যেই কালে, অথবা সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিলো স্বাভাবিক ভাবে পথ দিয়ে, কি ক’রে তা হ’লে তা’রা এ-রকম ফিচেল পাতালে হৃদয়ের জনপরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে? অথবা যে-সব লোক নিজের সুনাম ভালোবেসে দুয়ার ও পরচুলা না এঁটে জানে না কোনো লীলা, অথবা যে-সব নাম ভালো লেগে গিয়েছিলো: আপিলা চাপিলা —রুটি খেতে গিয়ে তা’রা ব্রেডবাস্কেট খেলো শেষে। এরা সব নিজেদের গণিকা, দালাল, রেস্ত, শত্রুর খোঁজে সাতপাঁচ ভেবে সনির্বন্ধতায় নেমে আসে; যদি বলি, তা’রা সব তোমাদের চেয়ে ভালো আছে; অসৎপাত্রের কাছে তবে তা’রা অন্ধ বিশ্বাসে কথা বলেছিলো ব’লে দুই হাত সতর্কে গুটায়ে হ’য়ে ওঠে কি যে উচাটন! কুকুরের ক্যানারির কান্নার মতন: তাজা ন্যাকড়ার ফালি সহসা ঢুকেছে নালি ঘায়ে। ঘরের ভিতর কেউ খোয়ারি ভাঙছে ব’লে কপাটের জং নিরস্ত হয় না তার নিজের ক্ষয়ের ব্যবসায়ে, আগাগোড়া গৃহকেই চৌচির করেছে বরং; অরেঞ্জপিকোর ঘ্রাণ নরকের সরায়ের চায়ে ক্রমেই অধিক ফিকে হ’য়ে আসে; নানারূপ জ্যামিতিক টানের ভিতরে স্বৰ্গ মর্ত্য পাতালের কুয়াশার মতন মিলনে একটি গভীর ছায়া জেগে ওঠে মনে; অথবা তা’ ছায়া নয়— জীব নয় সৃষ্টির দেয়ালের ’পরে। আপাদমস্তক আমি তার দিকে তাকায়ে রয়েছি; গগ্যাঁর ছবির মতো— তবু গগ্যাঁর চেয়ে গুরু হাত থেকে বেরিয়ে সে নাকচোখে ক্বচিৎ ফুটেছে টায়ে-টায়ে; নিভে যায়— জ্ব’লে ওঠে, ছায়া, ছাই, দিব্যযোনি মনে হয় তাকে। স্বাতিতারা শুকতারা সূর্যের ইস্কুল খুলে সে-মানুষ নরক বা মর্ত্যে বাহাল হ’তে গিয়ে বৃষ মেষ বৃশ্চিক সিংহের প্রাতঃকাল ভালোবেসে নিতে যায় কন্যা মীন মিথুনের কুলে।
জীবনানন্দ দাশ
স্থান থেকে জীবনানন্দ দাশ স্থান থেকে স্থানচ্যুত হ’য়ে চিহ্ন ছেড়ে অন্য চিহ্নে গিয়ে ঘড়ির কাঁটার থেকে সময়ের স্নায়ুর স্পন্দন খসিয়ে বিমুক্ত ক’রে তাকে দেখা যায় অবিরল শাদা কালো সময়ের ফাঁকে সৈকত কেবলি দূর সৈকতে ফুরায়; পটভূমি বার-বার পটভূমিচ্ছেদ ক’রে ফেলে আঁধারকে আলোর বিলয় আলোককে আঁধারের ক্ষয় শেখায় শুক্ল সূর্যে; গ্লানি রক্তসাগরের জয় দেখায় কৃষ্ণ সূর্যে; ক্রমেই গভীর কৃষ্ণ হয়।
জীবনানন্দ দাশ
১৯৪৬-৪৭ জীবনানন্দ দাশ দিনের আলোয় ওই চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা: পথে-ঘাটে ট্রাক ট্রামলাইনে ফুটপাতে; কোথাও পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে— মনে হয়, জলের মতন দামে। সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে সকলের আগে সকলেই তাই। অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়, তবু নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব— অথবা যা নিলেমের নয় সে-সব জিনিস বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু-জন কি একজন কিনে নিতে পারে। পৃথিবীতে সুদ খাটে: সকলের জন্যে নয়। অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দু-জনের হাতে। পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকদের দাবি এসে সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়। বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের অবিরল পাতার মতন কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়, অথবা মাটির দিকে— পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে মিশে গিয়ে। পৃথিবীতে ঢের জন্ম নষ্ট হ’য়ে গেছে জেনে, তবু আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে পরিচিত জল, আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার ক’রে নিতে হবে ভেবে তা’রা অন্ধকারে লীন হ’য়ে যায়। লীন হ’য়ে গেলে তা’রা তখন তো— মৃত। মৃতেরা এ-পৃথিবীতে ফেরে না কখনো। মৃতেরা কোথাও নেই; আছে? কোনো-কোনো অঘ্রাণের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতের কোথাও নেই বলে মনে হয়; তা হ’লে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হ’তো। বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ডুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল। সূর্য অস্তে চ’লে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার খোঁপা বেঁধে নিতে আসে— কিন্তু কার হাতে? আলুলায়িত হ’য়ে চেয়ে থাকে— কিন্তু কার তরে? হাত নেই— কোথাও মানুষ নেই; বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী হ’তে পেরেছিলো প্রায়; নিভে গেছে সব। এইখানে নবান্নের ঘ্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে; নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক এ-পাড়ার বড়ো মেজো…ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের ডাকশাঁখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত; এখন টুঁ শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও; মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়; সময়ের হাতে অন্তহীন। ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হ’তো ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি বাগ্‌দির ঈশ্বরী মেয়ের সাথে বিবাহের কিছু আগে— বিবাহের কিছু পরে— সন্তানের জন্মাবার আগে। সে-সব সন্তান আজ এ-যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ় ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা প’ড়ে মৃত প্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে— অন্ধকারে জমিদারদের চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে। ওরা খুব বেশি ভালো ছিলো না; তবুও আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায় অন্ধ শতছিন্ন গ্রাম্য প্রাণীদের চেয়ে পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিলো। আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো ক’রে কথা ভাবা এখন কঠিন; অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার নিয়ম এখন আছে; তারপর একা অন্ধকারে বাকি সত্য আঁচ ক’রে নেওয়ার রেওয়াজ র’য়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে। সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়— দ্বেষ। সৃষ্টির মনের কথা: আমাদেরি আন্তরিকতাতে আমাদেরি সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল ঝর্ণার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়; মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে বধ ক’রে ঘুমাতেছি— তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্রতী সকলকে আলো দেবে মনে ক’রে অগ্রসর হ’য়ে তবুও কোথাও কোনো আলো নেই ব’লে ঘুমাতেছে। ঘুমাতেছে। যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হ’য়ে ব’লে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি, হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ— আর তুমি?’ আমার বুকের ’পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে চোখ তুলে সুধাবে সে— রক্তনদী উদ্বেলিত হ’য়ে বলে যাবে, ‘গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার; মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রিটের, এণ্টালীর—’ কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে; সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে এই সব প্রাণকণা জেগেছিলো— বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিলো কোনো উজ্জ্বল চোখের মনীষী লোকের কাছে এই সব অনুর মতন উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে। সূর্যের আলোর ঢলে রোমাঞ্চিত রেণুর শরীরে রেণুর সংঘর্ষে যেই শব্দ জেগে ওঠে সেখানে সময় তার অনুপম কণ্ঠের সংগীতে কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী সহসা নিকটে এসে কোনো-কিছু বলবার আগে আধ খণ্ড অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের কথা বলে গিয়েছিলো; তবু— অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা অখণ্ড অনন্তে অন্তৰ্হিত হ’য়ে গেছে; কেউ নেই, কিছু নেই— সূর্য নিভে গেছে। এ-যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে। আমরা এ-পৃথিবীর বহুদিনকার কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার মর্যাদায় গড় কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি। মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল; জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে। অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু আমাদের এই শতকের বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু— বেড়ে যায় শুধু; তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই ব’লে অর্থময় জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। এ-যুগে কোথাও কোনো আলো— কোনো কান্তিময় আলো চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার রাত্রির মায়ের মতো: মানুষের বিহ্বল দেহের সব দোষ প্রক্ষালিত ক’রে দেয়— মানুষের বিহ্বল আত্মাকে লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে তাকে আর সুধায় না— অতীতের সুধানো প্রশ্নের উত্তর চায় না আর— শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ বীতকাম হয় যাতে— এ-জীবন ধীরে-ধীরে বীতশোক হয়, স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে কয়েকটি দেবদারুগাছের ভিতরে অবলীন বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে— মানুষের রক্তাক্ত আত্মায় সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের— মানুষের জীবন নির্মল। আজ এই পৃথিবীতে এমন মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার নেই আর? সুবাতাস গভীরতা পবিত্রতা নেই? তবুও মানুষ অন্ধ দুর্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে অন্ধকার হ’তে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে যে অনবনমনে চলেছে আজো— তার হৃদয়ের ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার বলয়ের নিজ গুণ র’য়ে গেছে ব’লে মনে হয়।
চর্যাগীতি পদাবলী
১ রাগ [ পটমঞ্জরী ] চর্যাপদ লুইপাদানাম্ কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল॥ ধ্রু॥ দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ। লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ॥ ধ্রু॥ সঅল সমাহিঅ কাহি করিঅই। সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরিঅই॥ ধ্রু॥ এড়ি এউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস। সুনুপাখ ভিতি লেহু রে পাস॥ ধ্রু॥ ভণই লুই আম্‌হে ঝানে দিঠা। ধমণ চমণ বেণি পিণ্ডি বইঠা॥ ধ্রু॥ ২ রাগ গবড়া চর্যাপদ কুক্কুরীপাদানাম্ দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই। রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ॥ আঙ্গন ঘরপণ সুন ভো বিআতী। কানেট চোরে নিল অধরাতী॥ ধ্রু॥ সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ। কানেট চোরে নিল কা গই [ন] মাগঅ॥ ধ্রু॥ দিবসই বহুড়ী কাড়ই ডরে ভাঅ। রাতি ভইলে কামরু জাঅ॥ ধ্রু॥ অইসন চর্য্যা কুক্কুরীপাএঁ গাইড়। কোড়ি মঝেঁ একু হিঅহি সমাইড়॥ ধ্রু॥ ৩ - রাগ গবড়া চর্যাপদ বিরুবাপাদানাম্ এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ। চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ॥ ধ্রু॥ সহজে থির করি বারুণী সান্ধ। জেঁ অজরামর হোই দিঢ় কান্ধ॥ ধ্রু॥ দশমি দুআরত চিহ্ন দেখিআ। আইল গরাহক অপণে বহিআ॥ ধ্রু॥ চউশটি ঘড়িয়ে দেল পসারা। পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা॥ ধ্রু॥ এক সে ঘড়লী সরুই নাল। ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল॥ ধ্রু॥ ৪ রাগ অরু চর্যাপদ গুণ্ডরীপাদানাম্ তিয়ড্ডা চাপী জোইনি দে অঙ্কবালী। কমলকুলিশ ঘাণ্টি করহুঁ বিআলী॥ ধ্রু॥ জোইনি তঁই বিনু খনহিঁ ন জীবমি। তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি॥ ধ্রু॥ খেপহুঁ জোইনি লেপ ন জাঅ। মণিকুলে বহিআ ওড়িআণে সমাঅ॥ ধ্রু॥ সাসু ঘরেঁ ঘালি কোঞ্চা তাল। চান্দসুজবেণি পখা ফাল॥ ধ্রু॥ ভণই গুণ্ডরী অম্‌হে কুন্দুরে বীরা। নরঅ নারী মাঝেঁ উভিল চীরা॥ ধ্রু॥ ৫ রাগ গুর্জরী চর্যাপদ চাটিল্লপাদানাম্ ভবণই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝে ন থাহী॥ ধ্রু॥ দামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই। পার্গামি লোঅ নিভর তরই॥ ধ্রু॥ ফাড্ডিঅ মোহতরু পাটি জোড়িঅ। অদঅ দিঢ় টাঙ্গী নিবাণে কোরিঅ॥ ধ্রু॥ সাঙ্কমত চড়িলে দাহিণ বাম মা হোহী। নিয়ড়ি বোহি দূর মা জাহী॥ ধ্রু॥ জই তুম্‌হে লোঅ হে হোইব পারগামী। পুচ্ছতু চাটিল অনুত্তরসামী॥ ধ্রু॥ ৬ রাগ পটমঞ্জরী চর্যাপদ ভুসুকুপাদানাম্ কাহেরে ঘিণি মেলি অচ্ছহু কীস। বেটিল হাক পড়অ চৌদীস॥ ধ্রু॥ অপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী। খনহ ন ছাড়অ ভুসুকু অহেরি॥ ধ্রু॥ তিন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই ন পানী। হরিণা হরিণীর নিলঅ ন জানী॥ ধ্রু॥ হরিণী বোলঅ সুণ হরিণা তো। এ বণ চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো॥ ধ্রু॥ তরংগতে হরিণার খুর ন দীসঅ। ভুসুকু ভণই মূঢ়হিঅহি ন পইসই॥ ধ্রু॥ ৭ রাগ পটমঞ্জরী চর্যাপদ কাহ্নুপাদানাম্ আলিএ কালিএ বাট রুন্ধেলা। তা দেখি কাহ্নু বিমন ভইলা॥ ধ্রু॥ কাহ্নু কহিঁ গই করিব নিবাস। জো মনগোঅর সো উআস॥ ধ্রু॥ তে তিনি তে তিনি তিনি হো ভিন্না। ভণই কাহ্নু ভব পরিচ্ছিন্না॥ ধ্রু॥ জে জে আইলা তে তে গেলা। অবণাগবণে কাহ্নু কাহ্নু বিমন ভইলা॥ ধ্রু॥ হেরি সে কাহ্নি নিঅড়ি জিনউর বট্টই। ভণই কাহ্নু মো হিঅহি ন পইসই॥ ধ্রু॥ ৮ রাগ দেবক্রী চর্যাপদ কম্বলাম্বরপাদানাম্ সোনে ভরিতী করুণা নাবী। রূপা থোই নাহিক ঠাবী॥ ধ্রু॥ বাহতু কামলি গঅণ উবেঁসে। গেলী জাম বহু উই কইসেঁ॥ ধ্রু॥ খুণ্টি উপাড়ী মেলিলি কাচ্ছি। বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি॥ ধ্রু॥ মাঙ্গত চড়্‌হিলে চউদিস চাহঅ। কেড়ুআল নাহি কেঁ কি বাহবকে পারঅ॥ ধ্রু॥ বাম দাহিণ চাপী মিলি মিলি মাঙ্গা। বাটত মিলিল মহাসুহসাঙ্গা॥ ধ্রু॥ ৯ রাগ পটমঞ্জরী চর্যাপদ কাহ্নুপাদানাম্ এবংকার দৃঢ় বাখোড় মোড্ডিউ। বিবিহ বিআপক বান্ধণ তোড়িউ॥ ধ্রু॥ কাহ্নু বিলসঅ আসবমাতা। সহজনিলীবন পইসি নিবিতা॥ ধ্রু॥ জিম জিম করিণা করিণিরেঁ রিসঅ। তিম তিম তথতামঅগল বরিসঅ॥ ধ্রু॥ ছড়গই সঅল সহাবে সূধ। ভাবাভাব বলাগ ন[া]ছুধ॥ ধ্রু॥ দশবলরঅণ হরিঅ দশদিসেঁ। [অ]বিদ্যাকরিকুঁ দম অকিলেসেঁ॥ ধ্রু॥ ১০ রাগ দেশাখ চর্যাপদ কাহ্নুপাদানাম্ নগরবাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ। ছোই ছোই জাহ সো বাহ্মনাড়িয়া॥ ধ্রু॥ আলো ডোম্বি তোএ সম করিব মা সাঙ্গ। নিঘিন কাহ্ন কাপালি জোই লাংগ॥ ধ্রু॥ এক সো পদুমা চৌষঠ্‌ঠী পাখুড়ী। তহিঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী॥ ধ্রু॥ হা লো ডোম্বি তো পুছমি সদভাবে। আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ॥ ধ্রু॥ তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবরনা চাংগেড়া। তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়পেড়া॥ ধ্রু॥ তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী। তোহোর অন্তরে মোএ ঘেণিলি হাড়ের মালী॥ ধ্রু॥ সরবর ভাঞ্জিঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ। মারমি ডোম্বি লেমি পরাণ॥ ধ্রু॥ ১১ রাগ পটমঞ্জরী চর্যাপদ কৃষ্ণাচার্য্যপাদানাম্ নাড়িশক্তি দিঢ় ধরিঅ খট্টে। অনহা ডমরু বাজই বীরনাদে॥ কাহ্ন কপালী যোগী পইঠ অচারে। দেহনঅরী বিহরই একাকারে॥ ধ্রু॥ আলি কালি ঘণ্টা নেউর চরণে। রবি শশী কুণ্ডল কিউ আভরণে॥ ধ্রু॥ রাগ দেষ মোহ লাইঅ ছার। পরম মোখ লবএ মুত্তাহার॥ ধ্রু॥ মারিঅ শাসু নণন্দ ঘরে শালী। মাঅ মারিআ কাহ্ন ভইল কবালী॥ ধ্রু॥ ১২ রাগ ভৈরবী চর্যাপদ কৃষ্ণপাদানাম্ করুণা পিহাড়ি খেলহুঁ নঅবল। সদ্‌গুরুবোহেঁ জিতেল ভববল॥ ধ্রু॥ ফীটউ দুআ মাদেসি রে ঠাকুর। উআরিউএসেঁ কাহ্ন ণিঅড় জিনউর॥ ধ্রু॥ পহিলেঁ তোড়িআ বড়িআ মারিউ। গঅবরেঁ তোড়িআ পাঞ্চজনা ঘালিউ॥ ধ্রু॥ মতিএঁ ঠাকুরক পরিনিবিতা। অবশ করিআ ভববল জিতা॥ ধ্রু॥ ভণই কাহ্নু আহ্মে ভাল দান দেহুঁ। চউষঠ্‌ঠি কোঠা গুণিয়া লেহুঁ॥ ধ্রু॥ ১৩ রাগ কামোদ চর্যাপদ কৃষ্ণাচার্য্যপাদানাম্ তিশরণ ণাবী কিঅ অঠকুমারী। নিঅ দেহ করুণাশূণমে হেরী॥ ধ্রু॥ তরিত্তা ভবজলধি জিম করি মাঅ সুইনা। মঝ বেণী তরঙ্গম মুনিআ॥ ধ্রু॥ পঞ্চ তথাগত কিঅ কেড়ুআল। বাহঅ কাঅ কাহ্নি ল মাআজাল॥ ধ্রু॥ গন্ধ পরস রস জইসোঁ তইসোঁ। নিংদ বিহুনে সুইনা জইসো॥ ধ্রু॥ চিঅকণ্ণহার সুণতমাঙ্গে। চলিল কাহ্ন মহাসুহসাঙ্গে॥ ধ্রু॥ ১৪ ধনসী রাগ চর্যাপদ ডোম্বীপাদানাম্ গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ। তহিঁ বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই॥ ধ্রু॥ বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা। সদ্‌গুরুপাঅপসাএ জাইব পুণু জিণউরা॥ ধ্রু॥ পাঞ্চ কেড়ুআল পড়ন্তে মাঙ্গে পিঠত কাচ্ছী বান্ধী। গঅণদুখোঁলে সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধি॥ ধ্রু॥ চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা। বাম দাহিণ দুই মাগ ন চেবই বাহতু ছন্দা॥ ধ্রু॥ কবড়ী ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছড়ে পার করই। জো রথে চড়িলা বাহবা ণ জা[ন]ই কুলেঁ কুল বুড়ই॥ ধ্রু॥ ১৫ রাগ রামক্রী চর্যাপদ শান্তিপাদানাম্ সঅসম্বেঅণসরুঅবিআরেঁ অলক্‌খ লক্‌খণ ন জাই। জে জে উজূবাটে গেলা অনাবাটা ভইলা সোই॥ ধ্রু॥ কুলেঁ কুল মা হোই রে মূঢ়া উজূবাট সংসারা। বাল ভিণ একু বাকু ণ্ ভূলহ রাজ পথ কন্ধারা॥ ধ্রু॥ মায়ামোহসমুদা রে অন্ত ন বুঝসি থাহা। অগে নাব ন ভেলা দীসঅ ভন্তি ন পুচ্ছসি নাহা॥ ধ্রু॥ সুনা পান্তর উহ ন দীসই ভান্তি ন বাসসি জান্তে। এষা অটমহাসিদ্ধি সিঝই উজূবাট জাঅন্তে॥ ধ্রু॥ বাম দাহিণ দোবাটা চ্ছাড়ী শান্তি বুলথেউ সংকেলিউ। ঘাট ন গুমা খড় তড়ি ণ হোই আখি বুজিঅ বাট জাইউ॥ ধ্রু॥ ১৬ রাগ ভৈরবী চর্যাপদ মহীধরপাদানাম্ তিনিএঁ পাটেঁ লাগেলি রে অণহ কসণ গাজই। তা সুনি মার ভয়ঙ্কর রে বিসঅমণ্ডল ভাজই॥ ধ্রু॥ মাতেল চীঅগএন্দা ধাবই। নিরন্তর গঅণন্ত তুসেঁ ঘোলই॥ ধ্রু॥ পাপ পুণ্ণ বেণি তোড়িঅ সিকল মোড়িঅ খম্ভাঠাণা। গঅণটাকলি লাগি রে চিত্ত পইঠ নিবাণা॥ ধ্রু॥ মহারসপানে মাতেল রে তিহুঅন সএল উএখী। পঞ্চবিসঅনায়ক রে বিপখ কোবি ন দেখি॥ ধ্রু॥ খররবিকিরণসন্তাপে রে গঅণাঙ্গণ গই পইঠা। ভণন্তি মহিত্তা মই এথু বুড়ন্তে কিম্পি ন দিঠা॥ ধ্রু॥ ১৭ রাগ পটমঞ্জরী চর্যাপদ বীণাপাদানাম্ সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী। অণহা দাণ্ডী একি কিঅত অবধূতী॥ ধ্রু॥ বাজই অলো সহি হেরুঅবীণা। সুনতান্তিধনি বিলসই রুণা॥ ধ্রু॥ আলি কালি বেণি সারি সুণিআ। গঅবর সমরস সান্ধি গুণিআ॥ ধ্রু॥ জবে করহা করহকলে চাপিউ। বতিশ তান্তিধনি সঅল বিআপিউ॥ ধ্রু॥ নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী। বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই॥ ধ্রু॥ ১৮ রাগ গউড়া চর্যাপদ কৃষ্ণবজ্রপাদানাম্ তিনি ভুঅণ মই বাহিঅ হেলেঁ। হাঁউ সুতেলি মহাসুহলীলেঁ॥ ধ্রু॥ কইসণি হালো ডোম্বী তোহোরি ভাভরিআলী। অন্তে কুলিণজণ মাঝেঁ কাবালী॥ ধ্রু॥ তঁই লো ডোম্বী সঅল বিটালিউ। কাজণ কারণ সসহর টালিউ॥ ধ্রু॥ কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই। বিদুজণ লোঅ তোরে কণ্ঠ ন মেলই॥ ধ্রু॥ কাহ্নে গাই তু কামচণ্ডালী। ডোম্বী ত আগলি নাহি চ্ছিণালী॥ ধ্রু॥ ১৯ রাগ ভৈরবী চর্যাপদ কৃষ্ণপাদানাম্ ভবনির্ব্বাণে পড়হ মাদলা। মণপবণবেণি করণ্ডকশালা॥ ধ্রু॥ জঅ জঅ দুন্দুহিসাদ উছলিআঁ। কাহ্ন ডোম্বীবিবাহে চলিআ॥ ধ্রু॥ ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম। জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম॥ ধ্রু॥ অহণিসি সুরঅপসঙ্গে জাঅ। জোইণিজালে রঅণি পোহাঅ॥ ধ্রু॥ ডোম্বীএর সঙ্গে জো জোই রত্তো। খণহ ন ছাড়অ সহজ উন্মত্তো॥ ধ্রু॥ ২০ রাগ পটমঞ্জরী চর্যাপদ কুক্কুরীপাদানাম্ হাঁউ নিরাসী খমণভতারি। মোহোর বিগোআ কহণ ন জাই॥ ধ্রূ॥ ফেটলিউ গো মাএ অন্তউরি চাহি। জা এথু চাহাম সো এথু নাহি॥ ধ্রূ॥ পহিল বিআণ মোর বাসনপূড়া। নাড়ি বিআরন্তে সেব বাপূড়া॥ ধ্রূ॥ জাণজৌবণ মোর ভৈলেসি পূরা। মূল নখলি বাপ সংঘারা॥ ধ্রূ॥ ভণথি কুক্কুরীপা এ ভব থিরা। জো এথু বুঝই সো এথু বীরা॥ ধ্রূ॥ ২১ রাগ বরাড়ী চর্যাপদ ভুসুকুপাদানাম্ নিসি অন্ধারী মুসঅ চারা। অমিঅভখঅ মুসা করঅ আহারা॥ ধ্রূ॥ মার রে জোইআ মুসা পবণা। জেণ তুটঅ অবণাগবণা॥ ধ্রূ॥ ভববিন্দারঅ মুসা খণঅ গাতী। চঞ্চল মুসা কলিআঁ নাশক থাতী॥ ধ্রূ॥ কাল মুসা উহ ণ বাণ। গঅণে উঠি চরঅ অমণধাণ॥ ধ্রূ॥ তাব সে মুসা উঞ্চল পাঞ্চল। সদ্‌গুরুবোহে করহ সো নিচ্চল॥ ধ্রূ॥ জবে মুসাএর চার তুটঅ। ভুসুকু ভণঅ তবে বান্ধন ফিটঅ॥ ধ্রূ॥ ২২ রাগ গুঞ্জরী চর্যাপদ সরহপাদানাং অপণে রচি রচি ভবনির্বাণা। মিছেঁ লোঅ বন্ধাবএ অপনা॥ধ্রু॥ অম্ভে ন জাণহূঁ অচিন্ত জোই‌। জাম মরণ ভব কইসণ হোই॥ধ্রু॥ জইসা জাম মরণ বি তইসো। জীবন্তে মঅলেঁ ণাহি বিশেসো॥ধ্রু॥ জা এথু জাম মরণে বি সঙ্কা। সো করউ রস রসানেরে কংখা॥ধ্রু॥ জে সচরাচর তিঅস ভমন্তি। তে অজরামর কিম্‌পি ন হোন্তি॥ধ্রু॥ জামে কাম কি কামে জাম। সরহ ভণতি অচিন্ত সো ধাম॥ধ্রু॥
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বর্গপরিচয় দ্বিতীয় ভাগ ঈশ্বরচন্দ্র বিষ্ঠাস।গর সংযুক্ত বর্ণ য ফলা য ্য ক য ক্য ঐক্য, বাক্য, অনৈক্য। খ য খ্য অসংখ্য, অখ্যাতি, উপাখ্যান। গ য গ্য ভাগ্য, আরোগ্য, সৌভাগ্য। চ য চ্য বাচ্য, বিবেচ্য, পদচ্যুত। জ য জ্য ত্যাজ্য, রাজ্য, জ্যোতি। ট য ট্য নাট্য, কাপট্য, নৈকট্য। ড য ড্য জাড্য। ঢ য ঢ্য আঢ্য, ধনাঢ্য। ণ য ণ্য পুণ্য, অরণ্য, লাবণ্য। ত য ত্য নিত্য, সত্য, হত্যা, মৃত্যু। থ য থ্য পথ্য, মিথ্যা। দ য দ্য অদ্য, বাদ্য, বিদ্যা, বিদ্যুৎ। ন য ন্য অন্য, ধন্য, মান্য, শূন্য, অন্যায়। প য প্য রৌপ্য, আপ্যায়িত। ভ য ভ্য লভ্য, সভ্য, অভ্যাস। ম য ম্য রম্য, অগম্য, বৈষম্য। য য য্য আতিশয্য, শয্যা। ল য ল্য বাল্য, তুল্য, মূল্য, কল্যাণ। ব য ব্য নব্য, দিব্য, ব্যয়, তালব্য। শ য শ্য অবশ্য, আবশ্যক, শ্যামল। ষ য ষ্য দূষ্য, পোষ্য, শিষ্য। স য স্য নস্য, শস্য, আলস্য, ঔদাস্য। হ য হ্য সহ্য, বাহ্য, লেহ্য। ১ম পাঠ। ১। কখনও কাহাকেও কুবাক্য বলিও না। কুবাক্য বলা বড় দোষ। যে কুবাক্য বলে, কেহ তাহাকে দেখিতে পারে না। ২। সদা সত্য কথা বলিবে। যে সত্য কথা বলে, সকলে তাহাকে ভাল বাসে। যে মিথ্য কথা বলে, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না, সকলেই তাহাকে ঘৃণা করে। তুমি কদাচ মিথ্যা কথা বলিও না। ৩। বাল্যকালে, মন দিয়া, লেখা পড়া শিখিবে। লেখা পড়া শিখিলে, সকলে তোমায় ভাল বাসিবে। যে লেখা পড়ায় আলস্য করে, কেহ তাহাকে ভাল বাসে না। তুমি, কখনও লেখা পড়ায় আলস্য করিও না। ৪। নিত্য যাহা পড়িবে, নিত্য তাহা অভ্যাস করিবে। কল্য অভ্যাস করিব বলিয়া, রাখিয়া দিবে না। যাহা রাখিয়া দিবে, আর তাহা অভ্যাস করিতে পারিবে না। ৫। কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইও না। তাঁহারা যখন যাহা বলিবেন, তাহা করিবে; কদাচ তাহার অন্যথা করিও না। পিতা মাতার কথা না শুনিলে, তাঁহারা তোমায় ভাল বাসিবেন না। ৬। অবোধ বালকেরা সারা দিন খেলিয়া বেড়ায়, লেখা পড়ায় মন দেয় না। এজন্য তাহারা চির কাল দুঃখ পায়। যাহারা মন দিয়া লেখা পড়া শিখে, তাহারা চিরকাল সুখে থাকে। র ফলা। র ্র ক র ক্র বক্র, বিক্রয়, ক্রূর, ক্রোধ। গ র গ্র অগ্র, গ্রহণ, গ্রাম, অগ্রিম। ঘ র ঘ্র শীঘ্র, ঘ্রাণ, আঘ্রাণ। জ র জ্র বজ্র, বজ্রাঘাত। ত র ত্র গাত্র, মিত্র, ত্রাস, কৃত্রিম। দ র দ্র রৌদ্র, নিদ্রা, হরিদ্রা। ধ র ধ্র গৃধ্র, ধ্রুব। প র প্র প্রণয়, প্রাণ প্রীতি, প্রেরণ। ভ র ভ্র শুভ্র, ভ্রমণ, ভ্রাতা, ভ্রুকুটি। ম র ম্র আম্র, তাম্র, নম্র। ব র ব্র ব্রণ, ব্রত। শ র শ্র শ্রম, বিশ্রাম, আশ্রিত, শ্রীমান্। স র স্র সহস্র, সংস্রব, স্রোত। হ র হ্র হ্রদ, হ্রাস। ২য় পাঠ। ১। শ্রম না করিলে, লেখা পড়া হয় না। যে বালক শ্রম করে, সেই লেখা পড়া শিখিতে পারে। শ্রম কর, তুমিও লেখা পড়া শিখিতে পারিবে। ২। যে বালক প্রত্যহ, মন দিয়া, লেখা পড়া শিখে, সে সকলের প্রিয় হয়। যদি তুমি প্রতিদিন মন দিয়া, লেখা পড়া শিখ, সকলে তোমায় ভাল বাসিবে। ৩। যখন পড়িতে বসিবে, অন্য দিকে মন দিবে না। অন্য দিকে মন দিলে, শীঘ্র অভ্যাস করিতে পারিবে না; অধিক দিন মনে থাকিবে না; পড়া বলিবার সময়, ভাল বলিতে পারিবে না। ৪। কখনও কাহারও সহিত কলহ করিও না। কলহ করা বড় দোষ। যে সতত সকলের সহিত কলহ করে, তাহার সহিত কাহারও প্রণয় থাকে না। সকলেই তাহার শত্রু হয়। ৫। পরের দ্রব্যে হাত দিও না। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, চোর বলিয়া তাহাকে সকলে ঘৃণা করে। চোরকে কেহ কখনও প্রত্যয় করে না। ৬। যে চুরি করে, মিথ্যা কথা বলে, ঝগড়া করে, গালাগালি দেয়, মারামারি করে, তাহাকে অভদ্র বলে। তুমি কদাচ অভদ্র হইও না; অভদ্র বালকের সংস্রবে থাকিও না। যদি তুমি অভদ্র হও, কিংবা অভদ্র বালকের সংস্রবে থাক, কেহ তোমাকে কাছে বসিতে দিবে না, তোমার সহিত কথা কহিবে না, সকলেই তোমায় ঘৃণা করিবে। ল ফলা ল ল ক ল ক্ল শুক্ল, ক্লীব, ক্লেশ। গ ল গ্ল গ্লানি। প ল প্ল বিপ্লব, প্লাবন, প্লীহা। ম ল ম্ল অম্ল, ম্লান, অম্লান। ল ল ল্ল প্রফুল্ল, উল্লাস, ভল্লুক। শ ল শ্ল শ্লাঘা, অশ্লীল, শ্লোক। হ ল হ্ল আহ্লাদ, আহ্লাদিত। ব ফলা। ব ক ব ক্ব পরিপক্ব। জ ব জ্ব জ্বর, জ্বালা। ট ব ট্ব খট্বা। ত ব ত্ব ত্বরা, সত্বর, মমত্ব, রাজত্ব। দ ব দ্ব দ্বার, দ্বিজ, দ্বীপ, দ্বেষ। ধ ব ধ্ব ধ্বনি, ধ্বংস। ন ব ন্ব অন্বেষণ। ল ব ল্ব বিল্ব। শ ব শ্ব অশ্ব, নিশ্বাস, আশ্বিন, শ্বেত। স ব স্ব স্বভাব, আস্বাদ, তেজস্বী। হ ব হ্ব জিহ্বা, আহ্বান। ৩ পাঠ। সুশীল বালক। ১। সুশীল বালক পিতা মাতাকে অতিশয় ভাল বাসে। তাঁহারা যে উপদেশ দেন, তাহা মনে করিয়া রাখে, কখনও ভুলিয়া যায় না। তাঁহারা যখন যে কাজ করিতে বলেন, তাহা করে, যে কাজ করিতে নিষেধ করেন, কদাচ তাহা করে না। ২। সে মন দিয়া লেখা পড়া করে, কখনও অবহেলা করে না। সে সতত এই ভাবে, লেখা পড়া না শিখিলে, চির কাল দুঃখ পাইব। ৩। সে আপন ভ্রাতা ও ভগিনীদিগকে বড় ভাল বাসে, কদাচ তাহাদের সহিত ঝগড়া করে না, তাহাদের গায়ে হাত তুলে না, খাবার দ্রব্য পাইলে, তাহাদিগকে না দিয়া, একাকী খায় না। ৪। সে কখনও মিথ্যা কথা বলে না। সে জানে, যাহারা মিথ্যা কথা বলে, কেহ তাহাদিগকে ভাল বাসে না, কেহ তাহাদের কথায় বিশ্বাস করে না, সকলেই তাহাদিগকে ঘৃণা করে। ৫। সে কখনও অন্যায় কাজ করে না। যদি দৈবাৎ করে, তাহার পিতা মাতা ধমকাইলে, সে রাগ করে না। সে এই মনে করে, অন্যায় কাজ করিয়াছিলাম, এজন্য পিতা মাতা ধমকাইলেন, আর কখনও এমন কাজ করিব না। ৬। সে কখনও কাহাকেও কটু বাক্য বলে না, কুকথা মুখে আনে না, কাহারও সহিত ঝগড়া ও মারামারি করে না, যাহাতে কাহারও মনে ক্লেশ হয়, কদাচ এমন কাজ করে না। ৭। সে কখনও পরের দ্রব্যে হাত দেয় না। জানে, না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে, চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ, যাহারা চুরি করে, সকলে তাহাদিগকে ঘৃণা করে। ৮। সে কখনও আলস্যে কাল কাটায় না। যে সময়ের যে কাজ, মন দিয়া তাহা করে। সে লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া না করিয়া, খেলা করিয়া বেড়ায় না। ৯। সে কখনও দুঃশীল বালকদিগের সহিত বেড়ায় না, তাহাদের সহিত খেলা করে না। সে মনে করে, দুঃশীলদিগের সহিত বেড়াইলে ও খেলা করিলে আমিও দুঃশীল হইয়া যাইব। ১০। সে যখন বিদ্যালয়ে থাকে, গুরু মহাশ্নয় যে সময়ে যাহা করিতে বলেন, প্রফুল্লু মনে তা করে, কদাচ তাহার অন্যথা করে না। সে কখনও তাঁহার কথার অবাধ্য হয় না, এজন্য তিনি তাহাকে ভাল বাসেন। ণ ফলা ণ ণ ণ ণ ণ্ণ বিষণ্ণ, ষণ্ণবতি। ষ ণ ষ্ণ কৃষ্ণ, তৃষ্ণা, সহিষ্ণু। হ ণ হ্ণ পরাহ্ণ, অপরাহ্ণ। ন ফলা। ন ন গ ন গ্ন ভগ্ন, মগ্ন, অগ্নি, আগ্নেয়। ঘ ন ঘ্ন বিঘ্ন, কৃতঘ্ন, বিষঘ্ন। ত ন ত্ন যত্ন, রত্ন, রত্নাকর। ন ন ন্ন অন্ন, ভিন্ন, অবসন্ন, সন্নিধান। ম ন ম্ন নিম্ন। স ন স্ন স্নান, স্নেহ। হ ন হ্ন চিহ্ন, জাহ্নবী, আহ্নিক। ম ফলা। ম ম ক ম ক্ম রুক্ম, রুক্মিণী। গ ম গ্ম যুগ্ম, বাগ্মী। ঙ ম ঙ্ম বাঙ্ময়, পরাঙ্মুখ। ণ ম ণ্ম হিরণ্ময়। ত ম ত্ম দুরাত্মা, আত্মীয়। দ ম দ্ম পদ্ম, ছদ্মবেশ। ন ম ন্ম জন্ম, উন্মাদ, উম্মূলিত। ম ম ম্ম সম্মত, সম্মান, সম্মুখ। ল ম ল্ম গুল্ম, শাল্মলী। শ ম শ্ম শ্মশান, রশ্মি। ষ ম ষ্ম উষ্ম। স ম স্ম ভস্ম, স্মরণ, অকস্মাৎ, বিস্মৃত। হ ম হ্ম জিহ্ম, জিহ্মগ, জিহ্মিত। ৪র্থ পাঠ। যাদব। যাদব নামে একটি বালক ছিল, তাহার বয়স আট বৎসর। যাদবের পিতা, প্রতিদিন তাহাকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়া দিতেন। লেখা পড়ায় যাদবের যত্ন। সে, এক দিনও, বিদ্যালয়ে যাইত না; প্রতিদিন পথে পথে খেলা করিয়া বেড়াইত। বিদ্যালয়ের ছুটী হইলে, সকল বালক যখন বাড়ী যাইত, যাদবও সেই সময়ে বাড়ী যাইত। তাহার বাপ মা মনে করিতেন, যাদব পাঠশালায় লেখা পড়া শিখিয়া আসিল। এই রূপে, প্রতি দিন সে বাপ মাকে ফাঁকি দিত। এক দিন যাদব দেখিল, ভুবন নামে একটি বালক পড়িতে যাইতেছে। সে তাহাকে কহিল, ভুবন, আজ তুমি পাঠশালায় যাইও না। এস, দুজনে মিলিয়া খেলা করি। পাঠশালার ছুটী হইলে, যখন সকলে বাড়ী যাইবে, আমরাও সেই সময়ে বাড়ী যাইব। ভুবন কহিল, না ভাই, আমি খেলা করিব না। সারাদিন খেলা করিলে, পড়া হবে না। কাল পাঠশালায় গেলে, গুরু মহাশয় ধমকাইবেন, বাবা শুনিলে রাগ করিবেন। আমি আর দেরি করিব না, পাঠশালায় যাই। এই বলিযা ভুবন চলিয়া গেল। আর একদিন, যাদব দেখিল, অভয় নামে একটি বালক পড়িতে যাইতেছে। সে তাহাকে বলিল, অভয় আজ পড়িতে যাইও না। এস, দুজনে খেলা করি। অভয় বলিল, না ভাই, তুমি বড় খারাপ ছোকরা; তুমি এক দিনও পড়িতে যাও না। তোমার সহিত খেলা করিলে আমিও তোমার মত খারাপ হইয়া যাইব। তোমার মত পথে পথে খেলিয়া বেড়াইলে লেখা পড়া কিছু হবে না। কাল গুরু মহাশয় বলিয়াছেন, ছেলেবেলায়, মন দিয়া লেখা পড়া না করিলে, চিরকাল দুঃখ পাইতে হয়। এই বলিয়া অভয় চলিয়া যায়। যাদব টানাটানি করিতে লাগিল। অভয় তাহার হাত ছাড়াইয়া, চলিয়া গেল। চলিয়া যাইবার সময় সে বলিল, আজ আমি তোমার সব কথা গুরু মহাশয়কে বলিয়া দিব। অভয়, বিদ্যালয়ে গিয়া গুরু মহাশয়কে་ যাদবের কথা বলিয়া দিল। গুরু মহাশয় যাদবের পিতার নিকট বলিয়া পাঠাইলেন, তোমার ছেলে, এক দিনও পড়িতে আইসে না। প্রত্যহ পথে পথে খেলিয়া বেড়ায়। আপনিও পড়িতে আইসে না, এবং অন্য অন্য বালককেও আসিতে দেয় না। যাদবের পিতা শুনিয়া অতিশয় ক্রোধ করিলেন, তাহাকে অনেক ধমকাইলেন; বই, কাগজ, কলম, যা কিছু দিয়াছিলেন, সব কাড়িয়া লইলেন। সেই অবধি, তিনি যাদবকে ভাল বাসিতেন না, কাছে আসিতে দিতেন না, সম্মুখে আসিলে, দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন। র রেফ কর্কশ শর্করা মুর্খ মূর্খতা। ছর্গম, নির্গত, বিসর্গ। দীর্ঘ, মহার্ঘ, নির্ঘাত | দুর্জন, নির্জন, নিজীব | ঝর্ঝর, নির্ঝর | কর্ণ, বর্ণ, নির্ণয়। অর্থ, সমর্থ, সার্থক | নির্দয়, ভুর্দব, নির্দোষ। নির্ধন, নির্ধূম। ছুর্নাম, ছুনিবার | সর্প কার্পাস, অপিত, কপূর। দুর্বল, দুর্বোধ । নির্ভয়, নির্ভর, দুর্ভাবনা। ৫ম পাঠ। নবীন। নবীন নামে একটী বালক ছিল। তাহার বয়ঃক্রম নয় বৎসর। সে খেলা করিতে এত ভাল বাসিত যে, সারা দিন, পথে পথে খেলিয়া বেড়াইত, এক বারও লেখা পড়াষ মন দিত না। এজন্য সে কিছুই শিখিতে পারিত না। গুরু মহাশয় প্রতিদিন তাহাকে ধমকাইতেন। ধমকের ভয়ে, সে আর বিদ্যালয়ে যাইত না। এক দিন, নবীন ফেখিল, একটি বালক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতে যাইতেছে। সে তাহা কে বলিল, ভাই, এস, দুজনে খানিক খেলা করি। সে বলিল, আমি পড়িতে যাইতেছি, এখন খেলিতে পারিব না। পড়িবার সময় খেলা করিলে, লেখা পড়া শিখিতে পারিব না। বাবা আমাকে পড়িবার সময় পড়িতে ও খেলিবার সময় খেলিতে, বলিয়া দিয়াছেন। আমি যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। এজন্য বাবা আমাকে ভাল বসেন। আমি তাঁর কাছে যখন যা চাই, তাই দেন। যদি এখন আমি পড়িতে না গিয়া তোমার সহিত খেলা করি, বাবা আমাকে আর ভাল বাসিবেন না। তিনি বলিয়াছেন, লেখা পড়ায় অবহেলা করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়াইলে, চিরকাল ছুঃখ পাইতে হয়। অতএব, আমি চলিলাম। এই বলিয়া সে সত্বর চলিয়া গেল। নবীন খানিক দূর গিয়া দেখিল, একটি বালক চলিয়া যাইতেছে। তাহাকে বলিল, ভাই, তুমি কোথায় যাইতেছ। সে বলিল, বাবা আমাকে এক জিনিস আনিতে পাঁঠাইয়াছেন। তখন নবীন বলিল, তুমি খানিক পূরে জিনিস আনিতে যাইবে। এখন এস, দুজনে মিলিয়। খানিক খেলা করি। ঐ বালক বলিল, না ভাই, এখন আমি খেলিতে পারিব না। বাবা যে কাজ করিতে বলিয়াছেন, আগে তাহা করিব। বাবা বলিয়াছেন, কাজে অযত্ব করা ভাল নয়। আমি কাজের সময় কাজ করি, খেলার সময় খেলা করি। কাজের সময়, কাজ না করিয়া, খেলিয়া বেড়াইলে, চিরকাল দুঃখ পাইব। আমি কখনও কাজে অমনোযোগ করি না। যে সময়ের যে কাজ, সে সময়ে সে কাজ করি। আমি, তোমার কথা শুনিয়া, কাজে অবহেলা করিব না। এই কথা শুনিয়া, নবীন সেখান হইতে চলিয়া গেল। খানিক গিয়া, এক রাখালকে দেখিয়া সে বলিল, আয় না ভাই, দুজনে মিলিয়া খেলা করি। রাখাল বলিল, আমি গরু চরাইতে যাইতেছি, এখন খেলা করিতে পারিব না। খেলা করিলে, গরু চরান হইবে না। প্রভু রাগ করিবেন, গালাগালি দিবেন। আমি কাজে অযত্ন করিব না। কাজের সময় কাজ করিব, খেলার সময় খেলা করিব। বাবা এক দিন বলিয়াছিলেন কাজের সময় কাজ না করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। তুমি যাও, এখন আমি খেলা করিতে পারিব না। এই রূপে, ক্রমে ক্রমে, তিন জনের কথা শুনিয়া, নবীন মনে মনে ভাবিতে লাগিল, সকলেই কাজের সময় কাজ করে। এক জনও, কাজে অবহেলা করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়ায় না। কেবল আমিই, সারা দিন, খেলা করিয়া বেড়াই। সকলেই বলিল, কাজের সময় কাজ না করিয়া খেলিয়া বেড়াইলে, চির কাল দুঃখ পাইতে হয়। এজন্য তারা, সারা দিন, খেলা করিয়া বেড়ায় না। আমি যদি, লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া না করিয়া, কেবল খেলিয়া বেড়াই, তা হলে, আমি চির কাল দুঃখ পাইব। বাবা জানিতে পারিলে আর আমায় ভাল বাসিবেন না, মারিবেন, গালাগালি দিবেন, কখন কিছু চাহিলে দিবেন না; আমি আর লেখা পড়ায় অবহেলা করিব না। আজ অবধি, লেখা পড়ার সময়, লেখা পড়া করিব। এই ভাবিয়া, সেই দিন অবধি, নবীন লেখা পড়ায় মনোযোগ করিল। তার মন আর সারা দিন খেলা করিয়া বেড়াইত না। কিছু দিনের মধ্যেই, নবীন অনেক শিখিয়া ফেলিল। তাহা দেখিয়া সকলে নবীনের প্রশংসা করিতে লাগিল। এইরূপে, লেখা পড়ায় যত্ন হওয়াতে, ক্রমে ক্রমে, অনেক বিদ্যা শিখিয়াছিল। মিশ্র সংযোগ—দুই অক্ষরে চিক্কণ, ধিক্কার, কুক্কুট। রক্ত, শক্ত, বক্তা, ভক্তি। ভক্ষণ, লক্ষণ, পরীক্ষা, রক্ষিত। দগ্ধ, ভুদ্ধ, মুগ্ধ। অঙ্ক, শঙ্কা, অঙ্কুর, সংকেত। শঙ্খ, শৃঙ্খলা, বিশৃঙ্খল। অঙ্গ, অঙ্গার, সঙ্গীত, অঙ্গুলি। লঙ্ঘন, জঙ্ঘা। উচ্চ, উচ্চারণ। তুচ্ছ, আচ্ছাদন। লজ্জা, সজ্জিত বিজ্ঞ, আজ্ঞা, অজ্ঞান | অঞ্চল, সঞ্চার, বঞ্চিত লাঞ্চনা, বাঞ্ছা, লাঞ্ছিত অঞ্জলি, পঞ্জিকা। চট্ট, ভট্ট, অট্টালিকা। খড়্গ কণ্টক, বণ্টন, ঘণ্টা। কণ্ঠ, উৎকণ্ঠা, কুষ্ঠিত | খণ্ড, চণ্ডাল, পুত, গণ্ডুষ। উত্তম, উত্তাপ, আবৃত্তি | উত্থান, উত্থাপন, উত্থিত। মুদ্গর উদ্ঘাটন, উদ্ঘাটিত। উদ্দেশ। বৃদ্ধ, উদ্ধার, বুদ্ধি। সন্ভাব, উদ্ভিদ, উদ্ভূত | দত্ত, চিন্তা, জন্তু, কিন্ত, সন্তোষ।' মন্থন, পন্থা। আনন্দ, মন্দির, সন্দেহ। অন্ধ , সন্ধা বন্ধু। তপ্ত, লিগ তৃন্ত, দীপ্তি। অব্জ, কুব্জ। শব্দ, শকাবন্দা, শাব্দিক। লব্ধ, লুব্ধ, আরন্ধ। হস্ত, নিস্তারঃ বস্ত, নিশ্তেজশ স্থান, অস্থি, স্থুল। স্থ স্থলন, স্বীলিতম ৬ষ্ঠ পাঠ। মাধব নামে একটি বালক ছিল। তাহার বয়স দশ বৎসর। তাহার পিতা তাহাকে বিদ্যালয়ে শিক্ষা করিতে দিয়াছিলেন। সে প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাইত, এবং মন দিয়া লেখা পড়া শিখিত; কখনও, কাহারও সহিত ঝগড়া বা মারামারি করিত না; এজন্য, সকলেই তাহাকে ভালবাসিত। এ সকল গুণ থাকিলে কি হয়, মাধবের একটা মহৎ দোষ ছিল। সে, পরের দ্রব্য লইতে, বড় ভাল বাসিত। সুযোগ পাইলেই, কোনও দিন কোনও বালকের পুস্তক লইত, কোনও দিন কোনও বালকের কলম লইত, কোনও দিন কোনও বালকের কাগজ লইত, কোনও দিন কোনও বালকের ছুরি লইত। এইরূপে, প্রায় প্রতিদিন, সে এক এক বালকের এক এক দ্রব্য অপহরণ করিত। মাধব যে বালকের কোনও দ্রব্য লইত, সে শিক্ষক মহাশয়ের নিকটে গিয়া বলিত, মহাশয়, আমার অমুক দ্রব্য কে লইয়াছে। মাধব, চুরি করিয়া এমন লুকাইয়া রাখিত যে, শিক্ষক মহাশয়, অনেক চেষ্টা করিযাও, তাহার সন্ধান করিতে পারিতেন না। কে চুরি করিয়াছে, স্থির করিতে না পারিয়া, তিনি সকল বালককেই তিরস্কার করিতেন। প্রত্যহ গালাগালি খাইয়া, কটিপয় বালক পরামর্শ করিল, আজ অবধি আমরা সতর্ক থাকিব। দেখিব, কে চুরি করে। দুই তিন দিনের মধ্যেই তাহারা মাধবকে চোর বলিয়া ধরিয়া দিল। মাধব, সে দিন, এক বালকের এক খানি পুস্তক লইয়াছিল। শিক্ষক মহাশয়, চোর বলিয়া, তাহাকে গালাগালি দিতে লাগিলেন। তখন মাধব বলিল, আমি চুরি করি নাই, ভুলিয়া লইয়াছিলাম। শিক্ষক মহাশয়, সে দিন তাহাকে ক্ষমা করিলেন, বলিয়া দিলেন, তুমি, আর কখনও, কাহারও দ্রব্যে হস্তার্পণ করিও না। মাধব বলিল, আমি, আর কখনও কাহারও কোন দ্রব্যে হাত দিব না। দুই তিন দিন, কাহারও কোনও দ্রব্য, হারাইল না। পরে, পুনরায়, বিদ্যালয়ের বালকদিগের দ্রব্য হারাইতে লাগিল। মাধব, পুনরায়, চোর বলিয়া ধরা পড়িল। সে বারেও, শিক্ষক মহাশয়, তাহাকে ক্ষমা করিলেন, এবং অনেক বুঝাইয়া বলিয়া দিলেন, যদি তুমি পুনরায় চুরি কর, তোমাকে বিদ্যালয় হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিব। সে বলিল, আমি আর কখনও চুরি করিব না। আর চুরি করিব না বলিয়া, সে শিক্ষক মহাশয়ের নিকট প্রতিজ্ঞা করিল বটে, কিন্তু কয়েক দিন পরে, পুনরায় চুরি করিল, এবং চোর বলিয়া ধরা পড়িল। এই রূপে বারংবার চুরি করাতে, শিক্ষক মহাশয়, তাহাকে বিদ্যালয় হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিলেন। তাহার পিতা, এই সকল বৃত্তান্ত জানিতে পারিয়া, যথেষ্ট তিরস্কার ও বিলক্ষণ প্রহার করিলেন। কিছু দিন পরে, তিনি তাহাকে আর এক বিদ্যালয়ে পাঠাইলেন। সে সেখানেও চুরি করিতে লাগিল। সে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাশয়, অতিশয় তিরস্কার ও প্রহার করিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিলেন। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া, তাহার পিতার মনে অত্যন্ত ঘৃণা জন্মিল। তিনি ক্রুদ্ধ হইয়া, তাহাকে বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। বাল্যকাল হইতে চুরি অভ্যাস করিয়া, মাধব আর সে অভ্যাস ছাড়িতে পারিল না। ক্রমে ক্রমে যত বড় হইতে লগিল, ততই তাহার এ প্রবৃত্তি বাড়িতে লাগিল। সে সুযোগ পাইলেই, কাহারও বাটীতে প্রবেশ করিয়া, চুরি করিত। এজন্য যে দেখিত, সেই তাহাকে ঘৃণা করিত। কেহ তাহাকে বিশ্বাস করিত না। কাহারও বাটীতে গেলে, সে তাহাকে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিত। মাধবের দুঃখের সীমা ছিল না। সে খাইতে না পাইয়া, পেটের জ্বালায় ব্যাকুল হইয়া, দ্বারে দ্বারে কাঁদিয়া বেড়াইত, তথাপি তাহার প্রতি, কাহারও স্নেহ বা দয়া হইত না। মিশ্র সংযোগ—তিন অক্ষরে। মম সুন্গম, লক্ষ্মী। জব উজ্জ্বল। পুত্র, ছত্র, ছাত্র। স্ব তপ্ত মহন্ত। দৌরাত্য, মাহাত্ম্য | তর তস্ত, মন্ত্র যত, মন্ত্রী। ক্র চন্দ্র, তন্দ্রা, ইন্দ্রিয়। বিন্ধ্য, বন্ধ্যা, সন্ধ্যা। উপার্জন, বঞ্চিত। নির্দেশ। নির্ধারিত। ৭ম পাঠ। রাম। রাম বড় সুবোধ। সে কদাচ পিতা মাতার কথার অবাধ্য হয়না। তাঁহারা রামকে যখন যাহা করিতে বলেন, সে তৎক্ষণাৎ তাহা করে, কদাচ তাহার অন্যথা করে না। তাঁহারা যাহা করিতে একবার নিষেধ করেন, সে আর কখনও তাহা করে না। এজন্য তাহার পিতা মাতা তাহাকে অতিশয় ভালবসেন। রাম আপন ভাই ভগিনী গুলির উপর অতিশয় সদয়। বড়ভাই ও বড় ভগিনীদিগের কথা শুনে, কখনও তাঁহাদের অনাদর করে না, ছোট ভাই ও ছোটি ভগিনীদিগকে অতিশয় ভাল বাসে, কখনও তাঁহাদিকে বিরক্ত করে না, তাহাদের গায়ে হাত তুলে না। রাম সকল সমবয়স্ক বালাকদিগের সঙ্গ খেলা করে, তাহাদের সকলকেই আপন ভ্রাতার ন্যায় ভাল বাসে, কদাচ তাহাদের সহিত ঝগড়া বা মারামারি করে না। যাহাতে তাহারা সন্তুষ্ট হয়, সে সর্বদা সেইরূপ কর্ম করে; যাহাতে তাহারা অসন্তুষ্ট হয়, কদাচ সেরূপ কর্ম করে না। এজন্য, তাহারা সকলেই রামকে অতিশয় ভাল বাসে। রামকে দেখিলে, তাহাদের বড় আহ্লাদ হয়। লেখা পড়ায় রামের বড় যত্ন। সে কখনও, সে বিষয়ে উপেক্ষা করে না। মে আপন শিক্ষকদিগকে অতিশয় ভক্তি করে। তাঁহারা যখন ষে উপদেশ দেন, সে তাহা মন দিয়া শুনে, কদাচ তাহা বিস্মৃত হয় না। রাম কখনও কোনও মন্দ কর্ম করে না। দৈবাৎ যদি করে, একবার বারণ করিলে, আর কখনও সেরূপ করে না। যদি তাহার পিতা মাতা, অথবা শিক্ষক বলেন, রাম, তুমি বড় মন্দ কর্ম করিয়াছ; সে বলে, আমি না বুঝিয়া করিয়াছি, আর কখনও এমন কর্ম করিব না, এবার আমায় ক্ষমা করুন। তার পর, রাম আর কদাচ তেমন কর্ম করে না। যাহা শুনিলে, লোকের মনে ক্লেশ হয, রাম কখনও কাছাকেও সেরূপ কথা বলে না। সে কখনও কাণাকে কাণা, বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিয়। ডাকে না। কাণাকে কাণা, বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিলে, তাঁহারা বড় দুঃখিত হয়। এজন্য কাহারও ওরূপ বলা উচিত নয়। রামের মুখে কেহ কখনও কটু, অপ্রিয়, বা অশ্লীল কথা শুনিতে পায় না। ৮ম পাঠ। পিতা মাতা। দেখ বালকগণ, পৃথিবীতে পিতা মাতা অপেক্ষা বড় কেহই নাই। তাহারা, কত যত্বে, কত কষ্ট, তোমাদের লালন পালন করিয়াছেন। তাঁহারা সেরূপ যত্ন ও সেরূপ কষ্ট না করিলে, কিছুতেই তোমাদের প্রাণরক্ষা হইত না। তাঁহারা তোমাদিগকে যেরূপ ভাল বাসেন, পৃথিবীতে আর কেহ তোমাদিগকে সেরূপ ভাল বসেন না। কিসে তোমাদের সুখ ও আহলাদ হয়, তাঁহারা সর্বদা সে চেষ্টা করেন। তোমাদের সুখ ও আহলাদ দেখিলে, তাহাদের যেরূপ সুখ ও আহলাদ হয়, আর কাহারও সেরূপ হয় না। তাঁহারা তোমাদের উপর যত সদয়, আর কেহ সেরূপ নহেন। যাহাতে তোমাদের মঙ্গল হয়, সে বিষয়ে তাঁহারা সতত কত যত্ব করেন। তোমাদের বিদ্যা হইলে, চির কাল সুখে থাকিতে পারিবে, এজন্য, তোমাদিগকে বিদ্যালয়ে পাঠাইয়াছেন। তোমরা মন দিয়া লেখা পড়া শিখিলে, তাহাদের কত আহ্লাদ হয়। তাঁহারা, দয়া করিয়া তোমাদিগকে খাওয়া পরা না দিলে, তোমাদের ক্লেশের সীমা থাকিত না। উপাদেয় বস্তু পাইলে, আপনারা না খাইয়া, তোমাদিগকে দেন। ভাল বস্ত্র পরিলে, তোমরা আহলাদিত হও, এজন্য তোঁমাদিগকে ভাল ভাল বস্ত্র কিনিয়া দেন | তোমাদের পীড়া হইলে, তাঁহাদের মনে কত কষ্ট ও কত দুর্ভাবনা হয়। তোমাদের পীড়া-শান্তির নিমিত্ত কত চেষ্টা ও কত যত্ন করেন। যাবৎ তোমরা সুস্থ হইয়া না উঠ, তাবৎ তাঁহারা স্থির ও নিশ্চিন্ত হইতে পারেন না। তোমরা সুস্থ হইয়া উঠিলে, তাহাদের আহ্লাদের সীমা থাকে না। অতএব, তোমরা কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইবে ন। তাঁহারা যাহা বলেন, তাহা করিবে। যাহা করিতে নিষেধ করেন, তাহা কখনও করিবে না। যাহাতে তাহারা সন্তুষ্ট হন, সর্বদা সে চেষ্টা করিবে। যাহাতে তাঁহারা অসন্তুষ্ট হন, কদাচ তাহা করিবে না। যাহারা এইরূপে চলে, তাহাদিগকে সুসন্তান বলে। সুসন্তান হইলে পিতা মাতার সুখের ও আহ্লাদের সীমা থাকে না। ৯ম পাঠ। সুরেন্দ্র। সুরেন্দ্র, আমার কাছে এস; তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করিব। এই কথা শুনিয়া, সুরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ শিক্ষকের নিকট উপস্থিত হইল। তিনি বলিলেন, আমি শুনিলাম, তুমি, পুষ্করিণীর পাড়ে দাঁড়াইয়া, ডেলা ছুড়িতেছিলে; ইহাতে আমি অতিশয় দুঃখিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে তোমায় জিজ্ঞাসা করি, এ কথা যথার্থ কি না। সুরেন্দ্র বলিল, হাঁ মহাশয়, যাহা শুনিয়াছেন, তাহা সত্য; আমি ডেলা ছুঁড়িয়াছিলাম। ডেলা ছুড়িলে যে কোন দোষ হয়, আমি তাহা মনে করি নাই। গাছের ডালে একটী পাখী বসিয়া ছিল; তাহাকে মারিবার জন্য, ডেলা ছুড়িয়াছিলাম। এই কথা শুনিয়া, শিক্ষক বলিলেন, সুরেন্দ্র, অতি অন্যায় কর্ম করিয়াছ। পাখী তোমার কোন ক্ষতি করে নাই; কি জন্য তাহাকে ডেল৷ মারিতে গেলে? যদি তাহার গায়ে ডেলালাগিয়া থাকে, সে কত কষ্ট পাইয়াছে। যদি আর কেহ ডেলা ছুড়ে আর এ ডেলা তোমার গায়ে লাগে, তোমার কত কষ্ট হয়। তোমায় বারণ করিতেছি, তুমি পাখী বা আর কোনও জন্তুকে কখনও ডেলা মারিও না। সুরেন্দ্র শুনিয়া অতিশয় লজ্জিত হইল; এবং বলিল, মহাশয়, আমি আর কখনও কোনও জন্তকে ডেলা মারিব না। অনেক বালক এরূপ করে; তাহা দেখিয়া আমিও এরূপ করিয়াছিলাম। এখন বুঝিতে পারিলাম, ডেলা ছোড়া ভাল নয়। তখন শিক্ষক বলিলেন, তোমার এই কথা শুনিয়া সন্তষ্ট হইলাম। কিন্তু তুমি, যে পাখীকে লক্ষ্য করিয়া, ডেলা ছুড়িয়াছিলে, উহার গায়ে এ ডেলা লাগে নাই। নিকটে একটি বালক দাড়াইয়া ছিল; ডেলা তাহার মাথায় লাগিয়া রক্তপাত হইয়াছে। চক্ষুতে লাগিলে, সে এ জন্মের মত, কাণা হইয়া যেত। বালকটি কাতর হইয়া কত রোদন করিতেছে। অতএব দেখ, ডেলা ছোড়ায় কত দোষ। সুরেন্দ্র শুনিরা অতিশয় দুঃখিত হইল; এবং আমি বড় দুষ্কর্ম করিয়াছি, এই বলিয়া রোদন করিতে লাগিল। কিঞ্চিৎ পরে, সে বলিল, মহাশয়, না বুঝিয়া, আমি এই দুষ্কর্ম করিয়াছি | আপনার সমক্ষে বলিতেছি, আর কখনও এমন কর্ম্ম করিব না। এবার আপনি আমায় ক্ষমা করুন। শিক্ষক শুনিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; এবং বলিলেন, সুরেন্দ্র, তুমি যে দোষ করিয়া, স্বীকার করিলে, ইহাতে আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। দেখিও, ডেলা ছোঁড়া ভাল নয়, এ কথা যেন ভুলিয়া না যাও। ১০ম পাঠ। চুরি করা কদাচ উচিত নয়। না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়। চুরি করা বড় দোষ। যে চুরি করে, তাহাকে চোর বলে। চোরকে কেহ বিশ্বাস করে না। চুরি করিয়া ধরা পড়িলে, চোরের দুর্গতির সীমা থাকে না। বালকগণের উচিত, কখনও চুরি না করে। পিতা মাতা প্রভৃতির কর্তব্য, পুত্র প্রভৃতিকে কাহারও কোনও দ্রব্য চুরি করিতে দেখিলে, তাহাদের শাসন করেন; এবং ছরি করিলে কি দোষ হয়, তাহাদিগকে ভাল করিয়া বুঝাইয়া দেন। একদা, একটি বালক বিদ্যালয় হইতে, অন্য এক বালকের এক খানি পুস্তক চুরি করিয়া আনিয়াছিল। অতি শৈশব কালে, ঐ বালকের পিতা মাতার মৃত্যু হয়। তাহার মাসী লালন-পালন করিয়াছিলেন। তিনি, তাহার হস্তে ঐ পুস্তক খানি দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, ভূবন, তুমি এই পুস্তক কোথায় পাইলে। সে বলিল, বিদ্যালয়ের এক বালকের পুস্তক। তিনি বুঝিতে পারিলেন, ভূবন এই পুস্তক খানি চুরি করিয়া আনিয়াছে। কিন্ত তিনি পুস্তক ফিরিয়া দিতে বলিলেন না। এবং ভূুবনের শাসন, বা ভুবনকে চুরি করিতে নিষেধ করিলেন না। ইহাতে ভূবনের সাহস বাড়িয়া গেল। সে যত দিন বিদ্যালয়ে ছিল, সুযোগ পাইলেই চুরি করিত। এইরূপে ক্রমে ক্রমে, সে বিলক্ষণ চোর হইয়া উঠিল। সকলেই জানিতে পারিল, ভুবন বড় চোর হইয়াছে। কাহারও কোনও দ্রব্য হারাইলে, সকলে তাহাকেই চোর বলিয়া সন্দেহ করিত। যদি ভুবন অন্য লোকের বাটাতে যাইত, পাছে সে কিছু চুরি করে, এই ভয়ে তাহারা অতিশয় সতর্ক হইত; এবং, যথোচিত তিরস্কার ও প্রহার পর্যন্ত্য করিয়া, তাহাকে তাড়াইয়া দিত। কিছু কাল পরে, ভুবন চোর বলিয়া ধরা পড়িল। সে বহু কাল চোর হইয়াছে, এবং অনেকের অনেক দ্রব্য চুরি করিয়াছে, তাহা সপ্রমাণ হইল। বিচারকর্তা ভুবনের ফাঁসির আজ্ঞা দিলেন। তখন ভূবনের চৈতন্য হইল। যে স্থানে অপরাধীদিগের ফাঁসি হয়, তথায় লইয়া গেলে পর, ভূবন রাজপুরুষদিগকে বলিল, তোমরা দয়া করিয়া, এ জন্মের মত, এক বার আমার মাসীর সঙ্গে দেখা করাও। ভুবনের মাসী এ স্থানে আনীত হইলেন; এবং ভুবনকে দেখিয়। উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে, কাঁদিতে, তাহার নিকটে গেলেন। ভুবন বলিল, মাসি, এখন আর কাঁদিলে কি হইবে। নিকটে এস, কানে কানে তোমায় একটি কথা বলিব। মাসী নিকটে গেলে পর, ভুবন তাঁহার কানের নিকটে মুখ লইয়া গেল; এবং জোরে কামড়াইয়া, দাঁত দিয়া তাঁহার একটি কান কাটিয়া লইল; পরে সে ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, মাসি, তুমিই আমার এ ফাঁসির কারণ। যখন আমি প্রথম চুরি করিয়াছিলাম, তুমি জানিতে পারিয়াছিলে। সে সময়ে যদি তুমি শাসন ও নিবারণ করিতে, তাহা হইলে, আমার এ দশা ঘটিত না। তাহা কর নাই, এজন্য, তোমার এই পুরস্কার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥ ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, মরি হায়, হায় রে— ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥ কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো— কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে। মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো, মরি হায়, হায় রে— মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥ তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে, তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি। তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে, মরি হায়, হায় রে— তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥ ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে, সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে, তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে, মরি হায়, হায় রে— ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥ ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে— দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে। ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে, মরি হায়, হায় রে— আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে, গাহে তব জয়গাথা। জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে ॥ অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে প্রেমহার হয় গাঁথা। জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে ॥ পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী। হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি। দারুণ বিপ্লব-মাঝে তব শঙ্খধ্বনি বাজে সঙ্কটদুঃখত্রাতা। জনগণপথপরিচায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে॥ ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে। দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে রক্ষা করিলে অঙ্কে স্নেহময়ী তুমি মাতা। জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে ॥ রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে— গাহে বিহঙ্গম, পুণ্য সমীরণ নবজীবনরস ঢালে। তব করুণারুণরাগে নিদ্রিত ভারত জাগে তব চরণে নত মাথা। জয় জয় জয় হে, জয় রাজেশ্বর ভারতভাগ্যবিধাতা! জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সহজ পাঠ: প্রথম ভাগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ আ ছোট খোকা বলে অ আ শেখেনি সে কথা কওয়া। ই ঈ হ্রস্ব ই দীর্ঘ ঈ বসে খায় ক্ষীর খই। উ ঊ হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ। ঋ ঘন মেঘ বলে ঋ দিন বড় বিশ্রী। এ ঐ বাটি হাতে এ ঐ হাঁক দেয় দে দৈ। ও ঔ ডাক পাড়ে ও ঔ ভাত আনো বড় বৌ। ক খ গ ঘ ক খ গ ঘ গান গেয়ে জেলে ডিঙি চলে বেয়ে। ঙ চরে বসে রাঁধে ঙ চোখে তার লাগে ধোঁয়া। চ ছ জ ঝ চ ছ জ ঝ দলে দলে বোঝা নিয়ে হাটে চলে। ঞ ক্ষিদে পায় খুকী ঞ শুয়ে কাঁদে কিয়োঁ কিয়োঁ। ট ঠ ড ঢ ট ঠ ড ঢ করে গোল কাঁধে নিয়ে ঢাক ঢোল। ণ বলে মূর্দ্ধন্য ণ, চুপ কর কথা শোন। ত থ দ ধ ত থ দ ধ বলে, ভাই আম পাড়ি চল যাই। ন রেগে বলে দন্ত্য ন যাব না তো কক্ষনো। প ফ ব ভ প ফ ব ভ যায় মাঠে সারাদিন ধান কাটে। ম ম চালায় গোরু-গাড়ি ধান নিয়ে যায় বাড়ি। য র ল ব য র ল ব বসে ঘরে এক মনে পড়া করে। শ ষ স শ ষ স বাদল দিনে ঘরে যায় ছাতা কিনে। হ ক্ষ শাল মুড়ি দিয়ে হ ক্ষ কোণে বসে কাশে খ ক্ষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সহজ পাঠ: দ্বিতীয় ভাগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম পাঠ বাদল করেছে মেঘের রং ঘন নীল। ঢং ঢং ক’রে ৯টা বাজল। বংশু ছাতা মাথায় কোথায় যাবে? ও যাবে সংসারবাবুর বাসায়। সেখানে কংসবধের অভিনয় হবে। আজ মহারাজ হংসরাজসিংহ আসবেন। কংসবধ অভিনয় তাঁকে দেখাবে। বাংলাদেশে তাঁর বাড়ি নয়। তিনি পাংশুপুরের রাজা। সংসারবাবু তাঁরি সংসারে কাজ করেন। কাংলা,তুই বুঝি সংসারবাবুর বাসায় চলেছিস? সেখানে কংসবধে সং সাজতে হবে। কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী? ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসারবাবুর মা চেয়েছেন। দ্বিতীয় পাঠ আজ আদ্যনাথবাবুর কন্যার বিয়ে— তাঁর এই শল্যপুরের বাড়িতে। কন্যার নাম শ্যামা। বরের নাম বৈদ্যনাথ। বরের বাড়ি অহল্যাপাড়ায়। তিনি আর তাঁর ভাই সৌম্য পাটের ব্যবসা করেন। তাঁর এক ভাই ধৌম্যনাথ কলেজে পড়ে, আর রম্যনাথ ইস্কুলে। আদ্যনাথ বড়ো ভালো লোক। দান-ধ্যান পুণ্যকাজে তাঁর মন। দেশের জন্য অনেক কাজ করেন। সবাই বলে,তিনি ধন্য। আদ্যনাথবাবু তাঁর ভৃত্য সত্যকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। আমি বলেছি তাঁর কন্যার বিবাহে অবশ্য অবশ্য যাব। এখানে এসে দেখি, আঙিনায় বাদ্য বাজছে। চাষীরা এ বৎসর ভালো শস্য পেয়েছে। তাই তারা ভিড় ক’রে এসেছে। ভিতরে ঢুকি— সাধ্য কী! অগত্যা বাইরে ব’সে আছি। দেখছি, ছেলেরা খুশী হয়ে নৃত্য করচে। কেউ বা ব্যাটবল খেলছে। নিত্যশরণ ওদের ক্যাপ্‌টেন। হাট কুমোর-পাড়ার গোরুর গাড়ি — বোঝাই-করা কল্‌সি হাঁড়ি । গাড়ি চালায় বংশীবদন , সঙ্গে-যে যায় ভাগ্নে মদন । হাট বসেচে শুক্রবারে বক্সীগঞ্জে পদ্মাপারে । জিনিষপত্র জুটিয়ে এনে গ্রামের মানুষ বেচে কেনে । উচ্ছে বেগুন পটল মূলো , বেতের বোনা ধামা কুলো , সর্ষে ছোলা ময়দা আটা , শীতের র‍্যাপার নক্‌শাকটা । ঝাঁঝ‍্‌রি কড়া বেড়ি হাতা , শহর থেকে সস্তা ছাতা । কল্‌‍সি-ভরা এখো গুড়ে মাছি যত বেড়ায় উড়ে । খড়ের আঁটি নৌকো বেয়ে আন‌ল ঘাটে চাষীর মেয়ে । অন্ধ কানাই পথের 'পরে গান শুনিয়ে ভিক্ষে করে! পাড়ার ছেলে স্নানের ঘাটে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটে । তৃতীয় পাঠ আজ মঙ্গলবার। পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গল বেঁধে যাবে। রঙ্গলালবাবুও এখনি আসবেন। আর আসবেন তাঁর দাদা বঙ্গবাবু। সিদ্ধি, তুমি দৌড়ে যাও তো। অনঙ্গদাদাকে ধরো, মোটরগাড়িতে তাঁদের আনবেন। সঙ্গে নিতে হবে কুড়ুল, কোদাল, ঝাঁটা, ঝুড়ি। আর নেব ভিঙ্গি মেথরকে। এবার পঙ্গপাল এসে বড়ো ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ ক’রে দিয়েছে। পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে। ঈশানবাবু ইঙ্গিতে বলেছেন, তিনি কিছু দান করবেন। চতুর্থ পাঠ চন্দননগর থেকে আনন্দবাবু আসবেন। তিনি আমার পাড়ার কাজ দেখতে চান। দেখো, যেন নিন্দা না হয়। ইন্দুকে ব’লে দিয়ো, তাঁর আতিথ্যে যেন খুঁত না থাকে। তাঁর ঘরে সুন্দর দেখে ফুলদানি রেখো। তাতে কুন্দফুল থাকবে আর আকন্দ থাকবে। রঙ্গু বেহারাকে ব’লো, তাঁর শোবার ঘরে তাঁর তোরঙ্গ যেন রাখে। ঘর বন্ধ যেন না থাকে। সন্ধ্যা হ’লে ঘরে ধুনোর গন্ধ দিয়ো। দীনবন্ধুকে রেখো পাশের ঘরেই। তাঁদের সঙ্গে সিন্ধুবাবু আসবেন, তাঁকে অন্য ঘরে রাখতে হবে। বিন্দুকে ব’লে মালাচন্দন তৈরি রাখা চাই। বন্দেমাতরং গান নন্দী জানে তো? সেই অন্ধ গায়ককেও ডেকে এনো। সে তো মন্দ গায় না। পঞ্চম পাঠ বর্ষা নেমেছে। গর্মি আর নেই। থেকে থেকে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চমকানি চলছে। শিলং পর্বতে ঝর্নার জল বেড়ে উঠলো। কর্ণফুলি নদীতে বন্যা দেখা দিয়েছে। সর্ষে ক্ষেত ডুবিয়ে দিলে। দুর্গানাথের আঙিনায় জল উঠেছে। তার দর্মার বেড়া ভেঙে গেল। বেচারা গোরুগুলোর বড়ো দুর্গতি। এক হাঁটু পাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। চাষীদের কাজকর্ম সব বন্ধ। ঘরে ঘরে সর্দি-কাশি। কর্তাবাবু বর্ষাতি প’রে চলেছেন। সঙ্গে তাঁর আর্দালি তুর্কি মিঞা। গর্ত সব ভ’রে গিয়ে ব্যাঙের বাসা হল। পাড়ার নর্দমাগুলো জলে ছাপিয়ে গেছে। ঐখানে মা পুকুর পাড়ে জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে হোথায় হব বনবাসী— কেউ কোত্থাও নেই। ঐখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে, শুক‍্‌নো পাতা বিছিয়ে ঘরে থাকব দুজনেই। বাঘ ভাল্লুক, অনেক আছে— আসবে না কেউ তোমার কাছে, দিনরাত্তির কোমর বেঁধে থাকব পাহারাতে। রাক্ষসেরা ঝোপে ঝাড়ে মারবে উঁকি আড়ে আড়ে, দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি ধনুক নিয়ে হাতে। আঁচলেতে খই নিয়ে তুই যেই দাঁড়াবি দ্বারে অম‍্‌নি যত বনের হরিণ আসবে সারে সারে। শিংগুলি সব আঁকাবাঁকা, গায়েতে দাগ চাকা চাকা, লুটিয়ে তারা পড়বে ভুঁয়ে পায়ের কাছে এসে। ওরা সবাই আমায় বোঝে, করবে না ভয় একটুও-যে হাত বুলিয়ে দেব গায়ে— বসবে কাছে ঘেঁসে। ফল্‌সাবনে গাছে গাছে ফল ধ’রে মেঘ ঘনিয়ে আছে, ঐখানেতে ময়ূর এসে নাচ দেখিয়ে যাবে। শালিখরা সব মিছিমিছি লাগিয়ে দেবে কিচিমিচি, কাঠবেড়ালি ল্যাজটি তুলে হাত থেকে ধান খাবে। ষষ্ঠ পাঠ উস্রি নদীর ঝর্না দেখতে যাব। দিনটা বড়ো বিশ্রী। শুনছ বজ্রের শব্দ? শ্রাবণ মাসের বাদ্‌লা। উস্রিতে বান নেমেছে। জলের স্রোত বড়ো দুরন্ত। অবিশ্রান্ত ছুটে চলেছে। অনন্ত, এসো একসঙ্গে যাত্রা করা যাক। আমাদের দু-দিন মাত্র ছুটি। কালেজের ছাত্রেরা গেছে ত্রিবেণী, কেউ বা গেছে আত্রাই। সাঁত্রাগাছির কান্তি মিত্র যাবে আমাদের সঙ্গে উস্রির ঝর্নায়। শান্তা কি যেতে পারবে? সে হয়তো শ্রান্ত হয়ে পড়বে। পথে যদি জল নামে মিশ্রদের বাড়ি আশ্রয় নেব। সঙ্গে খাবার আছে তো? সন্দেশ আছে, পান্তোয়া আছে, বোঁদে আছে। আমাদের কান্ত চাকর শীঘ্র কিছু খেয়ে নিক্‌। তার খাবার আগ্রহ দেখি নে। সে ভোরের বেলায় পান্তা ভাত খেয়ে বেরিয়েছে। তার বোন ক্ষান্তমণি তাকে খাইয়ে দিলে। সপ্তম পাঠ শ্রীশকে বোলো, তার শরীর যদি সুস্থ থাকে সে যেন বসন্তর দোকানে যায়। সেখান থেকে খাস্তা কচুরি আনা চাই। আর কিছু পেস্তা বাদাম কিনে আনতে হবে। দোকানের রাস্তা সে জানে তো? বাজারে একটা আস্ত কাতলা মাছ যদি পায়, নিয়ে আসে যেন। আর বস্তা থেকে গুন্তি ক’রে ত্রিশটা আলু আনা চাই। এবার আলু খুব সস্তা। একান্ত যদি না পাওয়া যায়, কিছু ওল অনিয়ে নিয়ো। রাস্তায় রেঁধে খেতে হবে, তার ব্যবস্থা করা দরকার। মনে রেখো— কড়া চাই, খুন্তি চাই জলের পাত্র একটা নিয়ো। অত ব্যস্ত হয়েছ কেন। আস্তে আস্তে চলো ক্লান্ত হয়ে পড়বে-যে। আমি-যে রোজ সকাল হ’লে যাই শহরের দিকে চ’লে তমিজ মিঞার গোরুর গাড়ি চ’ড়ে সকাল থেকে সারা দুপুর ইঁট সাজিয়ে ইঁটের উপর খেয়ালমত দেয়াল তুলি গ’ড়ে। সমস্ত দিন ছাতপিটুনী গান গেয়ে ছাত পিটোয় শুনি, অনেক নীচে চলচে গাড়ি ঘোড়া। বাসনওয়ালা থালা বাজায়, সুর ক’রে ঐ হাঁক দিয়ে যায় আতাওয়ালা নিয়ে ফলের ঝোড়া, সাড়ে চারটে বেজে ওঠে, ছেলেরা সব বাসায় ছোটে হোহো ক’রে উড়িয়ে দিয়ে ধুলো,— রোদ্‌দুর যেই আসে প’ড়ে পুবের মুখে কোথা ওড়ে দলে দলে ডাক দিয়ে কাকগুলো। আমি তখন দিনের শেষে ভারার থেকে নেমে এসে আবার ফিরে আসি আপন গাঁয়ে, জানো না কি আমার পাড়া যেখানে ওই খুঁটি-গাড়া পুকুরপাড়ে গাজনতলার বাঁয়ে। অষ্টম পাঠ আর্মানি গির্জের কাছে আপিস। যাওয়া মুস্কিল হবে। পূর্বদিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো। পশ্চিম দিকের মেঘ ঘন নীল। সকালে রৌদ্র ছিল, নিশ্চিন্ত ছিলাম। দেখতে দেখতে বিস্তর মেঘ জমেছে। বাদ্‌লা বেশিক্ষণ স্থায়ী না হলে বাঁচি। শরীরটা অসুস্থ আছে। মাথা ধরেছে, স্থির হয়ে থাকতে পারছি নে। আপিসের ভাত এখনো হল না। উনানের আগুনটা উস্কিয়ে দাও। ঠাকুর আমার ঝোলে যেন লঙ্কা না দেয়। বঙ্কিমকে আমার অঙ্কের খাতাটা আনতে বোলো। দোতলা ঘরের পালঙ্কের উপর আছে। কঙ্কা খাতা নিয়ে খেলতে গিয়ে তার পাতা ছিঁড়ে দিয়েছে। নবম পাঠ বৃষ্টি নামল দেখছি। সৃষ্টিধর, ছাতাটা খুঁজে নিয়ে আয়, না পেলে ভারী কষ্ট হবে। কেষ্ট, শিষ্ট শান্ত হয়ে ঘরে ব’সে থাকো। দুষ্টামি কোরো না। বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে। সঞ্জীবকে ব’লে দেব, তোমার জন্যে মিষ্টি লজঞ্চুস এনে দেবে। কাল-যে তোমাকে খেলার খঞ্জনী দিলাম সেটা হারিয়েছ বুঝি? ও বাড়ি থেকে রঞ্জনকে ডেকে দেব, সে তোমার সঙ্গে খেলা করবে। কাঞ্জিলাল, ব্যাঙগুলো ঘরের মধ্যে আসে-যে, ঘর নষ্ট করবে। ওরে তুষ্টু, ওদের তাড়িয়ে দে। ঘন মেঘে সব অস্পষ্ট হয়ে এলো। আর দৃষ্টি চলে না। বোষ্টমী গান গাইতে এসেছে। ওকে নিষ্ঠুর হয়ে বাইরে রেখো না। বৃষ্টিতে ভিজে যাবে, কষ্ট পাবে। সেদিন ভোরে দেখি উঠে বৃষ্টি বাদল গেছে ছুটে, রোদ উঠেছে ঝিল‍্‌মিলিয়ে বাঁশের ডালে ডালে, ছুটির দিনে কেমন সুরে পূজোর সানাই বাজায় দূরে, তিনটে শালিখ ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে। শীতের বেলায় দুই পহরে দূরে কাদের ছাদের ‘পরে ছোট্ট মেয়ে রোদ্‌দুরে দেয় বেগনি রঙের শাড়ি, চেয়ে চেয়ে চুপ ক’রে রই— তেপান্তরের পার বুঝি ওই, মনে ভাবি ঐখানেতেই আছে রাজার বাড়ি। থাকতো যদি মেঘে-ওড়া পক্ষিরাজের বাচ্ছা ঘোড়া তক্ষনি-যে যেতেম তারে লাগাম দিয়ে ক’ষে, যেতে যেতে নদীর তীরে ব্যঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে পথ শুধিয়ে নিতেম আমি গাছের তলায় ব’সে। দশম পাঠ এত রাত্রে দরজায় ধাক্কা দিচ্চে কে? কেউ না, বাতাস ধাক্কা দিচ্চে। এখন অনেক রাত্রি। উল্লাসপাড়ার মাঠে শেয়াল ডাকছে- হুক্কাহুয়া। রাস্তায় ও কি এক্কাগাড়ির শব্দ? না, মেঘ গুর‍্গুর্ করছে। উল্লাস, তুমি যাও তো, কুকুরের বাচ্ছাটা বড়ো চেঁচাচ্ছে, ঘুমতে দিচ্ছে না। ওকে শান্ত ক’রে এসো। ওটা কিসের ডাক উল্লাস? অশত্থ গাছে পেঁচার ডাক। উচ্ছের ক্ষেত থেকে ঝিল্লি ঐ ঝিঁ ঝিঁ করছে। দরজার পাল্লাটা বাতাসে ধড়াস্‌ ধড়াস্‌ ক’রে পড়ছে! বন্ধ করে দাও। ওটা কি কান্নার শব্দ? না, রান্নাঘর থেকে বিড়াল ডাকছে। যাও-না উল্লাস, থামিয়ে দিয়ে এসোগে। আমার ভয় করছে। বড়ো অন্ধকার। ভজ্জুকে ডেকে দিই। ছি ছি উল্লাস, ভয় করতে লজ্জা করে না? আচ্ছা, আমি নিজে যাচ্ছি। আর তো রাত নেই। পুব দিক উজ্জ্বল হয়েছে। ও ঘরে বিছানায় খুকী চঞ্চল হয়ে উঠল। বাঞ্ছাকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দাও। বাঞ্ছা শীঘ্র আমার জন্যে চা আনুক আর কিঞ্চিৎ বিস্কুট। আমি ততক্ষণ মুখ ধুয়ে আসি। রক্ষামণি, থাকো খুকুর কাছে। তুমিও সাজসজ্জা ক’রে তৈরী থাকো উল্লাস। বেড়াতে যাবো। উত্তম কথা। কিন্তু ঘাস ভিজে কেন? এক পত্তন বৃষ্টি হয়ে গেল বুঝি। এবার লণ্ঠনটা নিবিয়ে দাও। আর মণ্টুকে বলো, বারান্দা পরিষ্কার করে দিক। এখনি রেভারেণ্ড্‌ এন্ডার‍্‌সেন আসবেন। পণ্ডিত মশায়েরও আসবার সময় হল। ঐ শোনো, কুণ্ডুদের বাড়ি ঢং ঢং ক’রে ছটার ঘণ্টা বাজল। আকাশপারে পুবের কোণে কখন যেন অন্যমনে ফাঁক ধরে ঐ মেঘে, মুখের চাদর সরিয়ে ফেলে বন্ধ চোখের পাতা মেলে আকাশ ওঠে জেগে। ছিঁড়ে-যাওয়া মেঘের থেকে পুকুরে রোদ পড়ে বেঁকে লাগায় ঝিলিমিলি, বাঁশবাগানের মাথায় মাথায় তেঁতুলগাছের পাতায় পাতায় হাসায় খিলিখিলি। হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে বাদলবেলার কথা, হারিয়ে পাওয়া আলোটিরে নাচায় ডালে ফিরে ফিরে ঝুমকো ফুলের লতা। একাদশ পাঠ ভক্তরামের নৌকো শক্ত কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি। ভক্তরাম সেই নৌকো সস্তা দামে বিক্রি করে। শক্তিনাথবাবু কিনে নেন। শক্তিনাথ আর মুক্তিনাথ দুই ভাই। যে-পাড়ায় থাকেন তার নাম জেলেবস্তি। তাঁর বাড়ি খুব মস্ত। সামনে নদী, পিছনে বড়ো রাস্তা। তাঁর দরোয়ান শক্তু সিং আর আক্রম মিশ্র রোজ সকালে কুস্তি করে। শক্তিনাথবাবুর চাকরের নাম অক্রূর। তাঁর বড়ো ছেলের নাম বিক্রম। ছোটো ছেলের নাম শত্রুনাথ। শক্তিবাবু তাঁর নৌকো লাল রঙ ক’রে নিলেন। তার নাম দিলেন রক্তজবা। তিনি মাঝে মাঝে নৌকোয় ক’রে কখনো তিস্তা নদীতে কখনো আত্রাই নদীতে কখনো ইচ্ছামতীতে বেড়াতে যান। একদিন অঘ্রান মাসে পত্র পেলেন, বিপ্রগ্রামে বাঘ এসেছে। শিকারে যাত্রা করলেন। সেদিন শুক্রবার। শুক্লপক্ষের চন্দ্র সবে অস্ত গেচে। আক্রম বন্দুক নিয়ে চললো। আরো দুটো বল্লম ছিল। সিন্দুকে ছিল গুলি বারুদ। নদীতে প্রবল স্রোত। বেলা যখন দুই প্রহর, নৌকো নন্দগ্রামে পৌঁছলো। রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করছে। এক ভদ্রলোক খবর দিলেন, কাছেই বন্দীপুরের বন, সেখানে আছে বাঘ। শক্তিবাবু আর আক্রম বাঘ খুঁজতে নামলেন। জঙ্গল ঘন হয়ে এলো। ঘোর অন্ধকার। কিছু দূরে গিয়ে দেখেন, এক পোড়ো মন্দির। জনপ্রাণী নেই। শক্তিবাবু বললেন, এইখানে একটু বিশ্রাম করি। সঙ্গে ছিল লুচি, আলুর দম আর পাঁঠার মাংস। তাই খেলেন। আক্রম খেলো চাট‍্‌নি দিয়ে রুটি। তখন বেলা প’ড়ে আসছে। গাছের ফাঁক দিয়ে বাঁকা হয়ে রৌদ্র পড়ে। প্রকাণ্ড অর্জুন গাছের উপর কতকগুলো বাঁদর; তাদের লম্বা ল্যাজ ঝুলছে। শক্তিবাবু কিছু দূরে গিয়ে দেখলেন, একটা ছোটো সোঁতা। তাতে এক হাঁটুর বেশি জল হবে না। তার ধারে বালি। সেই বালির উপর বড়ো বড়ো থাবার দাগ। নিশ্চয় বাঘের থাবা। শক্তিবাবু ভাবতে লাগলেন, কী করা কর্তব্য। অঘ্রান মাসের বেলা। পশ্চিমে সূর্য্য অস্ত গেল। সন্ধ্যা হ’তেই ঘোর অন্ধকার। কাছে তেঁতুল গাছ। তার উপরে দুজনে চ’ড়ে বসলেন। গাছের গুঁড়ির সঙ্গে চাদর দিয়ে নিজেদের বাঁধলেন। পাছে ঘুম এলে প’ড়ে যান। কোথাও আলো নেই। তারা দেখা যায় না। কেবল অসংখ্য জোনাকি গাছে গাছে জ্বলছে। শক্তিবাবুর একটু নিদ্রা এসেছে এমন সময় হঠাৎ ধুপ্‌ ক’রে একটা শব্দ হওয়াতে চমকে জেগে উঠলেন। দেখলেন কখন বাঁধন আল্‌গা হয়ে আক্রম নীচে প’ড়ে গেছে। শক্তিনাথ তাকে দেখতে তাড়াতাড়ি নেমে এলেন। হঠাৎ দেখেন, কাছেই অন্ধকারে দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে। কী সর্বনাশ! এ তো বাঘের চোখ। বন্দুক তোলবার সময় নেই। ভাগ্যে দুজনের কাছে দুটো বিজ‍্‌লি বাতির মশাল ছিল। সে-দুটো যেমনি হঠাৎ জ্বালানো অমনি বাঘ ভয়ে দৌড় দিলে। সে-রাত্রি আবার দুজনের গাছে কাটল। পরের দিন সকাল হ’লো। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা মেলে না, যতই চলেন জঙ্গল বেড়ে যায়। গায়ে কাঁটার আঁচড় লাগে। রক্ত পড়ে। খিদে পেয়েছে। তেষ্টা পেয়েছে। এমন সময় মানুষের গলার শব্দ শোনা গেল। এক দল কাঠুরিয়া কাঠ কাটতে চলেছে। শক্তিবাবু বললেন— তোমাদের ঘরে নিয়ে চলো। রাস্তা ভুলেছি। কিছু খেতে দাও। নদীর ধারে একটা ঢিবির ’পরে তাদের কুঁড়ে ঘর। গোলপাতা দিয়ে ছাওয়া। কাছে একটা মস্ত বটগাছ। তার ডাল থেকে লম্বা লম্বা ঝুরি নেমেছে। সেই গাছে যত রাজ্যের পাখীর বাসা। কাঠুরিয়ারা শক্তিবাবুকে আক্রমকে যত্ন ক’রে খেতে দিলে। তালপাতার ঠোঙায় এনে দিলে চিঁড়ে আর বনের মধু। আর দিলে ছাগলের দুধ। নদী থেকে ভাঁড়ে ক’রে এনে দিলে জল। রাত্রে ভালো ঘুম হয় নি। শরীর ছিল ক্লান্ত। শক্তিবাবু বটের ছায়ায় শুয়ে ঘুমোলেন। বেলা যখন চার প্রহর তখন কাঠুরিয়ার সর্দার পথ দেখিয়ে নৌকোয় তাঁদের পৌঁছিয়ে দিলে। শক্তিবাবু দশ টাকার নোট বের ক’রে বললেন, বড়ো উপকার করেছো, বক‍্‌শিশ লও। সর্দার হাতজোড় ক’রে বললে, মাপ করবেন, টাকা নিতে পারবো না— নিলে অধর্ম হবে। এই ব’লে নমস্কার ক’রে সর্দার চ’লে গেল। একদিন রাতে আমি স্বপ্ন দেখিনু “চেয়ে দেখো” “চেয়ে দেখো” বলে যেন বিনু। চেয়ে দেখি, ঠোকাঠুকি বরগা কড়িতে, কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে। ইঁটে-গড়া গণ্ডার বাড়িগুলো সোজা চলিয়াছে দুদ্দাড় জানালা দরজা। রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ, পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্‌ ধাপ্‌। দোকান বাজার সব নামে আর উঠে, ছাদের গায়েতে ছাদ মরে মাথা কুটে। হাওড়ার ব্রিজ চলে মস্ত সে বিছে, হ্যারিসন্‌ রোড চলে তার পিছে পিছে। মনুমেণ্টের দোল যেন ক্ষ্যাপা হাতি শূন্যে দুলায়ে শুঁড় উঠিয়াছে মাতি। আমাদের ইস্‌কুল ছোটে হন্‌হন্‌, অঙ্কের বই ছোটে, ছোটে ব্যাকরণ। ম্যাপগুলো দেয়ালেতে করে ছট্‌ফট্‌, পাখি যেন মারিতেছে পাখার ঝাপট। ঘণ্টা কেবলি দোলে ঢঙ্‌ ঢঙ্‌ বাজে— যত কেন বেলা হোক তবু থামে না-যে। লক্ষ লক্ষ লোক বলে, “থামো থামো”। কোথা হতে কোথা যাবে এ কী পাগ্‌লামো।” কলিকাতা শোনে না কো চলার খেয়ালে— নৃত্যের নেশা তার স্তম্ভে দেয়ালে। আমি মনে মনে ভাবি চিন্তা তো নাই, কলিকাতা যাক নাকো সোজা বোম্বাই। দিল্লি লাহোরে যাক, যাক না আগরা, মাথায় পাগ‍্‌ড়ি দেবো, পায়েতে নাগ্‌রা। কিম্বা সে যদি আজ বিলাতেই ছোটে ইংরেজ হবে সবে বুট হ্যাট্‌ কোটে। কিসের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যেই দেখি, কলিকাতা আছে কলিকাতাতেই।। দ্বাদশ পাঠ গুপ্তিপাড়ার বিশ্বম্ভরবাবু পাল্কী চ’ড়ে চলেচেন সপ্তগ্রামে। ফাল্গুন মাস। কিন্তু এখনো খুব ঠাণ্ডা। কিছু আগে প্রায় সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বিশ্বম্ভরবাবুর গায়ে এক মোটা কম্বল। পাল্কীর সঙ্গে চলেচে তাঁর শম্ভু চাকর, হাতে এক লম্বা লাঠি। পাল্কীর ছাদে ওষুধের বাক্স, দড়ি দিয়ে বাঁধা। শম্ভুর গায়ে অদ্ভুত জোর। একবার কুম্ভীরার জঙ্গলে তাকে ভল্লুকে ধরেছিলো। সঙ্গে বন্দুক ছিল না, শুদ্ধ কেবল লাঠি নিয়ে ভল্লুকের সঙ্গে তার যুদ্ধ হলো। শম্ভুর হাতের লাঠি খেয়ে ভল্লুকের মেরুদণ্ড গেল ভেঙ্গে। আর তার উত্থানশক্তি রইলো না। আর একবার শম্ভু বিশ্বম্ভরবাবুর সঙ্গে গিয়েছিল স্বর্ণগঞ্জে। সেখানে পদ্মানদীর চরে রান্না চড়াতে হবে। তখন গ্রীষ্মকালের মধ্যাহ্ন পদ্মার ধারে ছোটো ছোটো ঝাউগাছের জঙ্গল। উনান ধরানো চাই। দা নিয়ে শম্ভু ঝাউডাল কেটে আঁটি বাধলো। অসহ্য রৌদ্র। বড়ো তৃষ্ণা পেয়েছে। নদীতে শম্ভু জল খেতে গেল। এমন সময় দেখলে,একটা বাছুরকে ধরেছে কুমীরে। শম্ভু এক লম্ফে জলে পড়ে কুমীরের পিঠে চ’ড়ে বসল। দা দিয়ে তার গলায় পোঁচ দিতে লাগল। জল লাল হয়ে উঠল রক্তে। কুমীর যন্ত্রণায় বাছুরকে দিল ছেড়ে। শম্ভু সাঁতার দিয়ে ডাঙায় উঠে এলো। বিশ্বম্ভরবাবু ডাক্তার। রোগী দেখতে চলেছেন বহুদূরে। সেখানে ইষ্টিমার ঘাটের ইস্টেশন্-মাস্টার মধু বিশ্বাস, তাঁর ছোটো ছেলের অম্লশূল, বড়ো কষ্ট পাচ্ছে। বিষ্ণুপুরের পশ্চিম ধারের মাঠ প্রকাণ্ড। সেখানে যখন পাল্কী এল তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাখাল গোরু নিয়ে চলেচে গোষ্ঠে ফিরে। বিশ্বম্ভরবাবু তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওহে বাপু, সপ্তগ্রাম কত দূরে বলতে পারো?" রাখাল বললে, “আজ্ঞে, সে তো সাত ক্রোশ হবে। আজ সেখানে যাবেন না। পথে ভীষ্মহাটের মাঠ, তার কাছে শ্মশান। সেখানে ডাকাতের ভয়।” ডাক্তার বললেন, “বাবা, রোগী কষ্ট পাচ্ছে, আমাকে যেতেই হবে।” তিল্পুনি খালের ধারে যখন পাল্কী এল, রাত্রি তখন দশটা। বাঁধন আল্‌গা হয়ে পাল্কীর ছাদ থেকে ডাক্তারের বাক্সটা গেল পড়ে। ক্যাস্টর অয়েলের শিশি ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে গেল। বাক্সটা তো ফের শক্ত ক’রে বাঁধলে। কিন্তু আবার বিপদ। খাল পেরিয়ে আন্দাজ দু-ক্রোশ পথ গেছে এমন সময় মড়্‌ মড়্‌ ক’ড়ে ডাণ্ডা গেল ভেঙে, পাল্কীটা পড়ল মাটিতে। পাল্কী হালকা কাঠের তৈরী; বিশ্বম্ভরবাবুর দেহটি স্থূল। আর উপায় নাই, এইখানেই রাত্রি কাটাতে হবে। ডাক্তারবাবু ঘাসের উপর কম্বল পাতলেন, লণ্ঠনটি রাখলেন কাছে। শম্ভুকে নিয়ে গল্প করতে লাগলেন। এমন সময় বেহারাদের সর্দার বুদ্ধু এসে বললে, “ঐ-যে কারা আসছে, ওরা ডাকাত সন্দেহ নেই।” বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, “ভয় কী, তোরা তো সবাই আছিস।” বুদ্ধু বললে,”বল্গু পালিয়েছে,পল্লুকেও দেখছি নে। বক্সি লুকিয়েছে ঐ ঝোপের মধ্যে। ভয়ে বিষ্ণুর হাত-পা আড়ষ্ট।” শুনে ডাক্তার ভয়ে কম্পিত। ডাকলেন,”শম্ভু!” শম্ভু বললে, “আজ্ঞে!” ডাক্তার বললেন, “এখন উপায় কী?” শম্ভু বললে,”ভয় নেই, আমি আছি।” ডাক্তার বললেন, “ওরা-যে পাঁচ জন।” শম্ভু বললে, “আমি-যে শম্ভু।” এই ব’লে উঠে দাঁড়িয়ে একলম্ফ দিলে,গর্জন ক’রে বললে, “খবরদার!” ডাকাতরা অট্টহাস্য ক’রে এগিয়ে আসতে লাগল। তখন শম্ভু পাল্কীর সেই ভাঙা ডাণ্ডাখানা তুলে নিয়ে ওদের দিকে ছুঁড়ে মারলে। তারি এক ঘায়ে তিন জন একসঙ্গে প’ড়ে গেল। তার পরে শম্ভু লাঠি ঘুরিয়ে যেই ওদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাকি দুজনে দিল দৌড়। তখন ডাক্তারবাবু ডাকলেন,”শম্ভু!” শম্ভু বললে, “আজ্ঞে!” বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, “এইবার বাক্সটা বের করো।” শম্ভু বললে, “কেন, বাক্স নিয়ে কী হবে? ডাক্তার বললেন, ঐ তিনটে লোকের ডাক্তারী করা চাই। ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে।” রাত্রি তখন অল্পই বাকী। বিশ্বম্ভরবাবু আর শম্ভু দুজনে মিলে তিন জনের শুশ্রূষা করলেন। সকাল হয়েছে। ছিন্ন মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্য্যের রশ্মি ফেটে পড়ছে। একে একে সব বেহারা ফিরে আসে। বল্গু এল, পল্লু এল, বক্সির হাত ধরে এল বিষ্ণু, তখনো তার হৃৎপিণ্ড কম্পমান। ষ্টীমার আসিছে ঘাটে, প’ড়ে আসে বেলা, পূজার ছুটির দল, লোকজন মেলা এলো দূর দেশ হ’তে; বৎসরের পরে ফিরে আসে যে-যাহার আপনার ঘরে। জাহাজের ছাদে ভীড়; নানা লোকে নানা মাদুরে কম্বলে লেপে পেতেচে বিছানা ঠেসাঠেসি ক’রে। তারি মাঝে হরেরাম মাথা নেড়ে বাজাইতেছে হারমোনিয়াম। বোঝা আছে কত শত— বাক্স কত রূপ টিন বেত চামড়ার, পুঁটুলির স্তূপ, থলি ঝুলি ক্যাম্বিশের, ডালা ঝুড়ি ধামা সব‍্‌জিতে ভরা। গায়ে রেশমের জামা, কোমরে চাদর বাঁধা, চন্ডী অবিনাশ কলিকাতা হ’তে আসে,বঙ্কু শ্যামদাস অম্বিকা অক্ষয়; নূতন চীনের জুতো করে মস্‌মস্‌, মেরে কুনুয়ের গুঁতা ভিড় ঠেলে আগে চলে— হাতে বাঁধা ঘড়ি, চোখেতে চশমা কারো, সরু এক ছড়ি সবেগে দুলায়। ঘন ঘন ডাক ছাড়ে ষ্টীমারের বাঁশি; কে পড়ে কাহার ঘাড়ে, সবাই সবার আগে যেতে চায় চ’লে— ঠেলাঠেলি, বকাবকি। শিশু মার কোলে চীৎকারস্বরে কাঁদে। গড় গড় করে নোঙর ডুবিল জলে; শিকলের ডোরে জাহাজ পড়িল বাঁধা; সিঁড়ি গেল নেমে, এঞ্জিনের ধকধকি সব গেল থেমে। ‘কুলি’ ‘কুলি’ ডাক পড়ে ডাঙা হ’তে মুটে দুড়দাড় ক’রে এলো দলে দলে ছুটে। তীরে বাজাইয়া হাঁড়ি গাহিছে ভজন অন্ধ বেণী। যাত্রীদের আত্মীয় স্বজন। অপেক্ষা করিয়া আছে; নাম ধ’রে ডাকে, খুঁজে খুঁজে বের করে যে চায় যাহাকে। চলিল গোরুর গাড়ি, চলে পালকী ডুলি, শ্যাক্‌রা-গাড়ির ঘোড়া উড়াইল ধূলি। সূর্য গেল অস্তাচলে; আঁধার ঘনালো; হেথা হোথা কেরোসিন লন্ঠনের আলো দুলিতে দুলিতে যায়, তার পিছে পিছে মাথায় বোঝাই নিয়ে মুটেরা চলিছে। শূন্য হয়ে গেল তীর। আকাশের কোণে পঞ্চমীর চাঁদ ওঠে। দূরে বাঁশবনে শেয়াল উঠিল ডেকে। মুদির দোকানে টিম্‌ টিম্‌ ক’রে দীপ জ্বলে একখানে।। ত্রয়োদশ পাঠ উদ্ধব মন্ডল জাতিতে সদ্গোপ। তার অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থা। ভূসম্পত্তি যা কিছু ছিল ঋণের দায়ে বিক্রয় হয়ে গেছে। এখন মজুরী করে কায়ক্লেশে তার দিনপাত হয়। এ দিকে তার কন্যা নিস্তারিনীর বিবাহ। বরের নাম বটকৃষ্ণ। তার অবস্থা মন্দ নয়। ক্ষেতের উৎপন্ন শস্য দিয়ে সহজেই সংসারনির্বাহ হয়। বাড়িতে পূজা-অর্চনা ক্রিয়াকর্মও আছে। আগামী কাল উনিশে জ্যৈষ্ঠ বিবাহের দিন। বরযাত্রীর দল আসবে। তার জন্যে আহারাদির উদ্যোগ করা চাই। পাড়ার লোকে কিছু কিছু সাহায্য করেছে। অভাব তবু যথেষ্ট। পাড়ার প্রান্তে একটি বড়ো পুষ্করিণী। তার নাম পদ্মপুকুর। বর্তমান ভূস্বামী দুর্লভবাবুর পূর্বপুরুষদের আমলে এই পুষ্করিণী সর্বসাধারণ ব্যবহার করতে পেতো। এমন কি গ্রামের গৃহস্থবাড়ির কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে প্রয়োজন উপস্থিত হ’লে মাছ ধ’রে নেবার বাধা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি দুর্লভবাবু সেই অধিকার বন্ধ ক’রে দিয়েছেন। অল্প কিছু দিন আগে খাজনা দিয়ে বৃন্দাবন জেলে তাঁর কাছ থেকে এই পুকুরে মাছ ধরবার স্বত্ব পেয়েছে। উদ্ধব এ সংবাদ ঠিকমত জানতো না। তাই সেদিন রাত্রি থাকতে উঠে পদ্মপুকুর থেকে একটা বড়ো দেখে রুইমাছ ধ’রে বাড়ি আনবার উপক্রম করছে। এমন সময় বিঘ্ন ঘটলো। সেদিন দুর্লভবাবুর ছোটো কন্যার অন্নপ্রাশন। খুব সমারোহ ক’রে লোক খাওয়ানো হবে। তারি মাছ-সংগ্রহের জন্য বাবুর কর্মচারী কৃত্তিবাস কয়েক জন জেলে নিয়ে সেই পুষ্করিণীর ধারে এসে উপস্থিত। দেখে, উদ্ধব এক মস্ত রুই মাছ ধরেছে। সেটা তখনি তার কাছ থেকে কেড়ে নিলে। উদ্ধব কৃত্তিবাসের হাতে পায়ে ধ’রে কাঁদতে লাগলো। কোনো ফল হ’লো না। ধনঞ্জয় পেয়াদা তাকে বলপূর্বক ধ’রে নিয়ে গেল দুর্লভবাবুর কাছে। দুর্লভের বিশ্বাস ছিল, ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে অত্যাচারী ব’লে উদ্ধব তাঁর দুর্নাম করেছে। তাই তার উপরে তাঁর বিষম ক্রোধ। বললেন, “তুই মাছ চুরি করেছিস, তার দন্ড দিতে হবে।” ধনঞ্জয়কে বললেন, “একে ধরে নিয়ে যাও। যতক্ষণ না দশ টাকা দন্ড আদায় হবে, ছেড়ে দিয়ো না।” উদ্ধব হাতজোড় ক’রে বললে, “আমার দশ পয়সাও নেই। কাল কন্যার বিবাহ। কাজ শেষ হয়ে যাক, তার পরে আমাকে শাস্তি দেবেন।” দুর্লভবাবু তার কাতর বাক্যে কর্ণপাত করলেন না। ধনঞ্জয় উদ্ধবকে সকল লোকের সম্মুখে অপমান ক’রে ধ’রে নিয়ে গেল। দুর্লভের পিসি কাত্যায়নী ঠাকরুন সেদিন অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণে অন্তঃপুরে উপস্থিত ছিলেন। উদ্ধবের স্ত্রী মোক্ষদা তাঁর কাছে কেঁদে এসে পড়লো। কাত্যায়নী দুর্লভকে ডেকে বললেন, “বাবা, নিষ্ঠুর হ’য়ো না। উদ্ধবের কন্যার বিবাহে যদি অন্যায় করো তবে তোমার কন্যার অন্নপ্রাশনে অকল্যাণ হবে। উদ্ধবকে মুক্তি দাও।” দুর্লভ পিসির অনুরোধ উপেক্ষা ক’রে চ’লে গেলেন। কৃত্তিবাসকে ডেকে কাত্যায়নী বললেন, “উদ্ধবের দন্ডের এই দশ টাকা দিলাম। এখনি তাকে ছেড়ে দাও।” উদ্ধব ছাড়া পেলে। কিন্তু অপমানে লজ্জায় তার দুই চক্ষু দিয়ে জল পড়তে লাগলো। পরদিন গোধূলিলগ্নে নিস্তারিণীর বিবাহ। বেলা যখন চারটে, তখন, পাঁচজন বাহক উদ্ধবের কুটীর প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত। কেউ বা এনেছে ঝুড়িতে মাছ, কেউ বা এনেছে হাঁড়িতে দই, কারও হাতে থালায় ভরা সন্দেশ, একজন এনেছে একখানি লাল চেলির শাড়ি। পাড়ার লোকের আশ্চর্য লাগল। জিজ্ঞাসা করলে, “কে পাঠালেন?” বাহকেরা তার কোনো উত্তর না ক’রে চ’লে গেল। তার কিছুক্ষণ পরেই কুটীরের সম্মুখে এক পাল্কী এসে দাঁড়ালো। তার মধ্যে থেকে নেমে এলেন কাত্যায়নী ঠাকরুন। উদ্ধব এত সৌভাগ্য স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতো না। কাত্যায়নী বললেন, “দুর্লভ কাল তোমাকে অপমান করেছে, সে কথা তুমি মনে রেখো না। আমি তোমার কন্যাকে আশীর্বাদ ক’রে যাবো, তাকে ডেকে দাও।” কাত্যায়নী নিস্তারিণীকে একগাছি সোনার হার পরিয়ে দিলেন। আর তার হাতে এক শত টাকার একখানি নোট দিয়ে বললেন, “এই তোমার যৌতুক।” অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে জীর্ণ ফাটল-ধরা— এক কোণে তারি অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী। আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর, আছে এক ল্যাজ-কাটা ভক্ত কুকুর। আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধ’রে গুন্‌ গুন্‌ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে। গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন দু-মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন। সাতকড়ি ভঞ্জের মস্ত দালান, কুঞ্জ সেখানে করে প্রত্যূষে গান। “হরি হরি” রব উঠে অঙ্গনমাঝে, ঝনঝনি ঝনঝনি খঞ্জনী বাজে। ভঞ্জের পিসি তাই সন্তোষ পান, কুঞ্জকে করেছেন কম্বল দান। চিঁড়ে মুড়কিতে তার ভরি দেন ঝুলি, পৌষে খাওয়ান ডেকে মিঠে পিঠে-পুলি। আশ্বিনে হাট বসে ভারী ধূম ক’রে, মহাজনী নৌকায় ঘাট যায় ভ’রে— হাঁকাহাঁকি ঠেলাঠেলি মহা সোরগোল, পশ্চিমী মাল্লারা বাজায় মাদোল। বোঝা নিয়ে মন্থর চলে গোরুগাড়ি, চাকাগুলো ক্রন্দন করে ডাক ছাড়ি। কল্লোলে কোলাহলে জাগে এক ধ্বনি অন্ধের কন্ঠের গান আগমনী। সেই গান মিলে যায় দূর হতে দূরে শরতের আকাশেতে সোনা রোদ্দুরে।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অদৃষ্টের হাতে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদৃষ্টের হাতে লেখা সূক্ষ্ম এক রেখা, সেই পথ বয়ে সবে হয় অগ্রসর। কত শত ভাগ্যহীন ঘুরে মরে সারাদিন প্রেম পাইবার আগে মৃত্যু দেয় দেখা, এত দূরে আছে তার প্রাণের দোসর! কখন বা তার চেয়ে ভাগ্য নিরদয়, প্রণয়ী মিলিল যদি–অতি অসময়! “হৃদয়টি?’ “দিয়াছি তা!’ কান্দিয়া সে কহে, “হাতখানি প্রিয়তম?’ “নহে, নহে, নহে!’ Matthew Arnold
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি দুখ জ্বালা সব যাই ভুলি। অধরে অধরে পরশিয়া প্রাণমন উঠে হরষিয়া। মাথা রাখি যবে ওই বুকে ডুবে যাই আমি মহা সুখে। যবে বল তুমি, “ভালবাসি’, শুনে শুধু আঁখিজলে ভাসি। Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আবার আবার কেন রে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার আবার কেন রে আমার সেই ছেলেবেলা আসে নি ফিরে, হরষে কেমন আবার তা হলে, সাঁতারিয়ে ভাসি সাগরের জলে, খেলিয়ে বেড়াই শিখরী শিরে! স্বাধীন হৃদয়ে ভালো নাহি লাগে, ঘোরঘটাময় সমাজধারা, না, না, আমি রে যাব সেই স্থানে, ভীষণ ভূধর বিরাজে যেখানে, তরঙ্গ মাতিছে পাগল পারা! অয়ি লক্ষ্মী, তুমি লহো লহো ফিরে, ধন ধান্য তুমি যাদেছ মোরে, জাঁকালো উপাধি নাহি আমি চাই, ক্রীতদাসে মম কোনো সুখ নাই, সেবকের দল যাক-না সোরে! তুলে দাও মোরে সেই শৈল-‘পরে, গরজি ওঠে যা সাগর-নাদে, অন্য সাধ নাই, এই মাত্র চাই, ভ্রমিব সেথায় স্বাধীন হৃদে! অধিক বয়স হয় নে তো মম, এখনি বুঝিতে পেরেছি হায়, এ ধরা নহে তো আমার কারণে, আর মম সুখ নাহি এ জীবনে, কবে রে এড়াব এ দেহ দায়! একদা স্বপনে হেরেছিনু আমি, সুবিমল এক সুখের স্থান, কেন রে আমার সে ঘুম ভাঙিল কেন রে আমার নয়ন মেলিল, দেখিতে নীরস এ ধরা খান! এক কালে আমি বেসেছিনু ভালো, ভালোবাসা-ধন কোথায় এবে, বাল্যসখা সব কোথায় এখন– হায় কী বিষাদে ডুবেছে এ মন, আশারও আলোক গিয়েছে নিবে! অমোদ-আসরে আমোদ-সাথীরা, মাতায় ক্ষণেক আমোদ রসে, কিন্তু এ হৃদয়, আমোদের নয়, বিরলে কাঁদি যে একেলা বসে! উঃ কী কঠোর, বিষম কঠোর, সেই সকলের আমোদ-রব, শত্রু কিম্বা সখা নহে যারা মনে, অথচ পদ বা বিভব কারণে, দাও ফিরে মোরে সেই সখাগুলি, বয়সে হৃদয়ে সমান যারা, এখনি যে আমি ত্যেজিব তা হলে, গভীর নিশীথ-আমোদীর দলে, হৃদয়ের ধার কি ধারে তারা! সর্বস্ব রতন, প্রিয়তমা ওরে, তোরেও সুধাই একটি কথা, বল দেখি কিসে আর মম সুখ, হেরিয়েও যবে তোর হাসি-মুখ, কমে না হৃদয়ে একটি ব্যথা! যাক তবে সব, দুঃখ নাহি তায়, শোকের সমাজ নাহিকো চাই, গভীর বিজনে মনের বিরাগে, স্বাধীন হৃদয়ে ভালো যাহা লাগে, সুখে উপভোগ করিব তাই! মানব-মন্ডলী ছেড়ে যাব যাব, বিরাগে কেবল, ঘৃণাতে নয়, অন্ধকারময় নিবিড় কাননে, থাকিব তবুও নিশ্চিন্ত মনে, আমারও হৃদয় আঁধারময়! কেন রে কেন রে হল না আমার, কপোতের মতো বায়ুর পাখা, তা হলে ত্যেজিয়ে মানব-সমাজ, গগনের ছাদ ভেদ করি আজ, থাকিতাম সুখে জলদে ঢাকা! George Gordon Byron ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৫
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কষ্টের জীবন (মানুষ কাঁদিয়া হাসে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষ কাঁদিয়া হাসে, পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া। পাদপ শুকায়ে গেলে, তবুও সে না হয় পতিত, তরণী ভাঙিয়া গেলে তবু ধীরে যায় সে ভাসিয়া, ছাদ যদি পড়ে যায়, দাঁড়াইয়া রহে তবু ভিত। বন্দী চলে যায় বটে, তবুও তো রহে কারাগার, মেঘে ঢাকিলেও সূর্য কোনোমতে দিন অস্ত হয়, তেমনি হৃদয় যদি ভেঙেচুরে হয় চুরমার, কোনোক্রমে বেঁচে থাকে তবুও সে ভগন হৃদয়। ভগন দর্পণ যথা, ক্রমশ যতই ভগ্ন হয়, ততই সে শত শত, প্রতিবিম্ব করয়ে ধারণ, তেমনি হৃদয় হতে, কিছুই গো যাইবার নয়। হোক না শীতল স্তব্ধ, শত খন্ডে ভগ্ন চূর্ণ মন, হউক-না রক্তহীন, হীনতেজ তবুও তাহারে, বিনিদ্র জ্বলন্ত জ্বালা, ক্রমাগত করিবে দাহন, শুকায়ে শুকায়ে যাবে, অন্তর বিষম শোকভারে, অথচ বাহিরে তার, চিহ্নমাত্র না পাবে দর্শন। George Gordon Byron
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা যেয়ো না ফেলিয়া মোরে! এতই যাতনা দুখিনী আমারে দিতেছ কেমন করে? গাঁথিয়া রেখেছি পরাতে মালিকা তোমার গলার-‘পরে, কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা, যেয়ো না ফেলিয়া মোরে! এতই যাতনা দুখিনী-বালারে দিতেছ কেমন করে? যে শপথ তুমি বলেছ আমারে মনে করে দেখো তবে, মনে করো সেই কুঞ্জ যেথায় কহিলে আমারি হবে। কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা যেয়ো না ফেলিয়া মোরে, এতই যাতনা দুখিনী-বালারে দিতেছ কেমন করে?’ এত বলি এক কাঁদিছে ললনা ভাসিছে লোচন-লোরে “কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা যেয়ো না ফেলিয়া মোরে। এতই যাতনা দুখিনী-বালারে দিতেছ কেমন করে?’ William Chappel
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১ গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে, নিভৃত নিরালা ঠাঁই, লেশমাত্র আলো নাই, লুকানো এ প্রেমসাধ গোপনে নিবসে, শুদ্ধ যবে ভালোবাসা নয়নে তোমার, ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়, উচ্ছ্বসয়ে এ-হৃদয়, ভয়ে ভয়ে জড়সড় তখনি আবার। ২ শূন্য এই মরমের সমাধি-গহ্বরে, জ্বলিছে এ প্রেমশিখা চিরকাল-তরে, কেহ না দেখিতে পায়, থেকেও না থাকা প্রায়, নিভিবারও নাম নাই নিরাশার ঘোরে। ৩ যা হবার হইয়াছে– কিন্তু প্রাণনাথ! নিতান্ত হইবে যবে এ শরীরপাত, আমার সমাধি-স্থানে কোরো নাথ কোরো মনে, রয়েছে এ এক দুঃখিনী হয়ে ধরাসাৎ। ৪ যত যাতনা আছে দলুক আমায়, সহজে সহিতে নাথ সব পারা যায়, কিন্তু হে তুমি-যে মোরে, ভুলে যাবে একেবারে সে কথা করিতে মনে হৃদি ফেটে যায়। ৫ রেখো তবে এই মাত্র কথাটি আমার, এই কথা শেষ কথা, কথা নাহি আর, (এ দেহ হইলে পাত, যদি তুমি প্রাণনাথ, প্রকাশো আমার তরে তিলমাত্র শোক, ধর্মত হবে না দোষী দোষিবে না লোক– কাতরে বিনয়ে তাই, এই মাত্র ভিক্ষা চাই, কখনো চাহি নে আরো কোনো ভিক্ষা আর) যবে আমি যাব ম’রে, চির এ দুঃখিনী তরে, বিন্দুমাত্র অশ্রুজল ফেলো একবার– আজন্ম এত যে ভালোবেসেছি তোমায়, সে প্রেমের প্রতিদান একমাত্র প্রতিদান, তা বই কিছুই আর দিয়ো না আমায়। George Gordon Byron
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গানগুলি মোর বিষে ঢালা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানগুলি মোর বিষে ঢালা কী হবে আর তাহা বই? ফুটন্ত এ প্রাণের মাঝে বিষ ঢেলেছে বিষময়ী! গানগুলি মোর বিষেঢালা, কী হবে আর তাহা বই? বুকের মধ্যে সর্প আছে, তুমিও সেথা আছে অয়ি! Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয় রূপের মোহনে আছিল মাতি, প্রাণের স্বপন আছিল যখন প্রেম প্রেম শুধু দিবস রাতি! শান্ত আশা এ হৃদয়ে আমার এখন ফুটিতে পারে, সুবিমলতর দিবস আমার এখন উঠিতে পারে। বালক কালের প্রেমের স্বপন– মধুর যেমন উজল যেমন তেমন কিছুই আসিবে না, তেমন কিছুই আসিবে না! সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা, স্মৃতি-মরু মোর উজল করিয়া এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা! সে প্রতিমা সেই পরিমল সম পলকে যা লয় পায়, প্রভাতকালের স্বপন যেমন পলকে মিশায়ে যায়। অলস প্রবাহ জীবনে আমার সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর সে কিরণ কভু ভাসিবে না, সে কিরণ কভু ভাসিবে না! Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া দূরেতে রাখিয়া এলেম তারে, রূপ-ফাঁদ হতে পালাইতে তার, প্রণয়ে ডুবাতে মদিরা-ধারে। এত দূরে এসে বুঝিনু এখন এখনো ঘুচে নি প্রণয়-ঘোর, মাথায় যদিও চড়েছে মদিরা প্রণয় রয়েছে হৃদয়ে মোর। যুবতীর শেষে লইনু শরণ মাগিনু সহায় তার, অনেক ভাবি সে কহিল তখন “চপলা নারীর সার।’ আমি কহিলাম “সে কথা তোমার কহিতে হবে না মোরে– দোষ যদি কিছু বলিবারে পারো শুনি প্রণিধান করে।’ যুবতী কহিল “তাও কভু হয়? যদি বলি দোষ আছে– নামের আমার কুযশ হইবে কহিনু তোমার কাছে।’ এখন তো আর নাই কোনো আশা হইয়াছি অসহায়– চপলা আমার মরমে মরমে বাণ বিঁধিতেছে, হায়! দলে মিশি তার ইন্দ্রিয় আমার বিরোধী হয়েছে মোর, যুবতী আমার–বলিছে আমারে রূপের অধীন ঘোর! Lord Cantalupe
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জাগি রহে চাঁদ (জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেহাগ জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন সারাটি রজনী! শ্রান্ত জগত ঘুমে অচেতন সারাটি রজনী! অতি ধীরে ধীরে হৃদে কী লাগিয়া মধুময় ভাব উঠে গো জাগিয়া সারাটি রজনী! ঘুমায়ে তোমারি দেখি গো স্বপন সারাটি রজনী! জাগিয়া তোমারি দেখি গো বদন সারাটি রজনী! ত্যজিবে যখন দেহ ধূলিময় তখনি কি সখি তোমার হৃদয়, আমার ঘুমের শয়ন-‘পরে ভ্রমিয়া বেড়াবে প্রণয়-ভরে। সারাটি রজনী!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবন উৎসর্গ (এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার, যূথভ্রষ্ট বাণবিদ্ধ হরিণী আমার, এইখানে বিরাজিছে সেই চির হাসি, আঁধারিতে পারিবে না তাহা মেঘরাশি। এই হস্ত এ হৃদয় চিরকাল মতো তোমার, তোমারি কাজে রহিবে গো রত! কিসের সে চিরস্থায়ী ভালোবাসা তবে, গৌরবে কলঙ্কে যাহা সমান না রবে? জানি না, জানিতে আমি চাহি না, চাহি না, ও হৃদয়ে এক তিল দোষ আছে কিনা, ভালোবাসি তোমারেই এই শুধু জানি, তাই হলে হল, আর কিছু নাহি মানি। দেবতা সুখের দিনে বলেছ আমায়, বিপদে দেবতা সম রক্ষিব তোমায়, অগ্নিময় পথ দিয়া যাব তব সাথে, রক্ষিব, মরিব কিংবা তোমারি পশ্চাতে। Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবন মরণ (ওরা যায়, এরা করে বাস) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরা যায়, এরা করে বাস; অন্ধকার উত্তর বাতাস বহিয়া কত-না হা-হুতাশ ধূলি আর মানুষের প্রাণ উড়াইয়া করিছে প্রয়াণ। আঁধারেতে রয়েছি বসিয়া; একই বায়ু যেতেছে শ্বসিয়া মানুষের মাথার উপরে, অরণ্যের পল্লবের স্তরে। যে থাকে সে গেলদের কয়, “অভাগা, কোথায় পেলি লয়। আর না শুনিবি তুই কথা, আর হেরিবি তরুলতা, চলেছিস মাটিতে মিশিতে, ঘুমাইতে আঁধার নিশীথে।’ যে যায় সে এই বলে যায়, “তোদের কিছুই নাই হায়, অশ্রুজল সাক্ষী আছে তায়। সুখ যশ হেথা কোথা আছে সত্য যা তা মৃতদেরি কাছে। জীব, তোরা ছায়া, তোরা মৃত, আমরাই জীবন্ত প্রকৃত।’ Victor Hugo ‘আলোচনা’ পত্রিকা, কার্তিক, ১২৯১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি একটি ফুলের মতো মণি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি একটি ফুলের মতো মণি এম্‌নি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর! মুখের পানে তাকাই যখনি ব্যথায় কেন কাঁদায় অন্তর! শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি পড়ি এই আশীষ মন্তর, বিধি তোরে রাখুন চিরকাল এমনি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর! Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দামিনীর আঁখি কিবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দামিনীর আঁখি কিবা ধরে জ্বল’ জ্বল’ বিভা কার তরে জ্বলিতেছে কেবা তাহা জানিবে? চারি দিকে খর ধার বাণ ছুটিতেছে তার কার-‘পরে লক্ষ্য তার কেবা অনুমানিবে? তার চেয়ে নলিনীর আঁখিপানে চাহিতে কত ভালো লাগে তাহা কে পারিবে কহিতে? সদা তার আঁখি দুটি নিচু পাতে আছে ফুটি, সে আঁখি দেখে নি কেহ উঁচু পানে তুলিতে! যদি বা সে ভুলে কভু চায় কারো আননে, সহসা লাগিয়া জ্যোতি সে-জন বিস্ময়ে অতি চমকিয়া উঠে যেন স্বরগের কিরণে! ও আমার নলিনী লো, লাজমাখা নলিনী, অনেকেরি আঁখি-‘পরে সৌন্দর্য বিরাজ করে, তোর আঁখি-‘পরে প্রেম নলিনী লো নলিনী! দামিনীর দেহে রয় বসন কনকময় সে বসন অপসরী সৃজিয়াছে যতনে, যে গঠন যেই স্থান প্রকৃতি করেছে দান সে-সকল ফেলিয়াছে ঢাকিয়া সে বসনে। নলিনী বসন পানে দেখ দেখি চাহিয়া তার চেয়ে কত ভালো কে পারিবে কহিয়া? শিথিল অঞ্চল তার ওই দেখো চারি ধার স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে, যেথা যে গঠন আছে পূর্ণ ভাবে বিকাশিছে যেখানে যা উঁচু নিচু প্রকৃতির বিধানে! ও আমার নলিনী লো, সুকোমলা নলিনী মধুর রূপের ভাস তাই প্রকৃতির বাস, সেই বাস তোর দেহে নলিনী লো নলিনী! দামিনীর মুখ-আগে সদা রসিকতা জাগে, চারি ধারে জ্বলিতেছে খরধার বাণ সে, কিন্তু কে বলিতে পারে শুধু সে কি ধাঁধিবারে, নহে তা কি খর ধারে বিঁধিবারি মানসে? কিন্তু নলিনীর মনে মাথা রাখি সঙ্গোপনে ঘুমায়ে রয়েছে কিবা প্রণয়ের দেবতা। সুকোমল সে শয্যার অতি যা কঠিন ধার দলিত গোলাপ তাও আর কিছু নহে তা! ও আমার নলিনী লো, বিনয়িনী নলিনী রসিকতা তীব্র অতি নাই তার এত জ্যোতি তোমার নয়নে যত নলিনী লো নলিনী। Thomas Moore ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৮
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দিন রাত্রি নাহি মানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিন রাত্রি নাহি মানি, আয় তোরা আয় রে, চির সুখ-রসে রত আমরা হেথায় রে। বসন্তে মলয় বায় একটি মিলায়ে যায়, আরেকটি আসে পুনঃ মধুময় তেমনি, প্রেমের স্বপন হায় একটি যেমনি যায় আরেকটি সুস্বপন জাগি উঠে অমনি। নন্দন কানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে! তবে তা ইহাই রে। প্রেমের নিশ্বাস হেথা ফেলিতেছি বালিকা, সুরভি নিশ্বাস যথা ফেলে ফুল-কলিকা, তাহাদের আঁখিজল এমন সে সুবিমল এমন সে সমুজল মুকুতার পারা রে, তাদের চুম্বন হাসি দিবে কত সুধারাশি যাদের মধুর এত নয়নের ধারা রে। নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে। তবে তা ইহাই রে! থাকুক ও-সব সুখ চাই না, গো চাই না, যে সুখ-ভিখারী আমি তাহা যে গো পাই না। দুই হৃদি এক ঠাঁই প্রণয়ে মিলিতে চাই সুখে দুখে যে প্রেমের নাহি হবে শেষ রে। প্রেমে উদাসীন হৃদি শত যুগে যাপে যদি, তার চেয়ে কত ভালো এ সুখ নিমেষ রে! নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে তবে তা ইহাই রে তবে তা ইহাই রে। Thomas Moore
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নলিনী (লীলাময়ী নলিনী) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লীলাময়ী নলিনী, চপলিনী নলিনী, শুধালে আদর করে ভালো সে কি বাসে মোরে, কচি দুটি হাত দিয়ে ধরে গলা জড়াইয়ে, হেসে হেসে একেবারে ঢলে পড়ে পাগলিনী! ভালো বাসে কি না, তবু বলিতে চাহে না কভু নিরদয়া নলিনী! যবে হৃদি তার কাছে, প্রেমের নিশ্বাস যাচে চায় সে এমন করে বিপাকে ফেলিতে মোরে, হাসে কত, কথা তবু কয় না! এমন নির্দোষ ধূর্ত চতুর সরল, ঘোমটা তুলিয়া চায় চাহনি চপল উজল অসিত-তারা-নয়না! অমনি চকিত এক হাসির ছটায় ললিত কপোলে তার গোলাপ ফুটায়, তখনি পলায় আর রয় না! Alfred Tennyson ভারতী, কার্তিক, ১২৮৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল রাঙা গোলাপ গাল দুখানি, সুধায় মাখা সুকোমল। শুভ্র বিমল করকমল ফুটে আছে চিরদিন! হৃদয়টুকু শুষ্ক শুধু পাষাণসম সুকঠিন! Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পাতায় পাতায় দুলিছে শিশির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূরবী পাতায় পাতায় দুলিছে শিশির গাহিছে বিহগগণ, ফুলবন হতে সুরভি হরিয়া বহিতেছে সমীরণ সাঁঝের আকাশ মাঝারে এখনো মৃদুল কিরণ জ্বলে। নলিনীর সাথে বসিয়া তখন কত-না হরষে কাটাইনু ক্ষণ, কে জানিত তবে বালিকা নিদয় রেখেছিল ঢাকি কপট-হৃদয় সরল হাসির তলে! এই তো সেথায় ভ্রমি, গো, যেথায় থাকিত সে মোর কাছে, প্রকৃতি জানে না পরিবরতন সকলি তেমনি আছে! তেমনি গোলাপ রূপ-হাসি-ময় জ্বলিছে শিশির-ভরে, যে হাসি-কিরণে আছিল প্রকৃতি দ্বিগুণ দ্বিগুণ মধুর আকৃতি, সে হাসি নাইকো আর! Irish Song
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রথমে আশাহত হয়েছিনু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে আশাহত হয়েছিনু ভেবেছিনু সবে না এ বেদনা; তবু তো কোনোমতে সয়েছিনু, কী করে যে সে কথা শুধায়ো না। Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমতত্ত্ব (নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে তটিনী মিশেছে সাগর-‘পরে, পবনের সাথে মিশিছে পবন চির-সুমধুর প্রণয়-ভরে! জগতে কেহই নাইকো একেলা, সকলি বিধির নিয়ম-গুণে, একের সহিত মিশিছে অপরে আমি বা কেন না তোমার সনে? দেখো, গিরি ওই চুমিছে আকাশে, ঢেউ-‘পরে ঢেউ পড়িছে ঢলি, সে কুলবালারে কে বা না দোষিবে, ভাইটিরে যদি যায় সে ভুলি! রবি-কর দেখো চুমিছে ধরণী, শশি-কর চুমে সাগর জল, তুমি যদি মোরে না চুম’, ললনা, এ-সব চুম্বনে কী তবে ফল? P. B. Shelley
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বলো গো বালা, আমারি তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিলু বলো গো বালা, আমারি তুমি হইবে চিরকাল! অনিয়া দিব চরণতলে যা-কিছু আছে সাগরজলে পৃথিবী-‘পরে আকাশতলে অমূল মণি জাল! শুনি আশার মোহন-রব যা-কিছু ভালো লাগিবে তব আনিয়া দিব, হও গো, যদি আমারি চিরকাল! যেথায় মোরা বেড়াব দুটি, কুসুমগুলি উঠিবে ফুটি, নদীর জলে শুনিতে পাব দেবতাদের বাণী। তারকাগুলি দেখাবে যেন প্রেমিকদেরি জগতহেন, মধুর এক স্বপন সম দেখাবে ধরাখানি! আকাশ-ভেদী শিখর হতে পতনশীল নিঝর-স্রোতে নাহিয়া যথা কানন-ভূমি হরিত-বাসে সাজে, চির-প্রবাহী সুখের ধারে দোঁহার হৃদি হাসিবে হারে– যেই সুখের মূল লুকানো কলপনার মাঝে! প্রেম দেবের কুহক জালে হৃদয়ে যার অমৃত ঢালে, সেই সে জনে করেন প্রেম কত না সুখ-দান। ভবন তাঁর স্বরগ-‘পরে, যেথায় তাঁর চরণ পড়ে ধরার মাঝে স্বরগ শোভা ধরে, গো, সেইখান! Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বারেক ভালোবেসে যে জন মজে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বারেক ভালোবেসে যে জন মজে দেবতাসম সেই ধন্য, দ্বিতীয়বার পুন প্রেমে যে পড়ে মূর্খের অগ্রগণ্য। আমিও সে দলের মূর্খরাজ দুবার প্রেমপাশে পড়ি; তপন শশী তারা হাসিয়া মরে, আমিও হাসি– আর মরি। Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিচ্ছেদ (প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊর্মিময় সিন্ধু-‘পরে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊর্মিময় সিন্ধু-‘পরে তরীখানি যেতেছিল ধীরি, কম্পমান কেতু তার, চেয়েছিল কতবার সে দ্বীপের পানে ফিরি ফিরি। যারে আহা ভালোবাসি, তারে যবে ছেড়ে আসি যত যাই দূর দেশে চলি, সেইদিক পানে হায়, হৃদয় ফিরিয়া চায় যেখানে এসেছি তারে ফেলি। বিদেশেতে দেখি যদি, উপত্যকা, দ্বীপ, নদী, অতিশয় মনোহর ঠাঁই, সুরভি কুসুমে যার, শোভিত সকল ধার শুধু হৃদয়ের ধন নাই, বড়ো সাধ হয় প্রাণে, থাকিতাম এইখানে, হেথা যদি কাটিত জীবন, রয়েছে যে দূরবাসে, সে যদি থাকিত পাশে কী যে সুখ হইত তখন। পূর্বদিক সন্ধ্যাকালে, গ্রাসে অন্ধকার জালে ভীত পান্থ চায় ফিরে ফিরে, দেখিতে সে শেষজ্যোতি, সুষ্ঠুতর হয়ে অতি এখনো যা জ্বলিতেছে ধীরে, তেমনি সুখের কাল, গ্রাসে গো আঁধার-জাল অদৃষ্টের সায়াহ্নে যখন, ফিরে চাই বারে বারে, শেষবার দেখিবারে সুখের সে মুমূর্ষু কিরণ। Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদায় (যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে নব বন্ধু নব হর্ষ নব সুখ আশে। সুন্দরী রমণী কত, দেখিবে গো শত শত ফেলে গেলে যারে তারে পড়িবে কি মনে? তব প্রেম প্রিয়তম, অদৃষ্টে নাইকো মম সে-সব দুরাশা সখা করি না স্বপনে কাতর হৃদয় শুধু এই ভিক্ষা চায় ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়। স্মরিলে এ অভাগীর যাতনার কথা, যদিও হৃদয়ে লাগে তিলমাত্র ব্যথা, মরমের আশা এই, থাক্‌ রুদ্ধ মরমেই কাজ নাই দুখিনীরে মনে করে আর। কিন্তু দুঃখ যদি সখা, কখনো গো দেয় দেখা মরমে জনমে যদি যাতনার ভার, ও হৃদয় সান্ত্বনার বন্ধু যদি চায় ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়। Mrs. Amelia Opie
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিদায়-চুম্বন (একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার জনমের মতো দেখা হবে না কো আর। মর্মভেদী অশ্রু দিয়ে, পূজিব তোমারে প্রিয়ে দুখের নিশ্বাস আমি দিব উপহার। সে তো তবু আছে ভালো, একটু আশার আলো জ্বলিতেছে অদৃষ্টের আকাশে যাহার। কিন্তু মোর আশা নাই, যে দিকে ফিরিয়া চাই সেই দিকে নিরাশার দারুণ আঁধার! ভালো যে বেসেছি তারে দোষ কী আমার? উপায় কী আছে বলো উপায় কী তার? দেখামাত্র সেই জনে, ভালোবাসা আসে মনে ভালো বাসিলেই ভুলা নাহি যায় আর! নাহি বাসিতাম যদি এত ভালো তারে অন্ধ হয়ে প্রেমে তার মজিতাম না রে যদি নাহি দেখিতাম, বিচ্ছেদ না জানিতাম তা হলে হৃদয় ভেঙে যেত না আমার! আমারে বিদায় দাও যাই গো সুন্দরী, যাই তবে হৃদয়ের প্রিয় অধীশ্বরী, থাকো তুমি থাকো সুখে, বিমল শান্তির বুকে সুখ, প্রেম, যশ, আশা থাকুক তোমার একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার। Robert Burns
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা! দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে, তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে। বিশ্বামিত্র তোমার মতো গোরু দুটি এমন দেখি নি বিশ্বে! নইলে একটি গাভী পাবার তরে এত যুদ্ধ এত তপিস্যে! Heinrich Hein সাধনা, বৈশাখ, ১২৯৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বৃদ্ধ কবি (মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে জীবন হতেছে শেষ, শিথিল কপোল মলিন নয়ন তুষার-ধবল কেশ! পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া অযতনে বীণাখানি, বাজাবার বল নাইকো এ হাতে জড়িমা জড়িত বাণী! গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা! হইল বিদায় নিতে; আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই অমৃত আমার চিতে? তবু একবার আর-একবার ত্যজিবার আগে প্রাণ, মরিতে মরিতে গাহিয়া লইব সাধের সে-সব গান! দুলিবে আমার সমাধি-উপরে তরুগণ শাখা তুলি, বনদেবতারা গাইবে তখন মরণের গানগুলি! ভারতী, কার্তিক, ১২৮৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে প্রেমিক যেমন চায় কাতর নয়ানে তেমনি যে তোমা-পানে নাহি চায় গ্রীস্‌ তাহার হৃদয় মন পাষাণ কুলিশ ইংরাজেরা ভাঙিয়াছে প্রাচীর তোমার দেবতাপ্রতিমা লয়ে গেছে [সিন্ধুপার] এ দেখে কার না হবে হবে ॥। [ধূম]কেতু সম তারা কী কুক্ষণে হায় [ছা]ড়িয়া সে ক্ষুদ্র দ্বীপ আইল হেথায় [অ]সহায় বক্ষ তব রক্তময় করি দেবতা প্রতিমাগুলি লয়ে গেল হরি। George Gordon Byron মালতী পুঁথি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভুজ-পাশ-বদ্ধ অ্যান্টনি (এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে! একটি ভুজঙ্গ-ভুজে আমারে জড়ায়ে আছে; আরেকটি শ্যাম-বাহু, শতেক মুকুতা ঝুলে, সোনার মদিরা পাত্র আকাশে রয়েছে তুলে। অলকের মেঘ মাঝে জ্বলিতেছে মুখখানি, রূপের মদিরা পিয়া আবেশে অবশ হিয়া, পড়েছে মাতাল হয়ে, কখন্‌ কিছু না জানি! রাখিয়া বক্ষের পরে অবশ চিবুক মোর, হাসিতেছি তার পানে, হৃদয়ে আঁধার ঘোর! বাতায়ন-যবনিকা, বাতাস, সরায়ে ধীরে বীজন করিছে আসি এ মোর তাপিত শিরে। সম্মুখেতে দেখা যায় পীতবর্ণ বালুকায় অস্তগামী রবিকর আদূর “নীলের’ তীরে। চেয়ে আছি, দেখিতেছি, নদীর সুদূর পারে, (কী জানি কিসের দুখ!) পশ্চিম দিকের মুখ বিষণ্ণ হইয়া আসে সন্ধ্যার আঁধার ভারে। প্রদোষ তারার মুখে হাসি আসি উঁকি মারে! রোমীয় স্বপন এক জাগিছে সম্মুখে মোর, ঘুরিছে মাথার মাঝে, মাথায় লেগেছে ঘোর। রোমীয় সমর-অস্ত্র ঝঞ্ঝনিয়া উঠে বাজি, বিস্ফারিত নাসা চাহে রণ-ধূম পিতে আজি। কিন্তু হায়! অমনি সে মুখ্‌ পানে হেসে চায়, কী জানি কী হয় মতি, হীন প্রমোদের প্রতি। বীরের ভ্রূকুটিগুলি তখনি মিলায়ে যায়! গরবিত, শূন্য হিয়া, জর্জর আবেশ-বাণে, যে প্রমোদ ঘৃণা করি হেসে চাই তারি পানে। অনাহূত হর্ষ এক জাগ্রতে স্বপনে আসি, শৌর্যের সমাধি-পরে ঢালে রবি-কর রাশি! কতবার ঘৃণি তারে! রমণী সে অবহেলে পৌরুষ নিতেছে কাড়ি বিলাসের জালে ফেলে! কিন্তু সে অধর হতে অমনি অজস্র স্রোতে ঝরে পড়ে মৃদু হাসি, চুম্বন অমৃত-মাখা আমারে করিয়া তুলে, ভাঙাঘর ফুলে ঢাকা। বীরত্বের মুখ খানি একবার মনে আনি, তার পরে ওই মুখে ফিরাই নয়ন মম, ওই মুখ! একখানি উজ্জ্বল কলঙ্ক সম! ওই তার শ্যাম বাহু আমারে ধরেছে হায়! অঙ্গুলির মৃদু স্পর্শে বল মোর চলে যায়! মুখ ফিরাইয়া লই– রমণী যেমনি ধীরি মৃদু কণ্ঠে মৃদু কহে, অমনি আবার ফিরি। রোমের আঁধার মেঘ দেখে যেই মুখ-‘পরে, অমনি দু বাহু দিয়ে কণ্ঠ জড়াইয়া ধরে, বরষে নয়নবারি আমার বুকের মাঝ, চুমিয়া সে অশ্রুবারি শুকানো বীরের কাজ। তার পরে ত্যজি মোরে চরণ পড়িছে টলে, থর থর কেঁপে বলে–“যাও, যাও, যাও চলে!’ ঢুলু ঢুলু আঁখিপাতা পুরে অশ্রু-মুকুতায়, শ্যামল সৌন্দর্য তার হিম-শ্বেত হয়ে যায়! জীবনের লক্ষ্য, আশা, ইচ্ছা, হারাইয়া ফেলি, চেয়ে দেখি তার পানে কাতর নয়ন মেলি। আবার ফিরাই মুখ, কটাক্ষেতে চেয়ে রই, কল&ড়বঁ;ঙ্ক প্রমোদে মাতি তাহারে টানিয়া লই! আরেকটি বার রোম, হইব সন্তান তোর একটি বাসনা এই বন্দী এ হৃদয়ে মোর। গৌরবে সম্মানে মরি এই এক আছে আশ, চাহি না করিতে ব্যয় চুম্বনে অন্তিম শ্বাস! বুঝি হায় সে আশাও পুরিবে না কোনো কালে রোমীয় মৃত্যুও বুঝি ঘটিবে না এ কপালে! রোমীয় সমাধি চাই তাও বুঝি ভাগ্যে নাই, ওই বুকে মরে যাব, বুঝি মরণের কালে! Robert Buchanan ভারতী, আশ্বিন-কার্তিক, ১২৮৮
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ম্যাক্‌বেথ্‌ (ঝড় বাদলে আবার কখন) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ডাকিনী । ম্যাক্‌বেথ্‌) দৃশ্য : বিজন প্রান্তর । বজ্র বিদ্যুৎ । তিনজন ডাকিনী। ১ম ডা — ঝড় বাদলে আবার কখন মিল্‌ব মোরা তিনটি জনে। ২য় ডা — ঝগড়া ঝাঁটি থামবে যখন, হার জিত সব মিট্‌বে রণে। ৩য় ডা — সাঁঝের আগেই হবে সে ত; ১ম ডা — মিল্‌ব কোথায় বোলে দে ত। ২য় ডা — কাঁটা খোঁচা মাঠের মাঝ। ৩য় ডা — ম্যাক্কেথ সেথা আস্‌চে আজ। ১ম ডা — কটা বেড়াল! যাচ্ছি ওরে! ২য় ডা — ঐ বুঝি ব্যাং ডাক্‌চে মোরে! ৩য় ডা — চল্‌ তবে চল্‌ ত্বরা কোরে! সকলে — মোদের কাছে ভালই মন্দ, মন্দ যাহা ভাল যে তাই, অন্ধকারে কোয়াশাতে ঘুরে ঘুরে ঘুরে বেড়াই! প্রস্থান। দৃশ্য : এক প্রান্তর। বজ্র। তিনজন ডাকিনী। ১ম ডা — এতক্ষণ বোন কোথায় ছিলি? ২য় ডা — মারতে ছিলুম শুয়োরগুলি। ৩য় ডা — তুই ছিলি বোন, কোথায় গিয়ে? ১ম ডা — দেখ্‌, একটা মাঝির মেয়ে গোটাকতক বাদাম নিয়ে খাচ্ছিল সে কচ্‌মচিয়ে কচ্‌মচিয়ে কচ্‌মচিয়ে– চাইলুম তার কাছে গিয়ে, পোড়ারমুখী বোল্লে রেগে “ডাইনি মাগী যা তুই ভেগে।’ আলাপোয় তার স্বামী গেছে, আমি যাব পাছে পাছে। বেঁড়ে একটা ইঁদুর হোয়ে চালুনীতে যাব বোয়ে– যা বোলেছি কোর্‌ব আমি কোর্‌ব আমি– নইক আমি এমন মেয়ে! ২য় ডা — আমি দেব বাতাস একটি। ১ম ডা — তুমি ভাই বেশ লোকটি! ৩য় ডা — একটি পাবি আমার কাছে। ১ম ডা — বাকি সব আমারি আছে। * * * খড়ের মত একেবারে শুকিয়ে আমি ফেল্‌ব তারে। কিবা দিনে কিবা রাতে ঘুম রবে না চোকের পাতে। মিশ্‌বে না কেউ তাহার সাথে। একাশি বার সাত দিন শুকিয়ে শুকিয়ে হবে ক্ষীণ। জাহাজ যদি না যায় মারা ঝড়ের মুখে সবে সারা। বল্‌ দেখি বোন্‌, এইটে কি! ২য় ডা — কই, কই, কই, দেখি, দেখি। ১ম ডা — একটা মাঝির বুড় আঙুল রোয়েচে লো বোন, আমার কাছে, বাড়িমুখো জাহাজ তাহার পথের মধ্যে মারা গেছে। ৩য় ডা — ঐ শোন্‌ শোন্‌ বাজ্‌ল ভেরী আসে ম্যাক্কেথ, নাইক দেরী! দৃশ্য : গুহা। মধ্যে ফুটন্ত কটাহ। বজ্র। তিনজন ডাকিনী। ১ম ডা — কালো বেড়াল তিনবার করেছিল চীৎকার। ২য় ডা — তিনবার আর একবার সজারুটা ডেকেছিল। ৩য় ডা — হার্পি বলে আকাশ তলে “সময় হোল’ “সময় হোল!’ ১ম ডা — আয় রে কড়া ঘিরে ঘিরে বেড়াই মোরা ফিরে ফিরে বিষমাখা ওই নাড়ি ভুঁড়ি কড়ার মধ্যে ফেল্‌ রে ছুঁড়ি। ব্যাং একটা ঠান্ডা ভুঁয়ে একত্রিশ দিন ছিল শুয়ে, কড়ার মধ্যে ফেল্‌ব মোরা। সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে কাজ সাধি আয় সবাই জুটে। দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌রে আগুন ওঠরে কড়া দ্বিগুণ ফুটে। ২য় ডা — জলার সাপের মাংস নিয়ে সিদ্ধ কর কড়ায় দিয়ে। গির্গিটি-চোক ব্যাঙ্গের পা, টিকটিকি-ঠ্যাং পেঁচার ছা। কুত্তোর জিব, বাদুড় রোঁয়া, সাপের জিব আর শুওর শোঁয়া। শক্ত ওষুধ কোরতে হবে টগ্‌বগিয়ে ফোটাই তবে। সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে কাজ সাধি আয় সবাই জুটে। দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বলরে আগুন ওঠ্‌রে কড়া দ্বিগুণ ফুটে। ৩য় ডা — মকরের আঁশ, বাঘের দাঁত, ডাইনি-মড়া, হাঙ্গর ব্যাঁৎ, ইষের শিকড় তুলেছি রাতে, নেড়ের পিলে মেশাই তাতে, পাঁঠার পিত্তি, শেওড়া ডাল গেরণ-কালে কেটেছি কাল, তাতারের ঠোঁট, তুর্কি নাক, তাহার সাথে মিশিয়ে রাখ। আন্‌গে রে সেই ভ্রূণ-মরা, খানায় ফেলে খুন-করা, তারি একটি আঙুল নিয়ে সিদ্ধ কর কড়ায় দিয়ে। বাঘের নাড়ি ফেলে তাতে ঘন কর আগুন-তাতে। সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে কাজ সাধি আয় সবাই জুটে। দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌রে আগুন ওঠরে কড়া দ্বিগুণ ফুটে। ২য় ডা — বাঁদর ছানার রক্তে তবে ওষুধ ঠান্ডা কোরতে হবে– তবেই ওষুধ শক্ত হবে। ভারতী, আশ্বিন, ১২৮৭
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১ যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায়, লভিবে সুযশ কীর্তি গৌরব যেথায়, কিন্তু গো একটি কথা, কহিতেও লাগে ব্যথা, উঠিবে যশের যবে সমুচ্চ সীমায়, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়– সুখ্যাতি অমৃত রবে, উৎফুল্ল হইবে যবে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়। ২ কত যে মমতা-মাখা, আলিঙ্গন পাবে সখা, পাবে প্রিয় বান্ধবের প্রণয় যতন, এ হতে গভীরতর, কতই উল্লাসকর, কতই আমোদে দিন করিবে যাপন, কিন্তু গো অভাগী আজি এই ভিক্ষা চায়, যখন বান্ধব-সাথ, আমোদে মাতিবে নাথ, তখন অভাগী বলে স্মরিয়ো আমায়। ৩ সুচারু সায়াহ্নে যবে ভ্রমিতে ভ্রমিতে, তোমার সে মনোহরা, সুদীপ্ত সাঁজের তারা, সেখানে সখা গো তুমি পাইবে দেখিতে– মনে কি পড়িবে নাথ, এক দিন আমা সাথ, বনভ্রমি ফিরে যবে আসিতে ভবনে– ওই সেই সন্ধ্যাতারা, দুজনে দেখেছি মোরা, আরো যেন জ্বল জ্বল জ্বলিত গগনে। ৪ নিদাঘের শেষাশেষি, মলিনা গোলাপরাশি, নিরখি বা কত সুখী হইতে অন্তরে, দেখি কি স্মরিবে তায়, সেই অভাগিনী হায় গাঁথিত যতনে তার মালা তোমা তরে! যে-হস্ত গ্রথিত বলে তোমার নয়নে হত তা সৌন্দর্য-মাখা, ক্রমেতে শিখিলে সখা গোলাপে বাসিত ভালো যাহারি কারণে– তখন সে দুঃখিনীকে কোরো নাথ মনে। ৫ বিষণ্ণ হেমন্তে যবে, বৃক্ষের পল্লব সবে শুকায়ে পড়িবে খসে খসে চারি ধারে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে। নিদারুণ শীত কালে, সুখদ আগুন জ্বেলে, নিশীথে বসিবে যবে অনলের ধারে, তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে। সেই সে কল্পনাময়ী সুখের নিশায়, বিমল সংগীত তান, তোমার হৃদয় প্রাণ। নীরবে সুধীরে ধীরে যদি গো জাগায়– আলোড়ি হৃদয়-তল, এক বিন্দু অশ্রুজল, যদি আঁখি হতে পড়ে সে তান শুনিলে, তখন করিয়ো মনে, এক দিন তোমা সনে, যে যে গান গাহিয়াছি হৃদি প্রাণ খুলে, তখন স্মরিয়ো হায় অভাগিনী বলে। Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি রানী, তোর মধুখানা দিঠি রানী, তুই মণি তুই ধন, তোর কথা ভাবি সারাক্ষণ। দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটে কী করিয়া? সাধ যায় তোর কাছে গিয়া চুপিচাপি বসি এক ভিতে ছোটোছোটো সেই ঘরটিতে। ছোটো হাতখানি হাতে করে অধরেতে রেখে দিই ধরে। ভিজাই ফেলিয়া আঁখিজল ছোট সে কোমল করতল। Heinrich Hein
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার যাইবি কি তুই, ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? পাদপের ছায়া মাথার ‘পরে, পাখিরা গাইছে মধুর স্বরে অথবা উড়িছে পাখা বিছায়ে হরষে সে গিরি-কাননে! রূপসী আমার প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার, যাইবি কি তুই ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? শিখর উঠেছে আকাশ-‘পরি, ফেনময় স্রোত পড়িছে মরি, সুরভি-কুঞ্জ ছায়া বিছায়ে শোভিছে সে গিরি-কাননে! রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার, যাইবি কি তুই ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? ধবল শিখর কুসুমে ভরা সরসে ঝরিছে নিঝর-ধারা উছসে উঠিয়া সলিল-কণা শীতলিছে গিরি-কাননে! রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই, রূপসী আমার, যাইবি কি তুই ভ্রমিবারে গিরি-কাননে? সুখ দুখ যাহা দিলেন, বিধি, কিছুই মানিতে চায় না হৃদি, তোমারে ও প্রেমে লইয়া পাশে ভ্রমি যদি গিরি-কাননে! Robert Burns
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ললিত-নলিনী (হা নলিনী গেছে আহা কী সুখের দিন) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (কৃষকের প্রেমালাপ।) ললিত হা নলিনী গেছে আহা কী সুখের দিন, দোঁহে যবে এক সাথে, বেড়াতেম হাতে হাতে নবীন হৃদয় চুরি করিলি নলিন! হা নলিনী কত সুখে গেছে সেই দিন। নলিনী কত ভালোবাসি সেই বনেরে ললিত, প্রথমে বলিনু যেথা, মনের লুকানো কথা, স্বর্গ-সাক্ষী করি যেথা হয়ে হরষিত বলিলে, আমারি তুমি হইবে ললিত। ললিত বসন্ত-বিহগ যথা সুললিত ভাষী, যত শুনি তত তার, ভালো লাগে গীতধার, যত দিন যায় তত তোরে ভালোবাসি, যত দিন যায় তব বাড়ে রূপরাশি। নলিনী কোমল গোলাপকলি থাকে যথা গাছে, দিন দিন ফুটে যত, পরিমল বাড়ে তত, এ হৃদয় ভালোবাসা আলো করি আছে সঁপেছি সে ভালোবাসা তোমারি গো কাছে। ললিত মৃদুতর রবিকর সুনীল আকাশ হেরিলে শস্যের আশে, হৃদয় হরষে ভাসে তার চেয়ে এ হৃদয়ে বাড়ে গো উল্লাস হেরিলে নলিনী তোর মৃদু মধু হাস। নলিনী মধু আগমন বার্তা করিতে কুজিত কোকিল যখন ডাকে, হৃদয় নাচিতে থাকে কিন্তু তার চেয়ে হৃদি হয় উথলিত, মিলিলে তোমার সাথে প্রাণের ললিত। ললিত কুসুমের মধুময় অধর যখন ভ্রমর প্রনয়ভরে, হরষে চুম্বন করে সে কি এত সুখ পায় আমার মতন যবে ও অধরখানি করি গো চুম্বন? নলিনী শিশিরাক্ত পত্রকোলে মল্লিকা হসিত, বিজন সন্ধ্যার ছায়ে, ফুটে সে মলয়বায়ে, সে অমন নহে মিষ্ট নহে সুবাসিত তোমার চুম্বন আহা যেমন ললিত। ললিত ঘুরুক অদৃষ্টচক্র সুখ দুখ দিয়া কভু দিক্‌ রসাতলে, কভু বা স্বরগে তুলে রহিবে একটি চিন্তা হৃদয়ে জাগিয়া সে চিন্তা তোমারি তরে জানি ওগো প্রিয়া। নলিনী ধন রত্ন কনকের নাহি ধার ধারি পদতলে বিলাসীর, নত করিব না শির প্রণয়ধনের আমি দরিদ্র ভিখারি, সে প্রণয়, ললিত গো তোমারি তোমারি। Robert Burns
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সংগীত (কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে চাঁদের জোছনা এই সমুদ্রবেলায়! এসো প্রিয়ে এইখানে বসি কিছুকাল; গীতস্বর মৃদু মৃদু পশুক শ্রবণে! সুকুমার নিস্তব্ধতা আর নিশীথিনী– সাজে ভালো মর্ম-ছোঁয়া সুধা-সংগীতেরে। বইস জেসিকা, দেখো, গগন-প্রাঙ্গণ জলৎ কাঞ্চন-পাতে খচিত কেমন! এমন একটি নাই তারকামণ্ডল দিব্য গীত যে না গায় প্রতি পদক্ষেপে! অমর আত্মাতে হয় এমনি সংগীত। কিন্তু ধূলিময় এই মর্ত্য-আবরণ যতদিন রাখে তারে আচ্ছন্ন করিয়া ততদিন সে সংগীত পাই না শুনিতে। William Shakespeare
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুখী প্রাণ (জান না তো নির্ঝরিণী, আসিয়াছ কোথা হতে) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জান না তো নির্ঝরিণী, আসিয়াছ কোথা হতে, কোথায় যে করিছ প্রয়াণ, মাতিয়া চলেছ তবু আপন আনন্দে পূর্ণ, আনন্দ করিছ সবে দান। বিজন-অরণ্য-ভূমি দেখিছে তোমার খেলা জুড়াইছে তাহার নয়ান। মেষ-শাবকের মতো তরুদের ছায়ে ছায়ে রচিয়াছ খেলিবার স্থান। গভীর ভাবনা কিছু আসে না তোমার কাছে, দিনরাত্রি গাও শুধু গান। বুঝি নরনারী মাঝে এমনি বিমল হিয়া আছে কেহ তোমারি সমান। চাহে না চাহে না তারা ধরণীর আড়ম্বর, সন্তোষে কাটাতে চায় প্রাণ, নিজের আনন্দ হতে আনন্দ বিতরে তারা গায় তারা বিশ্বের কল্যাণ। Robert Buchanan আলোচনা’ পত্রিকা, ভাদ্র, ১২৯১
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে দাঁড়াও একটিবার! একবার আমি দেখিয়া লইব মধুর হাসি তোমার! কত দুখ-জ্বালা সহি অকাতরে ভ্রমি, গো, দূর প্রবাসে যদি লভি মোর হৃদয়-রতন– সুশীলারে মোর পাশে! কালিকে যখন নাচ গান কত হতেছিল সভা-‘পরে, কিছুই শুনি নি, আছিনু মগন তোমারি ভাবনা-ভরে আছিল কত-না বালিকা, রমণী, রূপসী প্রমোদ-হিয়া, বিষাদে কহিনু, “তোমরা তো নহ সুশীলা, আমার প্রিয়া!’ সুশীলে, কেমনে ভাঙ তার মন হরষে মরিতে পারে যেই জন তোমারি তোমারি তরে! সুশীলে, কেমনে ভাঙ হিয়া তার কিছু যে করি নি, এক দোষ যার ভালোবাসে শুধু তোরে! প্রণয়ে প্রণয় না যদি মিশাও দয়া কোরো মোর প্রতি, সুশীলার মন নহে তো কখনো নিরদয় এক রতি! Robert Burns
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নিজ্বালার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নিজ্বালার সুন্দর চুলের, সুগন্ধি মালার, তিক্ত বচনের, মিষ্ট অধরের, বিমুগ্ধ গানের, বিষণ্ণ স্বরের। সে-সব মিলায়ে গেছে বহুদিন, সে স্বপ্নপ্রতিমা কোথায় বিলীন। শুধু সে অনন্ত জ্বলন্ত হুতাশ ছন্দে বন্ধ হয়ে করিতেছে বাস। তুমিও গো যাও, হে অনাথ গান, সে স্বপ্নছবিরে করগে সন্ধান। দিলাম পাঠায়ে, করিতে মেলানী, ছায়া-প্রতিমারে বায়ুময়ী বাণী। Heinrich Heine
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অকর্মার বিভ্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা, তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা? যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি। ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খ'সে, দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব'সে। ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই। চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা, এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা। হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে-- খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অকৃতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি সদা ব্যঙ্গ করে, ধ্বনি কাছে ঋণী সে যে পাছে ধরা পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অচেতন মাহাত্ম্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হে জলদ, এত জল ধ'রে আছ বুকে তবু লঘুবেগে ধাও বাতাসের মুখে। পোষণ করিছ শত ভীষণ বিজুলি তবু স্নিগ্ধ নীল রূপে নেত্র যায় ভুলি। এ অসাধ্য সাধিতেছ অতি অনায়াসে কী করিয়া, সে রহস্য কহি দাও দাসে। গুরুগুরু গরজনে মেঘ কহে বাণী, আশ্চর্য কী আছে ইথে আমি নাহি জানি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অদৃশ্য কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রজনী গোপনে বনে ডালপালা ভ'রে কুঁড়িগুলি ফুটাইয়া নিজে যায় স'রে। ফুল জাগি বলে, মোরা প্রভাতের ফুল-- মুখর প্রভাত বলে, নাহি তাহে ভুল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অধিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধিকার বেশি কার বনের উপর সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর। বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল, গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল। পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া, বর্ণে আমি দিগ্‌বিদিক রেখেছি কাড়িয়া। গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব, গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব। কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে, হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে। মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর, প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অনাবশ্যকের আবশ্যকতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী জন্যে রয়েছ, সিন্ধু তৃণশষ্যহীন-- অর্ধেক জগৎ জুড়ি নাচো নিশিদিন। সিন্ধু কহে, অকর্মণ্য না রহিত যদি ধরণীর স্তন হতে কে টানিত নদী?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অনুরাগ ও বৈরাগ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেম কহে, হে বৈরাগ্য, তব ধর্ম মিছে। প্রেম, তুমি মহামোহ--বৈরাগ্য কহিছে-- আমি কহি, ছাড়্‌ স্বার্থ, মুক্তিপথ দেখ্‌। প্রেম কহে, তা হলে তো তুমি আমি এক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অপরিবর্তনীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক যদি আর হয় কী ঘটিবে তবে? এখন যা হয়ে গেছে, তখনো তা হবে। তখন সকল দুঃখ ঘোচে যদি ভাই, এখন যা সুখ আছে দুঃখ হবে তাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অপরিহরণীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যু কহে, পুত্র নিব; চোর কহে ধন। ভাগ্য কহে, সব নিব যা তোর আপন। নিন্দুক কহিল, লব তব যশোভার। কবি কহে, কে লইবে আনন্দ আমার?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অযোগ্যের উপহাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নক্ষত্র খসিল দেখি দীপ মরে হেসে। বলে, এত ধুমধাম, এই হল শেষে! রাত্রি বলে, হেসে নাও, বলে নাও সুখে, যতক্ষণ তেলটুকু নাহি যায় চুকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অল্প জানা ও বেশি জানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৃষিত গর্দভ গেল সরোবরতীরে, "ছিছি কালো জল!' বলি চলি এল ফিরে। কহে জল, জল কালো জানে সব গাধা, যে জন অধিক জানে বলে জল সাদা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অসম্পূর্ণ সংবাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চকোরী ফুকারি কাঁদে, ওগো পূর্ণ চাঁদ, পণ্ডিতের কথা শুনি গনি পরমাদ! তুমি নাকি একদিন রবে না ত্রিদিবে, মহাপ্রলয়ের কালে যাবে নাকি নিবে! হায় হায় সুধাকর, হায় নিশাপতি, তা হইলে আমাদের কী হইবে গতি! চাঁদ কহে, পণ্ডিতের ঘরে যাও প্রিয়া, তোমার কতটা আয়ু এসো শুধাইয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অসম্ভব ভালো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথাসাধ্য-ভালো বলে, ওগো আরো-ভালো, কোন্‌ স্বর্গপুরী তুমি ক'রে থাকো আলো। আরো-ভালো কেঁদে কহে, আমি থাকি হায়, অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অসাধ্য চেষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শক্তি যার নাই নিজে বড়ো হইবারে বড়োকে করিতে ছোটো তাই সে কি পারে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অস্ফুট ও পরিস্ফুট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘটিজল বলে, ওগো মহাপারাবার, আমি স্বচ্ছ সমুজ্জ্বল, তুমি অন্ধকার। ক্ষুদ্র সত্য বলে, মোর পরিষ্কার কথা, মহাসত্য তোমার মহান্‌ নীরবতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আকাঙক্ষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আম্র, তোর কী হইতে ইচ্ছা যায় বল্‌। সে কহে, হইতে ইক্ষু সুমিষ্ট সরল।-- ইক্ষু, তোর কী হইতে মনে আছে সাধ? সে কহে, হইতে আম্র সুগন্ধ সুস্বাদ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আত্মশত্রুতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খোঁপা আর এলোচুলে বিবাদ হামাশা, পাড়ার লোকেরা জোটে দেখিতে তামাশা। খোঁপা কয় এলোচুল, কী তোমার ছিরি! এলো কয়, খোঁপা তুমি রাখো বাবুগিরি। খোঁপা কহে, টাক ধরে হই ভেবে খুশি। তুমি যেন কাটা পড়ো, এলো কয় রুষি। কবি মাঝে পড়ি বলে, মনে ভেবে দেখ্‌ দুজনেই এক তোরা, দুজনেই এক। খোঁপা গেলে চুল যায়, চুলে যদি টাক-- খোঁপা, তবে কোথা রবে তব জয়ঢাক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আদিরহস্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরব, কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব। ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি-- যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আরম্ভ ও শেষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ কহে, একদিন সব শেষ হবে, হে আরম্ভ, বৃথা তব অহংকার তবে। আরম্ভ কহিল ভাই, যেথা শেষ হয় সেইখানে পুনরায় আরম্ভ-উদয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঈর্ষার সন্দেহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেজ নড়ে, ছায়া তারি নড়িছে মুকুরে কোনোমতে সেটা সহ্য করে না কুকুরে। দাস যবে মনিবেরে দোলায় চামর কুকুর চটিয়া ভাবে, এ কোন্‌ পামর? গাছ যদি ন'ড়ে ওঠে, জলে ওঠে ঢেউ, কুকুর বিষম রাগে করে ঘেউ-ঘেউ। সে নিশ্চয় বুঝিয়াছে ত্রিভুবন দোলে ঝাঁপ দিয়া উঠিবারে তারি প্রভু-কোলে। মনিবের পাতে ঝোল খাবে চুকুচুকু, বিশ্বে শুধু নড়িবেক তারি লেজটুকু।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উচ্চের প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কহিল মনের খেদে মাঠ সমতল, হাট ভ'রে দিই আমি কত শষ্য ফল। পর্বত দাঁড়ায়ে রন কী জানি কী কাজ, পাষাণের সিংহাসনে তিনি মহারাজ। বিধাতার অবিচার, কেন উঁচুনিচু সে কথা বুঝিতে আমি নাহি পারি কিছু। গিরি কহে, সব হলে সমভূমি-পারা নামিত কি ঝরনার সুমঙ্গলধারা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উদারচরিতানাম্‌ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন। ধিক্‌ ধিক্‌ করে তারে কাননে সবাই-- সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উপলক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাল বলে, আমি সৃষ্টি করি এই ভব। ঘড়ি বলে, তা হলে আমিও স্রষ্টা তব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এক পরিণাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেফালি কহিল, আমি ঝরিলাম, তারা! তারা কহে, আমারো তো হল কাজ সারা-- ভরিলাম রজনীর বিদায়ের ডালি আকাশের তারা আর বনের শেফালি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এক-তরফা হিসাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাতাশ, হলে না কেন এক-শো সাতাশ, থলিটি ভরিত, হাড়ে লাগিত বাতাস। সাতাশ কহিল, তাহে টাকা হত মেলা, কিন্তু কী করিতে বাপু বয়সের বেলা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একই পথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কর্তব্যগ্রহণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি। শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি। মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কলঙ্কব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধুলা, করো কলঙ্কিত সবার শুভ্রতা সেটা কি তোমারি নয় কলঙ্কর কথা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কাকঃ কাকঃ পিকঃ পিকঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেহটা যেমনি ক'রে ঘোরাও যেখানে বাম হাত বামে থাকে, ডান হাত ডানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কীটের বিচার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাভারতের মধ্যে ঢুকেছেন কীট, কেটেকুটে ফুঁড়েছেন এপিঠ-ওপিঠ। পণ্ডিত খুলিয়া দেখি হস্ত হানে শিরে; বলে, ওরে কীট, তুই এ কী করিলি রে! তোর দন্তে শান দেয়, তোর পেট ভরে, হেন খাদ্য কত আছে ধূলির উপরে। কীট বলে, হয়েছে কী, কেন এত রাগ, ওর মধ্যে ছিল কী বা, শুধু কালো দাগ! আমি যেটা নাহি বুঝি সেটা জানি ছার, আগাগোড়া কেটেকুটে করি ছারখার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কুটুম্বিতা-বিচার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই ব'লে ডাক যদি দেব গলা টিপে। হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা-- কেরোসিন বলি উঠে, এসো মোর দাদা!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কুয়াশার আক্ষেপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "কুয়াশা, নিকটে থাকি, তাই হেলা মোরে-- মেঘ ভায়া দূরে রন, থাকেন গুমরে!' কবি কুয়াশারে কয়, শুধু তাই না কি? মেঘ দেয় বৃষ্টিধারা, তুমি দাও ফাঁকি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কৃতীর প্রমাদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি, হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি। হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল, কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ক্ষুদ্রের দম্ভ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির, লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
খেলেনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাবে শিশু, বড়ো হলে শুধু যাবে কেনা বাজার উজাড় করি সমস্ত খেলেনা। বড়ো হলে খেলা যত ঢেলা বলি মানে, দুই হাত তুলে চায় ধনজন-পানে। আরো বড়ো হবে না কি যবে অবহেলে ধরার খেলার হাট হেসে যাবে ফেলে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গদ্য ও পদ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শর কহে, আমি লঘু, গুরু তুমি গদা, তাই বুক ফুলাইয়া খাড়া আছ সদা। করো তুমি মোর কাজ, তর্ক যাক চুকে-- মাথা ভাঙা ছেড়ে দিয়ে বেঁধো গিয়ে বুকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গরজের আত্মীয়তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কহিল ভিক্ষার ঝুলি টাকার থলিরে, আমরা কুটুম্ব দোঁহে ভুলে গেলি কি রে? থলি বলে, কুটুম্বিতা তুমিও ভুলিতে আমার যা আছে গেলে তোমার ঝুলিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গালির ভঙ্গি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাঠি গালি দেয়, ছড়ি, তুই সরু কাঠি! ছড়ি তারে গালি দেয়, তুমি মোটা লাঠি!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গুণজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি প্রজাপতি ফিরি রঙিন পাখায়, কবি তো আমার পানে তবু না তাকায়। বুঝিতে না পারি আমি, বলো তো ভ্রমর, কোন্‌ গুণে কাব্যে তুমি হয়েছ অমর। অলি কহে, আপনি সুন্দর তুমি বটে, সুন্দরের গুণ তব মুখে নাহি রটে। আমি ভাই মধু খেয়ে গুণ গেয়ে ঘুরি, কবি আর ফুলের হৃদয় করি চুরি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গ্রহণে ও দানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃতাঞ্জলি কর কহে, আমার বিনয়, হে নিন্দুক, কেবল নেবার বেলা নয়। নিই যবে নিই বটে অঞ্জলি জুড়িয়া, দিই যবে সেও দিই অঞ্জলি পুরিয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চালক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে? সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিরনবীনতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়-- আমি মৃত্যু তোর মাতা, নাহি মোরে ভয়। নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন আমি তোরে ক'রে দিই প্রত্যহ নবীন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চুরি-নিবারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুয়োরাণী কহে, রাজা দুয়োরাণীটার কত মতলব আছে বুঝে ওঠা ভার। গোয়াল্‌-ঘরের কোণে দিলে ওরে বাসা, তবু দেখো অভাগীর মেটে নাই আশা। তোমারে ভুলায়ে শুধু মুখের কথায় কালো গরুটিরে তব দুয়ে নিতে চায়। রাজা বলে, ঠিক ঠিক, বিষম চাতুরী-- এখন কী ক'রে ওর ঠেকাইব চুরি! সুয়ো বলে, একমাত্র রয়েছে ওষুধ, গোরুটা আমারে দাও, আমি খাই দুধ।