author
stringclasses
33 values
text
stringlengths
86
1.25M
জীবনানন্দ দাশ
বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল; পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল; সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
জীবনানন্দ দাশ
ভিখিরী জীবনানন্দ দাশ একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো— তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে-মানে। —ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত। আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত; তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত। একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে, একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা, একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো— তা হ’লে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা। —ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ। ভিড়ের ভিতরে তবু— হ্যারিসন রোডে— আরো গভীর অসুখ, এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে: এক পৃথিবীর ভুলচুক।
জীবনানন্দ দাশ
সবিতা জীবনানন্দ দাশ সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে: ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি, তাহাদের সাথে সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন; মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী রেশম, মদের সার্থবাহ, দুধের মতন শাদা নারী। অনন্ত রৌদের থেকে তারা শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে সহসা বিকেলবেলা শেষ হ’য়ে গেলে চ’লে যেত কেমন নীরবে। চারিদিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র; মধ্যযুগের অবসান স্থির ক’রে দিতে গিয়ে ইওরোপ গ্রীস হতেছে উজ্জ্বল খ্রীষ্টান। তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা— সিন্ধুর রাত্রির জল জানে— আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে; কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে আমরা আকুল হ’য়ে উঠে মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধ করা হবে জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায় যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে। এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে; কি এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন! তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে কবেকার সমুদ্রের নুন; তোমার মুখের রেখা আজো মৃত কতো পৌত্তলিক খ্রীষ্টান সিন্ধুর অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন; কতো কাছে— তবু কতো দূর।
জীবনানন্দ দাশ
সুচেতনা জীবনানন্দ দাশ সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ বিকেলের নক্ষত্রের কাছে; সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে নির্জনতা আছে। এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা সত্য; তবু শেষ সত্য নয়। কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে; তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়। আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রে ঘুরে প্রাণ পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত ভাই বোন বন্ধু পরিজন প’ড়ে আছে; পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন; মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে। কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়; সেই শস্য অগণন মানুষের শব; শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময় আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়সের মতো আমাদেরো প্রাণ মূক ক’রে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান। সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে— এ-পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে; সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ; এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল; প্রায় তত দূর ভালো মানব-সমাজ আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে গ’ড়ে দেবো, আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে। মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি, না এলেই ভালো হ’তো অনুভব ক’রে; এসে যে গভীরতর লাভ হ’লো সে-সব বুঝেছি শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে; দেখেছি যা হ’লো হবে মানুষের যা হবার নয়— শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।
জীবনানন্দ দাশ
সুরঞ্জনা জীবনানন্দ দাশ সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো; পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন; কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো; গ্রীক হিন্দু ফিনিশিয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন শুনেছো ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা-নগরীর গায়ে কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? —গিয়েছে হারায়ে। বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো; তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আলপনা; একটি পাখির গান কী রকম ভালো। মানুষ কাউকে চায়— তার সেই নিহত উজ্জ্বল ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল। মনে পড়ে কবে এক তারাভরা রাতের বাতাসে ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে উতরোল বড়ো সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদের সুধীদের বিবর্ণতা নয়, আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়। যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে; তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।
জীবনানন্দ দাশ
অনুপম ত্রিবেদী জীবনানন্দ দাশ এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে। যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তূপ দেখে মনে হয় যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ-নিজ চিন্তার বিষয় পরিশেষ ক’রে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে এখন ঘুমায়ে আছে— তাহদের ঘুম ভেঙে দিতে নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে— ওই পারে মৃত্যুর তালা ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা ঈশার শবোত্থান— বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে হেগেল ও মার্কস: তার ডান আর বাম কান ধ’রে দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিলো; এমন সময় দু-পকেটে হাত রেখে ভ্রূকুটিল চোখে নিরাময় জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম; প্রেমের চেয়েও ভালো মনে হ’লো একটি টোটেম: উটের ছবির মতো— একজন নারীর হৃদয়ে; মুখে-চোখে আকুতিতে মরীচিকা জয়ে চলেছে সে; জড়ায়েছে ঘিয়ের রঙের মতো শাড়ি; ভালো ক’রে দেখে নিলে মনে হয় অতীব চতুর দক্ষিণরাঢ়ী দিব্য মহিলা এক; কোথায় যে আঁচলের খুঁট; কেবলি উত্তরপাড়া ব্যাণ্ডেল কাশীপুর বেহালা খুরুট ঘুরে যায় স্টালিন, নেহেরু, ব্লক, অথবা রায়ের বোঝা ব’য়ে, ত্রিপাদ ভূমির পরে আরো ভূমি আছে এই বলির হৃদয়ে? তা হ’লে তা’ প্রেম নয়; ভেবে গেল ত্রিবেদীর হৃদয়ের জ্ঞান। জড় ও অজড় ডায়ালেকটিক মিলে আমাদের দু-দিকের কান টানে ব’লে বেঁচে থাকি— ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিলো টান।
জীবনানন্দ দাশ
আট বছর আগের একদিন জীবনানন্দ দাশ শোনা গেল লাসকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে; কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হ’লো তার সাধ; বধূ শুয়েছিলো পাশে— শিশুটিও ছিলো; প্রেম ছিলো, আশা ছিলো— জ্যোৎস্নায়– তবু সে দেখিল কোন্ ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার? অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল— লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার। এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি! রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার; কোনোদিন জাগিবে না আর। ‘কোনোদিন জাগিবে না আর জানিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম— অবিরাম ভার সহিবে না আর—’ এই কথা বলেছিলো তারে চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে— অদ্ভুত আঁধারে যেন তার জানালার ধারে উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে। তবুও তো পেঁচা জাগে; গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে আরেকটি প্রভাতের ইশারায়— অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে। টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা; মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে। রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি; সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি। ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন— যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন; দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ মরণের সাথে লড়িয়াছে; চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা; যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা এই জেনে। অশ্বত্থের শাখা করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে করেনি কি মাখামাখি? থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে চমৎকার! ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’ জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার? জীবনের এই স্বাদ– সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের– তোমার অসহ্য বোধ হ’লো; মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো মর্গে— গুমোটে থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে। শোনো তবু এ মৃতের গল্প; কোনো নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই; বিবাহিত জীবনের সাধ কোথাও রাখেনি কোনো খাদ, সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ মধু— আর মননের মধু দিয়েছে জানিতে; হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই; তাই লাসকাটা ঘরে চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে। জানি— তবু জানি নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ– নয় সবখানি; অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়— আরো-এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে; আমাদের ক্লান্ত করে ক্লান্ত— ক্লান্ত করে; লাসকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই; তাই লাসকাটা ঘরে চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে। তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা, থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে এসে চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে? চমৎকার! ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার—’ হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার? আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো— বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো কালীদহে বেনোজলে পার; আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
জীবনানন্দ দাশ
কুড়ি বছর পরে জীবনানন্দ দাশ আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি! আবার বছর কুড়ি পরে— হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে— তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে— তখন হলুদ নদী নরম-নরম হয় শর কাশ হোগলায়— মাঠের ভিতরে। অথবা নাইকো ধান খেতে আর; ব্যস্ততা নাইকো আর, হাঁসের নীড়ের থেকে খড় পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার— তখন হঠাৎ যদি মেঠে পথে পাই আমি তোমারে আবার! হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার, শিরীষের অথবা জামের, ঝাউয়ের— আমের; কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে! জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার— তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে— বাবলার গলির অন্ধকারে অশথের জানালার ফাঁকে কোথায় লুকায় আপনাকে! চোখের পাতার মতো নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে— সোনালি-সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে— কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!
জীবনানন্দ দাশ
ঘাস জীবনানন্দ দাশ কচি লেবুপাতার মতো নরম সবুজ আলোয় পৃথিবী ভ’রে গিয়েছে এই ভোরের বেলা; কাঁচা বাতাবীর মতো সবুজ ঘাস— তেম্নি সুঘ্রাণ— হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। আমারো ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে-গেলাসে পান করি, এই ঘাসের শরীর ছানি– চোখে চোখ ঘষি, ঘাসের পাখনায় আমার পালক, ঘাসের ভিতর ঘাস হ’য়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস-মাতার শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।
জীবনানন্দ দাশ
নগ্ন নির্জন হাত জীবনানন্দ দাশ আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হ’য়ে উঠছে: আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার। যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি, সেই নারীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হ’য়ে উঠছে। মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে। ভারতসমুদ্রের তীরে কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিলো একদিন, কোনো এক প্রাসাদ ছিলো; মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ: পারস্য গালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল, আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা, আর তুমি নারী— এই সব ছিলো সেই জগতে একদিন। অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো, অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো, মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক; অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো, অনেক কমলা রঙের রোদ; আর তুমি ছিলে; তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না। ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনী, অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা, লুপ্ত নাসপাতির গন্ধ, অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি, রামধনু রঙের কাচের জানালা, ময়ূরের পেখমের মতে রঙিন পর্দায়-পর্দায় কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের ক্ষণিক আভাস— আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়। পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ! তোমার নগ্ন নির্জন হাত; তোমার নগ্ন নির্জন হাত।
জীবনানন্দ দাশ
বিড়াল জীবনানন্দ দাশ সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে-ফিরে কেবলই আমার দেখা হয় গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে; কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর তারপর শাদা মাটির কঙ্কালের ভিতর নিজের হৃদয়কে নিয়ে মৌমাছির মতে নিমগ্ন হ’য়ে আছে দেখি; কিন্তু তবুও তারপর কৃষ্ণচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে, সারাদিন সূর্যের পিছনে-পিছনে চলছে সে। একবার তাকে দেখা যায়, একবার হারিয়ে যায় কোথায়। হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান-রং-এর সূর্যের নরম শরীরে শাদা থাবা বুলিয়ে-বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে; তারপর অন্ধকারকে ছোটো-ছোটো বলের মতে থাবা দিয়ে লুফে আনলো সে, সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিলো।
জীবনানন্দ দাশ
বুনো হাঁস পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে— জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে বুনো হাঁস পাখা মেলে— সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার; এক— দুই— তিন— চার— অজস্র— অপার— রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে— ছুটিতেছে তা’রা। তারপর প’ড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ, হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ— দু-একটা কল্পনার হাঁস; মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ; উড়ুক উড়ুক তা’রা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।
জীবনানন্দ দাশ
মনোকণিকা জীবনানন্দ দাশ ও. কে. একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো; একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে; একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো; তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে। বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব। অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে অপরের নিয়মে নীরব। মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়; সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়; সব দিক ও. কে.। সাবলীল আকাশে সূর্যের আলো থাকুক না— তবু— দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে। আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই। মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে। মাঝে-মাঝে পুরুষার্থ উত্তেজিত হ’লে— (এ রকম উত্তেজিত হয়;) উপস্থাপয়িতার মতন আমাদের চায়ের সময় এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে। সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম; এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম। এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল: প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়— অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল। মানুষ সর্বদা যদি মানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো— (স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে), অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো, পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে, সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি যেমন সে প্রায়শই করে, পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা, অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে। চার্বাক প্রভৃতি— ‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়, মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়। তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’ ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল, চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর; অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা— অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর। সমুদ্রতীরে পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব। এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের আলোর পথে এসে জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে। এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে; তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।
জীবনানন্দ দাশ
শঙ্খমালা জীবনানন্দ দাশ কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে, বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্নায়— সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক জোনাকির দেহ হতে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে— ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে। দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা: সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা— বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর, শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর। কড়ির মতন শাদা মুখ তার, দুইখানা হাত তার হিম; চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে-আগুনে হায়। চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার; স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার; এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।
জীবনানন্দ দাশ
শব জীবনানন্দ দাশ যেখানে রুপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর, যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর; যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায় সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়; নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ; কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল বিকেলের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী রাঙা মেঘ— হলুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি; অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো; লাল নীল মাছ মেঘ— ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব ভাসিতেছে চিরদিন: নীল লাল রুপালি নীরব।
জীবনানন্দ দাশ
শিকার জীবনানন্দ দাশ ভোর; আকাশের রং ঘাসফড়িঙের দেহের মতো কোমল নীল: চারিদিকের পেয়ারা ও নোনার গাছ টিয়ার পালকের মতো সবুজ। একটি তারা এখনও আকাশে রয়েছে: পাড়াগাঁর বাসরঘরে সব চেয়ে গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো; কিংবা মিশরের মানুষী তার বুকের থেকে যে-মুক্তা আমার নীল মদের গেলাসে রেখেছিলো হাজার-হাজার বছর আগে এক রাতে— তেম্নি— তেম্নি একটি তারা আকাশে জ্বলছে এখনও। হিমের রাতে শরীর ‘উম্’ রাখবার জন্য দেশোয়ালীরা সারারাত মাঠে আগুন জ্বেলেছে— মোরগ ফুলের মতো লাল আগুন; শুকনো অশ্বত্থপাতা দুমড়ে এখনও আগুন জ্বলছে তাদের; সূর্যের আলোয় তার রং কুঙ্কুমের মতো নেই আর; হ’য়ে গেছে রোগা শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো। সকালের আলোয় টলমল শিশিরে চারিদিকের বন ও আকাশ ময়ূরের সবুজ নীল ডানার মতো ঝিলমিল করছে। ভোর; সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে নক্ষত্রহীন, মেহগনির মতো অন্ধকারে সুন্দরীর বন থেকে অর্জুনের বনে ঘুরে-ঘুরে সুন্দর বাদামী হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করছিলো। এসেছে সে ভোরের আলোয় নেমে; কচি বাতাবী লেবুর মতো সবুজ সুগন্ধি ঘাস ছিঁড়ে-ছিঁড়ে খাচ্ছে; নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামলো— ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের মতো একটা আবেগ দেওয়ার জন্য; অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মতো একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য; এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মতে জেগে উঠে সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য। একটা অদ্ভুত শব্দ। নদীর জল মচকাফুলের পাপড়ির মতো লাল। আগুন জ্বললো আবার— উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হ’য়ে এলো। নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় ব’সে অনেক পুরানো শিশিরভেজা গল্প; সিগারেটের ধোঁয়া; টেরিকাটা কয়েকটা মহিষের মাথা; এলোমেলো কয়েকট বন্দুক— হিম– নিঃস্পন্দ নিরপরাধ ঘুম।
জীবনানন্দ দাশ
সিন্ধুসারস জীবনানন্দ দাশ দু-এক মুহূর্ত শুধু রৌদ্রের সিন্ধুর কোলে তুমি আর আমি হে সিন্ধুসারস, মালাবার পাহাড়ের কোল ছেড়ে অতি দূর তরঙ্গের জানালায় নামি নাচিতেছ টারান্‌টেলা— রহস্যের; আমি এই সমুদ্রের পারে চুপে থামি চেয়ে দেখি বরফের মতো শাদা ডানা দুটি আকাশের গায় ধবল ফেনার মতো নেচে উঠে পৃথিবীরে আনন্দ জানায়। মুছে যায় পাহাড়ের শিঙে-শিঙে গৃধিনীর অন্ধকার গান, আবার ফুরায় রাত্রি, হতাশ্বাস; আবার তোমার গান করিছে নির্মাণ নতুন সমুদ্র এক, শাদা রৌদ্র, সবুজ ঘাসের মতো প্রাণ পৃথিবীর ক্লান্ত বুকে; আবার তোমার গান শৈলের গহ্বর থেকে অন্ধকার তরঙ্গেরে করিছে আহ্বান। জানো কি অনেক যুগ চ’লে গেছে? ম’রে গেছে অনেক নৃপতি? অনেক সোনার ধান ঝ’রে গেছে জানো না কি? অনেক গহন ক্ষতি আমাদের ক্লান্ত ক’রে দিয়ে গেছে— হারায়েছি আনন্দের গতি; ইচ্ছা, চিন্তা, স্বপ্ন, ব্যথা, ভবিষ্যৎ, বর্তমান— এই বর্তমান হৃদয়ে বিরস গান গাহিতেছে আমাদের— বেদনার আমরা সন্তান? জানি পাখি, শাদা পাখি, মালাবার ফেনার সন্তান, তুমি পিছে চাহোনাকো, তোমার অতীত নেই, স্মৃতি নেই, বুকে নেই আকীর্ণ ধূসর পাণ্ডুলিপি; পৃথিবীর পাখিদের মতো নেই শীতরাতে ব্যথা আর কুয়াশার ঘর। যে-রক্ত ঝরেছে তারে স্বপ্নে বেঁধে কল্পনার নিঃসঙ্গ প্রভাত নেই তব; নেই নিম্নভূমি—নেই আনন্দের অন্তরালে প্রশ্ন আর চিন্তার আঘাত। স্বপ্ন তুমি দ্যাখোনি তো— পৃথিবীর সব পথ সব সিন্ধু ছেড়ে দিয়ে একা বিপরীত দ্বীপে দূরে মায়াবীর আরশিতে হয় শুধু দেখা রূপসীর সাথে এক; সন্ধ্যার নদীর ঢেউয়ে আসন্ন গল্পের মতে রেখা প্রাণে তার— ম্লান চুল, চোখ তার হিজল বনের মতো কালো; একবার স্বপ্নে তারে দেখে ফেলে পৃথিবীর সব স্পষ্ট আলো নিভে গেছে; যেখানে সোনার মধু ফুরায়েছে, করে না বুনন মাছি আর; হলুদ পাতার গন্ধে ভ’রে ওঠে অবিচল শালিকের মন, মেঘের দুপুর ভাসে— সোনালি চিলের বুক হয় উন্মন মেঘের দুপুরে, আহা, ধানসিড়ি নদীটির পাশে; সেখানে আকাশে কেউ নেই আর, নেই আর পৃথিবীর ঘাসে; তুমি সেই নিস্তব্ধতা চেনোনাকো; অথবা রক্তের পথে পৃথিবীর ধূলির ভিতরে জানোনাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে; সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে; গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের— ইন্দ্রধনু পরিবার ক্লান্ত আয়োজন হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন। এই সব জানোনাকো প্রবালপঞ্জর ঘিরে ডানার উল্লাসে; রৌদ্রে ঝিলমিল করে শাদা ডান শাদা ফেনা-শিশুদের পাশে হেলিওট্রোপের মতে দুপুরের অসীম আকাশে! ঝিকমিক করে রৌদ্রে বরফের মতো শাদা ডানা, যদিও এ পৃথিবীর স্বপ্ন চিন্তা সব তার অচেনা অজানা। চঞ্চল শরের নীড়ে কবে তুমি— জন্ম তুমি নিয়েছিলে কবে, বিষণ্ণ পৃথিবী ছেড়ে দলে-দলে নেমেছিলে সবে আরব সমুদ্রে, আর চীনের সাগরে— দূর ভারতের সিন্ধুর উৎসবে। শীতার্ত এ-পৃথিবীর আমরণ চেষ্টা ক্লান্তি বিহ্বলতা ছিঁড়ে নেমেছিলে কবে নীল সমুদ্রের নীড়ে। ধানের রসের গল্প পৃথিবীর— পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই– আর তার প্রেমিকের ম্লান নিঃসঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ, জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায় শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।
জীবনানন্দ দাশ
সুবিনয় মুস্তফী জীবনানন্দ দাশ সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে। এক সাথে বেরাল ও বেরালের-মুখে-ধরা-ইঁদুর হাসাতে এমন আশ্চর্য শক্তি ছিলো ভূয়োদর্শী যুবার। ইঁদুরকে খেতে-খেতে শাদা বেরালের ব্যবহার, অথবা টুকরো হ’তে-হ’তে সেই ভারিক্কে ইঁদুর: বৈকুণ্ঠ ও নরকের থেকে তা’রা দুই জনে কতোখানি দূর ভুলে গিয়ে আধে আলো অন্ধকারে হেঁচকা মাটির পৃথিবীতে আরো কিছুদিন বেঁচে কিছুটা আমেজ পেয়ে নিতে কিছুটা সুবিধা ক’রে দিতে যেত— মাটির দরের মতো রেটে; তবুও বেদম হেসে খিল ধ’রে যেত ব’লে বেরালের পেটে ইঁদুর ‘হুর্‌রে’ ব’লে হেসে খুন হ’তো সেই খিল কেটে-কেটে।
জীবনানন্দ দাশ
হাওয়ার রাত জীবনানন্দ দাশ গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল— অসংখ্য নক্ষত্রের রাত; সারা রাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, কখনো বিছানা ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে; এক-একবার মনে হচ্ছিলো আমার–আধো ঘুমের ভিতর হয়তো— মাথার উপরে মশারি নেই আমার, স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে! কাল এমন চমৎকার রাত ছিলো। সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো— আকাশে এক তিল ফাঁক ছিলো না; পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি; অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা; জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ! কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো। যে-নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম'রে গিয়েছে তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে ক’রে এনেছে; যে-রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে, বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি— কাল তারা অতিদূর আকাশের সীমানার কুয়াশায়-কুয়াশায দীর্ঘ বর্শা হাতে ক’রে কাতারে-কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন— মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য? আড়ষ্ট—অভিভূত হয়ে গেছি আমি, কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন; আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল; আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে আমার জানালার ভিতর দিয়ে সাঁই সাঁই ক’রে, সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো। হৃদয় ভ’রে গিযেছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে, মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়। আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেল, নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে, একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে নিযে চললো একটা দুরন্ত শকুনের মতো।
জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর শুধু খেলা করে জীবনানন্দ দাশ হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো: চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ; বালির উপরে জ্যোৎস্না— খেজুর-ছায়ারা ইতস্তত বিচূর্ণ থামের মতো: এশিরিয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান। শরীরে মমির ঘ্রাণ আমাদের— ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন; ‘মনে আছে?’ সুধালো সে— সুধালাম আমি শুধু, ‘বনলতা সেন।’
জীবনানন্দ দাশ
হায় চিল জীবনানন্দ দাশ হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে-উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে! তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে; পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চ’লে গেছে রূপ নিয়ে দূরে; আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।
জীবনানন্দ দাশ
অশ্বত্থ বটের পথে অনেক হয়েছি আমি তোমাদের সাথী; ছড়ায়েছি খই ধান বহুদিন উঠানের শালিখের তরে; সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে গিয়েছি অনেক দিন,—দেখিয়াছি ধূপ জ্বাল, ধর সন্ধ্যাবাতি থোড়ের মতন শাদা ভিজে হাতে,—এখুনি আসিবে কিনা রাতি বিনুনি বেঁধেছ তাই—কাঁচপোকাটিপ তুমি কপালের ’পরে পরিয়াছ...তারপর ঘুমায়েছ: কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে পানের বাটার ’পরে; নোনার মতন নম্র শরীরটি পাতি নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ,—বউকথাকওটির ছানা নীল জামরুল নীড়ে—জ্যোৎস্নায়—ঘুমায়ে রয়েছে যেন, হায়, আর রাত্রি মাতা-পাখিটির মতো ছড়ায়ে রয়েছে তার ডানা।... আজ আমি ক্লান্ত চোখে ব্যবহৃত জীবনের ধূলোয় কাঁটায় চ’লে গেছি বহু দূরে;—দেখ নিকো, বোঝ নিকো, কর নিকো মানা; রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন—পানের বাটায়। ১৩২৬-এর কতকগুলো দিনের স্মরণে
জীবনানন্দ দাশ
অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবনে সঙ্কট শেষ হয়ে গেছে আজ;—চেয়ে দেখ কত শত শতাব্দীর বট হাজার সবুজ পাতা লাল ফল বুকে লয়ে শাখার ব্যজনে আকাঙ্ক্ষার গান গায়—অশ্বত্থেরো কি যেন কামনা জাগে মনে: সতীর শীতল শব বহু দিন কোলে লয়ে যেন অকপট উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে,—চন্দ্রশেখরের মতো তার জট উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদে আজ পুনরাগমনে; মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পারে গৌরী বাংলার এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি—রায়গুণাকর আসিবে না—দেশবন্ধু, আসিয়াছে খরধার পদ্মায় এবার, কালীদহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়, আসিয়াছে চণ্ডীদাস—রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার: শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা: মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর। দেশবন্ধু: ১৩২৬-১০৩২-এর স্মরণে
জীবনানন্দ দাশ
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে ব’সে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে—আসিয়াছে শান্ত অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা—কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে: আমার চোখের ’পরে আমার মুখের ’পরে চুল তার ভাসে; পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখে নিকো—দেখি নাই অত অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে র‍ূপসীর চুলের বিন্যাসে পৃথিবীর কোনো পথে:নরম ধানের গন্ধ—কল্‌মীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত—শীত হাতখান, কিশোরের পায়ে-দলা মুথাঘাস,—লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা—এরি মাঝে বাংলার প্রাণ: আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফাুটে আমি পাই টের।
জীবনানন্দ দাশ
আজ তারা কই সব? ওখানে হিজল গাছ ছিল এক—পুকুরের জলে বহুদিন মুখ দেখে গেছে তার; তারপর কি যে তার মনে হ’ল কবে কখন সে ঝ’রে গেল, কখন ফুরাল, আহা,—চ’লে গেল কবে যে নীরবে, তাও আর জানি নাকো;—ঠোঁট-ভাঙা দাঁড়কাক ঐ বেলগাছটির তলে রোজ ভোরে দেখা দিত—অন্য সব কাক আর শালিখের হৃষ্ট কোলাহলে তারে আর দেখি নাকো—কতদিন দেখি নাই; সে আমার ছেলেবেলা হবে, জানালার কাছে এক বোলতার চাক ছিল—হৃদয়ের গভীর উৎসবে খেলা ক’রে গেছে তারা কত দিন—ফড়িঙ্ কীটের দিন যত দিন চলে তাহারা নিকটে ছিল—রোদের আনন্দে মেতে—অন্ধকারে শান্ত ঘুম খুঁজে বহুদিন কাছে ছিল;—অনেক কুকুর আজ পথে ঘাটে নড়াচড়া করে তবুও আঁধারে ঢের মৃত কুকুরের মুখ—মৃত বিড়ালের ছায়া ভাসে; কোথায় গিয়েছে তারা? অই দূর আকাশের নীল লাল তারার ভিতরে অথবা মাটির বুকে মাটি হয়ে আছে শুধু—ঘাস হয়ে আছে শুধু ঘাসে? শুধালাম ... উত্তর দিল না কেউ উদাসীন অসীম আকাশে।
জীবনানন্দ দাশ
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে—এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়,—হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হ’ব—কিশোরীর—ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে; আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ কর‍ুণ ডাঙায়; হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শ‍ুনিবে এক লক্ষ্মীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশ‍ু এক উঠানের ঘাসে; র‍ূপ্‌সার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়;—রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে—
জীবনানন্দ দাশ
আমাদের রূঢ় কথা শুনে তুমি সরে যাও আরো দূরে বুঝি নীলাকাশ; তোমার অনন্ত নীল সোনালি ভোমরা নিয়ে কোনো দূর শান্তির ভিতরে ডুবে যাবে?... কত কাল কেটে গেল, তবু তার কুয়াশার পর্দা না স’রে পিরামিড্ বেবিলন শেষ হ’ল—ঝ’রে গেল কতবার প্রান্তরের ঘাস; তবুও লুকায়ে আছে যেই রূপ নক্ষত্রে তা’ কোনোদিন হ’ল না প্রকাশ; যেই স্বপ্ন যেই সত্য নিয়ে আজ আমরা চলিয়া যাই ঘরে, কোনো এক অন্ধকারে হয়তো তা’ আকাশের যাযাবর মরালের স্বরে নতুন স্পন্দন পায়—নতুন আগ্রহে গন্ধে ভ’রে ওঠে পৃথিবীর শ্বাস; তখন আমরা অই নক্ষত্রের দিকে চাই—মনে হয় সব অস্পষ্টতা ধীরে ধীরে ঝরিতেছে,—যেই রূপ কোনোদিন দেখি নাই পৃথিবীর পথে, যেই শান্তি মৃত জননীর মতো চেয়ে থাকে—কয় নাকো কথা, যেই স্বপ্ন বার বার নষ্ট হয় আমাদের এই সত্য রক্তের জগতে, আজ যাহা ক্লান্ত ক্ষীণ আজ যাহা নগ্ন চূর্ণ—অন্ধ মৃত হিম, একদিন নক্ষত্রের দেশে তারা হয়ে র’বে গোলাপের মতন রক্তিম৷
জীবনানন্দ দাশ
এ-সব কবিতা আমি যখন লিখেছি ব’সে নিজ মনে একা; চালতার পাতা থেকে টুপ্ টুপু জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির; কুয়াশায় স্থির হয়ে ছিল ম্লান ধানসিড়ি নদীটির তীর; বাদুড় আঁধার ডানা মেলে হিম জ্যোৎস্নায় কাটিয়াছে রেখা আকাঙ্ক্ষার; নিভু দীপ আগলায়ে মনোরমা দিয়ে গেছে দেখা সঙ্গে তার কবেকার মৌমাছির .. কিশোরীর ভিড় আমের বউল দিল শীতরাতে;—আনিল আতার হিম ক্ষীর; মলিন আলোয় আমি তাহাদের দেখিলাম,—এ-কবিতা লেখা তাহাদের ম্লান চুল মনে ক’রে; তাহাদের কড়ির মতন ধূসর হাতের রূপ মনে ক’রে; তাহাদের হৃদয়ের তরে। সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন তাদের হলুদ শাড়ি—ক্ষীর দেহ—তাহাদের অপরূপ মন চ’লে গেছে পৃথিবীর সব চেয়ে শান্ত হিম সান্ত্বনার ঘরে: আমার বিষণ্ণ স্বপ্নে থেকে থেকে তাহাদের ঘুম ভেঙে পড়ে।
জীবনানন্দ দাশ
এই জল ভালো লাগে;—বৃষ্টির রুপালি জল কত দিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ—বুলায়ে দিয়েছে চুল—চোখের উপরে তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,—আবেগের ভরে ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চ’লে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে; এই জল ভালো লাগে;—নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে—বনের ভিতরে বার বার উড়ে যায়,—তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে আমার দেহের ’পরে আমার চোখের ’পরে ধানের আবেশে ঝ’রে পড়ে;—যখন অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ, যখন জামের ডালে পেঁচার নরম হিম গান শোনা যায়, বনের কিনারে ঝরে যেই ধান বুকে ক’রে শান্ত শালি-ক্ষুদ, তেমনি ঝরিছে জল আমার ঠোঁটের ’পরে—চোখের পাতায়— আমার চুলের ’পরে;—অপরাহ্ণে রাঙা রোদ সবুজ আতায় রেখেছে নরম হাত যেন তার—ঢালিছে বুকের থেকে দুধ।
জীবনানন্দ দাশ
এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে। বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে: ছড়ায়ে র’য়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রাণে;— তাদের উপেক্ষা ক’রে কে যাবে বিদেশে বল—আমি কোনো-মতে বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে—উটির পর্বতে যাব নাকো;—দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে কোন্ দেশে,—কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে বিনুনি খসায়ে ব’সে থাকিবার স্বপ্ন আনে;—পৃথিবীর পথে যাব নাকো:অশ্বত্থের ঝরাপাতা ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর, যখন এ-দু’-পহরে কেউ নাই কোনো দিকে—পাখিটিও নাই, অবিরল ঘাস শুধু, ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ’পর, খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দ’-একটা বিষণ্ণ চড়াই, অশ্বত্থের পাতাগুলো পড়ে আছে ম্লান শাদা ধুলোর ভিতর; এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই।
জীবনানন্দ দাশ
এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি—আমি হৃষ্ট কবি আমি এক;—ধুয়েছি আমার দেহ অন্ধকারে একা একা সমুদ্রের জলে; ভালোবাসিয়াছি আমি রাঙা রোদ ক্ষান্ত কার্তিকের মাঠে—ঘাসের আঁচলে ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি;—দেখেছি কিশোরী এসে হলুদ করবী ছিঁড়ে নেয়—বুকে তার লাল-পেড়ে ভিজে শাড়ি করুণ শঙ্খের মতো ছবি ফুটাতেছে;—ভোরের আকাশখানা রাজহাঁস ভ’রে গেছে নব কোলাহলে নব নব সূচনার; নদীর গোলাপী ঢেউ কথা বলে—তবু কথা বলে, তবু জানি তার কথা কুয়াশায় ফুরায় না—কেউ যেন শুনিতেছে সবি কোন্ রাঙা শাটিনের মেঘে ব’সে—অথবা শোনে না কেউ, শূন্য কুয়াশায় মুছে যায় সব তার; একদিন বর্ণচ্ছটা মুছে যাব আমিও এমন; তবু আজ সবুজ ঘাসের ’পরে ব’সে থাকি; ভালোবাসি; প্রেমের আশায় পায়ের ধ্বনির দিকে কান পেতে থাকি চুপে; কাঁটাবহরের ফল করি আহরণ: কারে যেন এইগুলো দেব আমি; মৃদু, ঘাসে একা একা ব’সে থাকা যায় এই সব সাধ নিয়ে; যখন আসিবে ঘুম তারপর, ঘুমাব তখন।
জীবনানন্দ দাশ
এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে—সব চেয়ে সুন্দর করুণ: সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ; সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে,—সেখানে বরুণ কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল; সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল, সেইখানে লক্ষ্মীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ; সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর; সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে; সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর— শঙ্খমালা নাম তার: এ-বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো—বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর, তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।
জীবনানন্দ দাশ
(এই সব ভালো লাগে): জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালি রোদ এসে আমারে ঘুমাতে দেখে বিছানায়, আমার কাতর চোখ, আমার বিমর্ষ ম্লান চুল― এই নিয়ে খেলা করে: জানে সে যে বহুদিন আগে আমি করেছি কি ভুল পৃথিবীর সব চেয়ে ক্ষমাহীন গাঢ় এক রূপসীর মুখ ভালোবেসে; পউষের শেষ রাতে আজো আমি দেখি চেয়ে আবার সে আমাদের দেশে ফিরে এল; রং তার কেমন তা জানে অই টস্‌টসে ভিজে জামরুল, নরম জামের মতো চুল তার, ঘুঘুর বুকের মতো অস্ফুট আঙুল; পউষের শেষ রাতে নিমপেঁচাটির সাথে আসে সে যে ভেসে কবেকার মৃত কাক: পৃথিবীর পথে আজ নাই সে তো আর; তবুও সে ম্লান জানালার পাশে উড়ে আসে নীরব সোহাগে, মলিন পাখনা তার খড়ের চালের হিম শিশিরে মাখায়; তখন এ পৃথিবীতে কোনো পাখি জেগে এসে বসে নি শাখায়; পৃথিবীও নাই আর;―দাঁড়কাক একা একা সারারাত জাগে; ‘কি বা, হায়, আসে যায়, তারে যদি কোনোদিন না পাই আবার।’
জীবনানন্দ দাশ
একদিন এই দেহ ঘাস থেকে ধানের আঘ্রাণ থেকে এই বাংলার জেগেছিল; বাঙালী নারীর মুখ দেখে রূপ চিনেছিল দেহ একদিন; বাংলার পথে পথে হেঁটেছিল গাংচিল শালিখের মতন স্বাধীন; বাংলার জল দিয়ে ধুয়েছিল ঘাসের মতন স্ফুট দেহখানি তার; একদিন দেখেছিল ধূসর বকের সাথে ঘরে চ’লে আসে অন্ধকার বাংলার; কাঁচা কাঠ জ্বলে ওঠে—নীল ধোঁয়া নরম মলিন বাতাসে ভাসিয়া যায় কুয়াশার করুণ নদীর মতো ক্ষীণ; ফেনসা ভাতের গন্ধে আমমুকুলের গন্ধ মিশে যায় যেন বার বার; এই সব দেখেছিল; রূপ যেই স্বপ্ন আনে—স্বপ্নে যেই রক্তাক্ততা আছে, শিখেছিল সেই সব একদিন বাংলার চন্দ্রমালা রূপসীর কাছে; তারপর বেত বনে, জোনাকি ঝিঁঝিঁর পথে হিজল আমের অন্ধকারে ঘুরেছে সে সৌন্দর্যের নীল স্বপ্ন বুকে ক’রে,—রূঢ় কোলাহলে গিয়ে তারে— ঘমন্ত কন্যারে সেই—জাগাতে যায় নি আর—হয়তো সে কন্যার হৃদয় শঙ্খের মতন রুক্ষ, অথবা পদ্মের মতো—ঘুম তবু ভাঙিবার নয়৷
জীবনানন্দ দাশ
একদিন কুয়াশার এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে আর, জানি; হৃদয়ের পথ-চলা শেষ হল সেই দিন—গিয়েছে সে শান্ত হিম ঘরে, অথবা সান্ত্বনা পেতে দেরি হবে কিছু কাল—পৃথিবীর এই মাঠখানি ভুলিতে বিলম্ব হবে কিছু দিন; এ মাঠের কয়েকটা শালিখের তরে আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে র’ব কিছু, কাল অন্ধকার বিছানার কোলে, আর সে সোনালি চিল ডানা মেলে দূর থেকে আজো কি মাঠের কুয়াশায় ভেসে আসে? সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজো চ’লে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে? ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায় সন্ধ্যা হলে? মউমাছি চাক আজো বাঁধে না কি জামের নিবিড় ঘন ডালে, মউ খাওয়া হয়ে গেলে আজো তারা উড়ে যায় কুয়াশায় সন্ধ্যার বাতাসে— কত দূরে যায়, আহা,... অথবা হয়তো কেউ চালতার ঝরাপাতা জালে মধুর চাকের নিচে—মাছিগুলো উড়ে যায় ... ঝ’রে পড়ে... ম’রে থাকে ঘাসে—
জীবনানন্দ দাশ
একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে বিশীর্ণ বটের নিচে শ‍ুয়ে র’ব;—পশমের মতো লাল ফল ঝরিবে বিজন ঘাসে,—বাঁকা চাঁদ জেগে র’বে,—নদীটির জল বাঙালী মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে—তারপর যেই ভাঙা ঘাটে র‍ূপসীরা আজ আর আসে নাকো, পাট শ‍ুধু পচে অবিরল, সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল কাঁদিবে সে সারা রাত,—দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়ে রেখেছে চিতা: বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প—ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে; চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি—শাদা শাঁখা—বাংলার ঘাস আকন্দ বাসকলতা-ঘেরা এক নীল মঠ—আপনার মনে ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;—চারিদিকে এই সব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস—
জীবনানন্দ দাশ
একদিন পৃথিবীর পথে আমি ফলিয়াছি; আমার শরীর নরম ঘাসের পথে হাঁটিয়াছে; বসিয়াছে ঘাসে দেখিয়াছে নক্ষত্রেরা জোনাকিপোকার মতো কৌতুকের অমেয় আকাশে খেলা করে; নদীর জলের গন্ধে ভ’রে যায় ভিজে স্নিগ্ধ তীর অন্ধকারে; পথে পথে শব্দ পাই কাহাদের নরম শাড়ির, ম্লান চুল দেখা যায়; সান্ত্বনার কথা নিয়ে কারা কাছে আসে— ধূসর কড়ির মতো হাতগুলো—নগ্ন হাত সন্ধ্যার বাতাসে দেখা যায়; হলুদ ঘাসের কাছে মরা হিম প্রজাপতিটির সুন্দর করুণ পাখা প’ড়ে আছে—দেখি আমি; চুপে থেমে থাকি; আকাশে কমলা রঙ্ ফুটে ওঠে সন্ধ্যায়—কাকগুলো নীল মনে হয়; অনেক লোকের ভিড়ে ডুবে যাই—কথা কই—হাতে হাত রাখি; করুণ বিষণ্ন চুলে কার যেন কোথাকার গভীর বিস্ময় লুকায়ে রয়েছে বুঝি;... নক্ষত্রের নিচে আমি ঘুমাই একাকী; পেঁচার ধূসর ডানা সারারাত জোনাকির সাথে কথা কয়।
জীবনানন্দ দাশ
একদিন যদি আমি কোনো দূর মান্দ্রাজের সমুদ্রের জলে ফেনার মতন ভাসি শীত রাতে—আসি নাকো তোমাদের মাঝে ফিরে আর—লিচুর পাতার ’পরে বহুদিন সাঁঝে যেই পথে আসা-যাওয়া করিয়াছি,—একদিন নক্ষত্রের তলে কয়েকটা নাটাফল তুলে নিয়ে আনারসী শাড়ির আঁচলে ফিঙার মতন তুমি লঘু চোখে চ’লে যাও জীবনের কাজে, এই শুধু … বেজির পায়ের শব্দ পাতার উপরে যদি বাজে সারারাত … ডানার অস্পষ্ট ছায়া বাদুড়ের ক্লান্ত হয়ে চলে যদি সে-পাতার ’পরে,—শেষ রাতে পৃথিবীর অন্ধকারে শীতে তোমার ক্ষীরের মতো মৃদু দেহ—ধূসর চিবুক, বাম হাত চালতা গাছের পাশে খোড়ো ঘরে স্নিগ্ধ হয়ে ঘুমায় নিভৃতে, তবুও তোমার ঘুম ভেঙে যাবে একদিন চুপে অকস্মাৎ, তুমি যে কড়ির মালা দিয়েছিলে—সে-হার ফিরায়ে দিয়ে দিতে যখন কে এক ছায়া এসেছিল … দরজায় করে নি আঘাত।
জীবনানন্দ দাশ
এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন; আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;—বার বার রোদ তার সুচিক্কণ চুল কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়;—দহে বিলে চঞ্চল আঙুল বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন, ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ; মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল, কবেকার কোকিলের, জান কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়, লিখিতেছিলেন ব’সে দু’-পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল, কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়—থেমে থেমে যায়;— অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধান ক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায় কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল।
জীবনানন্দ দাশ
এখানে ঘুঘুর ডাকে অপরাহ্ণে শান্তি আসে মানুষের মনে; এখানে সবুজ শাখা আঁকাবাঁকা হলুদ পাখিরে রাখে ঢেকে; জামের আড়ালে সেই বউকথাকওটিরে যদি ফেল দেখে একবার,—একবার দু’-পহর অপরাহ্ণে যদি এই ঘুঘুর গুঞ্জনে ধরা দাও,—তাহ’লে অনন্তকাল থাকিতে যে হবে এই বনে; মৌরির গন্ধমাখা ঘাসের শরীরে ক্লান্ত দেহটিরে রেখে আশ্বিনের ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা পোকাদের কাছে ডেকে র’ব আমি;—চকোরীর সাথে যেন চকোরের মতন মিলনে; উঠানে কে রূপবতী খেলা করে—ছড়ায়ে দিতেছে বুঝি ধান শালিখেরে; ঘাস থেকে ঘাসে ঘাসে খুঁটে খুঁটে খেতেছে সে তাই; হলুদ নরম পায়ে খয়েরী শালিখগুলো ডলিছে উঠান; চেয়ে দেখ সুন্দরীরে: গোরোচনা রূপ নিয়ে এসেছে কি রাই! নীলনদে—গাঢ় রৌদ্রে—কবে আমি দেখিয়াছি—করেছিল স্নান—
জীবনানন্দ দাশ
এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায়—সন্ধ্যায় ঘুমায় নীরবে মাটির ভিটের ’পরে—লেগে থাকে অন্ধকার ধুলোর আঘ্রাণ তাহাদের চোখে-মুখে;—কদমের ডালে পেঁচা গেয়ে যায় গান; মনে হয় এক দিন পৃথিবীতে হয়তো এ-জ্যোৎস্না শুধু র’বে, এই শীত র’বে শুধু; রাত্রি ভ’রে এই লক্ষ্মীপেঁচা কথা ক’বে— কাঁঠালের ডাল থেকে হিজলের ডালে গিয়ে করিবে আহ্বান সাপমাসী পোকাটিরে...সেই দিন আঁধারে উঠিবে ন’ড়ে ধান ইঁদুরের ঠোঁটে-চোখে;—বাদুড়ের কালো ডানা করমচা-পল্লবে কুয়াশারে নিঙড়ায়ে উড়ে যাবে আরো দূর নীল কুয়াশায়, কেউ তাহা দেখিবে না;—সেদিন এ-পাড়াগাঁর পথের বিস্ময় দেখিতে পাব না আর—ঘুমায়ে রহিবে সব:যেমন ঘুমায় আজ রাতে মৃত যারা; যেমন হতেছে ঘুমে ক্ষয় অশ্বত্থ ঝাউয়ের পাতা চুপে চুপে আজ রাতে, হায়; যেমন ঘুমায় মৃতা,—তাহার বুকের শাড়ি যেমন ঘুমায়।
জীবনানন্দ দাশ
কখন সোনার রোদ নিভে গেছে—অবিরল শুপুরির সারি আঁধারে যেতেছে ডুবে—প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ-অন্ধকারে ফেলিতেছে শ্বাস; কোন চৈত্রে চ’লে গেছে সেই মেয়ে—আসিবে না, ক’রে গেছে আড়ি: ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে—তাহার শরীর থেকে শ্বাস ঝ’রে গেছে ব’লে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ, কোথাও সে নাই আর—পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি? এই মাঠে—এই ঘাসে—ফল্‌সা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে আজো তার; যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক—দুপুরের রোদে সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি—অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে, তাহার দু’এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে পৃথিবীর রাঙা রোদ চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে— জানি সে আমার কাছে আছে আজো—আজো সে আমার কাছে আছে!
জীবনানন্দ দাশ
কত দিন তুমি আর আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে;—সন্ধ্যায় ধূসর সজল মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে—বাদুড় কেবল করিতেছে আসা-যাওয়া আকাশের মৃদু পথে;—ছিন্ন ভিজে খড় বুকে নিয়ে সনকার মতো যেন প’ড়ে আছে নরম প্রান্তর; বাঁকা চাঁদ চেয়ে আছে;—কুয়াশায় গা ভাসায়ে দেয় অবিরল নিঃশব্দ গুবরে-পোকা—সাপমাসী—ধানী শ্যামাপোকাদের দল; দিকে দিকে চাল-ধোয়া গন্ধ মৃদু—ধূসর শাড়ির ক্ষীণ স্বর শোনা যায়;—মানুষের হৃদয়ের পুরোনো নীরব বেদনার গন্ধ ভাসে;—খড়ের চালের নিচে তুমি আর আমি কত দিন মলিন আলোয় ব’সে দেখেছি বুঝেছি এই সব; সময়ের হাত থেকে ছুটি পেয়ে স্বপনের গোধূলিতে নামি খড়ের চালের নিচে মুখোমুখি বসে থেকে তুমি আর আমি ধূসর আলোয় ব’সে কত দিন দেখেছি বুঝেছি এই সব।
জীবনানন্দ দাশ
কত দিন সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়াছি আমরা দু’জনে; আকাশপ্রদীপ জ্বেলে তখন কাহারা যেন কার্তিকের মাস সাজায়েছে,—মাঠ থেকে গাজন গানের ম্লান ধোঁয়াটে উচ্ছ্বাস ভেসে আসে;—ডানা তুলে সাপমাসী উড়ে যায় আপনার মনে আকন্দ বনের দিকে;—একদল দাঁড়কাক ম্লান গুঞ্জরণে নাটার মতন রাঙা মেঘ নিঙড়ায়ে নিয়ে সন্ধ্যার আকাশ দু’মুহূর্ত ভ’রে রাখে—তারপর মৌরির গন্ধমাখা ঘাস প’ড়ে থাকে; লক্ষ্মীপেঁচা ডাল থেকে ডালে শুধু, উড়ে চলে বনে আধ-ফোটা জ্যোৎস্নায়; তখন ঘাসের পাশে কত দিন তুমি হলুদ শাড়িটি বুকে অন্ধকারে ফিঙ্গার পাখনার মতো বসেছ আমার কাছে এইখানে—আসিয়াছে শটিবন চুমি গভীর আঁধার আরো—দেখিয়াছি বাদুড়ের মৃদু অবিরত আসা-যাওয়া আমরা দু’জনে ব’সে—বলিয়াছি ছেঁড়াফাঁড়া কত মাঠ ও চাঁদের কথা:ম্লান চোখে একদিন সব শুনেছ তো।
জীবনানন্দ দাশ
কত ভোরে—দু’-পহরে—সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন বাতাসে কাঁপিছে ধীরে;—খাঁচার শুকের মতো গাহিতেছে গান কোন এক রাজকন্যা—পরনে ঘাসের শাড়ি—কালো চুল ধান বাংলার শালিধান—আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ, হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার—ঘুম নাই, নাইকো মরণ তার আর কোনোদিন—পালঙ্কে সে শোয় নাকো, হয় নাকো ম্লান, লক্ষ্মীপেঁচা শ্যামা আর শালিখের গানে তারে জাগিতেছে প্রাণ সারাদিন—সারারাত বুকে ক’রে আছে তার শুপুরির বন; সকালে কাকের ডাকে আলো আসে, চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক সবুজ জঙ্গল ছেয়ে শুপুরির—শ্রীমন্তও দেখেছে এমন: যখন ময়ূরপঙ্খী ভোরের সিন্ধুর মেঘে হয়েছে অবাক, সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার শুপুরির বন দেখিয়াছে—অকস্মাৎ গাঢ় নীল; করুণ কাকের ক্লান্ত ডাক শুনিয়াছে—সে কত শতাব্দী আগে ডেকেছিল তাহারা যখন।
জীবনানন্দ দাশ
কোথাও চলিয়া যাব একদিন;—তারপর রাত্রির আকাশ অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি; জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস বুকে নিয়ে তাহাদের;—জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে— কাঁঠাল শাখার থেকে নামি পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী ধানী শাল পশমিনা বুকে তার —শরতের রোদের বিলাস কতো কাল নিঙড়াবে;—আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু; আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু মুখে গুজে পড়ে রবে—আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি; মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু—
জীবনানন্দ দাশ
কোথাও দেখি নি, আহা, এমন বিজন ঘাস—প্রান্তরের পারে নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে—নীল বুকে আছে তাহাদের গঙ্গাফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের, হিজলের ক্লান্ত পাতা—বটের অজস্র ফল ঝরে বারে বারে তাহাদের শ্যাম বুকে;—পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে বেতের নরম ফল, নাটাফল খেতে আসে, ধুন্দুল বীজের খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে,—বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের শালিখ খঞ্জনা তাহা;—লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারে নরম কান্তারে এই পাড়াগাঁর বুকে শ‍ুয়ে সে কোন দিনের কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শ‍ুকায় নি, মজে নি আকাশ, বল্লাল সেনের ঘোড়া—ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের শব্দ হ’ত এই পথে—আরো আগে রাজপুত্র কত দিন রাশ টেনে টেনে এই পথে—কি যেন খুঁজেছে, আহা, হয়েছে উদাস; আজ আর খোঁজাখুঁজি নাই কিছু—নাটাফলে মিটিতেছে আশ—
জীবনানন্দ দাশ
কোথাও মঠের কাছে—যেইখানে ভাঙা মঠ নীল হয়ে আছে শ্যাওলায়—অনেক গভীর ঘাস জমে গেছে বুকের ভিতর, পাশে দীঘি মজে আছে—রূপালি মাছের কণ্ঠে কামনার স্বর যেইখানে পাটরানী আর তার রূপসী সখীরা শুনিয়াছে বহু—বহু দিন আগে;—যেইখানে শঙ্খমালা কাঁথা বুনিয়াছে সে কত শতাব্দী আগে মাছরাঙা-ঝিলমিল;—কড়ি-খেলা ঘর; কোন্ যেন কুহকীর ঝাড়ফুঁকে ডুবে গেছে সব তারপর; একদিন আমি যাব দু’-পহরে সেই দূর প্রান্তরের কাছে, সেখানে মানুষে কেউ যায় নাকো—দেখা যায় বাঘিনীর ডোরা বেতের বনের ফাঁকে,—জারুল গাছের তলে রৌদ্র পোহায় রূপসী মৃগীর মুখে দেখা যায়,—শাদা ভাঁটপুষ্পের তোড়া আলোকলতার পাশে গন্ধ ঢালে দ্রোণ ফুল বাসকের গায়; তবুও সেখানে আমি নিয়ে যাব এক দিন পাট্‌কিলে ঘোড়া, যার রূপ জন্মে জন্মে কাঁদায়েছে আমি তারে খুঁজিব সেথায়৷
জীবনানন্দ দাশ
কোনোদিন দেখিব না তারে আমি; হেমন্তে পাকিবে ধান, আষাঢ়ের রাতে কালো মেঘ নিঙড়ায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান সারারাত,—তবু আমি সাপচরা অন্ধ পথে—বেণুবনে তাহার সন্ধান পাব নাকো: পুকুরের পাড়ে সে যে আসিবে না কোনোদিন হাঁসিনের সাথে, সে কোনো জ্যোৎস্নায় আর আসিবে না—আসিবে না কখনো প্রভাতে, যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান, যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান, ধূসর সন্ধ্যায় সেই আসিবে না সে এখানে;—এইখানে ধুন্দুল লতাতে জোনাকি আসিবে শুধু; ঝিঁঝিঁ শব্দ সারারাত কথা ক’বে ঘাসে আর ঘাসে; বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে; প্রতিটি নক্ষত্র তার স্থান খুঁজে জেগে র’বে প্রতিটির পাশে নীরব ধূসর কণা লেগে র’বে তুচ্ছ অণুকণাটির শ্বাসে অন্ধকারে;—তুমি, সখি, চ’লে গেলে দূরে তবু;—হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে অশ্বত্থের শাখা ঐ দুলিতেছে: আলো আসে, ভোর হয়ে আসে।
জীবনানন্দ দাশ
খুঁজে তারে মর মিছে—পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর; রয়েছে অনেক কাক এ-উঠানে—তব, সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক নাই আর;—অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক দাঁড়কাক দেখা যেত দিন রাত,—সে আমার ছেলেবেলাকার কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার: রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক,— এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হ’ল তার কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে ক’রে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস, সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্লান চুল, ভিজে শাদা হাত সেই সব নোনা গাছ, করমচা, শামুক, গুগলি, কচি তালশাঁস, সেই সব ভিজে ধূলো, বেলকুঁড়ি-ছাওয়া পথ—ধোঁয়াওঠা ভাত, কোথায় গিয়েছে সব?—অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ ভোর রাতে—নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত!
জীবনানন্দ দাশ
গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায় উড়ে যায়—মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে; পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার বার চায় যে জড়াতে করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়; এক-একটি ইঁট ধ্বসে—ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায় ভাঙা ঘাটলায় এই—আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে বিনুনি খসায় নাকো—শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে; কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়; ডাইনীর মতো হাত তুলে তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো,—বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে; পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নাই আমি, হায়, এমন বিজন শাদা পথ—সোঁদা পথ—বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে চ’লে গেছে—শ্মশানের পায়ে বুঝি;—সন্ধ্যা আসে সহসা কখন; সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম—নিম—নিম কার্তিকের চাঁদে।
জীবনানন্দ দাশ
ঘাসের বুকের থেকে কবে আমি পেয়েছি যে আমার শরীর— সবুজ ঘাসের থেকে; তাই রোদ ভালো লাগে—তাই নীলাকাশ মৃদু ভিজে সকরুণ মনে হয়;—পথে পথে তাই এই ঘাস জলের মতন স্নিগ্ধ মনে হয়;—মউমাছিদের যেন নীড় এই ঘাস;—যত দূর যাই আমি আরো যত দূর পৃথিবীর নরম পায়ের তলে যেন কত কুমারীর বুকের নিঃশ্বাস কথা কয়—তাহাদের শান্ত হাত খেলা করে—তাদের খোঁপার এলো ফাঁস খুলে যায়—ধূসর শাড়ির গন্ধে আসে তারা—অনেক নিবিড় পুরোনো প্রাণের কথা কয়ে যায়—হৃদয়ের বেদনার কথা— সান্ত্বনার নিভৃত নরম কথা—মাঠের চাঁদের গল্প করে— আকাশের নক্ষত্রের কথা কয়;—শিশিরের শীত সরলতা তাহাদের ভালো লাগে,—কুয়াশারে ভালো লাগে চোখের উপরে; গরম বৃষ্টির ফোঁটা ভালো লাগে; শীত রাতে—পেঁচার নম্রতা; ভালো লাগে এই যে অশ্বত্থপাতা আমপাতা সারা রাত ঝরে।
জীবনানন্দ দাশ
ঘাসের ভিতরে যেই চড়ায়ের শাদা ডিম ভেঙে আছে—আমি ভালোবাসি নিস্তব্ধ করুণ মুখ তার এই—কবে যেন ভেঙেছিল—ঢের ধূলো খড় লেগে আছে বুকে তার—বহুক্ষণ চেয়ে থাকি;—তারপর ঘাসের ভিতর শাদা শাদা ধূলোগুলো প’ড়ে আছে, দেখা যায়; খইধান দেখি একরাশি ছড়ায়ে রয়েছে চুপে; নরম বিষণ্ন গন্ধ পুকুরের জল থেকে উঠিতেছে ভাসি; কান পেতে থাক যদি, শোনা যায়, সরপুঁটি চিতলের উদ্ভাসিত স্বর মীনকন্যাদের মতো; সবুজ জলের ফাঁকে তাদের পাতালপুরী ঘর দেখা যায়—রহস্যের কুয়াশায় অপরূপ—রূপালি মাছের দেহ গভীর উদাসী চ’লে যায় মন্ত্রিকুমারের মতো, কোটাল-ছেলের মতো, রাজার ছেলের মতো মিলে কোন্ এক আকাঙ্ক্ষার উদ্ঘাটনে কত দূরে;—বহুক্ষণ চেয়ে থাকি একা; অপরাহ্ণ এল বুঝি?—রাঙা রৌদ্রে মাছরাঙা উড়ে যায়—ডানা ঝিলমিলে; এখুনি আসিবে সন্ধ্যা,—পৃথিবীতে ম্রিয়মাণ গোধূলি নামিলে নদীর নরম মুখ দেখা যাবে—মুখে তার দেহে তার কত মৃদু, রেখা তোমারি মুখের মতো:তবুও তোমার সাথে কোনোদিন হবে নাকো দেখা।
জীবনানন্দ দাশ
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে; তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা—আমার তরুণ দিন তখনো হয় নি শেষ—সেই ভালো—ঘুম আসে—বাংলার তৃণ আমার বুকের নিচে চোখ বুজে—বাংলার আমের পাতাতে কাঁচপোকা ঘুমায়েছে—আমিও ঘুমায়ে র’ব তাহাদের সাথে, ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে—এই ঘাসে—কথাভাষাহীন আমার প্রাণের গল্প ধীরে ধীরে মুছে যাবে—অনেক নবীন নতুন উৎসব র’বে উজানের—জীবনের মধুর আঘাতে তোমাদের ব্যস্ত মনে;—তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চ’লে যাবে—যখন মানিকমালা ভোরে লাল লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে— যখন হলুদ বোঁটা শেফালীর কোনো এক নরম শরতে ঝরিবে ঘাসের ’পরে,—শালিখ খঞ্জনা আজ কতদূর ওড়ে— কতখানি রোদ—মেঘ—টের পাব শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে৷
জীবনানন্দ দাশ
ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে শিয়রে বৈশাখ মেঘ—শাদা শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড় নদীর ওপার থেকে চেয়ে র’বে—কোনো এক শঙ্খবালিকার ধূসর র‍ূপের কথা মনে হবে—এই আম জামের ছায়াতে কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি—কবে যেন রাখিয়াছে হাতে তার হাত—কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড় ঝ’রে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন—এই পাড়াগাঁর পথে তবু, তিন শো বছর আগে হয়তো বা—আমি তার সাথে কাটায়েছি;—পাঁচ শো বছর আগে হয়তো বা—সাত শো বছর কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে; ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে মাঠে কত বার কুড়ালাম খড়, বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে, ভাসানের গান শ‍ুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হ’ল খড় আর ঘর।
জীবনানন্দ দাশ
জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে—আর এই বাংলার ঘাস র’বে বুকে; এই ঘাস: সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়— ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চ’লে যায়— এই ঘাস: এরি নিচে কঙ্কাবতী শঙ্খমালা করিতেছে বাস: তাদের দেহের গন্ধ, চাঁপাফুল মাখা ম্লান চুলের বিন্যাস ঘাস আজো ঢেকে আছে; যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায় কার্তিকের অপরাহ্ণে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চ’লে যায় হাঁস, আমি এ ঘাসের বুকে শ‍ুয়ে থাকি—শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে সোঁদা ধুলো শ‍ুয়ে আছে—কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে ভেরেণ্‍ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে—শাদা স্তন ঝরে করবীর: কোন্ এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল, তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে: নরম ব্যাকুল৷
জীবনানন্দ দাশ
তবু তাহা ভুল জানি … রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা; তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ়— আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, আরো ঢের জল, জয় আরো; তোমারো পৃথিবী পথ; নক্ষত্রের সাথে তুমি খেলিতেছ পাশা: শঙ্খমালা নয় শুধু:অনুরাধা রোহিণীরও চাও ভালোবাসা, না জানি সে কত আশা—কত ভালোবাসা তুমি বাসিতে যে পার! এখানে নদীর ধারে বাসমতী ধানগুলো ঝরিছে আবারো; প্রান্তরের কুয়াশায় এইখানে বাদুড়ের যাওয়া আর আসা— এসেছে সন্ধ্যার কাক ঘরে ফিরে;—দাঁড়ায়ে রয়েছে জীর্ণ মঠ; মাঠের আঁধার পথে শিশু কাঁদে—লালপেড়ে পুরোনো শাড়ির ছবিটি মুছিয়া যায় ধীরে ধীরে—কে এসেছে আমার নিকট? ‘কার শিশু? বল তুমি’:শুধালাম; উত্তর দিল না কিছু বট; কেউ নাই কোনোদিকে—মাঠে পথে কুয়াশার ভিড়; তোমারে শুধাই কবি: ‘তুমিও কি জান কিছু, এই শিশুটির।’
জীবনানন্দ দাশ
তুমি কেন বহু দূরে—ঢের দূরে—আরো দূরে—নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ, তুমি কেন কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বল নাকো একটিও কথা; আমরা মিনার গড়ি—ভেঙে পড়ে দু’-দিনেই—স্বপনের ডানা ছিঁড়ে ব্যথা রক্ত হয়ে ঝরে শুধু এইখানে—ক্ষুধা হয়ে ব্যথা দেয়—নীল নাভিশ্বাস ফেনায়ে তুলিছে শুধু পৃথিবীতে পিরামিড্-যুগ থেকে আজো বারোমাস; আমাদের সত্য, আহা, রক্ত হয়ে ঝরে শুধু;—আমাদের প্রাণের মমতা ফড়িঙের ডানা নিয়ে ওড়ে, আহা: চেয়ে দেখে অন্ধকার কঠিন ক্ষমতা ক্ষমাহীন—বার বার পথ আটকায়ে ফেলে—বার বার করে তারে গ্রাস; তারপরে চোখ তুলে দেখি অই কোন্ দূর নক্ষত্রের ক্লান্ত আয়োজন ক্লান্তিরে ভুলিতে বলে—ঘিয়ের সোনার-দীপে লাল নীল শিখা জ্বলিতেছে যেন দূরে রহস্যের কুয়াশায়,— আবার স্বপ্নের গন্ধে মন কেঁদে ওঠে;—তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রু, ক্লান্তি রক্তের কণিকা ঝরে শুধু—স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ—নিউসিডিয়ায় বসে দেখেনি মণিকা? স্বপ্ন কি দেখেনি রোম, এশিরিয়া, উজ্জয়িনী, গৌড়-বাংলা, দিল্লী, বেবিলন?
জীবনানন্দ দাশ
তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও―আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরী ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে―একবার―দুইবার―তারপর হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে; দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ―শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে শঙ্খের মতো কাঁদে; সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে, খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন কাহিনীর দেশে― ‘পরণ-কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে, কল্‌মীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে― নীরবে পা ধোয় জলে একবার―তারপর দূরে নির‍ুদ্দেশে চ’লে যায় কুয়াশায়,―তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে হারাব না তারে আমি―সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।
জীবনানন্দ দাশ
তোমার বুকের থেকে একদিন চ’লে যাবে তোমার সন্তান বাংলার বুকে ছেড়ে চ’লে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে, আকাশের নীলাভ নরম বুকে ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে ডুবে যায়,—কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে দিকে রূপশালী ধান একদিন;—হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান, আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে— হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্ক্ষার—তবুও তো চোখের উপরে নীল মৃত্যু উজাগর—বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ— কখন মরণ আসে কে বা জানে—কালীদহে কখন যে ঝড় কমলের নাল ভাঙে—ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিখের প্রাণ জানি নাকো;—তবু যেন মরি আমি এই মাঠ-ঘাটের ভিতর, কৃষ্ণা যমুনার নয়—যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ লেগে থাকে চোখে মুখে—রূপসী বাংলা যেন বুকের উপর জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।
জীবনানন্দ দাশ
দূর পৃথিবীর গন্ধে ভ’রে ওঠে আমার এ বাঙালীর মন আজ রাতে; একদিন মৃত্যু এসে যদি দূর নক্ষত্রের তলে অচেনা ঘাসের বুকে আমারে ঘুমায়ে যেতে বলে, তবুও সে ঘাস এই বাংলার অবিরল ঘাসের মতন মউরির মৃদু গন্ধে ভ’রে র’বে;―কিশোরীর স্তন প্রথম জননী হয়ে যেমন ননীর ঢেউয়ে গলে পৃথিবীর সব দেশে―সব চেয়ে ঢের দূর নক্ষত্রের তলে সব পথে এই সব শান্তি আছে: ঘাস―চোখ―শাদা হাত―স্তন― কোথাও আসিবে মৃত্যু―কোথাও সবুজ মৃদু ঘাস আমারে রাখিবে ঢেকে―ভোরে, রাতে, দু’-পহরে পাখির হৃদয় ঘাসের মতন সাধে ছেয়ে র’বে―রাতের আকাশ নক্ষত্রের নীল ফুলে ফুটে র’বে;―বাংলার নক্ষত্র কি নয়? জানি নাকো; তবুও তাদের বুকে স্থির শান্তি―শান্তি লেগে রয়: আকাশের বুকে তারা যেন চোখ―শাদা হাত―যেন স্তন―ঘাস―।
জীবনানন্দ দাশ
পাড়াগাঁর দু’-পহর ভালোবাসি—রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে স্বপনের;—কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাঁধিয়াছে ঘর আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো—কেবল প্রান্তর জানে তাহা, আর ঐ প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে যেন এ-জনমে নয়—যেন ঢের যুগ ধ’রে কথা শিখিয়াছে এ-হৃদয়—স্বপ্নে যে-বেদনা আছে: শুষ্ক পাতা—শালিখের স্বর, ভাঙা মঠ—নক্সাপেড়ে শাড়িখানা মেয়েটির রৌদ্রের ভিতর হলুদ পাতার মতো স’রে যায়, জলসিড়িটির পাশে ঘাসে শাখাগুলো নুয়ে আছে বহু দিন ছন্দোহীন বুনো চালতার: জলে তার মুখখানা দেখা যায়—ডিঙিও ভাসিছে কার জলে, মালিক কোথাও নাই, কোনোদিন এই দিকে আসিবে না আর, ঝাঁঝরা ফোঁপরা, আহা, ডিঙিটিরে বেঁধে রেখে গিয়েছে হিজলে পাড়াগাঁর দু’পহর ভালোবাসি—রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার গন্ধ লেগে আছে, আহা, কেঁদে কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে৷
জীবনানন্দ দাশ
পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোনখানে সফলতা শক্তির ভিতর, কোনখানে আকাশের গায়ে র‍ূঢ় মনুমেণ্ট উঠিতেছে জেগে, কোথায় মাস্তুল তুলে জাহাজের ভিড় সব লেগে আছে মেঘে, জানি নাকো;―আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাঁধিয়াছি ঘর: সন্ধ্যায় যে দাঁড়কাক উড়ে যায় তালবনে―মুখে দু’টো খড় নিয়ে যায়―সকালে যে নিমপাখি উড়ে আসে কাতর আবেগে নীল তেঁতুলের বনে―তেমনি করুণা এক বুকে আছে লেগে; বঁইচির বনে আমি জোনাকির র‍ূপ দেখে হয়েছি কাতর; কদমের ডালে আমি শ‍ুনেছি যে লক্ষ্মীপেঁচা গেয়ে গেছে গান নিশ‍ুতি জ্যোৎস্নার রাতে,―টুপ্ টুপ্ টুপ্ টুপ্ সারারাত ঝরে শ‍ুনেছি শিশিরগ‍ুলো, ম্লান মুখে গড় এসে করেছে আহ্বান ভাঙা সোঁদা ইঁটগ‍ুলো,―তারি বুকে নদী এসে কি কথা মর্মরে; কেউ নাই কোনোদিকে―তবু যদি জ্যোৎস্নায় পেতে থাক কান শ‍ুনিবে বাতাসে শব্দ: ‘ঘোড়া চ’ড়ে কই যাও হে রায়রায়ান―’
জীবনানন্দ দাশ
পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন বাস ক’রে হৃদয়ের নরম কাতর অনেক নিভৃত কথা জানিয়াছি; পৃথিবীতে আমি বহুদিন কাটায়েছি; বনে বনে ডালপালা উড়িতেছে—যেন পরী জিন্ কথা কয়; ধূসর সন্ধ্যায় আমি ইহাদের শরীরের ’পর খইয়ের ধানের মতো দেখিয়াছি ঝরে ঝর্ ঝর্ দু’-ফোঁটা মাঘের বৃষ্টি,—শাদা ধুলো জলে ভিজে হয়েছে মলিন, ম্লান গন্ধ মাঠে ক্ষেতে—গুবরে পোকার তুচ্ছ বুক থেকে ক্ষীণ অস্পষ্ট করুণ শব্দ ডুবিতেছে অন্ধকারে নদীর ভিতর: এই সব দেখিয়াছি; দেখিয়াছি নদীটিরে—মজিতেছে ঢালু, অন্ধকারে; সাপমাসী উড়ে যায়; দাঁড়কাক অশ্বত্থের নীড়ের ভিতর পাখ্‌নার শব্দ করে অবিরাম; কুয়াশায় একাকী মাঠের ঐ ধারে কে যেন দাঁড়ায়ে আছে: আরো দূরে দু’-একটা স্তব্ধ খোড়ো ঘর প’ড়ে আছে; খাগড়ার বনে ব্যাং ডাকে কেন—থামিতে কি পারে; (কাকের তরুণ ডিম পিছলায়ে প’ড়ে যায় শ্যাওড়ার ঝাড়ে।)
জীবনানন্দ দাশ
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর র‍ূপ খুঁজিতে যাই না আর: অন্ধকারে জৈগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড় পাতাটির নিচে ব’সে আছে ভোরের দয়েলপাখি―চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ জাম―বট―কাঁঠালের―হিজলের―অশথের ক’রে আছে চুপ; ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে; মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে এমনই হিজল―বট―তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিল; বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে― কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়― সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়, শ্যামার নরম গান শ‍ুনেছিল,―একদিন অমরায় গিয়ে ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায় বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।
জীবনানন্দ দাশ
বাতাসে ধানের শব্দ শুনিয়াছি—ঝরিতেছে ধীরে ধীরে অপরাহ্ণ ভ’রে; সোনালি রোদের রং দেখিয়াছি—দেহের প্রথম কোন্ প্রেমের মতন রূপ তার—এলোচুল ছড়ায়ে রেখেছে ঢেকে গূঢ় রূপ—আনারস বন; ঘাস আমি দেখিয়াছি; দেখেছি সজনে ফুল চুপে চুপে পড়িতেছে ঝ’রে মৃদু ঘাসে; শান্তি পায়; দেখেছি হলুদ পাখি বহুক্ষণ থাকে চুপ ক’রে, নির্জন আমের ডালে দুলে যায়—দলে যায়—বাতাসের সাথে বহু ক্ষণ; শুধু কথা, গান নয়—নীরবতা রচিতেছে আমাদের সবার জীবন বুঝিয়াছি: শুপুরির সারিগুলো দিনরাত হাওয়ায় যে উঠিতেছে ন’ড়ে, দিনরাত কথা কয়, ক্ষীরের মতন ফুল বুকে ধরে, তাদের উৎসব ফুরায় না; মাছরাঙাটির সাথী ম’রে গেছে—দুপুরের নিঃসঙ্গ বাতাসে তবু ঐ পাখিটির নীল লাল কমলা রঙের ডানা স্ফুট হয়ে ভাসে আম নিম জামরুলে; প্রসন্ন প্রাণের স্রোত—অশ্রু নাই—প্রশ্ন নাই কিছু, ঝিলমিল ডানা নিয়ে উড়ে যায় আকাশের থেকে দূর আকাশের পিছু; চেয়ে দেখি ঘুম নাই—অশ্রু নাই—প্রশ্ন নাই বটফলগন্ধ-মাখা ঘাসে৷
জীবনানন্দ দাশ
ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর—চিল একা নদীটির পাশে জারুল গাছের ডালে ব’সে ব’সে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে; পায়রা গিয়েছে উড়ে চবুতরে, খোপে তার;—শসালতাটিকে ছেড়ে গেছে মৌমাছি;—কালো মেঘ জমিয়াছে মাঘের আকাশে, মরা প্রজাপতিটির পাখার নরম রেণু, ফেলে দিয়ে ঘাসে পিঁপড়েরা চ’লে যায়;—দুই দণ্ড আম গাছে শালিখে শালিখে ঝুটোপুটি, কোলাহল—বউকথাকও আর রাঙা বউটিকে ডাকে নাকো—হলুদ পাখনা তার কোন্ যেন কাঁঠালে পলাশে হারায়েছে; বউও উঠানে নাই—প’ড়ে আছে একখানা ঢেঁকি: ধান কে কুটিবে বল—কত দিন সে তো আর কোটে নাকো ধান, রোদেও শুকাতে সে যে আসে নাকো চুল তার—করে নাকো স্নান এ-পুকুরে—ভাঁড়ারে ধানের বীজ কলায়ে গিয়েছে তার দেখি, তবুও সে আসে নাকো; আজ এ-দুপুরে এসে খই ভাজিবে কি? হে চিল, সোনালি চিল, রাঙা রাজকন্যা আর পাবে না কি প্রাণ?
জীবনানন্দ দাশ
ভেবে ভেবে ব্যথা পাব;—মনে হবে, পৃথিবীর পথে যদি থাকিতাম বেঁচে দেখিতাম সেই লক্ষ্মীপেঁচাটির মুখ যারে কোনোদিন ভালো করে দেখি নাই আমি— এমনি লাজুক পাখি,—ধূসর ডানা কি তার কুয়াশার ঢেউয়ে ওঠে নেচে; যখন সাতটি তারা ফুটে ওঠে অন্ধকারে গাবের নিবিড় বুকে আসে সে কি নামি? জিউলির বাবলার আঁধার গলির ফাঁকে জোনাকির কুহকের আলো ঝরে না কি? ঝিঁঝিঁর সবুজ মাংসে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বউদের প্রাণ ভুলে যায়; অন্ধকারে খুঁজে তারে আকন্দবনের ভিড়ে কোথায় হারালো মাকাল লতার তলে শিশিরের নীল জলে কেউ তার পাবে না সন্ধান। আর সেই সোনালি চিলের ডানা—ডানা তার আজো কি মাঠের কুয়াশায় ভেসে আসে?—সেই ন্যাড়া অশ্বত্থের পানে আজো চ’লে যায় সন্ধ্যা সোনার মতো হলে? ধানের নরম শিষে মেঠো ইঁদুরের চোখ নক্ষত্রের দিকে আজো চায়? আশ্চর্য বিস্ময়ে আমি চেয়ে র’ব কিছু কাল অন্ধকার বিছানার কোলে।
জীবনানন্দ দাশ
মনে হয় একদিন আকাশের শ‍ুকতারা দেখিব না আর; দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন নিভে যায়;—দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন, শ‍ুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার আমার চোখের কাছে;—লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়;—হিজলের বাঁকা ডাল করে গ‍ুঞ্জরণ; সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে—হাতের কাঁকন বেজে ওঠে: বুঝিব না—গঙ্গাজল, নারকোলনাড়ুগ‍ুলো তার জানি না সে কারে দেবে—জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে র’বে কি না... আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার— আমি তা জানি না;— মৃত্যুরে কে মনে রাখে?...কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস নতুন ডাঙার দিকে—পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা দিন তার কেটে যায়—শ‍ুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?
জীবনানন্দ দাশ
মানুষের ব্যথা আমি পেয়ে গেছি পৃথিবীর পথে এসে—হাসির আস্বাদ পেয়ে গেছি; দেখেছি আকাশে দূরে কড়ির মতন শাদা মেঘের পাহাড়ে সূর্যের রাঙা ঘোড়া: পক্ষিরাজের মতো কমলারঙের পাখা ঝাড়ে রাতের কুয়াশা ছিঁড়ে; দেখেছি শরের বনে শাদা রাজহাঁসদের সাধ উঠেছে আনন্দে জেগে—নদীর স্রোতের দিকে বাতাসের মতন অবাধ চ’লে গেছে কলরবে; দেখেছি সবুজ ঘাস—যত দূর চোখ যেতে পারে: ঘাসের প্রকাশ আমি দেখিয়াছি অবিরল,—পৃথিবীর ক্লান্ত বেদনারে ঢেকে আছে; দেখিয়াছি বাসমতী, কাশবন আকাঙ্ক্ষার রক্ত, অপরাধ মুছায়ে দিতেছে যেন বার বার—কোন্ এক রহস্যের কুয়াশার থেকে যেখানে জন্মে না কেউ, যেখানে মরে না কেউ, সেই কুহকের থেকে এসে রাঙা রোদ, শালিধান, ঘাস, কাশ, মরালেরা বার বার রাখিতেছে ঢেকে আমাদের রুক্ষ প্রশ্ন, ক্লান্ত ক্ষুধা, স্ফুট মৃত্যু —আমাদের বিস্মিত নীরব রেখে দেয়—পৃথিবীর পথে আমি কেটেছি আঁচড় ঢের, অশ্রু, গেছি রেখে; তব, ঐ মরালীরা কাশ ধান রোদ ঘাস এসে এসে মুছে দেয় সব।
জীবনানন্দ দাশ
যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে র’ব—অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে— দিনমানে কোনো মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে— তবুও কাঁঠাল জাম বাংলার—তাহাদের ছায়া যে পড়িছে আমার বুকের ’পরে—আমার মুখের ’পরে নীরবে ঝরিছে খয়েরী অশথপাতা—বঁইচি শেয়ালকাঁটা আমার এ দেহ ভালোবাসে, নিবিড় হয়েছে তাই আমার চিতার ছাইয়ে—বাংলার ঘাসে গভীর ঘাসের গুচ্ছে র’য়েছি ঘুমায়ে আমি,—নক্ষত্র নড়িছে আকাশের থেকে দূর—আরো দূর—আরো দূর—নির্জন আকাশে বাংলার—তারপর অকারণ ঘুমে আমি প’ড়ে যাই ঢুলে; আবার যখন জাগি, আমার শ্মশানচিতা বাংলার ঘাসে ভ’রে আছে, চেয়ে দেখি,—বাসকের গন্ধ পাই—আনারস ফুলে ভোমরা উড়িছে, শুনি—গ‍ুব্‌রে পোকার ক্ষীণ গুমরানি ভাসিছে বাতাসে রোদের দুপুর ভ’রে—শুনি আমি: ইহারা আমারে ভালোবাসে—
জীবনানন্দ দাশ
যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে অপরাজিতার মতো নীল হয়ে—আরো নীল—আরো নীল হয়ে আমি যে দেখিতে চাই;—সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে, আমি যে দেখিতে চাই;—আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে; পৃথিবীর পথে ঘুরে বহ‍ু দিন অনেক বেদনা প্রাণে স’য়ে ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে, যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে, যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প’রে কোনো এক সুন্দরীর শব চন্দন চিতায় চড়ে—আমের শাখায় শ‍ুক ভুলে যায় কথা; যেইখানে সব চেয়ে বেশি র‍ূপ—সব চেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা; যেখানে শ‍ুকায় পদ্ম—বহু দিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব; যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিকমালার কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর!
জীবনানন্দ দাশ
যদি আমি ঝ’রে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়: যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে, যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গ‍ুঁজে, যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠানের খয়েরী পাতায়, যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শ‍ুধু পায়, শামুক গ‍ুগলিগ‍ুলো প’ড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে,— তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে, ঠেস্ দিয়ে ব’সে আর থাকি নাকো যদি বুনো চাল্‌তার গায়, তাহ’লে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকারে মৃত্যুর আহ্বান— যার ডাক শ‍ুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড় একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর, যার ডাক শ‍ুনে আজ ক্ষেতে ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;— কবে যে আসিবে মৃত্যু: বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনার‍ূপে আমি করিব যে স্নান—
জীবনানন্দ দাশ
চ’লে যাব শুকনো পাতা-ছাওয়া ঘাসে—জামরূল হিজলের বনে; তল্‌তা বাঁশের ছিপ হাতে র’বে—মাছ আমি ধরিব না কিছু;— দীঘির জলের গন্ধে রূপালি চিতল তার রূপসীর পিছু জামের গভীর পাতা-মাখা শান্ত নীল জলে খেলিছে গোপনে; আনারস-ঝোপে ঐ মাছরাঙা তার মাছরাঙাটির মনে অস্পষ্ট আলোয় যেন মুছে যায়;—সিঁদুরের মতো রাঙা লিচু ঝ’রে পড়ে পাতা ঘাসে—চেয়ে দেখি কিশোরী করেছে মাথা নিচু— এসেছে সে দুপুরের অবসরে জামরুল লিচু আহরণে,— চ’লে যায়; নীলাম্বরী স’রে যায় কোকিলের পাখনার মতো ক্ষীরুয়ের শাখা ছুঁয়ে চালতার ডাল ছেড়ে বাঁশের পিছনে কোনো দূর আকাঙ্ক্ষার ক্ষেতে মাঠে চ’লে যায় যেন অব্যাহত, যদি তার পিছে যাও দেখিবে সে আকন্দের করবীর বনে ভোমরার ভয়ে ভীর; বহুক্ষণ পায়চারি ক’রে আনমনে তারপর চ’লে গেল:উড়ে গেল যেন নীল ভোমরার সনে।
জীবনানন্দ দাশ
যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়—সে তো আর ফিরে নাহি আসে: কাঞ্চনমালা যে কবে ঝ’রে গেছে;—বনে আজো কলমীর ফুল ফুটে যায়—সে তবু ফেরে না, হায়,—বিশালাক্ষী: সে-ও তো রাতুল চরণ মুছিয়া নিয়া চ’লে গেছে;—মাঝপথে জলের উচ্ছ্বাসে বাধা পেয়ে নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে—শ্মশানের পাশে আর তারা আসে নাকো;—সুন্দরীর বনে বাঘ ভিজে জুল জুল চোখ তুলে চেয়ে থাকে—কত পাটরানীদের গাঢ় এলো চুল এই গৌড় বাংলার—প’ড়ে আছে তাহার পায়ের তলে ঘাসে জানে সে কি! দেখে না কি তারাবনে প’ড়ে আছে বিচূর্ণ দেউল, বিশ‍ুষ্ক পদ্মের দীঘি—ফোঁপরা মহলা ঘাট, হাজার মহাল মৃত সব র‍ূপসীরা: বুকে আজ ভেরেণ্‍ডার ফুলে ভীমর‍ুল গান গায়—পাশ দিয়ে খল্ খল্ খল্ খল্ ব’য়ে যায় খাল, তবু ঘুম ভাঙে নাকো—একবার ঘুমালে কে উঠে আসে আর যদিও ডুকারি যায় শঙ্খচিল—মর্মরিয়া মরে গো মাদার।
জীবনানন্দ দাশ
যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে—দূর কুয়াশায় চ’লে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;—সেদিন দু’দণ্ড এই বাংলার তীর— এই নীল বাংলার তীরে শ‍ুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;— সেদিন র’বে না কোনো ক্ষোভ মনে—এই সোঁদা ঘাসের ধূলায় জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায়—চারিদিকে বাঙালীর ভিড় বহ‍ু দিন কীর্তন ভাসান গান র‍ূপকথা যাত্রা পাঁচালীর নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজো শ্রাবণের জীবন গোঙায়, আমারে দিয়েছে তৃপ্তি; কোনো দিন র‍ূপহীন প্রবাসের পথে বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শ‍ুকের মতন কাটাই নি দিন মাস, বেহ‍ুলার লহনার মধুর জগতে তাদের পায়ের ধুলো-মাখা পথে বিকায়ে দিয়েছি আমি মন বাঙালী নারীর কাছে—চাল-ধোয়া স্নিগ্ধ হাত, ধান-মাখা চুল, হাতে তার শাড়িটির কস্তা পাড়;—ডাঁশা আম কামরাঙা কুল৷
জীবনানন্দ দাশ
শ্মশানের দেশে তুমি আসিয়াছ—বহুকাল গেয়ে গেছ গান সোনালি চিলের মতো উড়ে উড়ে আকাশের রৌদ্র আর মেঘে,— লক্ষ্মীর বাহন যেই স্নিগ্ধ পাখি আশ্বিনের জ্যোৎস্নার আবেগে গান গায়—শুনিয়াছি রাখিপূর্ণিমার রাতে তোমার আহ্বান তার মতো; আম চাঁপা কদমের গাছ থেকে গাহে অফুরান যেন স্নিগ্ধ ধান ঝরে … অনন্ত সবুজ শালি আছে যেন লেগে বুকে তব; বল্লালের বাংলায় কবে যে উঠিলে তুমি জেগে; পদ্মা মেঘনা ইছামতী নয় শুধু, – তুমি কবি করিয়াছ স্নান সাত সমুদ্রের জলে,—ঘোড়া নিয়ে গেছ তুমি ধূম্র নারীদেশে অর্জুনের মতো, আহা,—আরো দূর ম্লান নীল রূপের কুয়াশা ফুঁড়েছ সুপর্ণ তুমি—দূর রং আরো দূর রেখা ভালোবেসে; আমাদের কালীদহ—গাঙুড়—গাঙের চিল তবু ভালোবাসা চায় যে তোমার কাছে—চায়, তুমি ঢেলে দাও নিজেরে নিঃশেষে এই দহে—এই চূর্ণ মঠে মঠে—এই জীর্ণ বটে বাঁধ বাসা।
জীবনানন্দ দাশ
সন্ধ্যা হয়—চারিদিকে শান্ত নীরবতা; খড় মুখে নিয়ে এক শালিখ যেতেছে উড়ে চুপে; গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ বেয়ে ধীরে ধীরে; আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে; পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে; পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে; পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু’-জনার মনে; আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।
জীবনানন্দ দাশ
সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি— এই নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন— সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! আমি চ’লে যাব ব’লে চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে? লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে? সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! চারিদিকে শান্ত বাতি—ভিজে গন্ধ—মৃদু কলরব; খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে; পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল;— এশিরিয়া ধুলো আজ—বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশ
সোনার খাঁচার বুকে রহিব না আমি আর শুকের মতন; কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে—কোন্ গান, বল, তাহ’লে এ-দেউলের খিলানের গল্প ছেড়ে চল, উড়ে চল,— যেখানে গভীর ভোরে নোনাফল পাকিয়াছে,—আছে আতাবন; পউষের ভিজে ভোরে, আজ হায় মন যেন করিছে কেমন;— চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, মুখ তুলে চেয়ে দেখ—শুধাই, শুন লো, কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে,—কোন্ গান, বল, আমার সোনার খাঁচা খুলে দাও, আমি যে বনের হীরামন; রাজকন্যা শোনে নাকো—আজ ভোরে আরসীতে দেখে নাকো মুখ, কোথায় পাহাড় দূরে শাদা হয়ে আছে যেন কড়ির মতন,— সেই দিকে চেয়ে চেয়ে দিনভোর ফেটে যায় রূপসীর বুক; তবুও সে বোঝে না কি আমারো যে সাধ আছে—আছে আনমন আমারো যে … চন্দ্রমালা, রাজকন্যা, শোন শোন তোল তো চিবুক। হাড়পাহাড়ের দিকে চেয়ে চেয়ে হিম হয়ে গেছে তার স্তন।
জীবনানন্দ দাশ
হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিলে না কি—দহের বাতাসে আষাঢ়ের দু’-পহরে কলরব কর নি কি এই বাংলায়! আজ সারাদিন এই বাদলের কোলাহলে মেঘের ছায়ায় চাঁদ সদাগর: তার মধুকর ডিঙাটির কথা মনে আসে, কালীদহে কবে তারা পড়েছিল একদিন ঝড়ের আকাশে,— সেদিনো অসংখ্য পাখি উড়েছিল না কি কালো বাতাসের গায়, আজ সারাদিন এই বাদলের জলে ধলেশ্বরীর চড়ায় গাংশালিখের ঝাঁক, মনে হয়, যেন সেই কালীদহে ভাসে: এই সব পাখিগুলো কিছুতেই আজিকার নয় যেন—নয়— এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন—এ আকাশ নয় আজিকার: ফণীমনসার বনে মনসা রয়েছে না কি?—আছে; মনে হয়, এ নদী কি কালীদহ নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার সনকার মুখে আমি দেখি না কি? বিষণ্ণ মলিন ক্লান্ত কি যে সত্য সব;—তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে৷
জীবনানন্দ দাশ
হৃদয়ে প্রেমের দিন কখন যে শেষ হয়—চিতা শুধু, প’ড়ে থাকে তার, আমরা জানি না তাহা;—মনে হয় জীবনে যা আছে আজো তাই শালিধান রূপশালি ধান তাহা...রূপ, প্রেম...এই ভাবি... ...খোসার মতন নষ্ট ম্লান একদিন তাহাদের অসারতা ধরা পড়ে,—যখন সবুজ অন্ধকার, নরম রাত্রির দেশ, নদীর জলের গন্ধ কোন্ এক নবীনাগতার মুখখানা নিয়ে আসে—মনে হয় কোনোদিন পৃথিবীতে প্রেমের আহ্বান এমন গভীর ক’রে পেয়েছি কি: প্রেম যে নক্ষত্র আর নক্ষত্রের গান, প্রাণ যে ব্যাকুল রাত্রি প্রান্তরের গাঢ় নীল অমাবস্যার— চ’লে যায় আকাশের সেই দূর নক্ষত্রের লাল নীল শিখার সন্ধানে, প্রাণ যে আঁধার রাত্রি আমার এ,—আর তুমি স্বাতীর মতন রূপের বিচিত্র বাতি নিয়ে এলে,—তাই প্রেম ধূলায় কাঁটায় যেইখানে মৃত হয়ে প’ড়ে ছিল পৃথিবীর শূন্য পথে পেল সে গভীর শিহরণ; তুমি, সখি, ডুবে যাবে মুহূর্র্তেই রোমহর্ষে—অনিবার অরুণের স্নানে জানি আমি; প্রেম যে তবুও প্রেম: স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে র’বে, বাঁচিতে সে জানে।
জীবনানন্দ দাশ
অনন্দা জীবনানন্দ দাশ এই পৃথিবীর এ এক শতচ্ছিদ্র নগরী। দিন ফুরুলে তারার আলো খানিক নেমে আসে। গ্যাসের বাতি দাঁড়িয়ে থাকে রাতের বাতাসে। দ্রুতগতি নরনারীর ক্ষণিক শরীর থেকে উৎসারিত ছায়ার কালো ভারে আঁধার আলোয় মনে হ’তে পারে এ-সব দেয়াল যে-কোনো নগরীর; সন্দেহ ভয় অপ্রেম দ্বেষ অবক্ষয়ের ভিড় সূর্য তারার আলোয় অঢেল রক্ত হ’তে পারে যে-কোনোদিন; সে কতোবার আঁধার বেশি শানিত হয়েছে; বাহক নেই— দুরন্ত কাল নিজেই বয়েছে নিজেরি শব নিজে মানুষ, মানবপ্রাণের রহস্যময় গভীর গুহার থেকে সিংহ শকুন শেয়াল নেউল সৰ্পদন্ত ডেকে। হৃদয় আছে ব’লেই মানুষ, দ্যাথো, কেমন বিচলিত হ’য়ে বোনভায়েকে খুন ক’রে সেই রক্ত দেখে আঁশটে হৃদয়ে জেগে উঠে ইতিহাসের অধম স্থূলতাকে ঘুচিয়ে দিতে জ্ঞানপ্রতিভা আকাশ প্রেম নক্ষত্রকে ডাকে। এই নগরী যে-কোনে দেশ; যে-কোনো পরিচয়ে আজ পৃথিবীর মানবজাতির ক্ষয়ের বলয়ে অন্তবিহীন ফ্যাক্টরি ক্রেন ট্রাকের শব্দে ট্র্যাফিক কোলাহলে হৃদয়ে যা হারিয়ে গেছে মেশিনকণ্ঠে তাকে শূন্য অবলেহন থেকে ডাকে। ‘তুমি কি গ্রীস পোল্যাণ্ড চেক প্যারিস মিউনিক টোকিও রোম ন্যুইয়র্ক ক্রেমলিন আটলাণ্টিক লণ্ডন চীন দিল্লী মিশর করাচী প্যালেস্টাইন? একটি মৃত্যু, এক ভূমিকা, একটি শুধু আইন।’ বলছে মেশিন। মেশিনপ্রতিম অধিনায়ক বলে: ‘সকল ভূগোল নিতে হবে নতুন ক’রে গ’ড়ে আমার হাতে গড়া ইতিহাসের ভেতরে, নতুন সময় সীমাবলয় সবই তো আজ আমি; ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আমার সত্ত্বাধিকারকামী; আমি সংঘ জাতি রীতি রক্ত হলুদ নীল; সবুজ শাদা মেরুন অশ্লীল নিয়মগুলো বাতিল করি; কালো কোর্তা দিয়ে ওদের ধূসর পাটকিলে বফ্ কোর্তা তাড়িয়ে আমার অনুচরের বৃন্দ অন্ধকারের বার আলোক ক’রে কী অবিনাশ দ্বৈপ-পরিবার। এই দ্বীপই দেশ; এ-দ্বীপ নিখিল তবে। অন্য সকল দ্বীপের হ’তে হবে আমার মতো— আমার অনুচরের মতো ধ্রুব। হে রক্তবীজ, তুমি হবে আমার আঘাত পেয়ে অনবতুল আমির মতে শুভ।’ সবাই তো আজ যে যার অন্তরঙ্গ জিনিস খুঁজে মানবভ্রাতাবোনকে বুকে টেনে নেবার ছলে তাদের নিকেশ ক’রে অনির্বচন রক্তে এই পৃথিবীর জলে নানারকম নতুন নামের বৃহৎ ভীষণ নদী হ’য়ে গেল; এই পৃথিবীর সব নগরী পরিক্রমা ক’রে নতুন অভিধানের শব্দে ছন্দে জেগে সুপরিসর ভোরে এ-সব নদী গভীরতর মানে পেতে চায়— দিকসময়ের আতল রক্ত ক্ষালন ক’রে অননুতপ্ততায়; বাস্তবিকই জল কি জলের নিকটতম মানে? অথবা কি মানবরক্ত বহন করি নির্মম অজ্ঞানে? কি আন্তরিক অর্থ কোথায় আছে? এই পৃথিবীর গোষ্ঠীরা কি পরস্পরের কাছে ভাইয়ের মতো: সৎ প্রকৃতির স্পষ্ট উৎস থেকে মানবসভ্যতার এই মলিন ব্যতিক্রমে জেগে উঠে? যে যার দেহ আত্মা ভালোবেসে অমল জলকণার মতন সমুদ্রকে এক মুঠে ধ’রে আছে? ভালো ক’রে বেঁচে থাকার বিশদ নির্দেশে সূর্যকরোজ্জ্বল প্রভাতে এসে হিংসা গ্লানি মৃত্যুকে শেষ ক’রে জেগে আছে? জেগে উঠে সময়সাগরতীরে সূর্যস্রোতে তবুও ক্লান্ত পতিত মলিন হ’তে কি আবেদন আসছে মানুষ প্রতিদিনই— কোথার থেকে শকুনক্রান্তি বলে: ‘জলের নদী? জেগে উঠুক আপামরের রক্ত কোলাহলে!’ এ-সুর শুরু হয়েছিলো কুরুবর্ষে— বেবিলনে ট্রয়ে; মানুষ মানী জ্ঞানী প্রধান হ’য়ে গেছে; তবুও হৃদয়ে ভালোবাসার যৌনকুয়াশা কেটে যে-প্রেম আসে সেটা কি তার নিজের ছায়ার প্রতি? জলের কলরোলের পাশে এই নগরীর অন্ধকারে আজ আঁধার আরো গভীরতর ক’রে ফেলে সভ্যতার এই অপার আত্মরতি; চারিদিকে নীল নরকে প্রবেশ করার চাবি অসীম স্বৰ্গ খুলে দিয়ে লক্ষ কোটি নরককীটের দাবি জাগিয়ে তবু সে-কীট ধ্বংস করার মতো হ’য়ে ইতিহাসের গভীরতর শক্তি ও প্রেম রেখেছে কিছু হয়তো হৃদয়ে।
জীবনানন্দ দাশ
আকাশলীনা জীবনানন্দ দাশ সুরঞ্জনা, ওইখানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে; ফিরে এসো সুরঞ্জনা: নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে; ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; ফিরে এসো হৃদয়ে আমার; দূর থেকে দূরে— আরো দূরে যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর। কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে! আকাশের আড়ালে আকাশে মৃত্তিকার মতো তুমি আজ: তার প্রেম ঘাস হ’য়ে আসে। সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস: বাতাসের ওপারে বাতাস— আকাশের ওপারে আকাশ।
জীবনানন্দ দাশ
আছে জীবনানন্দ দাশ এখন চৈত্রের দিন নিভে আসে— আরো নিভে আসে; এখানে মাঠের ’পরে শুয়ে আছি ঘাসে; এসে শেষ হ’য়ে যায় মামুষের ইচ্ছা কাজ পৃথিবীর পথে, দু-চারটে— বড়ো জোর একশো শরতে; উর ময় চীন ভারতের গল্প বহিঃপৃথিবীর শর্তে হ’য়ে গেছে শেষ; জীবনের রূপ আর রক্তের নির্দেশ পৃথিবীর কাম আর বিচ্ছেদের ভূমা— মনে হয়— এক তিলের সমান; কিন্তু এই চেয়ে থাকা, স্থিতি, রাত্রি, শান্তি— অফুরান। চারিদিকে বড়ো-বড়ো আকাশ ও গাছের শরীরে সময় এসেছে তার নীড়ে। ভালো লাগে পৃথিবীর রূঢ় নষ্ট সভ্যতার দিনের ব্যত্যয়; অন্ধকার সনাতনে মিশে যাওয়া— কিন্তু মরণের ঘুম নয়; জেগে থাকা: নক্ষত্রের বাগীশ্বরী দ্যোতনার থেকে কিছু দূরে; পৃথিবীর অবলুপ্ত জ্ঞানী বন্ধুরে এই স্তব্ধ মাটিতেই মিশে যেতে হ’লো জেনে তবু চোখ রেখে নীলাকাশে শুয়ে থাকা পৃথিবীর মাধুরীর অন্ধকার ঘাসে।
জীবনানন্দ দাশ
উত্তরপ্রবেশ পুরোনো সময় সুর ঢের কেটে গেল। যদি বলা যেত: সমুদ্রের পারে কেটে গেছে, সোনার বলের মতো সূর্য ছিলো পুবের আকাশে— সেই পটভূমিকায় ঢের ফেনশীর্ষ ঢেউ, উড়ন্ত ফেনার মতো অগণন পাখি। পুরোনো বছর দেশ ঢের কেটে গেল রোদের ভিতরে ঘাসে শুয়ে; পুকুরের জল থেকে কিশোরের মতো তৃপ্ত হাতে ঠাণ্ডা পানিফল, জল ছিঁড়ে নিতে গিয়ে; চোখের পলকে তবু যুবকের মতো মৃগনাভিঘন বড়ো নগরের পথে কোনো এক সূর্যের জগতে চোথের নিমেষ পড়েছিলো। সেইখানে সূর্য তবু অস্ত যায়। পুনরুদয়ের ভোরে আসে মানুষের হৃদয়ের অগোচর গম্বুজের উপরে আকাশে। এ ছাড়া দিনের কোনো সুর নেই; বসন্তের অন্য সাড়া নেই। প্লেন আছে: অগণন প্লেন অগণ্য এয়োরোড্রোম র’য়ে গেছে। চারিদিকে উঁচু-নিচু অন্তহীন নীড়— হ’লেও বা হ’য়ে যেত পাখির মতন কাকলীর আনন্দে মুখর; সেইখানে ক্লান্তি তবু— ক্লান্তি— ক্লান্তি; কেন ক্লান্তি তা’ ভেবে বিস্ময়; সেইখানে মৃত্যু তবু; এই শুধু— এই; চাঁদ আসে একলাটি; নক্ষত্রেরা দল বেঁধে আসে; দিগন্তের সমুদ্রের থেকে হাওয়া প্রথম আবেগে এসে তবু অস্ত যায়; উদয়ের ভোরে ফিরে আসে আপামর মানুষের হৃদয়ের অগোচর রক্ত হেডলাইনের— রক্তের উপরে আকাশে। এ ছাড়া পাখির কোনো সুর— বসন্তের অন্য কোনো সাড়া নেই। নিখিল ও নীড় জনমানবের সমস্ত নিয়মে সজন নির্জন হ’য়ে থেকে ভয় প্রেম জ্ঞান ভুল আমাদের মানবতা রোল উত্তরপ্রবেশ করে আরো-বড়ো চেতনার লোকে; অনন্ত সূর্যের অস্ত শেষ ক’রে দিয়ে বীতশোক হে অশোক সঙ্গী ইতিহাস, এ-ভোর নবীন ব’লে মেনে নিতে হয়; এখন তৃতীয় অঙ্ক অতএব; আগুনে আলোয় জ্যোতির্ময়
জীবনানন্দ দাশ
এই সব দিনরাত্রি জীবনানন্দ দাশ মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালো। এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে। তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই; তাদের হৃদয়ে কোনো সভাপতি নেই; শরীর বিবশ হ’লে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের কংগ্রেসের মতো কোনো আশা হতাশার কোলাহল নেই। অনেক শ্রমিক আছে এইখানে। আরো ঢের লোক আছে সঠিক শ্রমিক নয় তা’রা। স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝ’রে এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে। নামগুলো কুশ্রী নয়, পৃথিবীর চেনা-জানা নাম এই সব। আমরা অনেক দিন এ-সব নামের সাথে পরিচিত; তবু, গৃহ নীড় নির্দেশ সকলি হারায়ে ফেলে ওরা জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধান পাওয়া যাবে; জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে; অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে। মেডিকেল ক্যাম্বেলের বেলগাছিয়ার যাদবপুরের বেড কাঁচড়াপাড়ার বেড সব মিলে কতগুলো সব? ওরা নয়— সহসা ওদের হ’য়ে আমি কাউকে সুধায়ে কোনো ঠিকমতো জবাব পাইনি। বেড আছে, বেশি নেই– সকলের প্রয়োজনে নেই। যাদের আস্তানা ঘর তল্পিতল্পা নেই হাসপাতালের বেড হয়তো তাদের তরে নয়। বটতলা মুচিপাড়া তালতলা জোড়াসাঁকো— আরো ঢের ব্যর্থ অন্ধকারে যারা ফুটপাত ধ’রে অথবা ট্রামের লাইন মাড়িয়ে চলছে তাদের আকাশ কোন্ দিকে? জানু ভেঙে প’ড়ে গেলে হাত কিছুক্ষণ আশাশীল হ’য়ে কিছু চায়— কিছু খোঁজে; এ ছাড়া আকাশ আর নেই। তাদের আকাশ সর্বদাই ফুটপাতে; মাঝে-মাঝে এম্বুলেনস্ গাড়ির ভিতরে রণক্লান্ত নাবিকের ঘরে ফিরে আসে যেন এক অসীম আকাশে। এ-রকম ভাবে চ’লে দিন যদি রাত হয়, রাত যদি হ’য়ে যায় দিন, পদচিহ্নময় পথ হয় যদি দিকচিহ্নহীন, কেবলি পাথুরেঘাটা নিমতলা চিৎপুর— খালের এপার-ওপার রাজাবাজারের অস্পষ্ট নির্দেশে হাঘরে হাভাতেদের তবে অনেক বেডের প্রয়োজন; বিশ্রামের প্রয়োজন আছে; বিচিত্র মৃত্যুর আগে শান্তির কিছুটা প্রয়োজন। হাসপাতালের জন্যে যাহাদের অমূল্য দাদন, কিংবা যারা মরণের আগে মৃতদের জাতিধর্ম নির্বিচারে সকলকে— সব তুচ্ছতম আর্তকেও শরীরের সান্ত্বনা এনে দিতে চায়, কিংবা যারা এই সব মৃত্যু রোধ ক’রে এক সাহসী পৃথিবী সুবাতাস সমুজ্জ্বল সমাজ চেয়েছে— তাদের ও তাদের প্রতিভা প্রেম সংকল্পকে ধন্যবাদ দিয়ে মানুষকে ধন্যবাদ দিয়ে যেতে হয়। মানুষের অনিঃশেষ কাজ চিন্তা কথা রক্তের নদীর মতো ভেসে গেলে, তারপর, তবু, এক অমূল্য মুগ্ধতা অধিকার ক’রে নিয়ে ক্রমেই নির্মল হ’তে পারে। ইতিহাস অর্ধসত্যে কামাচ্ছন্ন এখনো কালের কিনারায়; তবুও মানুষ এই জীবনকে ভালোবাসে; মানুষের মন জানে জীবনের মানে: সকলের ভালো ক’রে জীবনযাপন। কিন্তু সেই শুভ রাষ্ট্র ঢের দূরে আজ। চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়— অলীক প্রয়াণ। মন্বন্তর শেষ হ’লে পুনরায় নব মন্বন্তর; যুদ্ধ শেষ হ’য়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল; মানুষের লালসার শেষ নেই; উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ অপরের মুখ ম্লান ক’রে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই। কেবলি আসন থেকে বড়ো, নবতর সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো। মানুষের দুঃখ কষ্ট মিথ্যা নিষ্ফলতা বেড়ে যায়। মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী কেমন আশ্চর্য গান গায়; বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়; গানের ঝঙ্কারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে রাত্রির বর্ণের মতো কালো-কালো শিকারী বেড়াল প্রেম নিবেদন করে আলোর রঙের মতো অগণন পাখিদের কাছে; ঝর্ ঝর্ ঝর্ সারারাত শ্রাবণের নিৰ্গলিত ক্লেদরক্ত বৃষ্টির ভিতর এ-পৃথিবী ঘুম স্বপ্ন রুদ্ধশ্বাস শঠতা রিরংসা মৃত্যু নিয়ে কেমন প্রমত্ত কালো গণিকার উল্লোল সংগীতে মুখের ব্যাদান সাধ দুৰ্দান্ত গণিকালয়— নরক শ্মশান হ’লো সব। জেগে উঠে আমাদের আজকের পৃথিবীকে এ-রকম ভাবে অনুভব আমিও করেছি রোজ সকালের আলোর ভিতরে বিকেলে— রাত্রির পথে হেঁটে; দেখেছি রজনীগন্ধা নারীর শরীর অন্ন মুখে দিতে গিয়ে আমরা অঙ্গার রক্ত: শতাব্দীর অন্তহীন আগুনের ভিতরে দাঁড়িয়ে। এ-আগুন এত রক্ত মধ্যযুগ দেখেছে কখনো? তবুও সকল কাল শতাব্দীকে হিসেব নিকেশ ক’রে আজ শুভ কাজ সূচনার আগে এই পৃথিবীর মানবহৃদয় স্নিগ্ধ হয়— বীতশোক হয়? মানুষের সব গুণ শান্ত নীলিমার মতো ভালো? দীনতা: অন্তিম গুণ, অন্তহীন নক্ষত্রের আলো।
জীবনানন্দ দাশ
একটি কবিতা জীবনানন্দ দাশ পৃথিবী প্রবীণ আরো হ’য়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে; বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে। ও-প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই— সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে নড়িতেছে— জ্বলিতেছে— মায়াবীর মতো জাদুবলে। সে-আগুন জ্ব’লে যায়— দহেনাকো কিছু। সে-আগুন জ্ব’লে যায় সে-আগুন জ্বলে’ যায় সে-আগুন জ্ব’লে যায় দহেনাকো কিছু। নিমীল আগুনে ওই আমার হৃদয় মৃত এক সারসের মতো। পৃথিবীর রাজহাঁস নয়— নিবিড় নক্ষত্র থেকে যেন সমাগত সন্ধ্যার নদীর জলে এক ভিড় হাঁস ওই— একা; এখানে পেল না কিছু; করুণ পাখায় তাই তা’রা চলে যায় শাদা, নিঃসহায়। মূল সারসের সাথে হ’লো মুখ দেখা। ২ রাত্রির সংকেতে নদী যতদূর ভেসে যায়— আপনার অভিজ্ঞান নিয়ে আমারো নৌকার বাতি জ্বলে; মনে হয় এইখানে লোকশ্রুত আমলকী পেয়ে গেছি আমার নিবিষ্ট করতলে; সব কেরোসিন-অগ্নি ম’রে গেছে; জলের ভিতরে আভা দ’হে যায় মায়াবীর মতো জাদুবলে। পৃথিবীর সৈনিকেরা ঘুমায়েছে বিম্বিসার রাজার ইঙ্গিতে ঢের দূর ভূমিকার পর; সত্য সারাংসার মূর্তি সোনার বৃষের ’পরে ছুটে সারাদিন হ’য়ে গেছে এখন পাথর; যে-সব যুবারা সিংহীগর্ভে জ’ন্মে পেয়েছিলো কৌটিল্যের সংযম তারাও মরেছে— আপামর। যেন সব নিশিডাকে চ’লে গেছে নগরীকে শূন্য ক’রে দিয়ে— সব ক্বাথ বাথরুমে ফেলে; গভীর নিসর্গ সাড়া দিয়ে শ্রুতি বিস্মৃতির নিস্তব্ধতা ভেঙে দিতো তবু একটি মানুষ কাছে পেলে; যে-মুকুর পারদের ব্যবহার জানে শুধু, যেই দীপ প্যারাফিন, বাটা মাছ ভাজে যেই তেলে, সম্রাটের সৈনিকেরা যে-সব লাবণি, লবণরাশি খাবে জেগে উঠে’, অমায়িক কুটুম্বিনী জানে; তবুও মানুষ তার বিছানায় মাঝরাতে নৃমুণ্ডের হেঁয়ালিকে আঘাত করিবে কোন্‌খানে? হয়তো নিসর্গ এসে একদিন ব’লে দেবে কোনো এক সম্রাজ্ঞীকে জলের ভিতরে এই অগ্নির মানে।
জীবনানন্দ দাশ
খেতে প্রান্তরে জীবনানন্দ দাশ ঢের সম্রাটের রাজ্যে বাস ক’রে জীব অবশেষে একদিন দেখেছে দু-তিন ধনু দূরে কোথাও সম্রাট নেই, তবুও বিপ্লব নেই, চাষা বলদের নিঃশব্দতা খেতের দুপুরে। বাংলার প্রান্তরের অপরাহ্ণ এসে নদীর খাড়িতে মিশে ধীরে বেবিলন লণ্ডনের জন্ম, মৃত্যু হ’লে— তবুও রয়েছে পিছু ফিরে। বিকেল এমন ব’লে একটি কামিন এইখানে দেখা দিতে এলো তার কামিনীর কাছে; মানবের মরণের পরে তার মমির গহ্বর এক মাইল রৌদ্রে প’ড়ে আছে। আবার বিকেল বেলা নিভে যায় নদীর খাড়িতে; একটি কৃষক শুধু খেতের ভিতরে তার বলদের সাথে সারাদিন কাজ ক’রে গেছে; শতাব্দী তীক্ষ্ণ হ’য়ে পড়ে। সমস্ত গাছের দীর্ঘ ছায়া বাংলার প্রান্তরে পড়েছে; এ-দিকের দিনমান— এ-যুগের মতো শেষ হ’য়ে গেছে, না জেনে কৃষক চোত বোশেখের সন্ধ্যার বিলম্বনে প’ড়ে চেয়ে দেখে থেমে আছে তবুও বিকাল; উনিশশো বেয়াল্লিশ ব’লে মনে হয় তবুও কি উনিশশো বেয়াল্লিশ সাল। ৩ কোথাও শান্তির কথা নেই তার, উদ্দীপ্তিও নেই; একদিন মুত্যু হবে, জন্ম হয়েছে; সূর্য উদয়ের সাথে এসেছিলো খেতে; সূর্যাস্তের সাথে চ’লে গেছে। সূর্য উঠবে জেনে স্থির হ’য়ে ঘুমায়ে রয়েছে। আজ রাতে শিশিরের জল প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতি নিয়ে খেলা করে; কৃষাণের বিবর্ণ লাঙল, ফালে ওপড়ানো সব অন্ধকার ঢিবি, পোয়াটাক মাইলের মতন জগৎ সারাদিন অন্তহীন কাজ ক’রে নিরুৎকীর্ণ মাঠে প’ড়ে আছে সৎ কি অসং। ৪ অনেক রক্তের ধ্বকে অন্ধ হ’য়ে তারপর জীব এইখানে তবুও পায়নি কোনো ত্রাণ; বৈশাখের মাঠের ফাটলে এখানে পৃথিবী অসমান। আর-কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। কেবল খড়ের স্তূপ প’ড়ে আছে দুই— তিন মাইল, তবু তা’ সোনার মতো নয়; কেবল কাস্তের শব্দ পৃথিবীর কামানকে ভুলে করুণ, নিরীহ, নিরাশ্রয়। আর-কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। জলপিপি চ’লে গেলে বিকেলের নদী কান পেতে নিজের জলের সুর শোনে; জীবাণুর থেকে আজ কৃষক, মানুষ জেগেছে কি হেতুহীন সংপ্রসারণে— ভ্রান্তিবিলাসে নীল আচ্ছন্ন সাগরে? চৈত্য, ক্রুশ, নাইণ্টিথ্রি ও সোভিয়েট শ্রুতি প্রতিশ্রুতি যুগান্তের ইতিহাস, অর্থ দিয়ে কূলহীন সেই মহাসাগরে প্রাণ চিনে-চিনে হয়তো বা নচিকেতা প্রচেতার চেয়ে অনিমেষে প্রথম ও অন্তিম মানুষের প্রিয় প্রতিমান হ’য়ে যায় স্বাভাবিক জনমানবের সূর্যালোকে।
জীবনানন্দ দাশ
গোধূলি সন্ধির নৃত্য জীবনানন্দ দাশ দরদালানের ভিড় — পৃথিবীর শেষে যেইখানে প’ড়ে আছে– শব্দহীন— ভাঙা— সেইখানে উঁচু-উঁচু হরিতকী গাছের পিছনে হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল— রাঙা— চুপে-চুপে ভুলে যায়— জ্যোৎস্নায়। পিপুলের গাছে ব’সে পেঁচা শুধু একা চেয়ে দ্যাখে; সোনার বলের মতো সূর্য আর রুপার ডিবের মতে চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা। হরিতকী শাখাদের নিচে যেন হীরের স্ফুলিঙ্গ আর স্ফটিকের মতো শাদা জলের উল্লাস; নৃমুণ্ডের আবছায়া— নিস্তব্ধতা— বাদামী পাতার ঘ্রাণ— মধুকূপী ঘাস। কয়েকটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো: পুরুষ তাদের: কৃতকর্ম নবীন; খোঁপার ভিতরে চুলে: নরকের নবজাত মেঘ, পায়ের ভঙ্গির নিচে হঙকঙের তৃণ। সেখানে গোপন জল ম্লান হ’য়ে হীরে হয় ফের, পাতাদের উৎসরণে কোনো শব্দ নাই; তবু তা’রা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে বিনষ্ট হতেছে সাংহাই। সেইখানে যূথচারী কয়েকটি নারী ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে। প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে স্বাদ নেই; এই নিচু পৃথিবীর মাঠের তরঙ্গ দিয়ে ওই চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে— বরুণে ক্রূর পথ নিয়ে যায় হরিতকী বনে— জ্যোৎস্নায়। যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বেলোয়ারি রৌদ্রের দিন শেষ হ’য়ে গেছে সব; বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ, পায়ের ভঙ্গির নিচে বৃশ্চিক— কর্কট— তুলা— মীন।
জীবনানন্দ দাশ
ঘোড়া জীবনানন্দ দাশ আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়: মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে, প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন— এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ’পরে। আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায়; বিষণ্ণ খড়ের শব্দ ঝ’রে পড়ে ইস্পাতের কলে; চায়ের পেয়ালা কটা বেড়ালছানার মতে— ঘুমে—ঘেয়ো কুকুরের অস্পষ্ট কবলে হিম হ’য়ে ন'ড়ে গেল ও-পাশের পাইস্-রেস্তরাঁতে; প্যারাফিন-লণ্ঠন নিভে গেল গোল আস্তাবলে সময়ের প্রশান্তির ফুঁয়ে; এই সব ঘোড়াদের নিওলিথ-স্তব্ধতার জ্যোৎস্নাকে ছুঁয়ে।
জীবনানন্দ দাশ
জনান্তিকে জীবনানন্দ দাশ তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই— তবু, গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই— তুমি আজো এই পৃথিবীতে র’য়ে গেছ। কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ; বহুদিন থেকে শান্তি নেই। নীড় নেই পাখিরো মতন কোনো হৃদয়ের তরে। পাখি নেই। মানুষের হৃদয়কে না জাগালে তাকে ভোর, পাখি, অথবা বসন্তকাল ব’লে আজ তার মানবকে কি ক’রে চেনাতে পারে কেউ। চারিদিকে অগণন মেশিন ও মেশিনের দেবতার কাছে নিজেকে স্বাধীন ব’লে মনে ক’রে নিতে গিয়ে তবু মানুষ এখনও বিশৃঙ্খল। দিনের আলোর দিকে তাকালেই দেখা যায় লোক কেবলি আহত হ’য়ে মৃত হ’য়ে স্তব্ধ হয়; এ ছাড়া নির্মল কোনো জননীতি নেই। যে-মানুষ— যেই দেশ টিঁকে থাকে সে-ই ব্যক্তি হয়— রাজ্য গড়ে— সাম্রাজ্যের মতো কোনো ভূমা চায়। ব্যক্তির দাবিতে তাই সাম্রাজ্য কেবলি ভেঙে গিয়ে তারই পিপাসায় গ’ড়ে ওঠে। এ ছাড়া অমল কোনো রাজনীতি পেতে হ’লে তবে উজ্জ্বল সময়স্রোতে চ’লে যেতে হয়। সেই স্রোত আজো এই শতাব্দীর তরে নয়। সকলের তরে নয়। পঙ্গপালের মতো মানুষেরা চরে; ঝ’রে পড়ে। এই সব দিনমান মৃত্যু আশা আলো গুনে নিতে ব্যাপ্ত হ’তে হয়। নবপ্রস্থানের দিকে হৃদয় চলেছে। চোখ না এড়ায়ে তবু অকস্মাৎ কখনো ভোরের জনান্তিকে চোখে থেকে যায় আরো-এক আভা: আমাদের এই পৃথিবীর এই ধৃষ্ট শতাব্দীর হৃদয়ের নয়— তবু হৃদয়ের নিজের জিনিস হ’য়ে তুমি রয়ে গেছ। তোমার মাথার চুলে কেবলি রাত্রির মতো চুল তারকার অনটনে ব্যাপক বিপুল রাতের মতন তার একটি নির্জন নক্ষত্রকে ধ’রে আছে। তোমার হৃদয়ে গায়ে আমাদের জনমানবিক রাত্রি নেই। আমাদের প্রাণে এক তিল বেশি রাত্রির মতো আমাদের মানবজীবন প্রচারিত হ’য়ে গেছে ব’লে— নারি, সেই এক তিল কম আর্ত রাত্রি তুমি। শুধু অন্তহীন ঢল, মানব-খচিত সাঁকো, শুধু অমানব নদীদের অপর নারীর কণ্ঠ তোমার নারীর দেহ ঘিরে; অতএব তার সেই সপ্রতিভ অমেয় শরীরে আমাদের আজকের পরিভাষা ছাড়া আরো নারী আছে। আমাদের যুগের অতীত এক কাল র’য়ে গেছে। নিজের নুড়ির ’পরে সারাদিন নদী সূর্যের— সুরের বীথি, তবু নিমেষে উপল নেই— জলও কোন্ অতীতে মরেছে; তবুও নবীন নুড়ি— নতুন উজ্জ্বল জল নিয়ে আসে নদী; জানি আমি জানি আদি নারী শরীরিণীকে স্মৃতির (আজকে হেমন্ত ভোরে) সে কবের আঁধার অবধি; সৃষ্টির ভীষণ অমা ক্ষমাহীনতায় মানবের হৃদয়ের ভাঙা নীলিমায় বকুলের বনে-মনে অপার রক্তের ঢলে গ্লেশিয়ারে জলে অসতী না হ’য়ে তবু স্মরণীর অনন্ত উপলে প্রিয়াকে পীড়ন ক’রে কোথায় নভের দিকে চলে।
জীবনানন্দ দাশ
জুহু জীবনানন্দ দাশ সাণ্টা ক্রুজ থেকে নেমে অপরাহ্লে জুহুর সমুদ্রপারে গিয়ে কিছুটা স্তব্ধতা ভিক্ষণ করেছিলো সূর্যের নিকটে থেমে সোমেন পালিত; বাংলার থেকে এত দূরে এসে—সমাজ, দর্শন, তত্ত্ব, বিজ্ঞান হারিয়ে, প্রেমকেও যৌবনের কামাখ্যার দিকে ফেলে পশ্চিমের সমুদ্রের তীরে ভেবেছিলো বালির উপর দিয়ে সাগরের লঘুচোখ কাঁকড়ার মতন শরীরে ধবল বাতাস খাবে সারাদিন; যেইখানে দিন গিয়ে বৎসরে গড়ায়— বছর আয়ুর দিকে— নিকেল-ঘড়ির থেকে সূর্যের ঘড়ির কিনারায় মিশে যায়— সেখানে শরীর তার নটকান-রক্তিম রৌদ্রের আড়ালে অরেঞ্জস্কোয়াশ থাবে হয়তো বা, বোম্বায়ের ‘টাইমস্’টাকে বাতাসের বেলুনে উড়িয়ে, বর্তুল মাথায় সূর্য বালি ফেনা অবসর অরুণিমা ঢেলে, হাতির হাওয়ার লুপ্ত কয়েতের মতো দেবে নিমেষে ফুরিয়ে চিন্তার বুদ্‌বুদ্‌দের। পিঠের ওপার থেকে তবু এক আশ্চর্য সংগত দেখা দিলো; ঢেউ নয়, বালি নয়, ঊনপঞ্চাশ বায়ু, সূর্য নয় কিছু— সেই রলরোলে তিন চার ধনু দূরে-দূরে এয়োরোড্রোমের কলরব লক্ষ্য পেলো অচিরেই— কৌতূহলে হৃষ্ট সব সুর দাঁড়ালো তাহাকে ঘিরে বৃষ মেষ বৃশ্চিকের মতন প্রচুর; সকলেরই ঝিঁক চোখে— কাঁধের উপরে মাথা-পিছু কোথাও দ্বিরুক্তি নেই মাথার ব্যথার কথা ভেবে। নিজের মনের ভুলে কখন সে কলমকে খড়্গের চেয়ে ব্যাপ্ত মনে ক’রে নিয়ে লিখেছে ভূমিকা, বই সকলকে সম্বোধন ক’রে! কখন সে বজেট-মিটিং, নারী, পার্টি-পলিটিক্স, মাংস, মার্মালেড ছেড়ে অবতার বরাহকে শ্রেষ্ঠ মনে করেছিলো; টোমাটোর মতো লাল গাল নিয়ে শিশুদের ভিড় কুকুরের উৎসাহ, ঘোড়ার সওয়ার, পার্শী, মেম, খোজা, বেদুইন, সমুদ্রের তীর, জুহু, সূর্য, ফেন, বালি— সাণ্টা ক্রুজে সব চেয়ে পররতিময় আত্মক্রীড় সে ছাড়া তবে কে আর? যেন তার দুই গালে নিরুপম দাড়ির ভিতরে দুটো বৈবাহিক পেঁচা ত্রিভুবন আবিষ্কার ক’রে তবু ঘরে ব’সে আছে; মুন্সী, সাভারকর, নরীম্যান তিন দৃষ্টিকোণ থেকে নেমে এসে দেখে গেল, মহিলারা মর্মরের মতো স্বচ্ছ কৌতূহলভরে, অব্যয় শিল্পীরা সব: মেঘ না চাইতে এই জল ভালোবাসে।
জীবনানন্দ দাশ
তবু জীবনানন্দ দাশ সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার বছরে বয়সী আমি; বুদ্ধকে স্বচক্ষে মহানির্বাণের আশ্চর্য শান্তিতে চ’লে যেতে দেখে— তবু— আবিরল অশান্তির দীপ্তি ভিক্ষা ক’রে এখানে তোমার কাছে দাঁড়ায়ে রয়েছি; আজ ভোরে বাংলার তেরোশো চুয়ান্ন সাল এই কোথাও নদীর জলে নিজেকে গণনা ক’রে নিতে ভুলে গিয়ে আগামী লোকের দিকে অগ্রসর হ’য়ে যায়; আমি তবুও নিজেকে রোধ ক’রে আজ থেমে যেতে চাই তোমার জ্যোতির কাছে; আড়াই হাজার বছর তা হ’লে আজ এইখানে শেষ হ’য়ে গেছে। নদীর জলের পথে মাছরাঙা ডান বাড়াতেই আলো ঠিকরায়ে গেছে— যারা পথে চ’লে যায় তাদের হৃদয়ে; সৃষ্টির প্রথম আলোর কাছে; আহা, অন্তিম আভার কাছে; জীবনের যতিহীন প্রগতিশীলতা নিখিলের স্মরণীয় সত্য ব’লে প্রমাণিত হ’য়ে গেছে; দ্যাখো পাখি চলে, তারা চলে, সূর্য মেঘে জ্ব’লে যায়, আমি তবুও মধ্যম পথে দাঁড়ায়ে রয়েছি— তুমি দাঁড়াতে বলোনি। আমাকে দ্যাখোনি তুমি; দেখাবার মতো অপব্যয়ী কল্পনার ইন্দ্রত্বের আসনে আমাকে বসালে চকিত হ’য়ে দেখে যেতে যদি— তবু, সে-আসনে আমি যুগে-যুগে সাময়িক শত্রুদের বসিয়েছি, নারি, ভালোবেসে ধ্বংস হ’য়ে গেছে তা’রা সব। এ-রকম অন্তহীন পটভূমিকায়— প্রেমে— নতুন ঈশ্বরদের বার-বার লুপ্ত হ’তে দেখে আমারো হৃদয় থেকে তরুণতা হারায়ে গিয়েছে; অথচ নবীন তুমি। নারি, তুমি সকালের জল উজ্জ্বলতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো নদীকেই বিকেলে অপর ঢেউয়ে খরশান হ’তে দিতে ভুলে গিয়েছিলে; রাতের প্রখর জলে নিয়তির দিকে ব’হে যেতে দিতে মনে ছিলো কি তোমার? এখনও কি মনে নেই? আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস কেবলি শিথিল হ’য়ে যায়; তবু তুমি সেই শিথিলতা নও, জানি, তবু ইতিহাসরীতিপ্রতিভার মুখোমুখি আবছায়া দেয়ালের মতো নীল আকাশের দিকে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চেয়ে তুমি আমাদের দেশে কোনো বিশ্বাসের দীর্ঘ তরু নও। তবু কী যে উদয়ের সাগরের প্রতিবিম্ব জ্ব’লে ওঠে রোদে! উদয় সমাপ্ত হ’য়ে গেছে নাকি সে অনেক আগে? কোথাও বাতাস নেই, তবু মৰ্মরিত হ’য়ে ওঠে উদয়ের সমুদ্রের পারে। কোনো পাখি কালের ফোকরে আজ নেই, তবু, নব সৃষ্টিমরালের মতো কলস্বরে কেন কথা বলি; কোনো নারী নেই, তবু আকাশহংসীর কণ্ঠে ভোরের সাগর উতরোল।
জীবনানন্দ দাশ
তিমিরহননের গান জীবনানন্দ দাশ কোনো হ্রদে কোথাও নদীর ঢেউয়ে কোনো এক সমুদ্রের জলে পরস্পরের সাথে দু-দণ্ড জলের মতো মিশে সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে আমাদের জীবনের আলোড়ন— হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো। অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে আমরা হেসেছি, আমরা খেলেছি; স্মরণীয় উত্তরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে একদিন ভালোবেসে গেছি। সেই সব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু— তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক। হেমন্তের প্রান্তরের তারার আলোক। সেই জের টেনে আজো থেলি। সূর্যালোক নেই— তবু— সূর্যালোক মনোরম মনে হ’লে হাসি। স্বতই বিমর্ষ হ’য়ে ভদ্র সাধারণ চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে আরো বেশি কালো-কালো ছায়া লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে মধ্যবিত্ত মাহুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে নর্দমায় নেমে— ফুটপাত থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাতে গিয়ে নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম’রে যেতে জানে। এরা সব এই পথে; ওরা সব ওই পথে— তবু মধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন— অন্তহীন বেদনার পথে। কিছু নেই— তবু এই জের টেনে খেলি; সূর্যালোক প্রজ্ঞাময় মনে হ’লে হাসি; জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে— অন্ধকারে— মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি। তিমিরহননে তবু অগ্রসর হ’য়ে আমরা কি তিমিরবিলাসী? আমরা তো তিমিরবিনাশী হ’তে চাই। আমরা তো তিমিরবিনাশী।
জীবনানন্দ দাশ
দিনরাত জীবনানন্দ দাশ সারাদিন মিছে কেটে গেল; সারারাত বড্ডো খারাপ নিরাশায় ব্যর্থতায় কাটবে; জীবন দিনরাত দিনগতপাপ ক্ষয় করবার মতো ব্যবহার শুধু। ফণীমনসার কাঁটা তবুও তো স্নিগ্ধ শিশিরে মেখে আছে; একটিও পাখি শূন্যে নেই; সব জ্ঞানপাপী পাখি ফিরে গেছে নীড়ে।
জীবনানন্দ দাশ
নাবিক জীবনানন্দ দাশ কোথাও তরণী আজ চ’লে গেছে আকাশ-রেখায়— তবে— এই কথা ভেবে নিদ্রায় আসক্ত হ’তে গিয়ে তবু বেদনায় জেগে ওঠে পরাস্ত নাবিক; সূর্য যেন পরম্পরাক্রম আরো— ওই দিকে— সৈকতের পিছে বন্দরের কোলাহল—পাম সারি; তবু তার পরে স্বাভাবিক স্বৰ্গীয় পাখির ডিম সূর্য যেন সোনালি চুলের ধর্মযাজিকার চোখে; গোধূম-খেতের ভিড়ে সাধারণ কৃষকের খেলার বিষয়; তবু তার পরে কোনো অন্ধকার ঘর থেকে অভিভূত নৃমুণ্ডের ভিড় বল্লমের মতো দীর্ঘ রশ্মির ভিতরে নিরাশ্রয়— আশ্চর্য সোনার দিকে চেয়ে থাকে; নিরন্তর দ্রুত উন্মীলনে জীবাণুরা উড়ে যায়— চেয়ে দ্যাখে— কোনো এক বিস্ময়ের দেশে। হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য ক’রে শুধু? বেবিলন, নিনেভে, মিশর, চীন, উরের আরশি থেকে ফেঁসে অন্য এক সমুদ্রের দিকে তুমি চ’লে যাও— দুপুর বেলায়; বৈশালীর থেকে বায়ু— গেৎসিমানি— আলেকজান্দ্রিয়ার মোমের আলোকগুলো রয়েছে পিছনে প’ড়ে অমায়িক সংকেতের মতো; তারাও সৈকত। তবু তৃপ্তি নেই। আরো দূর চক্রবাল হৃদয়ে পাবার প্রয়োজন রয়ে গেছে— যতদিন স্ফটিক-পাখনা মেলে বোলতার ভিড় উড়ে যায়ু রাঙা রৌদ্রে; এরোপ্লেনের চেয়ে প্রমিতিতে নিটোল সারস নীলিমাকে খুলে ফেলে যতদিন; ভুলের বুনুনি থেকে আপনাকে মানবহৃদয়; উজ্জ্বল সময়-ঘড়ি— নাবিক— অনন্ত নীর অগ্রসর হয়।
জীবনানন্দ দাশ
নাবিকী জীবনানন্দ দাশ হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে; এ-রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে সময়ের কুয়াশায়; মাঠের ফসলগুলো বার-বার ঘরে তোলা হ’তে গিয়ে তবু সমুদ্রের পারের বন্দরে পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেছে। মৃত্তিকার ওই দিক আকাশের মুখোমুখি যেন শাদা মেঘের প্রতিভা; এই দিকে ঋণ, রক্ত, লোকসান, ইতর, খাতক; কিছু নেই— তবুও অপেক্ষাতুর; হৃদয়স্পন্দন আছে— তাই অহরহ বিপদের দিকে অগ্রসর; পাতালের মতো দেশ পিছে ফেলে রেখে নরকের মতন শহরে কিছু চায়; কী ষে চায়। যেন কেউ দেখেছিলো খণ্ডাকাশ যতবার পরিপূর্ণ নীলিমা হয়েছে, যতবার রাত্রির আকাশ ঘিরে স্মরণীয় নক্ষত্র এসেছে, আর তাহাদের মতো নরনারী যতবার তেমন জীবন চেয়েছিলো, যত নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেছে রৌদ্রের আকাশে, নদীর ও নগরীর মানুষের প্রতিশ্রুতির পথে যত নিরুপম সূর্যালোক জ্ব’লে গেছে— তার ঋণ শোধ ক’রে দিতে গিয়ে এই অনন্ত রৌদ্রের অন্ধকার। মানবের অভিজ্ঞতা এ-রকম। অভিজ্ঞতা বেশি ভালো হ’লে তবু ভয় পেতে হ’তো? মৃত্যু তবে ব্যসনের মতো মনে হ’তো? এখন ব্যসন কিছু নেই। সকলেই আজ এই বিকেলের পরে এক তিমির রাত্রির সমুদ্রের যাত্রীর মতন ভালো-ভালো নাবিক ও জাহাজের দিগন্তর খুঁজে পৃথিবীর ভিন্ন-ভিন্ন নেশনের নিঃসহায় প্রতিভূর মতো পরস্পরকে বলে, ‘হে নাবিক, হে নাবিক তুমি— সমুদ্র এমন সাধু, নীল হ’য়ে— তবুও মহান মরুভূমি; আমরাও কেউ নই—’ তাহাদের শ্রেণী যোনি ঋণ রক্ত রিরংসা ও ফাঁকি উঁচু-নিচু নরনারী নিক্তিনিরপেক্ষ হ’য়ে আজ মানবের সমাজের মতন একাকী নিবিড় নাবিক হ’লে ভালো হয়; হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি।
জীবনানন্দ দাশ
নিরঙ্কুশ জীবনানন্দ দাশ মালয় সমুদ্র পারে সে এক বন্দর আছে শ্বেতাঙ্গিনীদের। যদিও সমুদ্র আমি পৃথিবীতে দেখে গেছি ঢের: নীলাভ জলের রোদে কুয়ালালুম্পুর, জাভা, সুমাত্রা ও ইন্দোচীন, বালি অনেক ঘুরেছি আমি— তারপর এখানে বাদামী মলয়ালী সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন। শাদা-শাদা ছোটো ঘর নারকেলখেতের ভিতরে দিনের বেলায় আরো গাঢ় শাদা জোনাকির মতো ঝরঝরে। শ্বেতাঙ্গদম্পতী সব সেইখানে সামুদ্রিক কাঁকড়ার মতো সময় পোহায়ে যায়, মলয়ালী ভয় পায় ভ্রান্তিবশত, সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন। বাণিজ্যবায়ুর গল্পে একদিন শতাব্দীর শেষে অভ্যুত্থান শুরু হ’লো এইখানে নীল সমুদ্রের কটিদেশে; বাণিজ্যবায়ুর হর্ষে কোনো একদিন, চারিদিকে পামগাছ— ঘোলা মদ— বেশ্যালয়— সেঁকো— কেরোসিন সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে রোখে সারাদিন। সারাদিন দূর থেকে ধোঁয়া রৌদ্রে রিরংসায় সে ঊনপঞ্চাশ বাতাস তবুও বয়— উদীচীর বিকীর্ণ বাতাস; নারকেলকুঞ্জবনে শাদা-শাদা ঘরগুলো ঠাণ্ডা ক’রে রাখে; লাল কাঁকরের পথ—রক্তিম গির্জার মুণ্ড দেখা যায় সবুজের ফাঁকে: সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে নীলিমায় লীন।
জীবনানন্দ দাশ
পৃথিবীতে এই জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীতে এই জন্মলাভ তবু ভালো; ভূমিষ্ঠ হবার পরে যদিও ক্রমেই মনে হয় কোনো এক অন্ধকার স্তব্ধ সৈকতের বিন্দুর ভেতর থেকে কোনো অন্য দূর স্থির বলয়ের চিহ্ন লক্ষ্য ক’রে দুই শব্দহীন শেষ সাগরের মাঝখানে কয়েক মুহূর্ত এই সূর্যের আলো। কেন আলো? মাছিদের ওড়াউড়ি? কেবলি ভঙ্গুর চিহ্ন মুখে নিয়ে জল সুয়েজ হেলেস্‌পণ্ট প্রশান্ত লোহিতে পরিণতি চায় এই মাছি মাছরাঙা প্রেমিক নাবিক নষ্ট নাসপাতি মুখ ঠোঁট চোখ নাক করোটির গন্ধ স্পষ্ট এক নিরসনে স্থির ক’রে রেখে দেবে ব’লে; চলেছে— চলেছে— শিশির কুয়াশা বৃষ্টি ঝড়ের বিহ্বল আলোড়ন সমুদ্রের শত মৃত্যুশীল ফাঁকি ডানে-বাঁয়ে সারাদিন আবছা মরণ ঝেড়ে ফেলে— ঝাপ্‌সায় বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে আমাদের আশা ভালোবাসা ব্যথা রণঘড়ি সূর্যের ঘড়ি চিন্তা বুদ্ধি চাকার ঘুরুনি গ্লানি দাঁতালো ইস্পাত খানিকটা আলো উজ্জ্বলতা শান্তি চায়; জলের মরণশীল চ্ছলচ্ছল শুনে কম্পাশের চেতনাকে সর্বদাই উত্তরের দিকে রেখে সমুদ্রকে সর্বদাই শান্ত হ’তে ব’লে আমরা অন্তিম মূল্য পেতে চাই— প্রেমে; পৃথিবীর ভরাট বাজার ভরা লোকসান লোভ পচা উদ্ভিদ কুষ্ঠ মৃত গলিত আমিষ গন্ধ ঠেলে সময়ের সমুদ্রকে বার-বার মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে যেতে ব’লে।