author
stringclasses
36 values
text
stringlengths
86
1.25M
অজ্ঞাত
যাও যাও গিরি, আনিতে গৌরী, উমা নাকি বড় কেঁদেছে দেখেছি স্বপন, নারদ বচন, উমা মা মা বলে কেঁদেছে ৷ সোনার বরণী গৌরী আমার, ভাঙড় ভিখারী জামাই তোমার, মায়ের বসন ভূষণ সব আভরণ তাও বেচে নাকি ভাঙ্গ খেয়েছে । মা এসেছে, মা এসেছে রে! (ওরে মা এসেছে, মা এসেছে, মা এসেছে রে) ওরে আয় রে তোরা, শঙ্খ বাজা, ‘আগমনী’ গা-রে । আজ সবার সাথে আনন্দেতে মায়ের চরণ ধূলি নে-রে ॥ (মায়ের চরণ-ধূলি নে-রে) বহুদিন পরে আসিবে ঘরে উমা আমার। উমা বিহনে না হেরি নয়নে ত্রিলোক হয়েছে আঁধার। শরৎ-আকাশে মেঘ ভাসে, উমারে হেরিতে ধায় উল্লাসে, নদী কুলুকুলু রবে নেচে নেচে চলে চরণ ধোয়াবে তার॥ যে ছিল মোর নয়নের মণি, সে আজি হয়েছে শিবের ঘরণি, উমারাণী আমার শ্মশানবাসিনী এই কি ছিল কপালে আমার। (আজি) শরৎ শান্ত ঊষার তিলকে শূন্য কুটীর দ্বারে । (ঐ) এলো গো জননী মুক্ত আলোকে ফুল্ল কুসুম ভারে ॥ সম্ভার শত নাহি মা পূজার ভকত শরণে লহ উপহার, অশিব-নাশিনী শিব কর মা মঞ্জুল ফুল হারে ॥ (পীতাম্বর দাস বা মুকুন্দ দাস রচিত) একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী। কলের বোমা তৈরি করে দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো, বড়লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম আরেক ইংলন্ডবাসী। হাতে যদি থাকতো ছোরা তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা মাগো রক্ত-মাংসে এক করিতাম দেখতো জগতবাসী শনিবার বেলা দশটার পরে জজকোর্টেতে লোক না ধরে মাগো হল অভিরামের দ্বীপ চালান মা ক্ষুদিরামের ফাঁসি বারো লক্ষ তেত্রিশ কোটি রইলো মা তোর বেটা বেটি মাগো তাদের নিয়ে ঘর করিস মা ওদের করিস দাসী দশ মাস দশদিন পরে জন্ম নেব মাসির ঘরে মাগো তখন যদি না চিনতে পারিস দেখবি গলায় ফাঁসি।
অতুলপ্রসাদ সেন
বলো বলো বলো সবে অতুলপ্রসাদ সেন বলো বলো বলো সবে, শত-বীণা-বেণু-রবে, ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে, নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পূরবে। আজও গিরিরাজ রয়েছে প্রহরী, ঘিরি তিন দিক নাচিছে লহরী; যায়নি শুকায়ে গঙ্গা গোদাবরী, —এখনও অমৃতবাহিনী। প্রতি প্রান্তর, প্রতি গুহা বন, প্রতিজনপদ, তীর্থ অগণন, কহিছে গৌরব-কাহিনী॥ বিদুষী মৈত্রেয়ী খনা লীলাবতী, সতী সাবিত্রী সীতা অরুন্ধতী, বহু বীরবালা বীরেন্দ্র-প্রসূতি, আমরা তাঁদেরই সন্ততি। অনলে দহিয়া রাখে যারা মান, পতিপুত্র তরে সুখে ত্যজে প্রাণ, —আমরা তাঁদেরই সন্ততি॥ ভোলেনি ভারত ভোলেনি সেকথা, অহিংসার বাণী উঠেছিল হেথা, নানক নিমাই করেছিল ভাই সকল ভারত-নন্দনে। ভুলি ধর্ম-দ্বেষ জাতি অভিমান, ত্রিশ কোটি দেহ হবে এক প্রাণ, একজাতি প্রেম-বন্ধনে॥ মোদের এদেশ নাহি রবে পিছে, ঋষি-রাজকুল জন্মেনি মিছে, দু’দিনের তরে হীনতা সহিছে, জাগিবে আবার জাগিবে। আসিবে শিল্প ধন বাণিজ্য, আসিবে বিদ্যা বিনয় বীর্য, আসিবে আবার আসিবে॥ এসো হে কৃষক কুটির—নিবাসী, এসো অনার্য গিরি—বনবাসী, এসো হে সংসারী, এসো হে সন্ন্যাসী, —মিলো’ হে মায়ের চরণে॥ এসো অবনত, এসো হে শিক্ষিত, পরহিত-ব্রতে হইয়া দীক্ষিত, —মিলো’ হে মায়ের চরণে। এসো হে হিন্দু, এসো মুসলমান, এসো হে পারসী, বৌদ্ধ, খ্রিস্টিয়ান্,—মিল হে মায়ের চরণে॥ উঠোগো ভারতলক্ষ্মী অতুলপ্রসাদ সেন উঠোগো ভারতলক্ষ্মী! উঠো আদি জগত-জন-পূজ্যা, দুঃখ দৈন্য সব নাশি, করো দূরিত ভারত-লজ্জা। ছাড়োগো ছাড়ো শোক-শয্যা, করো সজ্জা পুনঃ কমল কনক ধন-ধান্যে। জননী গো লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে; কাঁদিছে তব চরণতলে ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো। কাণ্ডারী নাহিকো কমলা দুঃখ-লাঞ্ছিত ভারতবর্ষে, শঙ্কিত মোরা সব যাত্রী, কাল-সাগর-কম্পন দর্শে, তোমার অভয় পদ-স্পর্শে, নব হর্ষে, পুনঃ চলিবে তরণী শুভ লক্ষ্যে জননী গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে; কাঁদিছে তব চরণতলে ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো। ভারত-শ্মশান করো পূর্ণ পুনঃ কোকিল-কূজিত কুঞ্জে, দ্বেষ-হিংসা করি’ চূর্ণ, করো পূরিত প্রেম-অলি-গুঞ্জে, দূরিত করি পাপ-পুঞ্জে, তপঃ-তুঞ্জে, পুনঃ বিমল করো ভারত পুণ্যে৷ জননী গো, লহো তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস দেহ তুলে চক্ষে; কাঁদিছে তব চরণতলে ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো॥ মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা অতুলপ্রসাদ সেন মোদের গরব, মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা। কী যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে, (এমন কোথা আর আছে গো!) গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা॥ ঐ ভাষাতেই নিতাই গোরা, আনল দেশে ভক্তি-ধারা, (মরি হায়, হায়রে!) আছে কৈ এমন ভাষা, এমন দুঃখ-শ্রান্তি-নাশা॥ বিদ্যাপতি, চণ্ডি, গোবিন্, হেম, মধু, বঙ্কিম, নবীন; (আরও কত মধুপ গো!) ঐ ফুলেরই মধুর রসে বাঁধলো সুখে মধুর বাসা॥ বাজিয়ে রবি তোমার বীণে, আন্‌লো মালা জগৎ জিনে!- (গরব কোথায় রাখি গো!) তোমার চরণ-তীর্থে আজি জগৎ করে যাওয়া আসা॥ ঐ ভাষাতেই প্রথম বোলে, ডাক্‌নু মায়ে “মা, মা,” বলে; ঐ ভাষাতেই ব’লবো ‘হরি’, সাঙ্গ হ’লে কাঁদা হাসা॥ হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর অতুলপ্রসাদ সেন হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর, হও উন্নতশির—নাহি ভয়। ভুলি ভেদাভেদ-জ্ঞান, হও সবে আগুয়ান, সাথে আছে ভগবান—হবে জয়। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান; দেখিয়া ভারতে মহাজাতির উত্থান—জগজন মানিবে বিস্ময়! জগজন মানিবে বিস্ময়॥ তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ, হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন; ভারতে জনম, পুনঃ আসিবে সুদিন—ঐ দেখো প্রভাত-উদয়! ঐ দেখো প্রভাত-উদয়॥ ন্যায় বিরাজিত যাদের করে, বিঘ্ন পরাজিত তাদের শরে; সাম্য কভু নাহি স্বার্থে ডরে—সত্যের নাহি পরাজয়! সত্যের নাহি পরাজয়॥ তোর কাছে আসব মাগো অতুলপ্রসাদ সেন তোর কাছে আসব মাগো, শিশুর মত, সব আবরণ ফেলব দুরে আমার হৃদয় জুড়ে আছে যত। দৈন্য যে মা মনের মাঝে, ঘুচবে না তা মিথ্যা সাজে, সব আভরণ করব খালি, দেখবি মা তুই মনের কালি, শূন্য যে মোর প্রেমের থালি, তাই চরণে করব নত। মারবি মাগো যতই মোরে, ডাকব আমি ততই তোরে, ধরব যখন জড়িয়ে হাত, দেখব কেমন করবি আঘাত; তখন মা তুই পাবি ব্যথা, ব্যথা দিতে অবিরত। মনের হরষ মনের আশে; বলব সরল শিশুর ভাষে, সুখের খেলনা হাতে পেয়ে, তোর কাছে মা যাব ধেয়ে; তোর স্নেহাশীষ মাথায় লয়ে, ভবের খেলা খেলব যত॥ দাও হে, ওহে প্রেমসিন্ধু অতুলপ্রসাদ সেন দাও হে, ওহে প্রেমসিন্ধু! দাও এ নবীন যুগলে তোমার প্রেমের মধুর বিন্দু সুর-নর-চিত-বাঞ্চিত। যে প্রেমের শুধু প্রেম পরিণাম, তোমাতে উদয় তোমাতে বিরাম, বিষয়-বাসনা, ধন-জন-মান যে প্রেম করে না লাঞ্চিত। দুইটি হৃদয় হয়ে একাকার, স্বার্থের বাঁধ করিয়া বিদার বিশ্বের বুকে চলুক উদার কখনো না হয়ে কুঞ্চিত। টেনে লও, ওহে প্রেম পারাবার, তব শুভ কোলে হৃদি দুজনার, তোমার মধুর কঠোর শাসনে, কখনো কোরো না বঞ্চিত॥ দে মা দেখা সময় কালে অতুলপ্রসাদ সেন দে মা দেখা সময় কালে তুমি হর্তা কর্তা সর্বকালে॥ যে তোমারে পূজা করে সে থাকে সদা কুশলে কর্ম ধর্ম সকল তুমি জানবে লোকে কালে কালে॥ তুমি যারে ভালোবাস মরণ নাই তার কোনো কালে মৃত্যুঞ্জয়ী নাম ধরো মৃত্যু পালায় নাম শুনিলে॥ দয়াময়ের রাজ্যে তুমি আছো মাগো কৌতূহলে আমি হিসেব করে দেখলাম আবার জগৎ আছে তোমার কোলে॥ দয়াময়ের নামটি তোমার দেও মা আমার হৃদ কমলে আমি জন্ম দুঃখ দিয়া বিদায় পড়ে থাকব চরণ তলে॥ নমো বাণী বীণাপাণি, জগত-চিত্ত-সস্মোহিনী, নমো বাদ-সংগীত মাতঃ.ভারতী ভরতারিণী। সৌরলোক গীতচালিত, দ্যুলোকে ভুলোক গীতমুখরিত; ষড় ঋতু ষড়রাগরঞ্জিত বন্দে চরণে বন্দিনী। সুপ্ত স্মৃতি পুনঃ জীবিত, শান্ত তৃপ্ত তাপিত চিত, সুখী জন সদা নন্দিত তব সংগীত চন্দে। প্রেমমুখর মুরলী রন্ধ্র, সমরে ডমরু মরণমন্দ্র, গীত আদি-বেদ মন্ত্র তব সংগীত ছন্দে। নমো ঈশ্বর নন্দিনী। সংসারে যদি নাহি পাই সাড়া, তুমি তো আমার রহিবে। বহিবারে যদি না পারি এ ভার, তুমি তো বন্ধু, বহিবে। কলুষ আমার, দীনতা আমার, তোমারে আঘাত করে শতবার; আর কেহ যদি না পারে সহিতে, তুমি তো বন্ধু, সহিবে। যাক ছিঁড়ে যাক মোর ফুলমালা, থাক পরে থাক ভরা ফুলডালা। হবে না বিফল মোর ফুল তোলা- তুমি তো চরণে লইবে। দুঃখেরে আমি ডরিব না আর, কন্টক হোক কন্ঠের হার, জানি তুমি মোরে করিবে অমল যতই অনলে দহিবে॥ তোমায় ঠাকুর বলব নিঠুর কোন মুখে? শাসন তোমার যতই শুরু ততই টেনে লও বুকে। সুখ পেলে দিই অবহেলা মরণ মাগি দুখের বেলা; তবু ফেলে যাওনা চলে, সদাই থাক সস্মুখে। প্রতিদিনের অশেষ যতন, ভুলায় দেয় ক্ষণিক বেদন; নিত্য আছি ডুবিয়ে তাই পাসরি প্রেমসিন্ধুকে। সুখের পিছে মরি ঘুরে তাই তো রে সুখ পালায় দুরে; সে আনন্দ, ওরে অন্ধ, বন্ধ মনের । ভুলে যে যাই সবাই আমার, নই তো ভিন্ন আমি সবার; দশের মুখে হাসি রেখে কাঁদব আমি কোন দুখে? ভবের পথে শূন্য থালি, বেড়াই ঘুরে দীন কাঙালী, দৈন্য আমার ঘুচবে যবে পাব দীনবন্ধুকে! তাহারে ভুলিবে বলো কেমনে? গাঁথা যে সে তব শত গানের যতনে। কী হবে রুধিয়া দোর? ভাঙা যে হৃদয় তোর, মানিবে না মন-চোর বাহিরের বারণে॥ যাবি কোন দুর বিজনে পাসরিতে সেই জনে? সেথাও তো গাহে পাখি কাননে। সেথাও তো ফোটে ফুল, বরষা বিরহাকুল; সেথাও তো ওঠে চাঁদ রজনীর গগনে॥ ওহে জগত কারণ অতুলপ্রসাদ সেন ওহে জগত কারণ ! একি নিয়ম তব? এ কি মহোৎসব, এ কি মিলন নব? গ্রহ ডাকিয়া গ্রহে মিলন মাগে? অনু অনুকে ডাকে চির অনুরাগে। হৃদয় হৃদয়ে ডাকে প্রেম-সোহাগে, অখিল নিখিল ভরা এ কি আহবান রব? যে নিয়মে জীবগণ সুখ-দুখ-অন্ধ; প্রেম-পারিজাতে, প্রভু, একি মকরন্দ? দুইটি অন্তর তাই দুরান-র হতে, করিছে শপথ আজ মিলি একসাথে, ‘প্রেম হইবে রথী জীবনের রথে, তুচ্ছ দৈন্য, অতি তুচ্ছ বিভব।’ মিছে তুই ভাবিস মন অতুলপ্রসাদ সেন মিছে তুই ভাবিস মন। তুই গান গেয়ে যা গান গেয়ে যা আজীবন। পাখিরা বনে বনে, গাহে গান আপন-মনে; ওরে নাই বা যদি কেহ শোনে, তুই গেয়ে যা গান অকারণ। ফুলটি ফোটে যবে ভাবে কি কাল কি হবে? না-হয় তাদের মতন শুকিয়ে যাবি গন্ধ করি বিতরণ । মনোদুখ চাপি মনে হেসে নে সবার সনে, যখন ব্যথার ব্যথীর পাবি দেখা জানাস প্রাণের বেদন। আজি তোর যার বিরহে নয়নে অশ্রু বহে ওরে হয়তো তাহার পাবি দেখা গানটি হলে সমাপন। আয়, আয়, আমার সাথে ভাসবি কে আয় অতুলপ্রসাদ সেন আয়, আয়, আমার সাথে ভাসবি কে আয়! আজ আমার জোড় লেগেছে ভাঙা ভেলায়! ঐ দেখ চাঁদের আলো ঐ শোন কলকল কেমনে থাকবি বল শুকনো ডাঙায় ? আয় তোরা কুল ভুলানো কুল ভুলানো এই দরিয়ায়! নায়ে মোর নাই কিছু নাই তাই সবার লাগি হবে রে ঠাঁই। ভুলেছি কুলের বালাই, ভেসেছি তাই। কে তোরা বাঁধা বাটে, কে তোরা বাঁধা ঘাটে, সুখেতে থাকিস যদি থাক তোরা ভাই। যার আঁখি ছলছল চল চল আমার এ নায়! ঐ দেখ সুরধনী ছোটে কার ডাকটি শুনি; আমিও ডাক শুনেছি ‘আয়, ‘আয়, আয়!’ চল আজ স্রোতের সনে, ছুটি সেই ডাকের পানে, যেখানে জীবন মরণ সব ভেসে যায়! যেখানে যাবে জানা সেই অজানায়। পরের শিকল ভাঙিস পরে, নিজের নিগড় ভাই। আপন কারায় বন্ধ তোরা, পরের কারায় বন্দী তাই। হা রে মুর্খ, হা রে অন্ধ, ভাইয়ে ভাইয়ে করি দ্বন্দ্ব। দেশের শক্তি করিস মন্দ তোদের তুচ্ছ করে তাই সবাই। সার ত্যজিয়ে খোসার বড়াই! তাই মন্দিরে মসজিদে লড়াই। প্রবেশ করে দেখবে দু’ভাই অন্দরে যে একজনাই। দেশ-মাতার আর বিশ্ব-মাতার ম্লেচ্ছ কাফের এক পরিবার। নয় তুরস্ক, নয়কো তাতার জন্ম মৃত্যু এই যে ঠাঁই। ভিন্ন জাত আর বংশ, এক জাতি তাই একশো অংশ। হিন্দুরে, তুই হবি ধ্বংস, না ঘুচালে এই বালাই। ভাইকে ছুঁলে পদতলে শুদ্ধ হোস তুই গঙ্গাজলে, ওরে সেই অচ্ছৎ ছেলেই তুলে কোলে তুষ্ট হন যে গঙ্গা মাঈ॥ খাবি নে জল ভাইয়ের দেওয়া? খাসনে অন্ন তাদের ছোঁওয়া? ওরে শবরীর আধ খাওয়া মেওয়া রঘুনাথ তো খেলেন তাই। তোরাই আবার সভাস\’লে হাঁকিস সাম্য উচ্চরোলে সম-তন্ত্র চাস সকলে বিশ্ব প্রেমের দিস দোহাই। জাতির গলায় জাতের ফাঁস, ধর্ম করছে ধর্মনাশ, নিজের পায়ে, পারলি পাশ, দাসত্ব ঘোচে না তাই। ছাড়, দেখি রে রেশারেশি কর প্রাণে প্রাণে মেলামেশি। তখন তোদের সব বিদেশী দাস না বলে বলবে ভাই॥ মোর আজি গাঁথা হল না মালা, পরের তোলা ফুলে ভরা ডালা। তুলিব ফুল যত আপন মনোমত, যদিও কাঁটা শত দিবে জ্বালা। যদিও খুঁছিলে চামেলি নাহি মিলে, সাজাব বনফুলে তার গলা। একেলা তরু ছায় গাঁথিতে সে মালায় যদিও বেলা যায়-যাক বেলা॥ চাঁদিনী রাতে কে গো আসিলে? উজল নয়নে কে গো হাসিলে? মোহন সুরে ধীরে মধুরে পরাণ-বীণায় কে গো বাজিলে? হেম-যমুনায় প্রেম-তরী বায়, ডাকে আমায় ‘আয় গো আয়’- প্রভাতবেলায় সোনার ভেলায় কেমনে চলে যাবে হায়! তব সে ফুলে যাবে কি ভুলে যে ভালোবাসা বাসিলে? এসো গো একা ঘরে একার সাথী। সজল নয়নে বল রব কত রাতি! সুনীলআকাশে চন্দ্র বিকাশে, তামস নাশে; এ আঁধারে হাসিবে তব্ মুখ ভাতি। তোমারে গোপন ব্যথা জানাব গোপনে, তোমারে কুসুমমালা পরাব যতনে। তব সঙ্গ মাগি আছি আমি জাগি সরব-তেয়াগী; তব চরণ লাগি আছি কান পাতি॥ ওগো নিঠুর দরদী, এ কি খেলছ অনুক্ষণ। তোমার কাঁটায় ভরা বন,তোমার প্রেমে ভরা মন॥ মিছে দাও কাঁটার ব্যথা, সহিতে না পার তা ; আমার আঁখিজল তোমার করে গো চঞ্চল, তাই নয় বুঝি বিফল আমার অশ্রু বরিষণ। ডাকিলে কওনা কথা, কি নিঠুর নিরবতা॥ আবার ফিরে চাও, বল, ‘ওগো শুনে যাও; তোমার সাথে আছে আমার অনেক কথন॥ নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন, তুই সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন। মূঢ় মন, সুখি জনের করিস পূজা, দুঃখীর অযতন। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। লাগে নি যার পায়ে ধুলি, কি নিবি তার চরণ ধুলি, নয়রে সোনায়, বনের কাঠেই হয় রে চন্দন। মূঢ় মন, হয় রে চন্দন। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। এ মোধন মায়ের মতন, দুঃখীটুতেই অধিক যতন, এ ধনেতে ধনি যে জন, সেই তো মহাজন। মূঢ় মন, সেই তো মহাজন। বৃথা তোর কৃচ্ছসাধন, সেবাই নরের শ্রেষ্ঠ সাধন, মানবের পরম তীর্থ দীনের শ্রীচরণ। মূঢ় মন, দীনের শ্রীচরণ। মতামতের তর্কে মত্ত, আছিস ভুলে পরম সত্য, সকল ঘরে সকল নরে আছেন নারায়ণ। মূঢ় মন, আছেন নারায়ণ। নীচুর কাছে নীচু হতে শিখলি না রে মন। জল বলে, চল মোর সাথে চল, কখনো তোর আঁখিজল হবে না বিফল। চেয়ে দেখ মোর নীল জলে, শত চাঁদ করে টলমল। বধুরে আন ত্বরা করি, কূলে এসে মধু হেসে ভরবে গাগরি; ভরবে প্রেমে হৃদকলসী, করবে ছলছল। মোরা বাহিরে চঞ্চল, মোরা অন্তরে অতল, সে অতলে সদা জ্বলে রতন উজল। এই বুকে ফোটে সুখে হাসিমুখে শতদল; নহে তীরে, ওই নীরে হ’রি রে শীতল॥ একা মোর গানের তরী অতুলপ্রসাদ সেন একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন-জলে। সহসা কে এলে গো এ তরী বাইবে ব’লে যা ছিল কল্পমায়া, সে কি আজ ধরল কায়া? কে আমার বিফল মালা পরিয়ে দিল তোমার গলে। কেন মোর গানের ভেলায় এলে না প্রভাত-বেলায়? হলে না সুখের সাথী জীবনের প্রথম দোলায়। বুঝি মোর করুণ গানে ব্যাথা তাঁর বাজল প্রাণে, এলে কি দু’কুল হতে কূল মেলাতে এ অকূলে॥ আর কতকাল থাকব ব’সে দুয়ার খুলে, বধূ আমার! তোমার বিশ্বকাজে আমারে কি রইলে ভুলে, বধূ আমার। বাহিরে উষ্ণ বায়ে মালা যে যায় শুকায়ে, নয়নের জল, বুঝি তাও, বধূ মোর, যায় ফুরায়ে। শুধু ডোরখানি হায় কোন পরাণে তোমার গলায় দিব তুলে, বধূ আমার। হৃদয়ের শব্দ শুনে চমকি’ভাবি মনে, ঐ বুঝি এল বধূ ধীরে মৃদুল চরণে; পরাণে লাগলে ব্যথা ভাবি বুঝি আমায় ছুঁলে, বধূ আমার। বিরহে দিন কাটিল, কত যে কথা ছিল, কত যে মনের আশা মন-মাঝে রহিল; কী ল’য়ে থাকব বলো তুমি যদি রইলে ভুলে, বধূ আমার॥ আমারে এ আঁধারে এমন ক’রে চালায় কে গো? আমি দেখতে নারি, ধরতে নারি, বুঝতে নারি কিছুই যে গো। নয়নে নাহি ভাতি, মনে হয় চিররাতি, মনে হয় তুমি আমার চিরসাথী; একবার জ্বালিছে বাতি, ঘুচিয়ে রাতি নয়ন ভ’রে দেখা দে গো। কাঁদায়ে কাঁটার ক্রেশে, কঠিন এই পথের শেষে না জানি নিয়ে যাবে কোন বিদেশে। একবার ভালোবেসে, কাছে এসে, কানে কানে ব’লে দে গো । রয়েছিস যদি সাথে, দারুণ এ আঁধার রাতে, ক্লান্ত মোরে চালিয়ে নে যা হাতে হাতে। হস্ত আমার শিথিল হলেও তুই আমারে ছাড়িস নে গো। পাগলা, মনটারে তুই বাঁধ। কেন রে তুই যেথা সেথা পরিস প্রাণে ফাঁদ শীতল বায়ে আসলে নিশি, তুই কেন রে হোস উদাসী? ওরে নীলাকাশে অমন ক’রে হেসেই থাকে চাঁদ। শৈলশিরে সোনার খেলা দেখিস যবে প্রভাতবেলা, তুই কেন রে হোস উতলা দেখে মোহন ছাঁদ? করুণ সুরে গাইলে পাখি তোর কেন রে ঝরে আঁখি? কবে তুই মুছবি নয়ন, ঘুচবে মনের ধাঁদ সংসারেতে উঠলে হাসি তুই শুনিস রে ব্রজের বাঁশি। ওরে ভাবিস কি রে সবই গোকুল, সবই কালাচাঁদ? কতই পেলি ভালোবাসা, তবু না তোর মেটে আশা। এবার তুই একলা ঘরে নয়ন ভ’রে কাঁদ। ওগো, সুখ নাহি চাই। তোমার পরাণ-পাশে দিয়ো মোরে ঠাঁই। তুমি যদি থাক সুখে, আমারে রাখিয়ো সুখে; তুমি যদি পাও দুঃখ যেন দুখ পাই॥ নাহি বুঝি কান্না হাসি, দারিদ্র্য সম্পদরাশি; তোমাছাড়া সুখ দুঃখ সকলি বালাই। ওগো আমার নবীন সাথী অতুলপ্রসাদ সেন ওগো আমার নবীন সাথী, ছিলে তুমি কোন বিমানে? আমার সকল হিয়া মুঞ্জরিছে তোমারি ওই করুণ গানে॥ জগতের গহন বনে ছিনু আমি সঙ্গোপনে, না জানি কি লয়ে মনে এলে উড়ে আমার পানে। লয়ে তোমার মোহন বরণ আমার শুকনো ডালে রাখলে চরণ; আজ আমার জীবন-মরণ কোথা আছে কে বা জানে॥ ঝরে গেছে সকল আশা, ফোটে না আর ভালোবাসা, আজ তুমি বাঁধলে বাসা আমার প্রাণে কোন পরাণে? মেঘের দল বেঁধে যায় কোন দেশে, ও আকাশ, বল আমারে! তারা কেউ বা রঙিন ওড়না গায়ে, কেউ সাদা, কেউ নীল বেশে॥ তারা কোন্ যমুনার নীরে ভরবে গাগরি, কার বাঁশরী শুনল এরা সাগর নাগরী, মরি মরি। তারা বাজিয়ে নূপুর ঝুমুর ঝুমুর, যায় চলে কার উদ্দেশ্যে? কভু বাজিয়ে ডমরু তারা উল্লাসে নাচে, কভু ভানুর সঙ্গে খেলে হোলি প্রভাতে সাঁঝে, মরি মরি! তারা বিধুর সনে কী কথা কয় উজ্জ্বল মধুর হেসে। আকাশ, বল রে আমায় বল, আমার আঁখি জল তাদের মতো জীবনখানি করবে কি শ্যামল-আমায় বল রে। আমি তাদের মতো আমার বধুর সনে মধুর খেলা খেলব কি দিনের শেষে?
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ক্ষীরের পুতুল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক রাজার দুই রানী, দুও আর সুও। রাজবাড়িতে সুওরানীর বড়ো আদর, বড়ো যত্ন। সুওরানী সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশো দাসী তাঁর সেবা করে, পা ধোয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুল, সেই ফুলে সুওরানী মালা গাঁথেন। সাত সিন্দুক-ভরা সাত-রাজার-ধন মানিকের গহনা, সেই গহনা অঙ্গে পরেন। সুওরানী রাজার প্রাণ। আর দুওরানী— বড়োরানী, তাঁর বড়ো অনাদর, বড়ো অযত্ন। রাজা বিষ নয়নে দেখেন। একখানি ঘর দিয়েছেন— ভাঙাচোরা, এক দাসী দিয়েছেন— বোবা-কালা। পরতে দিয়েছেন জীর্ণ শাড়ি, শুতে দিয়েছেন— ছেঁড়া কাঁথা। দুওরানীর ঘরে রাজা একটি দিন আসেন, একবার বসেন, একটি কথা কয়ে উঠে যান। সুওরানী— ছোটোরানী, তারই ঘরে রাজা বারোমাস থাকেন। একদিন রাজা রাজমন্ত্রীকে ডেকে বললেন— মন্ত্রী, দেশবিদেশ বেড়াতে যাব, তুমি জাহাজ সাজাও। রাজার আজ্ঞায় রাজমন্ত্রী জাহাজ সাজাতে গেলেন। সাতখানা জাহাজ সাজাতে সাত মাস গেল। ছ’খানা জাহাজে রাজার চাকরবাকর যাবে, আর সোনার চাঁদোয়া-ঢাকা সোনার জাহাজে রাজা নিজে যাবেন। মন্ত্রী এসে খবর দিলেন— মহারাজ, জাহাজ প্রস্তুত। রাজা বললেন— কাল যাব। মন্ত্রী ঘরে গেলেন। ছোটোরানী— সুওরানী রাজ-অন্তঃপুরে সোনার পালঙ্কে শুয়েছিলেন, সাত সখী সেবা করছিল, রাজা সেখানে গেলেন। সোনার পালঙ্কে মাথার শিয়রে বসে আদরের ছোটোরানীকে বললেন— রানী, দেশ-বিদেশ বেড়াতে যাব, তোমার জন্য কী আনব? রানী ননীর হাতে হীরের চুড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন— হীরের রঙ বড়ো শাদা, হাত যেন শুধু দেখায়। রক্তের মতে রাঙা আট-আট গাছ মানিকের চুড়ি পাই তো পরি। রাজা বললেন— আচ্ছা রানী, মানিকের দেশ থেকে মানিকের চুড়ি আনব। রানী রাঙা পা নাচিয়ে নাচিয়ে, পায়ের নূপুর বাজিয়ে বাজিয়ে বললেন— এ নূপুর ভালো বাজে না। আগুনের বরন নিরেট সোনার দশ গাছা মল পাই তো পরি। রাজা বললেন— সোনার দেশ থেকে তোমার পায়ের সোনার মল আনব। রানী গলার গজমতি হার দেখিয়ে বললেন— দেখ রাজা, এ মুক্তো বড়ো ছোটো, শুনেছি কোন দেশে পায়রার ডিমের মতো মুক্তো আছে, তারি একছড়া হার এনো। রাজা বললেন— সাগরের মাঝে মুক্তোর রাজ্য, সেখান থেকে গলার হার আনব। আর কী আনব রানী? তখন আদরিনী সুওরানী সোনার অঙ্গে সোনার আঁচল টেনে বললেন— মা গো, শাড়ি নয় তো বোঝা! আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পাই তো পরে বাঁচি। রাজা বললেন— আহা, আহা, তাই তো রানী, সোনার আঁচলে সোনার অঙ্গে ছড় লেগেছে, ননীর দেহে ব্যথা বেজেছে। রানী, হাসিমুখে বিদায় দাও, আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি আনিগে। ছোটােরানী হাসিমুখে রাজাকে বিদায় করলেন। রাজা বিদায় হয়ে জাহাজে চড়বেন— মনে পড়ল দুখিনী বড়োরানীকে।  দুওরানী— বড়োরানী, ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কাঁদছেন, রাজা সেখানে এলেন। ভাঙা ঘরের ভাঙা দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন— বড়োরানী, আমি বিদেশ যাব। ছোটোরানীর জন্যে হাতের বালা, গলার মালা, পায়ের মল, পরনের শাড়ি আনব। তোমার জন্যে কী আনব? বলে দাও যদি কিছু সাধ থাকে। রানী বললেন— মহারাজ, ভালোয় ভালোয় তুমি ঘরে এলেই আমার সকল সাধ পূর্ণ হয়। তুমি যখন আমার ছিলে তখন আমার সোহাগও অনেক ছিল, সাধও অনেক ছিল। সোনার শাড়ি অঙ্গে পরে সাতমহল বাড়িতে হাজার হাজার আলো জ্বালিয়ে সাতশো সখীর মাঝে রানী হয়ে বসবার সাধ ছিল, সোনার পিঞ্জরে শুক-শারীর পায়ে সোনার নূপুর পরিয়ে দেবার সাধ ছিল। মহারাজ, অনেক সাধ ছিল, অনেক সাধ মিটেছে। এখন আর সোনার গহনায় সোনার শাড়িতে কী কাজ? মহারাজ, আমি কার সোহাগে হীরের বালা হাতে পরব? মোতির মালা গলায় দেব? মানিকের সিঁথি মাথায় বাঁধব? মহাবাজ, সেদিন কি আর আছে! তুমি সোনার গহনা দেবে, সে সোহাগ তো ফিরে দেবে না! আমার সে সাতশো দাসী সাতমহল বাড়ি তো ফিরে দেবে না! বনের পাখি এনে দেবে, কিন্তু, মহারাজ, সোনার খাঁচা তো দেবে না! ভাঙা ঘরে সোনার গহনা চোর-ডাকাতে লুটে নেবে, ভাঙা খাঁচায় বনের পাখি কেন ধরা দেবে? মহারাজ, তুমি যাও, যাকে সোহাগ দিয়েছ তার সাধ মেটাও গে, ছাই সাধে আমার কাজ নেই। রাজা বললেন— না রানী, তা হবে না, লোকে শুনলে নিন্দে করবে। বল তোমার কী সাধ? রানী বললেন— কোন লাজে গহনার কথা মুখে আনব? মহারাজ, আমার জন্যে পোড়ারমুখ একটা বাঁদর এনো। রাজা বললেন— আচ্ছা রানী, বিদায় দাও। তখন বড়োরানী— দুওরানী ছেঁড়া কাঁথায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে রাজাকে বিদায় দিলেন। রাজা গিয়ে জাহাজে চড়লেন। সন্ধ্যাবেলা সোনার জাহাজ সোনার পাল মেলে অগাধ সাগরের নীল জল কেটে সোনার মেঘের মতো পশ্চিম মুখে ভেসে গেল। ভাঙা ঘরে দুওরানী নীল সাগরের পারে চেয়ে, ছেঁড়া কাঁথায় পড়ে রইলেন। আর আদরিনী সুওরানী সাতমহল অন্তঃপুরে, সাতশো সখীর মাঝে, গহনার কথা ভাবতে ভাবতে, সোনার পিঞ্জরে সোনার পাখির গান শুনতে শুনতে, সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে পড়লেন। রাজাও জাহাজে চড়ে দুঃখিনী বড়োরানীকে ভুলে গেলেন। বিদায়ের দিনে ছোটোরানীর সেই হাসিহাসি মুখ মনে পড়ে আর ভাবেন— এখন রানী কী করছেন? বোধ হয় চুল বাঁধছেন। এবার রানী কী করছেন? বুঝি রাঙা পায়ে আলতা পরছেন। এবার রানী সাত মালঞ্চে ফুল তুলছেন, এবার বুঝি সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুলে রানী মালা গাঁথছেন আর আমার কথা ভাবছেন। ভাবতে ভাবতে বুঝি দুই চক্ষে জল এল, মালা আর গাঁথা হল না। সোনার সুতো, ফুলের সাজি পায়ের কাছে পড়ে রইল; বসে বসে সারা রাত কেটে গেল, রানীর চোখে ঘুম এল না। সুওরানী— ছোটোরানী রাজার আদরিনী, রাজা তারই কথা ভাবেন। আর বড়োরানী রাজার জন্যে পাগল, তার কথা একবার মনেও পড়ে না। এমনি করে জাহাজে দেশ-বিদেশে রাজার বারো-মাস কেটে গেল। তেরো মাসে রাজার জাহাজ মানিকের দেশে এল। মানিকের দেশে সকলই মানিক। ঘরের দেওয়াল মানিক, ঘাটের শান মানিক, পথের কাঁকর মানিক। রাজ সেই মানিকের দেশে সুয়োরানীর চুড়ি গড়ালেন। আট হাজার মানিকের আটগাছি চুড়ি, পরলে মনে হয় গায়ের রক্ত ফুটে পড়ছে।  রাজা সেই মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে এলেন। সেই সোনার দেশে স্যাক্‌রার দোকানে নিরেট সোনার দশগাছা মল গড়ালেন। মল জ্বলতে লাগল যেন আগুনের ফিন্‌কি, বাজতে লাগল যেন বীণার ঝংকার— মন্দিরার রিনি-রিনি। রাজা মানিকের দেশে মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে এলেন। সে দেশে রাজার বাগানে দুটি পায়রা। তাদের মুক্তোর পা, মানিকের ঠোঁট, পান্নার গাছে মুক্তোর ফল খেয়ে মুক্তোর ডিম পাড়ে। দেশের রানী সন্ধ্যাবেলা সেই মুক্তোর মালা গাঁথেন, রাতের বেলায় খোঁপায় পরেন, সকাল বেলায় ফেলে দেন। দাসীরা সেই বাসি মুক্তোর হার এক জাহাজ রুপো নিয়ে বাজারে বেচে আসে। রাজা এক জাহাজ রুপো দিয়ে সুওরানীর গলায় দিতে সেই মুক্তোর এক ছড়া হার কিনলেন। তারপর মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর হার গাঁথিয়ে, ছ’মাস পরে রাজা এক দেশে এলেন। সে দেশে রাজকন্যের উপবনে নীল মানিকের গাছে নীল গুটিপোকা নীলকান্ত মণির পাতা খেয়ে, জলের মতো চিকন, বাতাসের মতো ফুরফুরে, আকাশের মতো নীল রেশমের গুটি বাঁধে। রাজার মেয়ে সারা রাত ছাদে বসে, আকাশের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে, সেই নীল রেশমে শাড়ি বোনেন। একখানি শাড়ি বুনতে ছ’মাস যায়। রাজকন্যে একটি দিন সেই আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পরে শিবের মন্দিরে মহাদেব নীলকণ্ঠের পূজা করেন। ঘরে এসে শাড়ি ছেড়ে দেন, দাসীরা যার কাছে সাত জাহাজ সোনা পায় তার কাছে শাড়ি বেচে। রাজা সাত জাহাজ সোনা দিয়ে আদরিনী সুওরাণীর শখের শাড়ি কিনলেন। তারপর আর ছ’মাসে রাজার সাতখানা জাহাজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ছোটোরানীর মানিকের চুড়ি, সোনার মল, মুক্তোর মালা, সাধের শাড়ি নিয়ে দেশে এল। তখন রাজার মনে পড়ল বড়োরানী বাঁদর চেয়েছেন। রাজা মন্ত্রীকে বললেন— মন্ত্রীবর, বড়ো ভুল হয়েছে। বড়োরানীর বাঁদর আনা হয়নি, তুমি একটা বাঁদরের সন্ধানে যাও। রাজমন্ত্রী একটা বাঁদরের সন্ধানে চলে গেলেন। আর রাজা শ্বেতহস্তী চড়ে লোকারণ্য রাজপথ দিয়ে, ছোটোরানীর সাধের গহনা শখের শাড়ি নিয়ে অন্তঃপুরে চলে গেলেন। ছোটোরানী সাত-মহল বাড়ির সাত-তলার উপরে সোনার আয়না সামনে রেখে, সোনার কাঁকুইয়ে চুল চিরে, সোনার কাঁটা সোনার দড়ি দিয়ে খোঁপা বেঁধে সোনার চেয়াড়িতে সিঁদুর নিয়ে ভুরুর মাঝে টিপ পরছেন, কাজল-লতায় কাজল পেড়ে চোখের পাতায় কাজল পরছেন, রাঙা পায়ে আলতা দিচ্ছেন, সখীরা ফুলের থালা নিয়ে, পানের বাটা নিয়ে রাজরানী ছোটোরানীর সেবা করছে— রাজা সেখানে এলেন। স্ফটিকের সিংহাসনে রানীর পাশে বসে বললেন— এই নাও, রানী! মানিকের দেশে মানিকের ঘাট, মানিকের বাট— সেখান থেকে হাতের চুড়ি এনেছি। সোনার দেশে সোনার ধুলো, সোনার বালি— সেখান থেকে পায়ের মল এনেছি। মুক্তোর রাজ্যে মুক্তোর পা, মানিকের ঠোঁট, দুটি পাখি মুক্তোর ডিম পাড়ে। দেশের রানী সেই মুক্তোর হার গাঁথেন, রাতের বেলায় খোঁপায় পরেন, ভোরের বেলায় ফেলে দেন। রানী, তোমার জন্যে সেই মুক্তোর হার এনেছি। রানী, এক দেশে রাজার মেয়ে, এক-খী রেশমে সাত-খী সুতো কেটে নিশুতি রাতে ছাদে বসে ছ’টি মাসে একখানি শাড়ি বোনেন, এক দিন পরে পুজো করেন, ঘরে এসে ছেড়ে দেন। রানী, আমি সেই রাজার মেয়ের দেশ থেকে সাত জাহাজ সোনা দিয়ে রাজকন্যার হাতে বোনা শাড়ি এনেছি। তুমি একবার চেয়ে দেখ! পৃথিবী খুঁজে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, একবার পরে দেখ!  রানী তখন দু’হাতে আটগাছা চুড়ি পরলেন; মানিকের চুড়ি রানীর হাতে ঢিলে হল, হাতের চুড়ি কাঁধে উঠল। রানী তখন দু’পায়ে দশ-গাছা মল পরলেন; রাঙা পায়ে সোনার মল আল্‌গা হল, দু’পা যেতে দশ গাছা মল শানের উপর খসে পড়ল। রানী মুখ ভার করে মুক্তোর হার গলায় পরলেন; মুক্তোর দেশের মুক্তোর হার রানীর গলায় খাটো হল, হার পরতে গলার মাস কেটে গেল। রানী ব্যথা পেলেন। সাত-পুরু করে শখের শাড়ি অঙ্গে পরলেন; নীল রেশমের নীল শাড়ি হাতে বহরে কম পড়ল। রানীর চোখে জল এল। তখন মানিনী ছোটোরানী আট হাজার মানিকের অাটগাছা চুড়ি খুলে ফেলে, নিরেট সোনার দশগাছা মল পায়ে ঠেলে, মুক্তোর মালা শখের শাড়ি ধুলোয় ফেলে বললেন— ছাই গহনা! ছাই এ শাড়ি! কোন্ পথের কাঁকর কুড়িয়ে এ চুড়ি গড়ালে? মহারাজ, কোন্ দেশের ধুলো বালিতে এ মল গড়ালে? ছি ছি, এ কার বাসি মুক্তোর বাসি হার! এ কোন্ রাজকন্যার পরা শাড়ি! দেখলে যে ঘৃণা আসে, পরতে যে লজ্জা হয়! নিয়ে যাও মহারাজ, এ পরা শাড়ি পরা-গহনায় আমার কাজ নেই। রানী অভিমানে গোসা-ঘরে খিল দিলেন। আর রাজা মলিনমুখে সাত জাহাজ সোনা দিয়ে কেনা সেই সাধের গহনা, শখের শাড়ি নিয়ে রাজসভায় এলেন। রাজমন্ত্রী রাজসিংহাসনের এক পাশে, রাজ্যের মাঠ-ঘাট দোকানপাট সন্ধান করে, যাদুকরের দেশের এক বণিকের জাহাজ থেকে, কানা-কড়ি দিয়ে একটি বাঁদরছানা কিনে বসে আছেন। রাজা এসে বললেন— মন্ত্রীবর, আশ্চর্য হলুম! মাপ দিয়ে ছোটোরানীর গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি আনলুম, সে শাড়ি, সে গহনা, রানীর গায়ে হল না! তখন সেই বনের বানর রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে—বড়ো ভাগ্যবতী পুণ্যবতী না হলে দেবকন্যের হাতে বোনা, নাগকন্যের হাতে গাঁথা, মায়া-রাজ্যের এ মায়া-গহনা, মায়া-শাড়ি, পরতে পায় না। মহারাজ, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ, যাকে বৌ করবে তাকে পরতে দিও। বানরের কথায় রাজা অবাক হলেন। হাসতে হাসতে মন্ত্রীকে বললেন— মন্ত্রী বানরটা বলে কি? ছেলেই হল না, বৌ অানব কেমন করে? মন্ত্রী, তুমি স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়তে দাওগে, তাঁতির তাঁতে রানীর শাড়ি বুনতে দাওগে। এ গহনা, এ শাড়ি, রাজভাণ্ডারে তুলে রাখ; যদি বৌ ঘরে আনি তাকে পরতে দেব। রাজমন্ত্রী স্যাকরার দোকানে ছোটোরানীর নতুন গহনা গড়াতে গেলেন। আর, রাজা সেই বাঁদর-কোলে বড়োরানীব কাছে গেলেন। দুঃখিনী বড়োরানী, জীর্ণ আঁচলে পা মুছিয়ে, ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় রাজাকে বসতে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন— মহারাজ, বোসো। আমার এই ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় বোসো। আমার আর কী আছে তোমায় বসতে দেব? হায়, মহারাজ, কতদিন পরে তুমি ফিরে এলে, আমি এমনি অভাগিনী তোমার জন্যে ছেঁড়া কাঁথা পেতে দিলুম। রানীর কথায় রাজার চোখে জল এল। ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় বসে বড়োবানীর কোলে বাঁদর-ছানা দিয়ে বললেন— মহারানী, তোমার এ ছেঁড়া কাঁথা ভাঙা ঘর, ছোটোরানীর সোনার সিংহাসন, সোনার ঘরের চেয়ে লক্ষগুণে ভালো। তোমার এ ভাঙা ঘরে অাদর আছে, যত্ন আছে, দুটো মিষ্টি কথা আছে; সেখানে তা তো নেই। রানী, সাত জাহাজ সোনা দিয়ে গায়ের গহনা, পরনের শাড়ি দিয়েছি, ছোটোরানী পায়ে ঠেলেছে; আর কানাকড়ি দিয়ে তোমার বাঁদর এনেছি, তুমি আদর করে কোলে নিয়েছ। রানী, আমি আর তোমায় দুঃখ দেব না। এখন বিদায় দাও, আমি আবার আসব রানী। কিন্তু দেখো, ছোটোরানী যেন জানতে না-পারে! তোমার কাছে এসেছি শুনলে আর রক্ষে রাখবে না! হয় তোমায়, নয়তো আমায়, বিষ খাওয়াবে। এমনি করে রাত কাটল। ছোটোরানীর সোনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, রাজার পাশে রাত কাটল; আর বড়োরানীর জলে ঝড়ে, ভাঙা ঘরে, ছেঁড়া কাঁথায় রাত কাটল। সকাল হল। রাজবাড়িতে প্রহরীখানায় প্রহর বাজল, নাকরাখানায় নবৎ বাজল, রাজারানীর ঘুম ভাঙল। রাজা সোনার ভৃঙ্গারে স্ফটিকজলে মুখ ধুয়ে, রাজবেশ অঙ্গে পরে, রাজ-দরবারে নেবে গেলেন। আর ছোটোরানী সোনার পালঙ্কে, ফুলের বিছানায়, ফুলের পাখায় হাওয়া খেতে খেতে পাশ ফিরে ঘুম গেলেন। আর বড়োরানী কী করলেন? ভাঙা ঘরে সোনার রোদ মুখে পড়ল, রানী উঠে বসলেন। এদিক দেখলেন ওদিক দেখলেন, এপাশ দেখলেন, ওপাশ দেখলেন— বানর নেই! রানী এ-ঘর খুঁজলেন ও-ঘর খুঁজলেন ঘরের চাল খুঁজলেন, গাছের ডাল খুঁজলেন— বানর নেই! বড়োবানী কাঁদতে লাগলেন। বানর কোথা গেল? বানর ভাঙা ঘরে ঘুমন্ত রানীকে একলা রেখে রাত না-পোহাতে রাজ-দরবারে চলে গেল। রাজা বার দিয়ে দরবারে বসেছেন। চারিদিকে সভাসদ মন্ত্রী, দুয়ারে সিপাই-সান্ত্রী, আশে-পাশে লোকের ভিড়। রানীর বানর সেই লোকের ভিড় ঠেলে, সিপাই-সান্ত্রীর হাত এড়িয়ে, রাজার পায়ে প্রণাম করে বললে— মহারাজ, বড়ো সুখবর এনেছি, মায়ের আমার ছেলে হবে। রাজা বললেন— ওরে বানর বলিস কী? এ কথা কি সত্য? বড়োরানী দুওরানী তার ছেলে হবে? দেখিস এ কথা যদি মিথ্যা হয় তো তোকেও কাটব আর তোর মা দুওরানীকেও কাটব। বানর বললে— মহারাজ, সে ভাবনা আমার। এখন আমায় খুশি কর, আমি বিদায় হই। রাজা গলার গজমোতি হার খুলে দিয়ে বানরকে বিদায় করলেন। বানর নাচতে নাচতে ভাঙা ঘরে দুওরানী পড়ে পড়ে কাঁদছেন— সেখানে গেল। দুওরানীর চোখের জল, গায়ের ধুলো মুছিয়ে বানর বললে— এই দেখ্ মা, তোর জন্যে কী এনেছি! তুই রাজার রানী, গলায় দিতে হার পাসনে, কাঠের মালা কিনে পরিস, এই মুক্তোর মালা পর! রানী বানরের হাতে গজমোতি হার দেখে বললেন— এই হার তুই কোথা পেলি? এ যে রাজার গলার গজমোতি হার! যখন রানী ছিলুম রাজার জন্যে গেঁথেছিলুম, তুই এ হার কোথা পেলি? বল্ বানর, রাজা কি এ হার ফেলে দিয়েছেন, রাজপথে কি কুড়িয়ে পেলি? বানর বললে— না মা, কুড়িয়ে পাইনি। তোর হাতে গাঁথা রাজার গলার গজমোতি হার কুড়িয়ে কি পাওয়া যায়? রানী বললেন— তবে কি রাজার ঘরে চুরি করলি? বানর বললে— ছি ছি মা, চুরি কি করতে আছে! আজ রাজাকে সু-খবর দিয়েছি তাই রাজা হার দিয়ে খুশি করেছেন। রানী বললেন— ওরে বাছা, তুই যে দুঃখীর সন্তান, বনের বানর! ভাঙা ঘরে দুঃখিনীর কোলে শুয়ে, রাজাকে দিতে কি সুখের সন্ধান পেলি যে রাত না-পোহাতে রাজবাড়িতে ছুটে গেলি? বানর বললে— মা আমি স্বপ্ন পেয়েছি আমার যেন ভাই হয়েছে, তোর কোলে খোকা হয়েছে; সেই খোকা যেন রাজসিংহাসনে রাজা হয়েছে। তাই ছুটে রাজাকে খবর দিলুম— রাজামহাশয়, মায়ের খোকা হবে। তাইতে রাজা খুশি হয়ে গলার হার খুলে দিলেন। রানী বললেন— ওরে, রাজা আজ শুনলেন ছেলে হবে, কাল শুনবেন মিছে কথা। আজ রাজা গলায় দিতে হার দিলেন কাল যে মাথা নিতে হুকুম দেবেন। হায় হায়, কী করলি? একমুঠো খেতে পাই, একপাশে পড়ে থাকি, তবু বছর গেলে রাজার দেখা পাই, তুই আমার তাও ঘোচালি? ওরে তুই কী সর্বনাশ করলি? মিছে খবর কেন রটালি? এ জঞ্জাল কেন ঘটালি? বানর বললে— মা তোর ভয় কী, ভাবিস কেন? এ দশমাস চুপ করে থাক্, সবাই জানুক— বড়োরানীর ছেলে হবে। তারপর রাজা যখন ছেলে দেখবেন তখন তোর কোলে সোনারচাঁদ ছেলে দেব, তুই রাজাকে দেখাস। এখন চল, বেলা হল, খিদে পেয়েছে। রানী বললেন— চল্ বাছা চল্। বাটি পুরে জল রেখেছি, গাছের ফল এনেছি, খাবি চল্। রানী ভাঙা পিঁড়েয় বানরকে খাওয়াতে বসলেন। আর রাজা ছোটোরানীর ঘরে গেলেন। ছোটে রানী কুস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সোনার পলিঙ্কে বসে বসে ভাবছেন, এমন সময় রাজ এসে খবর দিলেন— আরে শুনেছ ছোটোরানী, বড়োরানীর ছেলে হবে! বড়ো ভাবনা ছিল রাজসিংহাসন কাকে দেব, এতদিনে ভাবনা ঘুচল। যদি ছেলে হয় তাকে রাজা করব, আর যদি মেয়ে হয়, তবে তার বিয়ে দিয়ে জামাইকে রাজ্য দেব। রানী, বড়ো ভাবনা ছিল, এতদিনে নিশ্চিন্ত হলুম। রানী বললেন— পারিনে বাপু, আপনার জ্বালায় বাঁচিনে, পরের ভাবনা! রাজা বললেন— সে কী রানী? এমন সুখের দিনে এমন কথা বলতে হয়? রাজপুত্র কোলে পাব, রাজ সিংহাসনে রাজা করব, এ কথা শুনে মুখ-ভার করে? রানী, রাজবাড়িতে সবার মুখে হাসি, তুমি কেন অকল্যাণ কর? রানী বললেন— আর পারিনে! কার ছেলে রাজা হবে, কার মেয়ে রাজ্য পাবে, কে রাজসিংহাসনে বসবে, এত ভাবনা ভাবতে পারিনে। নিজের জ্বালায় মরি, পরের ছেলে মোলো বাঁচল তার খবর রাখিনে। বাবারে, সকালবেলা বকে বকে ঘুম হল না, মাথা ধরল, যাই নেয়ে আসি।  রাগভরে ছোটোরানী অাটগাছা চুড়ি, দশগাছা মল্ ঝমঝমিয়ে একদিকে চলে গেলেন। রাজার বড়ো রাগ হল, রাজকুমারকে ছোটোরানী মর্ বললে। রাজা মুখ আঁধার করে বার-মহলে চলে এলেন। রাজা-রানীতে ঝগড়া হল। রাজা আর ছোটোরানীর মুখ দেখলেন না, বড়োরানীর ঘরেও গেলেন না— ছোটোরানী শুনে যদি বিষ খাওয়ায়, বড়োরানীকে প্রাণে মারে! রাজা বার-মহলে একলা রইলেন। এক মাস গেল, দুমাস গেল, দুমাস গিয়ে তিন মাস গেল, রাজা-রানীর ভাব হল না। ঝগড়ায় ঝগড়ায় চার মাস কাটল। পাঁচ মাসে দুওরানীর পোষা বানর রাজার সঙ্গে দেখা করলে। রাজা বললেন— কী হে বানর, খবর কী? বানর বললে— মহারাজ, মায়ের বড়ো দুঃখ! মোটা চালের ভাত মুখে রোচে না, মা আমার না-খেয়ে কাহিল হলেন। রাজা বললেন— এ কথা তো আমি জানিনে। মন্ত্রীবর, যাও এখনি সরু চালের ভাত, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন, সোনার থালে সোনার বাটিতে বড়োরানীকে পাঠিয়ে দাও। আজ থেকে আমি যা খাই বড়োরানীও তাই খাবেন। যাও মন্ত্রী, বানরকে হাজার মোহর দিয়ে বিদায় কর। মন্ত্রী বানরকে বিদায় করে রান্নাঘরে গেলেন। অার রানীর বানর মোহরের তোড়া নিয়ে রানীর কাছে এল। রানী বললেন— আজ আবার কোথা ছিলি? এতখানি বেলা হল নাইতে পেলুম না, রাঁধব কখন, খাব কখন? বানর বললে— মা আর তোকে রাঁধতে হবে না। রাজবাড়ি থেকে সোনার থালায় সোনার বাটিতে সরু চালের ভাত, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন আসবে, তাড়াতাড়ি নেয়ে আয়। রানী নাইতে গেলেন। বানর একমুঠো মোহর নিয়ে বাজারে গেল। ষোলো থান মোহরে যোলো জন ঘরামি নিলে, ষোলে গাড়ি খড় নিলে, ষোলোশো বাঁশ নিলে। সেই ষোলোশো বাঁশ দিয়ে, যোলো গাড়ি খড় দিয়ে, ষোলোজন ঘরামি খাটিয়ে, চক্ষের নিমেষে দুওরানীর বানর ভাঙাঘর নতুন করলে। শোবার ঘরে নতুন কাঁথা পাতলে, খাবার ঘরে নতুন পিঁড়ি পাতলে, রাজবাড়ির ষোলো বামুনে রানীর ভাত নিয়ে এল; ষোলো মোহর বিদায় পেলে। দুওরানী নেয়ে এলেন। এসে দেখলেন— ঘর নতুন! ঘরের চাল নতুন! চালের খড় নতুন! মেঝেয় নতুন কাঁথা! অালনায় নতুন শাড়ি! রানী অবাক হলেন। বানরকে বললেন— বাছা, ভাঙা ঘর দেখে ঘাটে গেলুম, এসে দেখি নতুন ঘর! কেমন করে হল? বানর বলল— মা, রাজামশায় মোহর দিয়েছেন। সেই মোহরে ভাঙা ঘর নতুন করেছি, ছেঁড়া কাঁথা নতুন করেছি, নতুন পিঁড়ে পেতেছি, তুই সোনার থালে গরম ভাত, সোনার বাটিতে তপ্ত দুধ খাবি চল। রানী খেতে বসলেন। কতদিন পরে সোনার থালায় ভাত খেলেন, সোনার ঘটিতে মুখ ধুলেন, সোনার বাটায় পান খেলেন, তবু মনে সুখ পেলেন না। রানী রাজভোগ খান আর ভাবেন— আজ রাজা সোনার থালে ভাত পাঠালেন, কাল হয়তো মশানে নিয়ে মাথা কাটবেন। এমনি করে ভয়ে-ভয়ে এক মাস, দুমাস, তিন মাস গেল। বড়োরানীর নতুন ঘর পুরোনো হল, ঘরের চাল ফুটাে হল, চালের খড় উড়ে গেল। বানর রাজার সঙ্গে দেখা করলে। রাজা বললেন— কী বানর, কী মনে করে? বানর বললে— মহারাজ, ভয়ে কব না নিৰ্ভয়ে কব? রাজা বললেন— নিৰ্ভয়ে কও। বানর বললে—মহারাজ, ভাঙা ঘরে মা আমার বড়ো দুঃখ পান। ঘরের দুয়োর ফাটা, চালে খড় নেই, শীতের হিম ঘরে আসে। মা আমার গায়ে দিতে নেপ পান না, আগুন জ্বালতে কাঠ পান না, সার রাত শীতে কাঁপেন। রাজা বললেন— তাইতো! তাইতো! একথা বলতে হয়। বানর তোর মাকে রাজবাড়িতে নিয়ে আয়, আমি মহল সাজাতে বলি।  বানর বললে— মহারাজ, মাকে আনতে ভয় হয়, ছোটোরানী বিষ খাওয়াবে। রাজা বললেন— সে ভয় নেই। নতুন মহলে রানীকে রাখব, মহল ঘিরে গড় কাটাব, গড়ের দুয়ারে পাহারা বসাব, ছোটোরানী আসতে পাবে না। সে মহলে বড়োরানী থাকবেন, বড়োরানীর বোবাকালা দাই থাকবে, আর বড়োরানীর পোষা ছেলে তুই থাকবি। বানর বললে— মহারাজ, যাই তবে মাকে আনি। রাজা বললেন— যাও মন্ত্রী, মহল সাজাও গে। মন্ত্রী লক্ষ লক্ষ লোক লাগিয়ে একদিনে বড়োরানীর নতুন মহল সাজালেন। দুওরানী ভাঙা ঘর ছেড়ে, ছেঁড়া কাঁথা ছেড়ে, সোনার শাড়ি পরে নতুন মহলে এলেন। সোনার পালঙ্কে বসলেন, সোনার থালে ভাত খেলেন, দীন-দুঃখীকে দান দিলেন, রাজ্যে জয় জয় হল; রাগে ছোটোরানীর সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। ডাকিনী ব্রাহ্মণী— ছোটোরানীর ‘মনের কথা’, প্রাণের বন্ধু। ছোটোরানী বলে পাঠালেন— মনের কথাকে আসতে বল, কথা আছে। রানী ডেকেছেন— ডাকিনী বুড়ি তাড়াতাড়ি চলে এল। রানী বললেন— এস ভাই, মনের কথা, কেমন আছ? কাছে বোসো। ডাকিনী ব্রাহ্মণী ছোটোরানীর পাশে বসে বললে— কেন ভাই, ডেকেছ কেন? মুখখানি ভার-ভার, চোখের কোণে জল, হয়েছে কী? রানী বললেন— হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু! সতীন আবার ঘরে ঢুকেছে, সে সোনার শাড়ি পরেছে, নতুন মহল পেয়েছে, রাজার প্রেয়সী রানী হয়েছে! ভিখারিনী দুওরানী এত দিনে সুওরানীর রানী হয়ে রাজমহল জুড়ে বসেছে! বামুন সই, দেখে অঙ্গ জ্বলে গেল, আমায় বিষ দে খেয়ে মরি, সতীনের এ অাদর প্রাণ সয় না। ব্রাহ্মণী বললে— ছি! ছি! সই। ও কথা কি মুখে আনে! কোন্ দুঃখে বিষ খাবে? দুওরানী আজ রানী হয়েছে, কাল ভিখারিনী হবে, তুমি যেমন সুওরানী তেমনি থাকবে। সুওরানী বললেন— না-ভাই, বাঁচতে আর সাধ নাই। আজ বাদে কাল দুওরানীর ছেলে হবে, সে ছেলে রাজা হবে! লোকে বলবে আহা, দুওরানী রত্নগর্ভা, রাজার মা হল! আর দেখনা, পোড়ামুখী সুওরানী মহারাজার সুওরানী হল, তবু রাজার কোলে দিতে ছেলে পেলে না! ছি! ছি! অমন অভাগীর মুখ দেখেনা, নাম করলে সারাদিন উপোস যায়! ভাই, এ গঞ্জনা প্রাণে সবে না। তুই বিষ দে, হয় আমি খাই, নয়তো সতীনকে খাওয়াই। ব্রাহ্মণী বললে— চুপ কর রানী, কে কোন্ দিকে শুনতে পাবে। ভাবনা কী? চুপি চুপি বিষ এনে দেব, দুওরানীকে খেতে দিও। এখন বিদায় দাও, বিষের সন্ধানে যাই। রানী বললেন— যাও ভাই। কিন্তু দেখো, বিষ যেন আসল হয়, খেতে-না-খেতে বড়োরানী ঘুরে পড়বে। ডাকিনী বললে— ভয় নেই গো, ভয় নেই! আজ বাদে কাল বড়োরানীকে বিষ খাওয়াব, জন্মের মতো মা হবার সাধ ঘোচাব, তুমি নির্ভয়ে থাক। ডাকিনী বিষের সন্ধানে গেল। বনে বনে খুঁজে খুঁজে ভরসন্ধ্যাবেলা ঝোপের আড়ালে ঘুমন্ত সাপকে মন্ত্রে বশ করে, তার মুখ থেকে কালকূট বিষ এনে দিল। ছোটোরানী সেই বিষে মুগের নাড়ু, ক্ষীরের ছাচ, মতিচুর মেঠাই গড়ালেন। একখানা থালা সাজিয়ে ডাকিনী ব্রাহ্মণীকে বললেন— ভাই এক কাজ কর্, এই বিষের নাড়ু, বড়োরানীকে বেচে আয়। ব্রাহ্মণী থালা হাতে বড়োরানীর নতুন মহলে গেল। বড়োরানী বললেন— আয় লো আয়, এতদিন কোথায় ছিলি? দুওরানী বলে কি ভুলে থাকতে হয়? ডাকিনী বললে— সে কী গো! তোমাদের খাই, তোমাদের পরি, তোমাদের কি ভুলতে পারি? এই দেখ, তোমার জন্যে যতন করে মুগের নাড়ু, ক্ষীরের ছাচ, মতিচুর মেঠাই এনেছি। রানী দেখলেন, বুড়ি ব্রাহ্মণী বড়ো যত্ন করে, থালা সাজিয়ে সামগ্রী এনেছে। খুশি হয়ে তার দুহাতে দুমুঠো মোহর দিয়ে বিদায় করলেন, ব্রাহ্মণী হাসতে হাসতে চলে গেল। রানী ক্ষীরের ছাচ ভেঙে খেলেন, জিবের স্বাদ গেল। মুগের নাড়ু মুখে দিলেন, গলা কাঠ হল। মতিচুর মেঠাই খেলেন, বুক যেন জ্বলে গেল। বানরকে ডেকে বললেন— ব্রাহ্মণী আমায় কী খাওয়ালে! গা-কেমন করছে, বুঝি আর বাঁচব না। বানর বললে— চল্ মা, খাটে শুবি, অসুখ সারবে। রানী উঠে দাঁড়ালেন, সাপের বিষ মাথায় উঠল। রানী চোখে আঁধার দেখলেন, মাথা টলে গেল, সোনার প্রতিমা শানের উপর ঘুরে পড়লেন। বানর রানীর মাথা কোলে নিলে, হাত ধরে নাড়ি দেখলে, চোখের পাতা খুলে চোখ দেখলে— রানী অজ্ঞান, অসাড়! বানর সোনার প্রতিমা বড়োরানীকে সোনার খাটে শুইয়ে দিয়ে ওষুধের সন্ধানে বনে ছুটে গেল। বন থেকে কে জানে কী লতাপাতা, কোন গাছের কী শিকড় এনে নতুন শিলে বেটে বড়োরানীকে খাওয়াতে লাগল। রাজবাড়িতে খবর গেল— বড়োরানী বিষ খেয়েছেন। রাজা উঠতে-পড়তে রানীর মহলে এলেন। রাজমন্ত্রী ছুটতে ছুটতে সঙ্গে এলেন। রাজবৈদ্য মন্তর আওড়াতে আওড়াতে তারপর এলেন। তারপর রাজার লোক-লস্কর, দাসী-বাঁদী যে যেখানে ছিল হাজির হল। বানর বললে— মহারাজ, এত লোক কেন এনেছ? আমি মাকে ওষুধ দিয়েছি, মা আমার ভালো আছেন, একটু ঘুমোতে দাও। এত লোককে যেত বল। রাজা বিষের নাড়ু পরখ করিয়ে রাজবৈদ্যকে বিদায় করলেন। রাজ্যের ভার দিয়ে রাজমন্ত্রীকে বিদায় করলেন। বড়োরানীর মহলে নিজে রইলেন। তিন দিন, তিন রাত বড়োরানী অজ্ঞান। চার দিনে জ্ঞান হল, বড়োরানী চোখ মেলে চাইলেন। বানর রাজাকে এসে খবর দিলে— মহারাজ, বড়োরানী সেরে উঠেছেন, তোমার একটি রাজচক্রবর্তী ছেলে হয়েছে। রাজ বানরকে হীরেব হার খুলে দিয়ে বললেন— চল বানর, বড়োরানীকে আর বড়োরানীর ছেলেকে দেখে আসি। বানর বললে— মহারাজ, গণনা করেছি ছেলের মুখ এখন দেখলে তোমার চক্ষু অন্ধ হবে। ছেলের বিয়ে হলে মুখ দেখো, এখন বড়োরানীকে দেখে এস ছোটোরানী কী দুর্দশা করেছে। রাজা দেখলেন– বিষের জ্বালায় বড়োরানীর সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেছে, রানী পাতাখানার মতো পড়ে আছেন, রানীকে আর চেনা যায় না! রাজা রাজবাড়িতে এসে ছোটোরানীকে প্রহরী-খানায় বন্ধ করলেন, তার ডাকিনী বুড়িকে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে, উল্‌টো গাধায় চড়িয়ে দেশের বার করে দিলেন। তারপর হুকুম দিলেন– মন্ত্রীবর, আজ বড়ো শুভদিন, এতদিন পরে রাজচক্রবর্তী ছেলে পেয়েছি। তুমি পথে পথে আলো জ্বালাও, ঘরে ঘরে বাজি পোড়াও, দীন-দুঃখী ডেকে রাজ ভাণ্ডার লুটিয়ে দাও, রাজ্যে যেন একটিও ভিখারী না-থাকে। মন্ত্রী রাজার আজ্ঞায় নগরের পথে পথে আলো দিলেন, ঘরে ঘরে বাজি পোড়ালেন, দীন-দুঃখীকে রাজভাণ্ডার লুটিয়ে দিলেন, রাজ্যে জয়-জয়কার হল। এমনি করে নিত্য নতুন আমোদে, দেবতার মন্দিরে পূজা দিয়ে, মা কালীর পায়ে বলি দিয়ে দেখতে দেখতে দশ বৎসর কেটে গেল। রাজা বানরকে ডেকে বললেন– দশ বৎসর তো পূর্ণ হল এখন ছেলে দেখাও!  বানর বললে— মহারাজ, আগে ছেলের বৌ ঠিক কর, তারপর তার বিয়ে দাও, তারপর মুখ দেখো! এখন ছেলে দেখলে অন্ধ হবে। রাজা বানরের কথায় দেশ-বিদেশে ভাট পাঠালেন। কত দেশের কত রাজকন্যার সন্ধান এল, একটিও রাজার মনে ধরল না। শেষে পাটলী দেশের রাজার ভাট সোনার কৌটায় সোনার প্রতিমা রাজকন্যার ছবি নিয়ে এল। কন্যার অঙ্গের বরন কাঁচা সোনা, জোড়াভুরু— বাঁকাধনু, দুটি চোখ টান-টানা, দুটি ঠোঁট হাসি-হাসি, এলিয়ে দিলে মাথার কেশ পায়ে পড়ে। রাজার সেই কন্যা পছন্দ হল। বানরকে ডেকে বললেন– ছেলের বৌ ঠিক করেছি, কাল শুভদিনে শুভলগ্নে বিয়ে দিতে যাব। বানর বললে— মহারাজ, কাল সন্ধ্যাবেলা, বেহারা দিয়ে বরের পাল্‌কি মায়ের দুয়ারে পাঠিয়ে দিও, বরকে নিয়ে বিয়ে দিতে যাব। রাজা বললেন— দেখো বাপু, দশ বৎসর তোমার কথা শুনেছি, কাল ছেলে না-দেখালে অনর্থ করব। বানর বললে, মহারাজ, সে ভাবনা নেই। তুমি বেহাই-বাড়ি চলে যাও, আমরা কাল বর নিয়ে যাব। রাজা পাছে রানীর ছেলেকে দেখে ফেলেন, পাছে চক্ষু অন্ধ হয়, সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি বেহাই-বাড়ি চলে গেলেন। আর বানর নতুন মহলে বড়োরানীর কাছে গেল। বড়োরানী ছেলের বিয়ে শুনে অবধি পড়ে পড়ে কাঁদছেন আর ভাবছেন– ছেলে কোথা পাব, এবার রাজাকে কী ছলে ভোলাব! বানর এসে বললে, মা গো মা, ওঠ্। চেলীর জোড় আন্, মাথার টোপর আন্, ক্ষীরের ছেলে গড়ে দে, বর সাজিয়ে বিয়ে দিয়ে আনি। রানী বললেন— বাছারে, প্রাণে কি তোর ভয় নেই? কোন্ সাহসে ক্ষীরের পুতুল বর সাজিয়ে বিয়ে দিতে যাবি? রাজাকে কী ছলে ভোলাবি? বাছা কাজ নেই, ছল করে রাজার প্রেয়সী হলুম, সেই পাপে সতীন বিষ খাওয়ালে, ভাগ্যে-ভাগ্যে বেঁচে উঠেছি, আবার কোন্ সাহসে রাজার সঙ্গে ছল করব? বাছা ক্ষান্ত দে, কেন আর পাপের বোঝা বাড়াস! তুই রাজাকে ডেকে আন্, আমি সব কথা খুলে বলি। বানর বললে— রাজাকে পাব কোথা? দুদিনের পথ কনের বাড়ি, রাজা সেখানে গেছেন। তুই কথা রাখ, ক্ষীরের বর গড়ে দে। রাজা পথ চেয়ে আছেন কখন বর আসবে, বর না-এলে বড়ো অপমান। মা তুই ভাবিসনে, ক্ষীরের পুতুল বিয়ে দিতে পাঠালি, যদি ষষ্ঠীর কৃপা হয় তবে ষষ্ঠীদাস ষেঠের বাছা কোলে পাবি৷ রানী বানরের ভরসায় বুক বেঁধে মনের মতো ক্ষীরের ছেলে গড়লেন। তাকে চেলীর জোড় পরালেন, সোনার টোপর পরালেন, জরির জুতে পায়ে দিলেন। বানর চুপি চুপি ক্ষীরের বর পাল্‌কিতে তুলে রঙিন ঢাকা নামিয়ে দিলে, বরের কেবল দুখানি ছোটো পা, দুপাটি জরির জুতো দেখা যেতে লাগল। ষোলো জন কাহার বরের পাল্‌কি কাঁধে তুল্‌লে। বানর মাথায় পাগড়ি, কোমরে চাদর বেঁধে, নিশেন উড়িয়ে, ঢাক বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে, ক্ষীরের পুতুলের বিয়ে দিতে গেল। রানী আঁধার পুরে একলা বসে বিপদ-ভঞ্জন বিঘ্নহরণকে ডাকতে লাগলেন। এদিকে বর নিয়ে ষোলো কাহার, মশাল নিয়ে মশালধারী, ঢাক ঢোল নিয়ে ঢাকী ঢুলী, ঘোড়ায় চড়ে বরযাত্রী— সারারাত বাঁশি বাজিয়ে, আলো জ্বালিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দিগ্‌নগরে এসে পড়ল। দিগ্‌নগরে দিঘির ধারে ভোর হল। মশাল পুড়ে-পুড়ে নিবে গেল, ঘোড়া ছুটেছুটে বেদম হল, কাহার পাল্‌কি বয়ে হয়রান হল, ঢাক পিটে পিটে ঢাকীর হাতে খিল্ ধরল। বানর দিঘির ধারে তাবু ফেলতে হুকুম দিলে। দিঘির ধারে ষষ্ঠীতলায় বরের পাল্‌কি নামিয়ে কাহারদের ছুটি দিলে, মন্ত্রীকে ডেকে বলে দিলে— মন্ত্রীমশায়, রাজার হুকুম বরকে যেন কেউ না দেখে, আজকের দিনে বর দেখলে বড়ো অমঙ্গল।  মন্ত্রী রাজার হুকুম জারি করলেন। রাজার লোকজন দিঘির জলে নেয়ে, রেঁধে-বেড়ে খেয়ে, তাঁবুর ভিতর শুয়ে রইল, বটগাছের দিকে এল না। গাঁয়ের বৌ-ঝি ষষ্ঠীঠাকরুণের পুজো দিতে এল, রাজার পাহারা হাঁকিয়ে দিলে। সেদিন বটতলায় ষষ্ঠীঠাকরুনের পুজো হল না। ষষ্ঠীঠাকরুন খিদের জ্বালায় অস্থির হলেন, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হল। বানর মনে মনে হাসতে লাগল। এমনি বেলা অনেক হল। ষষ্ঠীঠাকরুনের মুখে জলবিন্দু পড়ল না, ঠাকরুন কাঠামোর ভিতর ছট্‌ফট করতে লাগলেন, ঠাকরুনের কালো বেড়াল মিউ-মিউ করে কাঁদতে লাগল। বানর তখন মনে-মনে ফন্দি এঁটে পাল্‌কির দরজা খুলে রেখে আড়ালে গেল। ষষ্ঠীঠাকরুন ভাবলেন— আঃ আপদ গেল! কাঠফাটা রোদে কাঠামো থেকে বার হয়ে নৈবেদ্যের ছোলাটা কলাটা সন্ধান করতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে দেখেন, পাল্‌কির ভিতর ক্ষীরের পুতুল। ঠাকরুন আর লোভ সামলাতে পাবলেন না, মনে-মনে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসিকে স্মরণ করলেন। দিগ্‌নগরে যখন দিন, ঘুমের দেশে তখন রাত। ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি সারারাত দিগ্‌নগরে ষষ্ঠীরদাস ষেঠের-বাছা ছেলেদের চোখে ঘুম দিয়ে, সকালবেলা ঘুমের দেশে রাজার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে, অনেক বেলায় একটুখানি চোখ বুজেছেন, এমন সময় ষষ্ঠীঠাকরুনের ডাক পড়ল। ঘুমের দেশে ঘুমপাড়ানি মাসি জেগে উঠলেন, ঘুমপাড়ানি পিসি উঠে বসলেন, দুই বোনে ঘুমের দেশ ছেড়ে দিগ্‌নগরে এলেন। ষষ্ঠীর পায়ে প্রণাম করে বললেন— ঠাকরুন, দিনে-দুপুরে ডেকেছেন কেন? ঠাকরুন বললেন— বাছারা, এতখানি বেলা হল এখনও ভোগ পাইনি। তোরা একটি কাজ কর, দেশের যে যেখানে আছে ঘুম পাড়িয়ে দে, আমি ডুলির ভিতর ক্ষীরের পুতুলটি খেয়ে আসি। ষষ্ঠীঠাকরুনের কথায় মাসি-পিসি মায়া করলেন, দেশের লোক ঘুমিয়ে পড়ল। মাঠের মাঝে রাখাল, ঘরের মাঝে খোকা, খোকার পাশে খোকার মা, খেলাঘরে খোকার দিদি ঘুমিয়ে পড়ল। ষষ্ঠীতলায় রাজার লোকজন, পাঠশালায় গাঁয়ের ছেলেপিলে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজার মন্ত্রী হুঁকোর নল মুখে ঘুমিয়ে পড়লেন, গাঁয়ের গুরু বেত হাতে ঢুলে পড়লেন। দিগ্‌নগরে দিনে-দুপুরে রাত এল। মাসি-পিসি সবার চোখে ঘুম দিলেন— জেগে রইল গাঁয়ের মাঝে রাস্তার শেয়াল-কুকুর, দিঘির ধারে রাজার হাতি-ঘোড়া, বনের মাঝে বনের পাখি, গাছের ডালে রানীর বানর। আর জেগে রইল, ষষ্ঠীরদাস বনের বেড়াল, জলের বেড়াল, গাছের বেড়াল, ঘরের বেড়াল। ষষ্ঠীঠাকরুন তখন ডুলি খুলে ক্ষীরের ছেলে হাতে নিলেন। ক্ষীরের গন্ধে গাছ থেকে কাঠবেড়াল নেমে এল, বন থেকে বনবেড়াল ছুটে এল, জল থেকে উদ্‌বেড়াল উঠে এল, কুনোবেড়াল কোণ ছেড়ে ষষ্ঠীতলায় চলে এল। ষষ্ঠীঠাকরুন ক্ষীরের ছেলের দশটি আঙুল বেড়ালদের খেতে দিলেন। নিজে ক্ষীরের হাত, ক্ষীরের পা, ক্ষীরের বুক পিঠ মাথা খেয়ে, ক্ষীরের দুটি কান মাসি-পিসির হাতে দিয়ে বিদায় করলেন। মাসি-পিসি ঘুমের দেশে চলে গেলেন, দিগ্‌নগরে দিঘিব ঘাটে বরযাত্রীর ঘুম ভাঙল, গাঁয়ের ভিতর ঘরে ঘরে গ্রামবাসীর ঘুম ভাঙল। ষষ্ঠীঠাকরুন তাড়াতাড়ি মুখ মুছে কাঠামোয় ঢুকতে যাবেন, এমন সময় বানর গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে বললে— ঠাকরুন, পালাও কোথা, আগে ক্ষীরের ছেলে দিয়ে যাও! চুরি করে ক্ষীর খাওয়া ধরা পড়েছে, দেশ-বিদেশে কলঙ্ক রটাব। ঠাকরুন ভয় পেয়ে বললেন— আঃ মর! এ মুখপোড়া বলে কী! সর্ সর্, আমি পালাই, লোকে আমায় দেখতে পাবে! বানর বললে— তা হবে না, আগে ছেলে দাও তবে ছেড়ে দেব। নয় তো কাঠামো-সুদ্ধ আজ তোমায় দিঘির জলে ডুবিয়ে যাব, দেবতা হয়ে ক্ষীর চুরির শাস্তি হবে। ঠাকরুন লজ্জায় মরে গেলেন, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন— বাছা চুপ কর্, কে কোন্ দিকে শুনতে পাবে? তোর ক্ষীরের ছেলে খেয়ে ফেলেছি ফিরে পাব কোথা? ওই বটতলায় আমার ছেলেরা খেলা করছে, তোর যেটিকে পছন্দ সেটিকে নিয়ে বিয়ে দিগে যা, আমার বরে দুওরানী তাকে আপনার ছেলের মতো দেখবে, এখন আমায় ছেড়ে দে। বানর বললে— কই ঠাকরুণ, বটতলায় তো ছেলের নেই! আমায় দিব্যচক্ষু দাও তবে তো ষষ্ঠীরদাস ষেঠের বাছাদের দেখতে পাব! ষষ্ঠীঠাকরুণ বানরের চোখে হাত বোলালেন, বানরের দিব্যচক্ষু হল। বানর দেখলে— ষষ্ঠীতলা ছেলের রাজ্য, সেখানে কেবল ছেলে— ঘরে ছেলে, বাইরে ছেলে, জলে স্থলে, পথে ঘাটে, গাছের ডালে, সবুজ ঘাসে যেদিকে দেখে সেইদিকেই ছেলের পাল, মেয়ের দল। কেউ কালো, কেউ সুন্দর, কেউ শ্যামলা। কারো পায়ে নূপুর কারো কাঁকালে হেলে, কারো গলায় সোনার দানা। কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ ঝুমঝুমি ঝুম্‌ঝুম্ করছে, কেউবা পায়ের নূপুর বাজিয়ে বাজিয়ে কচি হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। কারো পায়ে লাল জুতুয়া, কারো মাথায় রাঙা টুপি, কারো গায়ে ফুলদার লক্ষ টাকার মলমলি চাদর। কোনো ছেলে রোগা-রোগা, কোনো ছেলে মোটাসোটা, কেউ দস্যি, কেউ লক্ষ্মী। একদল কাঠের ঘোড়া টক্‌বক্‌ হাঁকাচ্ছে, একদল দিঘির জলে মাছ ধরছে, একদল বাঁধের জলে নাইতে নেমেছে, একদল তলায় ফুল কুড়চ্ছে, একদল গাছের ডালে ফল পাড়ছে, চারিদিকে খেলাধুলো, মারামারি, হাসিকান্না। সে এক নতুন দেশ, স্বপ্নের রাজ্য! সেখানে কেবল ছুটোছুটি, কেবল খেলাধুলো; সেখানে পাঠশালা নেই, পাঠশালের গুরু নেই, গুরুর হাতে বেত নেই। সেখানে আছে দিঘির কালো জল তার ধারে সর বন, তেপান্তর মাঠ তার পরে আমকাঁঠালের বাগান, গাছে গাছে ন্যাজঝোলা টিয়েপাখি, নদীর জলে গোল-চোখ বোয়াল মাছ, কচু বনে মশার ঝাঁক। আর আছেন বনের ধারে বনগাঁ-বাসী মাসি-পিসি, তিনি খৈয়ের মোয়া গড়েন, ঘরের ধারে ডালিম গাছটি তাতে প্রভু নাচেন। নদীর পারে জন্তীগাছটি তাতে জন্তী ফল ফলে, সেখানে নীল ঘোড়া মাঠে মাঠে চরে বেড়াচ্ছে, গৌড় দেশের সোনার ময়ূর পথে ঘাটে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ছেলেরা সেই নীল ঘোড়া নিয়ে, সেই সোনার ময়ূর দিয়ে ঘোড়া সাজিয়ে, ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজিয়ে, ডুলি চাপিয়ে, কমলাপুলির দেশে পুঁটুরানীর বিয়ে দিতে যাচ্ছে। বানর কমলাপুলির দেশে গেল। সে টিয়েপাখির দেশ, সেখানে কেবল ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়েপাখি, তারা দাঁড়ে বসে ধান খোঁটে, গাছে বসে কেঁচ্‌মেচ্ করে, আর সে-দেশের ছেলেদের নিয়ে খেলা করে। সেখানে লোকেরা গাই-বলদে চাষ করে, হীরে দিয়ে দাঁত ঘষে! সে এক নতুন দেশ— সেখানে নিমেষে সকাল, পলকে সন্ধ্যা হয়, সে দেশের কাণ্ডই এক! ঝুরঝুরে বালির মাঝে চিক্‌চিকে জল, তারি ধারে এক পাল ছেলে দোলায় চেপে ছ-পণ কড়ি গুণতে গুণতে মাছ ধরতে এসেছে; কার। পায়ে মাছের কাঁটা ফুটেছে, কারো চাঁদমুখে রোদ পড়েছে। জেলেদের ছেলে জাল মুড়ি দিয়ে ঘুম দিচ্ছে— এমন সময় টাপুর-টুপুর বিষ্টি এল, নদীতে বান এল; অমনি সেই ছেলের পাল, সেই কাঠের দোলা, সেই ছ-পণ কড়ি ফেলে, কোন্ পাড়ায় কোন্ ঘরের কোণে ফিরে গেল। পথের মাঝে তাদের মাছগুলো চিলে কেড়ে নিলে, কোলা ব্যাঙে ছিপগুলো টেনে নিলে, খোকাবাবুরা ক্ষেপ্ত হয়ে ঘরে এলেন, মা তপ্ত দুধ জুড়িয়ে খেতে দিলেন। আর সেই চিক্‌চিকে জলের ধারে ঝুর্‌ঝুরে বালির চরে শিবঠাকুর এসে নৌকো বাঁধলেন, তাঁর সঙ্গে তিন কন্যে— এক কন্যে রাঁধলেন বাড়লেন, এক কন্যে খেলেন আর এক কন্যে না-পেয়ে বাপের বাড়ি গেলেন। বানর তার সঙ্গে বাপের বাড়ির দেশে গেল। সেখানে জলের ঘাটে মেয়েগুলি নাইতে এসেছে, কালে কালো চুলগুলি ঝাড়তে লেগেছে। ঘাটের দুপাশে দুই রুই কাতলা ভেসে উঠল, তার একটি গুরুঠাকুর নিলেন, আর একটি নায়ে ভরা দিয়ে টিয়ে আসছিল সে নিলে। তাই দেখে ভোঁদড় টিয়েকে এক হাতে নিয়ে আর মাছকে এক হাতে নিয়ে নাচতে আরম্ভ করলে, ঘরের দুয়োরে খোকার মা খোকাবাবুকে নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন— ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা। বানর দেখলে— ছেলেটি বড়ো সুন্দর, যেন সোনার চাঁদ, তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে কেড়ে নিলে! অমনি ষষ্ঠীতলার সেই স্বপ্নের দেশ কোথায় মিলিয়ে গেল, ন্যাজঝোলা টিয়েপাখি আকাশ সবুজ করে কোন্ দেশে উড়ে গেল, শিবঠাকুরের নৌকো কোন্ দেশে ভেসে গেল। ঘাটের মেয়েরা ডুরে শাড়ি ঘুরিয়ে পরে চলে গেল। ষষ্ঠীর দেশে কুনোবেড়াল কোমর বেঁধে, শাশুড়ি ভোলাতে উড়কি ধানের মুড়কি নিয়ে, চার মিন্‌সে কাহার নিয়ে, চার মাগী দাসী সঙ্গে, আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে পুঁটুরানীকে শ্বশুর-বাড়ি নিয়ে যেতে যেতে আমতলার অন্ধকারে মিশে গেল। তেঁতুল গাছের ভোঁদড়গুলো নাচতে নাচতে পাতার সঙ্গে মিলিয়ে গেল— দেশটা যেন মাটির নিচে ডুবে গেল। বানর দেখলে— কোথায় ষষ্ঠীঠাকরুণ, কোথায় কে! বটতলায় দিঘির ধারে ছেলে কোলে একলা দাঁড়িয়ে আছে! তখন বানর লোকজন ডেকে সেই সোনার চাঁদ ছেলেটিকে পাল্‌কি চড়িয়ে, আলো জ্বালিয়ে বাদ্যি বাজিয়ে সন্ধ্যাবেলা দিগ্‌নগর ছেড়ে গেল। এদিকে পাটলি দেশে বেয়াইবাড়ি বসে বসে রাজা ভাবছেন— বানর এখনো এল না? আমার সঙ্গে ছল করলে? রাজ্যে গিয়ে মাথা কাটব। বিয়ের কনেটি ভাবছে— না জানি বর দেখতে কেমন? কনের মা-বাপ ভাবছে— আহা, বুকের বাছা পর হয়ে কার ঘরে চলে যাবে! রাজবাড়ির চাকর-দাসীরা ভাবছে কাজ কখন সারা হবে, ছাদে উঠে বর দেখব। এমন সময় গুরু গুরু ঢোল বাজিয়ে, পোঁ পোঁ বাঁশি বাজিয়ে, টক্‌বক্‌ ঘোড়া হাঁকিয়ে ঝক্‌মক্ আলো জ্বালিয়ে, বানর বর নিয়ে এল। রাজা ছেলেকে হাত ধরে সভায় বসলেন, কনের বাপ বিয়ের সভায় মেয়ের হাত জামাইয়ের হাতে সঁপে দিলেন, পাড়া-পড়শী বরকে বরণ করলে, দাস-দাসী শাঁক বাজালে, হুলু দিলে— বরকনের বিয়ে হল। রাজা ছেলের বিয়ে দিয়ে তার পরদিন বৌ ছেলে নিয়ে, বাঁশি বাজিয়ে, ঘোড়া হাঁকিয়ে বানরের সঙ্গে দেশে ফিরলেন। পাটলি দেশের রাজার বাড়ি এক রাত্তিরে শূন্য হয়ে গেল, মা-বাপের কোলের মেয়ে পরের ঘরে চলে গেল। এদিকে রাজার দেশে বড়রানী দুদিন দুরাত কেঁদে কেঁদে, ভেবে ভেবে, ভোর বেলা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছেন যষ্ঠীঠাকরুন বলছেন, রানী, ওঠ্। চেয়ে দেখ্ তোর কোলের বাছা ঘরে এল। রানী ঘুম ভেঙে উঠে বসলেন, দুয়ারে শুনলেন দাসীরা ডাকছে ওঠ গো রানী ওঠ, পাটের শাড়ি পর, বৌ-বেটা বরণ করগে! রানী পাটের শাড়ি পরে বাইরে এলেন। এসে দেখলেন সত্যিই রাজা বৌ-বেটা এনেছেন! হাসিমুখে বর-কনেকে কোলে নিলেন, ষষ্ঠীর বরে দুঃখের দিনের ক্ষীরের ছেলের কথা মনে রইল না, ভাবলেন ছেলের জন্য ভেবে ভেবে ক্ষীরের ছেলে স্বপ্ন দেখেছি। রাজা এসে ছেলেকে রাজ্য যৌতুক দিলেন, সেই রাজ্যে বানরকে মন্ত্রী করে দিলেন, তার ছেলের বৌকে মায়ারাজ্যের সেই আট হাজার মানিকের আটগাছি চুড়ি, দশশো ভরি সোনার সেই দশগাছা মল পরিয়ে দিলেন। কন্যের হাতে মানিকের চুড়ি যেন রক্ত ফুটে পড়ল, পায়ে মল রিনিঝিনি বাজতে লাগল, ঝিকিমিকি জ্বলতে লাগল। হিংসেয় ছোটোরানী বুক ফেটে মরে গেল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০১. বর্ষামঙ্গল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূমিকা যত সুখের স্মৃতি এত দুঃখের স্মৃতি আমার মনের এই দুই তারে যা দিয়ে দিয়ে এইসব কথা আমার শ্রুতিধরই শ্রীমতী রানী চন্দ এই লেখায় ধরে নিয়েছেন, সুতরাং এর জন্যে যা কিছু পাওনা তাঁরই প্রাপ্য। মুখের কথা লেখার টানে ধরে রাখা সহজ নয়, প্রায় বাতাসে ফাঁদ পাতার মতও কঠিন ব্যাপার সুতরাং যদি কিছু দোষ থাকে এই বইখানিতে সেটা আমি নিতে রাজি হলেম ইতি শ্রীঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মাষ্টমী ১৩৫১ ————– ১ তোমাদের এখানে আজ বর্ষামঙ্গল হবে? আমাদেরও ছেলেবেলা বর্ষামঙ্গল হত। আমরা কি করতুম জানো? আমরা বর্ষাকালে রথের সময়ে তালপাতার ভেঁপু কিনে বাজাতুম; আর টিনের রথে মাটির জগন্নাথ চাপিয়ে টানতুম, রথের চাকা শব্দ দিত ঝন্‌ ঝন্‌; যেন সেতার নূপুর সব একসঙ্গে বাজছে। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ত দেখতে পেতুম, থেকে থেকে মেঘলা আলোকে রোদ পরাত চাপাই শাড়ি—কি বাহার খুলত! তবে শোনো বলি একটা বাদলার কথা। সন্ধ্যে হতে ঝড়জল আরম্ভ হল, সে কি জল, কি ঝড়! হাওয়ার ঠেলায় জোড়াসাঁকোর তেতালা বাড়ি যেন কাঁপছে, পাকা ছাত ফুটো হয়ে জল পড়ছে সব শোবার ঘরে। পিদিম জ্বালায় দাসীরা, নিবে নিবে যায় বাতাসের জোরে। বিছানাপত্তর গুটিয়ে নিয়ে দাসীরা আমাদের কোলে করে দোতলায় নাচঘরে এনে শোয়ালে। বাবা মা, পিসি পিসে, চাকর দাসী, ছেলেপুলে, সব এক ঘরে। এক কোণে আমাকে নিয়ে আমার পদ্ম দাসী কটর কটর কলাই ভাজা চিবোচ্ছে, আমাকেও দু-একটা দিচ্ছে আর ঘুম পাড়াচ্ছে, চুপি চুপি ছড়া কাটছে—ঘুমতা ঘুমায়; গাল চাপড়াচ্ছে আমার, পা নাচাচ্ছে নিজের ছড়া কাটার তালে তালে। ওদিকে শোঁ-শোঁ শব্দ করছে বাইরের বাতাস; এক-একবার নড়েচড়ে উঠছে বড় ঘরের বড় বড় কাঠের দরজাগুলো। খানিক ঘুমিয়ে খানিক জেগে কাটল ঝড়ের রাত। সকালে কাক পাখি ডাকে না, আকাশ ফরশা হয় না। মাছের বাজারে মাছ আসেনি, পানবারুই পান আনেনি। শশী পরামানিক এসে খবর দেয়, শহরের রাস্তায় হয়েছে এককোমর জল। ও দিব্য ঠাকুর, আজ কি রান্না?—‘ভাতে ভাত খিচুড়ি’ বলে খুন্তি হাতে চলে যায় রান্নাবাড়ির দিকে। কেরঞ্চি গাড়ি? গাড়ি চলল না আপিসের দিকে, গোরুর গাড়িতে ব্যাঙের ছাতার নিচে বসে ব্যাঙ্কের বড়বাবুরা সরকারি কাজে যাচ্ছেন। সিংগিদের পুকুর ভেসে মাছ পালিয়েছে। পাড়ার লোক ধরে ধরে ভেজে খাচ্ছে। হিরু মেথর এসে খবর দিতেই, বেরিয়ে পড়ল বিপনে চাকর ছোট ডিঙি বেয়ে শহরের অলিগলিতে ফিরতে। কাগজের নৌকো চলল আমাদের ভেসে—এ গাছ ঘুরে, ও বাগানে ডুবে-যাওয়া গোল চক্কর ঘুরে, একটানা স্রোতে পড়ে-চলতে চলতে, ফটকের লোহার শিকে ঠেকে উলটে পড়ল কাদায় জলে লট্‌পট্‌ একগোছা বিচিলির লঙর ফেলে। ঈশ্বর দাদা খোঁড়াতে খোঁড়াতে লাঠি ঠকঠকিয়ে ভিস্তিখানায় এসে হাঁকলেন ‘বিশ্বেশ্বর!’ যাই—বলে বিশ্বেশ্বর হুঁকো কল্কে হাতে দিতেই—“শনি সাত, মঙ্গলে তিন, আর সব দিন দিন’ বলতেই হুঁকো শব্দ দিতে থাকল—চুপ চুপ—ছুপ ছুপ —কুর্‌র্‌—ঝুপ ঝুপ। তখন বর্ষাকাল পড়লে সত্যি সত্যি বৃষ্টি ঝড় আকাশ ভেঙে খড়ের চাল খোলার চাল ফুটাে করে আসত। এ দেখেছি। ডালে চালে খিচুড়ি চেপে যেত। মেঘ করলেই শহর বাজার ডুবত জলে, পুকুরের মাছ উঠে আসত রান্নাবাড়ির উঠানে খেলা করতে করতে—ধরা পড়ে ভাজা হয়ে যেত কখন বুঝতেই পারত না। ফুটে ছাত—ভাতে ভাত ভাজ্‌ মাছ। সারারাত সাতদিন ঝমাঝম্‌। মটর ভাজি কড়াই ভাজি ভিজে ছাতি। যেদিকে চাও ভিজে শাড়ি ভিজে কাপড় পরদা টেনে হাওয়ায় দুলছে, তারই তলায় তলায় খেলে বেড়ানো সারাদিন, সন্ধ্যে থেকে কোলা ব্যাঙে বাদ্যি বাজায়, রাজ্যের মশা ঘরে সেঁধোয় টাকাংদিং টাকাংদিং মশারি ঘিরে। দাসী চাকর সরকার বরকার সবার মাথায় চড়ে গোলপাতার ছাতা; শোলার টুপি, ওয়াটারপ্রুভ, রেনকোট ছিল না; ছিল ছেলেবুড়ো মিলে গান গল্প, বাবু ভায়ে মিলে খোস গল্প—আর কত কি মজা আঠারো ভাজা জিবেগজা। গুড়গুড়ি ফরসী দাদুরীর বোল ধরত গুড়ুক ভুড়ুক।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০২. ছোট ছেলেরা হো-হো করে স্কুলে যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে দেখি ছোট ছেলেরা হো-হো করে স্কুলে যায়, আসন খাতা বই দু-হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। কত ফুর্তি তাদের, এমন স্কুল আমার ছেলেবেলায় পেলে আমিও বুঝিবা একটু আধটু লেখাপড়া শিখলেও শিখতে পারতুম। বাড়ির কাছেই নর্ম্যাল স্কুল; কিন্তু হলে হবে কি? নিজের ইচ্ছেয় কোনোদিন যাইনি স্কুলে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই, আজ পেটে ব্যথা, কাল মাথাধরার ছুতো— রেহাই নেই কিছুতেই। স্কুলে যাবার জন্য গাড়ি আসে গেটে। চিৎকার কান্নাকাটি—যাব না, কিছুতেই যাব না। চাকররা জোর করে গাড়িতে তুলবেই তুলবে। মনে হয় গাড়ির চাকা দুটো বুকের উপর দিকে চলে যাক্‌—সেও ভালো, তবু স্কুলে যাব না। মহা ধ্বস্তাধস্তি, অতটুকু ছেলে পারব কেন তাদের সঙ্গে? আমার কান্নায় ছোটপিসিমার এক-একদিন দয়া হয়, বলেন ‘ও গুনু, নাইবা গেল অবা আজ স্কুলে। রামলালকে বলেন, ‘রামলাল, আজ আর ও স্কুলে যাবে না, ছেড়ে দে ওকে।’ কোনো কোনো দিন তার কথায় ছাড়া পাই। কিন্তু বেশির ভাগ দিনই চাকররা আমায় দু-হাতে ধরে ঠেলে গাড়ির ভিতরে তুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে, কি আর করি, জোরে না পেরে বন্দী অবস্থায় দু-চোখের জল মুছে গুম হয়ে বসে থাকি। স্কুল ভালো লাগে না মোটেই। ভালো লাগে শুধু স্কুলে একটি ঘরে কাচের আলমারিতে তোলা একখানি খেলনার জাহাজ আর গোটাকয়েক নানা আকারের শঙ্খ—। বেশির ভাগ সময় কাচের আলমারির সামনে বসে বসে সেগুলো দেখি। জানো, আমার ছবি আঁকার হাতেখড়ি হয় সেইখানেই, ওই নর্ম্যাল স্কুলেই। আর কোনো বিদ্যের হাতেখড়ি তো হল না, তবু ভাগ্যিস ওই হাতেখড়িটুকু হয়েছিল। তাই না তোমাদের এখনও একটু ছবি-টবি এঁকে দিয়ে খুশি রাখতে পারি। নয়তো আর কারে কোনো কাজেই লাগতুম না আমি। এখন শোনো তবে সেই হাতেখড়ির গল্প। একটি মেটে কুঁজো, একটি মেটে গ্লাস, ছবির হাতেখড়ি আমার এই দুটি দিয়ে। বললুম তো, আমি তখন নর্মাল স্কুলে, পড়াশুনা করি বলব না, যাওয়া-আসা করি। পাশেই বড় ছেলেদের ক্লাস, সেই ক্লাসের জানালার ধারে গিয়ে সময় সময় বসে থাকি। বোতল বোতল ভরা লাল নীল জল নিয়ে মাস্টারমশায় ঢালাঢালি করেন; লাল হয় নীল, নীল হয় লাল, মাঝে মাঝে লাল নীল দুইই উবে যায়, বোতলে পড়ে থাকে ফিকে রঙের জল খানিকটে, চেয়ে চেয়ে দেখি, ভারি মজা লাগে। কেমিয়াবিদ্যা শেখানো হয়ে গেলে আসেন সাতকড়িবাবু ড্রইং মাস্টার। একটা মোট কাগজে বড় বড় করে আঁকা একটি মেটে কুঁজো ও গ্লাস, সেইটে কালো বোর্ডের গায়ে ঝুলিয়ে দিয়ে ছেলেদের বলেন, ‘দেখে দেখে আঁকো এবারে।’ ছেলেরা তাই আঁকে খাতার পাতায়। মাস্টার ঘুরে ঘুরে সবার কাছে গিয়ে দেখেন। এখন সেই ক্লাসে আছে আমাদের পাশের গলির ভুলু। একসঙ্গেই স্কুলে যাওয়া-আসা করি। তাকে ধরে পড়লুম, ‘কি করে কুঁজো আর গ্লাস আঁকতে হয় আমায় শিখিয়ে দে, ভাই।’ তার কাছে কুঁজো গ্লাস আঁকা শিখে ভারি ফুর্তি আমার। যখন-তখন সুবিধে পেলেই কুঁজো গ্লাস আঁকি। বড় মজা লাগে, কুঁজোর মুখের গোল রেখাটি যখন টানি। মন একেবারে কুঁজোর ভিতরে কুয়োর তলায় ব্যাঙের মতে টুপ করে ডুব দিতে চায়। আর সেই কাচের আলমারির স্টীম জাহাজ—তাতে চড়ে বসে মন কাপ্তেন হয়ে যেতে চায় সাত সমুদ্দর তেরো নদীর পার। কি খেলার জাহাজই ছিল সেটি—পালমাস্তুল, দড়িদড়া, যেখানকার যা হুবহু আসল জাহাজের মতো। ভুলু আমায় প্রায়ই বলে, ‘ভালো করে লেখাপড়া কর্‌—দেখবি এই জাহাজটিই তুই প্রাইজ পেয়ে যাবি। কিন্তু লেখাপড়ায়ই যে মন বসে না আমার, তা প্রাইজ পাবো কোত্থেকে? কোনো আশা নেই জানি, তবুও লোভ হয় মনে এক-আধটা প্রাইজ পেতে। কিন্তু কোনোবার কোনো কিছুরই জন্য প্রাইজ আর পেলেম না নর্ম্যাল স্কুলে। একবার প্রাইজ বিতরণের সময় এল, ইস্কুলে ছিল একটা মস্ত বড় ঘর আগাগোড়া গ্যালারি সাজানো। এক পাশে আছে খানকয়েক চেয়ার ও একটা টেবিল। রোজ ক্লাস আরম্ভ হবার আগে ছোট বড় সব ছেলেরা সেই ঘরে জড়ো হই। রেজিস্টার খুলে মাস্টার একে একে নাম হাঁকেন; আমরা বলি, ‘প্রেজেন্ট স্যার, অ্যাবসেন্ট স্যার।’ নাম ডাকা সারা হলে শুরু হয় ড্রিল। গ্যালারিতে বসে ছিলুম, উঠে দাঁড়াই এবার। মাস্টার হেঁকে চলেন, ‘দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন, বাম হস্ত উত্তোলন, অঙ্গুলি সঞ্চালন। অমনি আমাদের পাঁচ পাঁচ দশটা অঙ্গুলি থর থর করে কাঁপতে থাকে যেন কচি কচি আমপাতা নড়ছে হাওয়াতে। তারপর পদক্ষেপ; ডান পা বাঁ পা তুলে বেঞ্চিতে খুব খানিকটে ধুপ ধাপ ঠুকে যার যার ক্লাসে যাই। সেই বড় ঘর সাজানো হয়েছে প্রাইজ বিতরণের দিনে, টেবিলের উপরে লাল ফিতেয় বাঁধা গাদা গাদা চটি মোটা সোনালি রুপোলি নানা রঙের বই। সামনে এক সারি চেয়ার—বিশিষ্ট লোকেরা বসবেন তাতে। আমরাও সকলে হাজির গ্যালারিতে অনেক আগে থেকেই। প্রাইজ বিতরণের আগে জিতেন বাঁড়ুজ্জে কুস্তি দেখালেন—লোহার শিকল ছিঁড়লেন, লোহার বড় বড় বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে লুফে নিলেন। মস্ত পালোয়ান তিনি। এবার প্রাইজ বিতরণ হবে। গোপালবাবু হেডমাস্টার, টাকমাথা, ঘাড়ের কাছে একটু একটু চুল, অনেকটা এই এখনকার আমার মতোই; তবে রঙ তাঁর আরো পরিষ্কার। গম্ভীর মানুষ; কামিয়ে জুমিয়ে ফিটফাট হয়ে গলায় চাদর ঝুলিয়ে এসে বসলেন চেয়ারে। ছেলেরা কেউ বুঝুক ন-বুঝুক এই সব উপলক্ষে তিনি ইংরেজিতেই বক্তৃতা করেন। তিনি তাঁর লম্বা ইংরেজি বক্তৃতা শেষ করলেন। তারপর এইবারে একজন মাস্টার উঠে যারা প্রাইজ পাবে তাদের নাম পড়ে যেতে লাগলেন। ছেলেদের নাম ডাকা হতেই তারা টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, হেডমাস্টার মশায় তাদের হাতে লাল ফিতেয় বাঁধা প্রাইজ তুলে দেন। এক-একটি প্রাইজ দেওয়া হয় আর আমরা হাততালি দিয়ে উঠি, যে যত জোরে পারি। হাততালির ধুম কি। লাল হয়ে উঠল হাতের তেলো, তবু থামিনে। সেবার অনেকেই প্রাইজ পেলে; তার মধ্যে ভুলু পেলে, সমরদাও একটা পেয়ে গেলেন for good conduct, চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি এইবার বুঝি আমার নাম ডাকবে, আমাকে এমনি একটা কিছুর জন্য হয়তে প্রাইজ দিয়ে দেবে। কান পেতে আছি নাম শোনবার জন্য; শেষ প্রাইজটি পর্যন্ত দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু আমার কানে আমার নাম আর পৌঁছল না। প্রাইজ বিতরণ হয়ে গেলে মাস্টার উঠে পড়লেন, ছেলেরা হৈ হৈ করে বাইরে এল ; আর আমি তখন দু-চোখের জলে ভাসছি। ভুলু সাত্ত্বনা দেয়, ‘আরে, তাতে কি হয়েছে, ভাল করে পড়াশুনো কর্‌, সামনের বারে ভালো প্রাইজ ঠিক পাবি তুই।’ সে কথায় কি মন ভোলে? না-পাওয়া মণ্ডার জন্য বাচ্চু বেজিটা যেমন হয়ে থাকে আমারও মনটার তেমনি দশা হয়। চোখের ধারা গড়াইতেই থাকে, থামে না আর। শেষে ভুলু বললে, ‘প্রাইজ চাস তুই, এই কথা তো? আচ্ছা এই নে’—বলে খাতা থেকে একটুকরো সাদা কাগজ ছিঁড়ে তাতে খসখস করে কি সব লিখে আমার হাতে দিলে। আমি তাতেই খুশি। কাগজের টুকরোটি যত্নে ভাঁজ করে পকেটে রেখে চোখের জল মুছে বাড়ি এলেম। বৈঠকখানায় বাবামশায় পিসেমশায় সবাই বসে ছিলেন। বললেন, ‘দেখি কে কি প্রাইজ পেলি।’ সমরদা তাঁর প্রাইজ লালফিতে-বাঁধা টিকিট-মারা সোনালি বই দেখালেন। আমি বললুম, ‘আমিও পেয়েছি।’ পিসেমশায় বললেন, ‘কই দেখি?’ গম্ভীরভাবে পকেট থেকে ভাঁজকরা সাদা কাগজটুকু বের করে তাঁদের সামনে মেলে ধরলুম। উলটেপালটে সেটি দেখে তাঁরা হো-হো করে হেসে উঠলেন। তখন বুঝলুম, ভুলুটা আমায় ঠকিয়েছে। এমন রাগ হল তার উপরে! রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি প্রাইজ না-পাওয়ার দুঃখু আর একটুও নেই। তা লেখাপড়ায় মন বসবে কি? তোমাদের মতো তো গাছের ছায়ায় খোলা হাওয়ায় বসে পড়তে পাইনি কখনও। স্কুলের ওই পাকা দেয়াল-ঘেরা বন্ধ ঘরের ভিতরে দম যেন আটকে আসে আমার। যতক্ষণ পারি ঘরের বাইরেই ঘোরাফেরা করি। স্কুলের পাশে শ্যাম মল্লিকের বাড়ি, তাদের বাড়ির একটি মেয়ে পড়তে আসে আমাদের স্কুলে, ইজের চাপকান প’রে, বেণী ঝুলিয়ে। তাদের বাড়িতে একটা পোষা কালো ভাল্লুক চরে বেড়ায় সামনের বাগানে, দেখা যায়, ইস্কুল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাল্লুক দেখি। ইস্কুলঘরের বাইরে যা কিছু সবই আমার কাছে ভালো লাগে। ইস্কুলের গেটের কাছে রাস্তা। নানা রকম লোক যাচ্ছে আসছে, তাদের আনাগোনা দেখি। এই রকম দেখতে দেখতে একদিন যা কাণ্ড। কাবুলিওয়ালার রাগ দেখেছ কখনও? গেটের কাছে কতগুলি কাবুলিওয়ালা রোজই বসে থাকে আঙুর বেদানা নিয়ে। টিফিনের সময়ে ছেলেরা কিনে খায়। সেদিন হয়েছে কি, বড়ছেলেদের মধ্যে কে একজন বুঝি এক কাবুলিকে বলেছে ‘বেইমান’। আর যায় কোথায়! দেখতে দেখতে সব কয়টা কাবুলি উঠল রুখে, দারোয়ান বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি লোহার ফটকটা দিলে বন্ধ করে। বাইরে কাবুলি, ভিতরে ছেলের দল; রাস্তা থেকে পড়তে লাগল টপাটপ কাবলাই বেদানা। মাথার উপরে যেন এক চোট শিলাবৃষ্টি হয়ে গেল। জানো তো, মারপিট দেখলে আমি থাকি বরাবরই সবার পিছনে। শিশুবোধে চাণক্যশ্লোক মনে পড়ে—ন গণস্যাগ্রতো গচ্ছেৎ। তা, বাপু, সত্যি কথাই বলব। আমি ওই পিছনে থেকেই ফাটা বেদানাগুলো ফাঁকতালে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খেতে লাগলুম। সেদিনের ঝগড়ায় জিত হল বটে আমারই। কিন্তু ইস্কুলের ছুটির পর বাড়ি ফিরতে হবে; কাবুলিওয়ালার ভয় যায় না। পালকির ভিতরে বসে আচ্ছা করে দরজা বন্ধ করে অতি ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরি শেষে। নর্ম্যাল স্কুলের এক-এক পণ্ডিতের চেহারা যদি দেখতে তো বুঝতে কেমন পণ্ডিত সব ছিলেন তারা। আমাদের পড়ান লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত, চেহারা তাঁর ঠিক যেন মা দুর্গার অসুর। মস্ত বড় মাথা, কালো কুচকুচে গায়ের রং, বোয়াল মাছের মতো চোখ দুটাে লাল টকটক করছে। তাঁর কাছে পড়ব কি? যতক্ষণ ক্লাসে থাকি শিশুমন কাঁপে বলির পাঠার মতো। কোনো রকমে ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তারপর পড়ি মাধব পণ্ডিতের কাছে। বাংলা, সংস্কৃত পড়ান; অতি অমায়িক ভটচাজ্জি চেহারা, শিশুবোধের চাণক্য পণ্ডিতের ছবিখানি—মস্ত টিকি। সেই সময়ে একবার দিনে তারা উঠল, হঠাৎ ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছুটে সবাই বাইরে এলুম। ইস্কুলে একটা টেলিস্কোপ ছিল, তাই নিয়ে তারা দেখতে ঠেলাঠেলি লেগে গেল। সেই মাধব পণ্ডিতের কাছে পড়ি ‘পত্র পততি’, এমনি সব নানা সাধুভাষার বুলি। সেখান থেকে হেডমাস্টারের হাতে-পায়ে ধরাধরি করে অতিকষ্টে উঠলুম তো হরনাথ পণ্ডিতের কেলাসে। তাঁর চোয়াল দুটাে কেমন অদ্ভুত চওড়া, আর শক্ত রকমের। কথা যখন বলেন চোয়াল দুটে ওঠে পড়ে, মনে হয় যেন চিবোচ্ছেন কিছু। তাঁর কাছে পড়লুম কিছুদিন। এই করতে করতে তিনটে শ্রেণী উঠে গেছি। এইবার মাস্টার মশায়ের হাতে পড়ার পালা। এখন সেই শ্রেণীতে আসেন এক ইংরেজি পড়াবার মাস্টার। তিনি এক ইংলিশ রীডার লিখে বই ছাপিয়ে তা পাঠ্যপুস্তক করিয়ে নিয়েছিলেন। সেই বই আমাদের পড়তে হয়। একদিন হয়েছে কি—ক্লাসে ইংরেজির মাস্টার আমাদের পড়ালেন p-u-d-d-i-n-g—পাডিং। আমার মাথায় কি বুদ্ধি খেলে গেল, বলে উঠলুম, ‘মাস্টারমশায়, এর উচ্চারণ তো পাডিং হবে না, হবে পুডিং, আমি যে বাড়িতে এ জিনিস রোজ খাই।’ মাস্টার ধমকে উঠলেন, ‘বল পাডিং।’ আমি বলি, ‘না পুডিং।’ তিনি যত বলতে বলেন পাডিং, আমি আমার বুলি ছাড়িনে। বা রে, আমি পুডিং খাই যে, পাডিং বলতে যাব কেন? মাস্টার গোঁ ধরলেন পাডিং বলবেনই। আমি বলে চলি পুডিং। বাকি ছেলেরা থ হয়ে বসে দেখে কি হয় কাণ্ড। এই করতে করতে ক্লাসের ঘণ্টা শেষ হল। শাস্তি দিলেন চারটের পর এক ঘণ্টা ‘কনফাইন’। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল; বাড়ির গাড়ি নিয়ে রামলাল অপেক্ষা করছে দরজার সামনে। কিন্তু ‘কনফাইন’, এক ঘণ্টার আগে যেতে পারিনে। মাস্টার নিজের বৈকালিক সেরে এলেন। ঘরে ঢুকে বললেন, ‘এবারে বল্‌ পাডিং।’ উত্তর দিলেম, ‘পুডিং’। যেমন শোনা টানাপাখার দড়ি দিয়ে হাত দুটো বেঁধে তবে রে ব্যাদ্‌ড়া ছেলে, বলবিনে? বলতেই হবে তোকে পাডিং। দেখি কেমন না বলিস!’ বলে সপাসপ জোড়া বেত লাগালেন পিঠে। বেতের ঘায়ে পিঠ হাত লাল হয়ে গেল—তখনও বলছি পুডিং। রামলাল ব্যস্ত হয়ে বারে বারে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখে, এ কি কাণ্ড হচ্ছে! যা হোক, বাড়ি এলাম। ছোটপিসিমা বললেন, ‘কি ব্যাপার?’ রামলাল বললে, ‘আমার বাবু আজ বড্ড মার খেয়েছেন।’ আমিও জামা খুলে পিঠ দেখালুম, হাত দেখালুম। দড়ির দাগ বসে গিয়েছিল হাতে। বাবামশায় তৎক্ষণাং নৰ্ম্যাল স্কুল থেকে নাম কাটাবার হুকুম দিলেন; বললেন, ‘কাল থেকে ছেলেরা বাড়িতে পড়বে।’ চুকে গেল ইস্কুল যাবার ভয়; জোড়া বেত খেয়ে ছাড়া পেলুম। এক ‘পাডিং’এই ইংরেজি বিদ্যে শেষ। পরদিন থেকে বাড়িতে বাবামশায়ের মাস্টার যদু ঘোষাল আমায় পড়াবার ভার নিলেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
০৩. এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখন স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে নামকাটা সেপায়ের কি বিপদ হল শোনো। স্কুলে যাওয়ার থেকে তো নিস্তার পেলুম, ভাবলুম বেশ হল, এবার বড়দের মতোই বুঝি আমি স্বাধীন হয়ে গেলুম। যা ইচ্ছে তাই করতে পারব, স্নানের জন্য, ভাত খাবার জন্য চাকররা আর তাড়া দেবে না। নিয়মমতো চলবারও দরকার হবে না। লম্বা পুজোর ছুটি, গরমের ছুটি পেলে যেমন আনন্দ হয় তেমনি আনন্দে দিন কাটবে বুঝি। কবে স্কুল খুলবে সে ভয়ও নেই। এই সব ফুর্তিতেই মাতলুম। কিন্তু দুদিন যেতে না যেতেই দেখি, ওমা, তা তো নয়। যদু ঘোষাল মাস্টার বাড়িতেই থাকেন; ঠিক সময়ে পড়তে বসতে হয় তাঁর কাছে। দশটা বাজলেই চাকররা তাড়া লাগায়। স্নান করে খেয়ে নিতে হয় চটপট। খেয়েদেয়ে ঘুর্‌ ঘুর্‌ করি। স্কুল ছুটি তো শুধু আমারই হয়েছে। দাদা, ইন্দুদা ওঁরা সবাই চলে যান ইস্কুলে। ভেবেছিলেম, বেশ খেলাধুলো হুটোপাটি করে সময় কাটবে রোজ। তা আর হয় না। খেলব কার সঙ্গে? খেলার সাথীরা সবাই স্কুল করে, আমি একলা ঘরে কি করি ভেবে পাইনে। চাকররা থাকে তাদের কাজে ব্যস্ত। রামলাল ধমক দেয়, ‘কোথাও যেয়ো না, চুপটি করে বসে থাকো। এদিকে ওদিকে গেছ কি মুশকিল হবে বলে দিচ্ছি। গলির মোড়ে ওই ওইখানে কন্ধকাটা আছে,ধরে নেবে।’ বলে গলির মোড়ে একটা বাসাবাড়ির নিচে ড্রেনের খিলেন ছিল, সেইটে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আগে অন্দরে যেতে পারতুম যখন-তখন। আজকাল সেই যে চাকররা সকালবেলা আমায় বের করে আনে অন্দর থেকে, সারাদিনে আর ভিভরে ঢুকবার হুকুম নেই, তবু দু-এক ফাঁকে ঢুকে পড়ি অন্দরে। মা ব্যস্ত ছোটভাইকে নিয়ে। সুনয়নী বিনয়নী ছোটবোন—তাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে খেলনা একটা ভেঙে গেল কি তারা কাঁদতে শুরু করে দিলে, ‘অ্যাঁ, অবনদাদা আমাদের পুতুল ভেঙে দিলে।’ অমনি তাড়া লাগায় আমায় সকলে, ‘তুই এখানে কেন? যা বাইরে যা। সেখানে গিয়ে খেলা কর্‌।’ তাড়া খেয়ে বাইরে চলে আসি। বাইরে এসে ভাবের লোক আর পাইনে কাউকে। সবাই দেখি তাড়া লাগায়, ধমক দেয়। বাবামশায়ের ছিল পোষা একটি কাকাতুয়া গোলাপী রঙের। বারান্দার দেয়ালে-টাঙানো হরিণের শিঙের উপর বসে থাকে, কি সুন্দর লাগে দেখতে। সকালবেলা মা পান সাজেন; মার কাছে গিয়ে পানের বোঁটা খায়। ছোটপিসিমার কাছে ছোলা খায়; আবার এসে শিঙের উপর উঠে বসে। ভাবলুম এবার মানুষ ছেড়ে পশুপাখির সঙ্গেই ভাব করা যাক। এই ভেবে কাকাতুয়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ঝুঁটি তুলে গায়ের পালক ফুলিয়ে সে এল তেড়ে আমায় ঠোকরাতে। ভাব করা থাকুক পড়ে, ছুটে পালিয়ে বাঁচি সেখান থেকে। তার ডানার তলায় তলায় বাবামশায় নিজের হাতে পাউডার মাখান। পাউডার মেখে সে মেমসাহেব হয়ে ঝুঁটি বাগিয়ে বসে থাকে। গুমোর কি তার। সে করবে আবার আমার সঙ্গে ভাব। ভয়ে আর সেদিক দিয়েই যাইনে। বাবামশায়ের আদরের কুকুর কামিনী। কি তার আদরযত্নের ঘটা। কামিনীর জন্য আলাদা চাকর মেথর। তাকে যখন সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে, গায়ে পাউডার মাখিয়ে, পরিপাটি করে আঁচড়ে সিঁথি কেটে, সাজিয়েগুজিয়ে ছেড়ে দেয়, আর কামিনী ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়, যেন বাড়ির খেঁদি মেয়েটি। বাড়ির ছেলে আমাদেরও অত আদরযত্ন হয় না যত হয় কামিনীর। সেই কামিনীর কাছে যাই। সে আমায় তোয়াক্কাই করে না। লেজ নেড়ে চলে যায় বাবামশায়ের ঘরের দিকে। ছোট্ট ছোট্ট এক জোড়া পোষা বাঁদরও আছে বাবামশায়ের। কত তাদের আদরই বা। গ্রেট ঈস্টার্‌ন্‌ হোটেল থেকে বাঁদরের জন্য স্পেশাল লাল টুকটুকে চেরি আসে চিনিমাখানো। বাবামশায় একটি একটি করে ওই চেরি খাওয়ান তাদের। দেখে হিংসেয় জ্বলে মরি। ভাবি ওই চেরিগুলো নিজেরা যদি খেতে পাই, আঃ। তাঁর শখের হরিণও আছে একটি, নাম গোলাপী। গোলাপীর কাছে গেলে মালী আসে হৈ-হৈ করে। দেখো এমন আমার কপাল! পশুপাখির কাছেও পাত্তা পাইনে। ওই একটু যা আদর পাই ছোটপিসিমার কাছে। মাঝে মাঝে তাঁর ঘরে আমায় ডেকে নেন। সেখানে কথকতা হয় রোজ। মাইনে-করা মহিম কথক আছেন। বসে শুনি খানিক। কিন্তু তাও আর কতক্ষণই বা! মহামুশকিল, একলা একলা সময় আর কাটে না। মনের দুঃখে ভাবি, এর চেয়ে বেশ ছিলুম স্কুলেই। গাড়িতে ওঠবার আগেই যত কান্নাকাটি, উঠেই সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। গাড়ি চলত গলির মোড় ঘুরে। সেই শিবমন্দির, কাঁসরঘণ্টা, লোকজন, দোকানপাট, রাস্তার দুদিক দেখতে দেখতে বেশ যেতম। তবুও তো বাইরের জগৎ দেখতে পেতুম কিছুটা; এখন কোন বন্ধখানায় পড়লুম! ফটক পেরিয়ে ওদিকে যাবারই আর উপায় নেই। খোলা ফটক আগলে বসে আছে মনোহর সিং দারোয়ান দেউড়িতে। মনে পড়ে স্কুলের সামনে প্রতাপের লজেঞ্জুসের দোকান। চেয়ে নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হলদে লাল সবুজ লজেঞ্জুস খেতুম। চাইলেই দুটি-একটি হাতে গুঁজে দিত প্রতাপ। আর মনে পড়ে সমবয়সীদের কথা । তাদের নিয়ে হুটোপাটি করেও মন্দ ছিলুম না। আমারই মতো ডানপিটে ছেলেও ছিল একটি-দুটি। একটির কথা বলি, স্কুলে যেতে তারও ছিল বেজায় আপত্তি। স্কুলে যাবার সময় হলেই সে পালিয়ে বেড়ায়। একদিন স্কুলে যাবার সময় হয়েছে; সে এদিকে করেছে কি, বাড়ির পাশেই এক শিবমন্দির, তার ভিতরে ঢুকে কাপড়জামা খুলে অন্ধকার ঘরে কালো পাথরের শিবকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। ছেলেটির রঙও কালো, শিবের কালোয় তার কালোয় মিশে গেল। চাকরবাকররা আর খুঁজে তাকে পায় না। মহা হৈ-চৈ। শেষে কে একজন শিবের মাথায় জল ঢালতে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করলে। সেই সব সঙ্গীর কথা মনে পড়ে, আর মন খারাপ হয়ে যায়। নর্ম্যাল স্কুলের বাড়িটিও ছিল কেমন রহস্যময়। প্রকাণ্ড রাজবাড়ি; তাতে কত অলিগলি, অন্দিসন্দি, এখানে ঘর, ওখানে খিলেনদেওয়া বারান্দা, মোটা মোটা থাম; তারি গায়ে দিনের আলো পড়ে চক্চক্‌ করত। ঘুরে ঘুরে দেখতুম এই সব। কোথায় গেল আমার সেই নর্ম্যাল স্কুল! বহুকাল পর এই সেদিন কোন্‌ এক সিনেমাতে দেখলুম সেই বাড়ির ছবি। দেখে ভারি মজা লাগল। যাক সে কথা। এখন আমার একলা থাকার গল্পটাই বলি। সকালবেলাটা লেখাপড়ায় যদিই বা কোনোমতে কেটে যায়, দুপুর আর কাটে না। দাদারা চলে যান স্কুলে, বাবামশায় যান কাছারিতে। ফার্সি পড়াবার মুনশী আসেন; দু-চারটে আ লে বে পড়িয়ে চলে যান। এই মুনশীই দাঁড়িয়ে দেয়ালে নিজের ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতেন। একদিন লড়াই করতে গিয়ে রোখের মাথায় ছায়াতে যেমন ঢুঁ-মারা অমনি মুনশীর কপাল ফেটে রক্তপাত। চাকররাও তাদের তোষাখানায় গল্পগুজব করে। বৈঠকখানা শোনশান, একলা আমি সেখানে পড়ে থাকি। থেকে থেকে দাদাদের ডেক্‌সোর ঢাকা তুলে দেখি ভিতরে কি আছে। নেড়েচেড়ে দেখে আবার তেমনি সব ঠিকঠাক রেখে দিই। প্রাণে ভয়, যদি জানতে পারেন হয়তো বকুনি দেবেন। বাবামশায়ের টেবিলটা দেখি। কতরকম রঙ তার উপরে সাজানো। একটা ক্রিস্ট্যালের কলমদানি ছিল, ঠিক যেন সমুদ্রের ঝিনুক একটি। সেইরকম নকশায় গোলবাগানে ফোয়ারা তৈরি করিয়েছিলেন বাবামশায়। এখনও তা আছে। সেদিন যখন গেলুম জোড়াসাঁকোয়, দেখি বাগানের সব কিছু ভেঙে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে, একটি গাছও বাকি রাখেনি; কিন্তু ফোয়ারাটি তেমনি আছে সেখানে, ফটিক জলে ভরতি। টেবিলে সেই কলমদানিতে কলম সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সেটাতে একবার হাত বুলোই, আবার এসে শুয়ে থাকি। তাও কোথায় শুয়ে থাকতুম জানো? বিলিয়ার্ড টেবিলের নিচে। মাকড়সার জাল, ধুলো বালি, কত কি সেখানে। শুয়ে শুয়ে দেখি মাথার উপরে ঝুলছে সেসব। শোবার জায়গা আমার ওই রকমেরই। ছেঁড়া মাদুরের উপরে, কৌচ-টেবিলের তলায় তলায়, ঢুকে শুয়ে থাকি। ঠিক যেন একটা জানোয়ার। বুদ্ধিও কতকটা আমার তেমনি। তবে একলা থাকার গুণ আছে একটা। দেখতে শুনতে শেখা যায়। ওই অমনি করে একলা থাকতে থাকতেই চোখ আমার দেখতে শিখল, কান শব্দ ধরতে লাগল। তখন থেকেই কত কি বস্তু, কত কি শব্দ যেন মন-হরিণের কাছে এসে পৌঁছতে লেগেছে। মানুষ, পশুপাখি সঙ্গী পেলেম না কাউকেই। ওই অত বড় বাড়িটাই তখন আমার সঙ্গী হয়ে উঠল; নতুন রূপ নিয়ে আমার কাছে দেখা দিতে লাগল। এখানে ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে তখন বাড়িটার সঙ্গে আমার পরিচয় হচ্ছে। জোড়াসাঁকোর বাড়িকে যে কত ভালো বেসেছি। বলি যে, ও বাড়ির ইটকাঠগুলিও আমার সঙ্গে কথা কয়, এত চেনাপরিচয় তাদের সঙ্গে; তা ওই তখন থেকেই তার শুরু। পড়ে আছি; দেখছি, ঘরের কোণায় কোথায় কার্নিশের ছায়া পড়েছে, কোথায় টিকটিকিটা পোকা ধরবার জন্য ওত পেতে আছে, চড়ুইপাখি ছোট কুলুঙ্গিতে বাসা বাঁধছে। আবার কোথায় কোন্‌ উঁচুতে ছাদের উপরে লোহার শিকে এক চিল বসে আছে তাকে দেখছি তো দেখছিই। একসময়ে সে চিঃ-ঃ-ঃ করে দুটো চক্কর খেয়ে উড়ে গেল। আবার কখনো বা চেয়ে থাকতুম সামনে সাদা দেওয়ালের দিকে, ওপাশের উত্তরের খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দিনের আলো এসে পড়েছে তাতে; বাইরে মানুষ হেঁটে যায়, ছায়াটিও চলে যায় ঘরের ভিতরে দেয়ালের গা দিয়ে। রঙিন এক-একখানি ছবির মতো তারা আলোর রাস্তা ধরে চলতে চলতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এই ছবি-দেখা রোগ আমার এখনো আছে, দিনে দুপুরে ঘরের ভিতরে বসে বসে ছবি দেখি। কাল দুপুরে কৌচে বসে ঝিমোচ্ছি। বাইরের তালগাছের ছায়া এসে পড়েছে দেয়ালে, পাতাগুলি নড়ছে হাওয়াতে, পিছনের আকাশে সাদা মেঘ—ঠিক যেন চাঁদের আলোর ছবি একটি। তখনও সব দেখতুম, একমনে দেখতুম। এই দেখতে যখন আরম্ভ করলুম তখন আর একলা থাকতে খারাপ লাগত না। এদিকে আবার নানারকম শব্দও আসে কানে, দুপুর হতেই গলির মোড়ে শব্দ হল ঠং ঠং, ‘বাসন চাই ​​‌‍বাসন।’ শব্দ চলে গেল দূরে। তার পরে এল ‘চুড়ি চাই, খেলনা চাই।’ প্রায়ই মায়েদের মহলে তাদের ডাক পড়ে, ঝুড়ি ঝুড়ি নান৷ রঙের কাচের চুড়ি সাজিয়ে বসে এসে। একরকমের মজার খেলনা থাকে তাদের ঝুড়িতে; টিনের এতটুকু এতটুকু মাছ আর চুম্বকের কাঠি। মাছটি জলে ভাসিয়ে চুম্বকের কাঠি দিয়ে টানলেই মাছও সঙ্গে সঙ্গে জলের উপর চলতে থাকে, এমন লোভ হয় ওই খেলনার জন্য। বাড়ির অন্য সব ছেলেমেয়েরা প্রায়ই পায় সেই খেলনা, আমি পাই ক্বচিং কখনো। আমাকে কেউ যে খেয়ালই করে না তেমন। তারপর বেলা পড়ে এলে গরমের দিনে বরফওয়ালা হেঁকে যায়, “বরিফ, বরিফ চাই, বরিফ–কুলপি বরিফ। জ্যোতিকাকা মশায় লিখেছিলেন একটা গান ‘বরিফ বরিফ’ ব’লে বরফওয়ালা যান। গা ঢালো রে, নিশি আগুয়ান। ‘বেল ফুল বেল ফুল’ ঘন হাঁকে মালীকুল— সন্ধ্যাবেলার শব্দ হচ্ছে ওই বেলফুল। ‘বেলফুল চাই বেলফুল’ হাঁকতে হাঁকতে শব্দ গলির এদিক থেকে ওদিক চলে যায়। তাদের ডেকে বেলফুল কেনে দাসীরা, মালা গাঁথেন মেয়েরা। ভরসন্ধ্যেবেলা মুশকিল আসান আসে খিড়কির দরজায় চেরাগ হাতে, লম্বা দাড়ি; পিদিম জ্বলছে মিটমিট করে। বারান্দ থেকে দেখি তার চেহারা। দোরগোড়ায় এসেই হাঁক দেয়, ‘মুশকিল আসান, মুশকিল আসান।’ দপ্তরে বরাদ থাকে, মুশকিল আসান এলেই তাকে চাল পয়সা যা হয় দিয়ে দেয়; সে আবার হাঁক দিতে দিতে চলে যায়। আরও একটি শব্দ, সেটি এখনও থেকে থেকে কানে বাজে। দুপুরে সব যখন শোনশান, কোনো সাড়াশব্দ নেই কোথাও, তখন শব্দ কানে আসে ‘কূ-য়ো-র ঘটি তোলা’। মনে হয় ঠিক যেন অদ্ভুত কোন্‌ একটি পাখি ডেকে চলেছে। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে দেখি ঘনকালো তেঁতুলগাছের মাথা। দাসীরা বলে, বংশের সকলের নাড়ী পোঁতা আছে তার তলায়, মাঝে মাঝে ছাতের উপরে ভোঁদড় চলে বেড়ায়, সেই চলার শব্দে গল্প তৈরি হয় মনের ভিতরে; ব্রহ্মদত্যি হাঁটছে, জটেবুড়ি কাসছে। জটেবুড়ি সত্যিই ছিল, লাঠি ঠক ঠক করে আসত; ময়ূরে তার চোখ উপড়ে নিয়েছিল। ‘ক্ষীরের পুতুল’এ যে ষষ্ঠী বুড়ি এঁকেছি ঠিক সেই রকম ছিল সে দেখতে। ওদিকে নিচে রাত দশটার পর নন্দ ফরাসের ঘরে নোটো খোঁড়ার বেহালা শুরু হয়। একটাই সুর অনেক রাত্তির অবধি চলে একটানা। বেহালা যেন সুরে এক দুই মুখস্থ করছে; এক, দুই, তিন, চার; এক, দুই, তিন, চার। ওই থেকে পরে আমি একটা যাত্রার সুর দিয়েছিলুম। বাবামশায়ের বৈঠক ভাঙলে নন্দ ফরাসের ঘরে বৈঠক বসে—ছিরু মেথর, নোটো খোঁড়া, আরও অনেকের। ভোরবেলা বাড়ির সামনে ঘোড়া মলে টপ টপ ধপধপ। কাকপক্ষী ডাকার আগে এই শব্দ শুনেই ঘুম ভাঙে আমার। রোজ ঘুমোবার আগে আর ঘুম ভেঙে এই দুটি শব্দ শুনি—বেহালার এক, দুই, তিন, চার; আর ঘোড়ামলার টপ টপ ধপ ধপ। তখন এক-একটা সময়ের এক-একটা শব্দ ছিল। এখন সেই শব্দ আর নেই। সব মিলিয়ে যেন কোলাহল চারদিকে। ট্যাক্‌সির ভোঁ-ভোঁ, দোকানদারের চিংকার, রাস্তার হট্টগোল, এসবে ঘরের কোণায়ও কান পাতা দায়। তার উপরে জুটেছে আজকাল মাথার উপরে উড়োজাহাজের ঘড়ঘড়ানি, রেডিওর ভনভনানি, আরও কত কি। তেতালার ছাদে জ্যোতিকাকামশায়ের পিয়ানোর সুর, রবিকার গান, জ্যাঠামশায়ের হাসির ধমক, কোথায় চলে গেল সে সব! তা সেই সময়ে দুপুরে বৈঠকখানাতেই একদিন আমি আবিষ্কার করলুম ‘লণ্ডন নিউজে’র ছবি। বাঁধানো ‘লণ্ডন নিউজ’ পড়েছিল এক কোণায়। সব-কিছু ঘেঁটে ঘেঁটে দেখতে গিয়ে বইয়ের ভিতরে ছবির সন্ধান পেলুম। সে কতরকম কাণ্ডকারখানার ছবি, নিবিষ্ট মনে বসে বসে দেখি। একদিন ঘোষাল মাস্টার এসে ঢুকলেন সেই ঘরে। দিব্যি ভুঁড়িদার চেহারা তার; খালি গায়ে যখন আসেন, তেলচুকচুকে ভুঁড়িটি ঠিক যেন পিতলাই হাড়া একটি। তিনি ঘরে ঢুকে বললেন, ‘দেখি কি দেখছ’—বলে আমার হাত থেকে বইগুলি নিয়ে পাতা উলটে উলটে দেখতে লাগলেন। দেখতে দেখতে একটা পাতায় আছে ফরাসী রানীর ছবি, তিনি সেই ছবিটি সামনে রেখে হাতজোড় করে তিনবার মাথায় ঠেকালেন। তারপর থেকে দেখি রোজই তিনি স্নানের পর ফরাসী রানীর ছবি বের করে তিনবার পেন্নাম করেন। কারণ আর বুঝিনে কিছু। দেবদেবীর ছবি এ নয়, তবে কেন এত পেন্নামের ঘটা। শেষে বড়দাকে একদিন জিজ্ঞেস করি, ‘এর মানে কি বলে না।’ বড়দা হেসে বললেন, ‘ওহো তা বুঝি জানিসনে? ঘোষাল মশায়কে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে, তিনি বললেন, এই ফরাসী রানী তাঁর স্ত্রীর মতো দেখতে। তাই রোজ তিনি ওই ছবিকে পেন্নাম করেন।’
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"০৪. ছেলেবেলায় খুব গান আর ছবি-আঁকা\nঅবন(...TRUNCATED)
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"০৫. জোড়াসাঁকোর দুটো স্বতন্ত্র বাড়ি\(...TRUNCATED)
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"০৬. পলতার বাগান\nঅবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর\n\n(...TRUNCATED)
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"০৭. তার পর গেল বেশ কিছুকাল\nঅবনীন্দ্রন(...TRUNCATED)

বাংলা সাহিত্য (Bangla Sahitya or Bengali Literature)

A non-exhaustive collection of Bengali literary works (poems, stories, novels, songs, essays, letters) by more than 35 authors. These works span between the 8th and 20th centuries. All these works are in the public domain.

The contents of some of the rows can be large, e.g., novels. Also, some of the earlier works may be noisy.

If you are only interested in Bengali poems, take a look at this smaller subset of Bengali Poems dataset.

Downloads last month
45