author
stringclasses
33 values
text
stringlengths
86
1.25M
কামিনী রায়
এরা যদি জানে কামিনী রায় এদেরও তো গড়েছেন নিজে ভগবান্, নবরূপে দিয়েছেন চেতনা ও প্রাণ; সুখে দুঃখে হাঁসে কাঁদে স্নেহে প্রেমে গৃহ বাঁধে বিধে শল্যসম হৃদে ঘৃণা অপমান, জীবন্ত মানুষ এরা মায়ের সন্তান॥ এরা যদি আপনারে শেখে সম্মানিতে, এরা দেশ-ভক্ত রূপে জন্মভূমি-হিতে মরণে মানিবে ধর্ম বাক্য নহে —দিবে কর্ম; আলস্য বিলাস আজো ইহাদের চিতে পারেনি বাঁধিতে বাসা, পথ ভুলাইতে॥ এরা হতে পারে দ্বিজ—যদি এরা জানে, এরা কি সভয় সরি' রহে ব্যবধানে? এরা হতে পারে ,বীর, এরা দিতে পারে শির, জননীর, ভগিনীর, পত্নীর সম্মানে, ভবিষ্যের মঙ্গলের স্বপনে ও ধ্যানে। এরা যদি জানে॥ উচ্চ কূলে জন্ম ব'লে কত দিন আর ভাই বিপ্র রবে তব এই অহংকার? কৃতান্ত সে কুলীনের রাখে না তো মান, তার কাছে দ্বিজ শূদ্র পারীয়া সমান। তার স্পর্শে যেই দিন পঞ্চভূতে দেহ লীন বাহ্মণে চণ্ডালে রহে কত ব্যবধান?
কামিনী রায়
কত ভালবাসি কামিনী রায় জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,— “মা, তোমারে কত ভালোবাসি!” “কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়। “এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়। “তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?” মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।” “তবু কতখানি, বল।” “যতখানি ধরে তোমার মায়ের বুকে।” “নহে তার পরে?” “তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।” “আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে!
কামিনী রায়
কর'না জিজ্ঞাসা কামিনী রায় মোরে প্রিয় কর'না জিজ্ঞাসা, সুখে আমি আছি কি না আছি। ডরি আমি রসনার ভাষা ; দোঁহে যবে এত কাছাকাছি, মাঝখানে ভাষা কেন চাই ; বুঝবার আর কিছু নাই ? হাত মোর বাঁধা তব হাতে, শ্রান্ত শির তব স্কন্ধোপরি, জানিনা এ সুস্নিগ্ধ সন্ধ্যাতে অশ্রু যেন ওঠে আঁখি ভরি। দুঃখ নয়, ইহা দুঃখ নয়, এইটুকু জানিও নিশ্চয়। নীলাকাশে ফুটিতেছে তারা, জাতি যুথী পল্লব হরিতে ; অতি শুভ্র, অত্যুজ্জ্বল যারা, আসে চলি আঁধার তরীতে। ভেসে আজ নয়নের জলে কি আসিছে, কে আমারে বলে? (২) সুখ সে কেমন যাদুকর, তাকাইলে হয় অন্তর্ধান, ডাকিলে সে দেয় না উত্তর, চাহিলে সে করে না তো দান। দুঃখ যে হইলে অতীত সুখ বলি হয়গো প্রতীত ! সুখ সাথে আছে, কি না আছে, কোন নাই প্রশ্ন মিমাংশার, চলিছে সে পার্শ্বে কিবা পাছে ; সুখ দুঃখ চেনা বড় ভার ; আমরা দুজনে দু'জনার, পিছে পাছে দৃষ্টি কেন আর? ওগো প্রিয় মোর মনে হয়, প্রেম যদি থাকে মাঝখানে, আনন্দ সে দূরে নাহি রয়। প্রাণ যবে মিলে যায় প্রাণে, সঙ্গীতে আলোকে পায় লয়, যত ভয়, যতেক সংশয়।
কামিনী রায়
কর্তব্যের অন্তরায় কামিনী রায় কে তুমি দাঁড়ায়ে কর্তব্যের পথে, সময় হরিছ মোর ; কে তুমি আমার জীবন ঘিরিয়া জড়ালে স্নেহের ডোর, চির-নিদ্রাহীন নয়নে আমার আনিছ ঘুমের ঘোর? দু'নয়ন হ'তে দূরস্থ আলোকে কেন কর অন্তরাল? কেমনে লভিব লক্ষ্য জীবনের পথে কাটাইলে কাল? আমার রয়েছে কঠোর সাধনা, ফেলনা মায়ার জাল | তোমারে দেখিলে গত অনাগত যাই একেবারে ভুলে মুগ্ধ হিয়া মম চাহে লুটাইতে তোমার চরণমূলে, ফেলে যাও তারে, দলে যাও তারে, নিওনা, নিওনা তু'লে | তোমার মমতা অকল্যাণময়ী, তোমার প্রণয় ক্রূর, যদি লয়ে যায় ভুলাইয়া পথ, লয়ে যাবে কত দূর? এই স্বপ্নাবেশ রহিবার নয়, চলে যাও হে নিষ্ঠুর |
কামিনী রায়
ডেকে আন্ কামিনী রায় পথ ভুলে গিয়াছিল, আবার এসেছে ফিরে, দাঁড়ায়ে রয়েছে দূরে, লাজে ভয়ে নত শিরে ; সম্মুখে চলে না পদ, তুলিতে পারে না আঁখি, কছে গিয়ে, হাত ধরে, ওরে তারে আন্ ডাকি। ফিরস্ নে মুখ আজ নীরব ধিক্কার করি, আজি আন্ স্নেহ-সুধা লোচন বচন ভরি। অতীতে বরষি ঘৃণা কিবা আর হবে ফল? আঁধার ভবিষ্য ভাবি, হাত ধরে লয়ে চল্। স্নেহের অভাবে পাছে এই লজ্জানত প্রাণ সঙ্কোচ হারায়ে ফেলে—আন্ ওরে ডেকে আন্! আসিয়াছে ধরা দিতে, শত স্নেহ-বাহু-পাশে বেঁধে ফেল্ ; আজ গেলে আর যদি না-ই আসে। দিনেকের অবহেলা, দিনেকের ঘৃণাক্রোধ, একটি জীবন তোরা হারাবি জীবন-শোধ। তোরা কি জীবন দিবি? উপেক্ষা যে বিষবাণ, দুঃখ-ভরা ক্ষমা লয়ে, আন্, ওরে ডেকে আন্।
কামিনী রায়
দিন চলে যায় কামিনী রায় একে একে একে হায়! দিনগুলি চলে যায়, কালের প্রবাহ পরে প্রবাহ গড়ায়, সাগরে বুদ্বুদ্ মত উন্মত্ত বাসনা যত হৃদয়ের আশা শত হৃদয়ে মিলায়, আর দিন চলে যায়। জীবনে আঁধার করি, কৃতান্ত সে লয় হরি প্রাণাধিক প্রিয়জনে, কে নিবারে তায়? শিথির হৃদয় নিয়ে, নর শূণ্যালয়ে গিয়ে, জীবনের বোঝা লয় তুলিয়া মাথায়, আর দিন চলে যায়। নিশ্বাস নয়নজল মানবের শোকানল একটু একটু করি ক্রমশঃ নিবায়, স্মৃতি শুধু জেগে রহে, অতীত কাহিনী কহে, লাগে গত নিশীথের স্বপনের প্রায় ; আর দিন চলে যায়!
কামিনী রায়
পাছে লোকে কিছু বলে কামিনী রায় করিতে পারি না কাজ সদা ভয় সদা লাজ সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,- পাছে লোকে কিছু বলে। আড়ালে আড়ালে থাকি নীরবে আপনা ঢাকি, সম্মুখে চরণ নাহি চলে পাছে লোকে কিছু বলে। হৃদয়ে বুদবুদ মত উঠে চিন্তা শুভ্র কত, মিশে যায় হৃদয়ের তলে, পাছে লোকে কিছু বলে। কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি সযতনে শুকায়ে রাখি;- নিরমল নয়নের জলে, পাছে লোকে কিছু বলে। একটি স্নেহের কথা প্রশমিতে পারে ব্যথা,- চলে যাই উপেক্ষার ছলে, পাছে লোকে কিছু বলে। মহৎ উদ্দেশ্য যবে, এক সাথে মিলে সবে, পারি না মিলিতে সেই দলে, পাছে লোকে কিছু বলে। বিধাতা দেছেন প্রাণ থাকি সদা ম্রিয়মাণ; শক্তি মরে ভীতির কবলে, পাছে লোকে কিছু বলে।
কামিনী রায়
মাতৃপূজা কামিনী রায় যেইদিন ও চরণে ডালি দিনু এ জীবন, হাসি অশ্রু সেইদিন করিয়াছি বিসর্জন। হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর, দুঃখিনী জনম-ভূমি,—মা আমার, মা আমার! অনল পুষিতে চাহি আপনির হিয়া মাঝে, আপনারে অপরেরে নিয়োজিতে তব কাজে ; ছোটখাটো সুখ-দুঃখ—কে হিসাব রাখে তার তুমি যবে চাহ কাজ,—মা আমার, মা আমার! অতীতের কথা কহি' বর্তমান যদি যায়, সে কথাও কহিব না, হৃদয়ে জপিব তায় ; গাহি যদি কোন গান, গাব তবে অনিবার, মরিব তোমারি তরে,—মা আমার, মা আমার! মরিব তোমারি কাজে, বাঁচিব তোমারি তরে, নহিলে বিষাদময় এ জীবন কেবা ধরে? যতদিন না ঘুচিবে তোমার কলঙ্ক-ভার, থাক্ প্রাণ, যাক্ প্রাণ,—মা আমার, মা আমার!
কামিনী রায়
সুখ কামিনী রায় নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?— এ ধরা কি শুধু বিষাদময়? যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে কেবলি কি নর জনম লয়?— কাঁদাইতে শুধু বিশ্বরচয়িতা সৃজেন কি নরে এমন করে'? মায়ার ছলনে উঠিতে পড়িতে মানবজীবন অবনী 'পরে? বল্ ছিন্ন বীণে, বল উচ্চৈঃস্বরে,— না,—না,—না,—মানবের তরে আছে উচ্চ লক্ষ্য, সুখ উচ্চতর, না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে। কার্যক্ষেত্র ওই প্রশস্ত পড়িয়া, সমর-অঙ্গন সংসার এই, যাও বীরবেশে কর গিয়ে রণ ; যে জিনিবে সুখ লভিবে সেই। পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে? আপনার কথা ভুলিয়া যাও। পরের কারণে মরণের সুখ ; 'সুখ' 'সুখ' করি কেঁদনা আর, যতই কাঁদিবে ততই ভাবিবে, ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার। গেছে যাক ভেঙ্গে সুখের স্বপন স্বপন অমন ভেঙ্গেই থাকে, গেছে যাক্ নিবে আলেয়ার আলো গৃহে এস আর ঘুর'না পাকে। যাতনা যাতনা কিসেরি যাতনা? বিষাদ এতই কিসের তরে? যদিই বা থাকে, যখন তখন কি কাজ জানায়ে জগৎ ভ'রে? লুকান বিষাদ আঁধার আমায় মৃদুভাতি স্নিগ্ধ তারার মত, সারাটি রজনী নীরবে নীরবে ঢালে সুমধুর আলোক কত! লুকান বিষাদ মানব-হৃদয়ে গম্ভীর নৈশীথ শান্তির প্রায়, দুরাশার ভেরী, নৈরাশ চীত্কার, আকাঙ্ক্ষার রব ভাঙ্গে না তায়। বিষাদ—বিষাদ—বিষাদ বলিয়ে কেনই কাঁদিবে জীবন ভরে'? মানবের মন এত কি অসার? এতই সহজে নুইয়া পড়ে? সকলের মুখ হাসি-ভরা দেখে পারনা মুছিতে নয়ন-ধার? পরহিত-ব্রতে পারনা রাখিতে চাপিয়া আপন বিষাদ-ভার? আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
কামিনী রায়
সে কি? কামিনী রায় 'প্রণয়?' 'ছি!' 'ভালবাসা—প্রেম?' 'তাও নয়।' 'সে কি তবে?' 'দিও নাম, দিই পরিচয়— আসক্তি বিহীন শুদ্ধ ঘন অনুরাগ, আনন্দ সে নাহি তাহে পৃথিবীর দাগ ; আছে গভীরতা আর উদ্বেল উচ্ছ্বাস, দু'ধারে সংযম-বেলা, ঊর্দ্ধে নীল আকাশ, উজ্জ্বল কৌমুদীতলে অনাবৃত প্রাণ, বিম্ব প্রতিবিম্ব কার প্রাণে অধিষ্ঠান ; ধরার মাঝারে থাকি ধরা ভুলে যাওয়া, উন্নত-কামনা-ভরে ঊর্দ্ধ দিকে চাওয়া ; পবিত্র পরশে যার, মলিন হৃদয়, আপনাতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবালয়, ভকতি বিহ্বল, প্রিয় দেব-প্রতিমারে প্রণমিয়া দূরে রহে, নারে ছুঁইবারে ; আলোকের আলিঙ্গনে, আঁধারের মত, বাসনা হারায়ে যায়, দুঃখ পরাহত ; জীবন কবিতা-গীতি, নহে আর্তনাদ, চঞ্চল নিরাশা, আশা, হর্ষ, অবসাদ। আপনার বিকাইয়া আপনাতে বাস, আত্মার বিস্তার ছিঁড়ি' ধরণীর পাশ। হৃদয়-মাধুরী সেই, পূণ্য তেজোময়, সে কি তোমাদের প্রেম?—কখনই নয়। শত মুখে উচ্চারিত, কত অর্থ যার, সে নাম দিও না এরে মিনতি আমার।'
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পত্রগুচ্ছ সুকান্ত ভট্টাচার্য বেলেঘাটা ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেন, শ্রীরুদ্রশরণম্‌ কলিকাতা। পরম হাস্যাম্পদ, অরুণ,১—আমার ওপর তোমার রাগ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক, আর আমিও তোমার রাগকে সমর্থন করি। কারণ, আমার প্রতিবাদ করবার কোনো উপায় নেই, বিশেষত তোমার স্বপক্ষে আছে যখন বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ। কিন্তু চিঠি না-লেখার মতো বিশ্বাসঘাতকতা আমার দ্বারা সম্ভব হত না, যদি না আমি বাস করতাম এক বিরাট অনিশ্চয়তার মধ্যে—তবুও আমি তোমাকে রাগ করতে অনুরোধ করছি। কারণ কলকাতার বাইরে একজন রাগ করবার লোক থাকাও এখন আমার পক্ষে একটা সান্ত্বনা, যদিও কলকাতার ওপর এই মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো কিছু ঘটে নি, তবুও কলকাতার নাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সব কটা লক্ষণই বিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো আমি প্রত্যক্ষ করছি।… … … …ম্লানায়মান কলকাতার ক্রমন্তস্বমান২ স্পন্দনধ্বনি শুধু বারম্বার আগমনী ঘোষণা করছে আর মাঝে-মাঝে আসন্ন শোকের ভয়ে ব্যথিত জননীর মতো সাইরেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নগরীর বুঝি অকল্যাণ হবে। আর ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতা, তবে নাটকটি হবে বিয়োগান্তক। এই হল কলকাতার বর্তমান অবস্থা। জানি না তোমার হাতে এ চিঠি পৌঁছবে কি না; জানি না ডাকবিভাগ ততদিন সচল থাকবে কি না। কিন্তু আজ রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে পৃথিবী কলকাতার দিকে চেয়ে, কখন কলকাতার অদূরে জাপানী বিমান দেখে আর্তনাদ করে উঠবে সাইরেন —সম্মুখে মৃত্যুকে দেখে, ধ্বংসকে দেখে, প্রতিটি মুহূর্ত এগিয়ে চলেছে বিপুল সম্ভাবনার দিকে। এক-একটি দিন যেন মহাকালের এক-একটি পদক্ষেপ, আমার দিনগুলি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে বাসরঘরের নববধূর মতো এক নতুন পরিচয়ের সামীপ্যে। ১৯৪২ সাল কলকাতার নতুন সজাগ্রহণের এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। বাস্তবিক ভাবতে অবাক লাগে, আমার জন্ম-পরিচিত কলকাতা ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাবে অপরিচয়ের গর্ভে, ধ্বংসের সমুদ্রে, তুমিও কি তা বিশ্বাস কর, অরুণ? কলকাতাকে আমি ভালবেসেছিলাম, একটা রহস্যময়ী নারীর মতো, ভালবেসেছিলাম প্রিয়ার মতো, মায়ের মতো। তার গর্ভে জন্মানোর পব আমার জীবনের এতগুলি বছর কেটে গেছে তারই উষ্ণ-নিবিড় বুকের সান্নিধ্যে; তার স্পর্শে আমি জেগেছি, তার স্পর্শে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। বাইরের পৃথিবীকে আমি জানি না, চিনি না, আমার পৃথিবী আমার কলকাতার মধ্যেই সম্পূর্ণ। একদিন হয়তো এ পুথিবীতে থাকব না, কিন্তু এই মুহূর্ত পর্যন্ত আমি যে কলকাতায় বসে কলকাতাকে উপভোগ করছি! সত্যি অরুণ, বড় ভাল লেগেছিল পৃথিবীর স্নেহ, আমার ছোট্ট পৃথিবীর করুণা। বঁচতে ইচ্ছা করে, কিন্তু নিশ্চিত জানি কলকাতার মৃত্যুর সঙ্গেই আমিও নিশ্চিহ্ন হব। “মরিতে চাহি না আমি মুন্দর ভুবনে।” কিন্তু মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে, প্রতিদিন সে ষড়যন্ত্র করছে সভ্যতার সঙ্গে। তবু একটা বিরাট পরিবর্তনের মূল্য যে দিতেই হবে। আবার পৃথিবীতে বসন্ত আসবে, গাছে ফুল ফুটবে। শুধু তখন থাকব না আমি, থাকবে না আমার ক্ষীণতম পরিচয়। তবু তো জীবন দিয়ে এক নতুনকে সার্থক করে গেলাম!… …এই আমার আজকের সান্ত্বনা। তুমি চলে যাবার দিন আমার দেখা পাও নি কেন জান? শুধু আমার নির্লিপ্ত উদাসীনতার জন্যে। ভেবে দেখলাম কোনো লাভ নেই সেই দেখা করায়, তবু কেন মিছিমিছি মন খারাপ করব?”… …  কিন্তু সেদিন থেকে আর চিঠি লেখবার সুযোগ পাই নি। কারণ উপক্রমণিকা৩ ভরিয়ে তুলল আমাকে তার তীব্র শারীরিকতায়—তার বিদ্যুৎময় ক্ষণিক দেহ-ব্যঞ্জনায়, আমি যেন যেতে-যেতে থমকে দাঁড়ালাম, স্তব্ধতায় স্পন্দিত হতে লাগলাম প্রতিদিন। দৃষ্টি দিয়ে পেতে চাইলাম তাকে নিবিড় নৈকট্যে। মনে হল আমি যেন সম্পূর্ণ হলাম তার গভীরতায়। তার দেহের প্রতিটি ইঙ্গিত কথা কয়ে উঠতে লাগল আমার প্রতীক্ষমান মনে। একি চঞ্চলতা আমার স্বাভাবিকতার? ওকে দেখবার তৃষ্ণায় আমি অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম বহুদর্শনেও। না-দেখার ভান করতাম ওকে দেখার সময়ে। অর্থাৎ এ ক’দিন আমার মনের শিশুত্বে দোলা লেগেছিল গভীরভাবে। অবিশ্যি একবার দুলিয়ে দিলে সে দোলন থামে বেশ একটু দেরি করেই,—তাই আমার মনে এখনও চলছে সেই আন্দোলন। তবু কী যে হয়েছিল আমার, এখনও বুঝতে পারছি না; শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, আমার মনের অন্ধকারে ফুটে উঠেছিল একটি রৌদ্রময় ফুল। তার সৌরভ আজও আমায় চঞ্চল করে তুলেছে থেকে-থেকে। ওর চলে যাবার দিন দেখেছিলাম ওর চোখ, সে চোখে যেন লেখা ছিল “হে বন্ধু বিদায়, তোমাকে আমার সান্নিধ্য দিতে পারলাম না, ক্ষমা কর।” সে ক’দিন কেটেছিল যেন এক মূর্ছার মধ্যে দিয়ে, সমস্ত চেতনা হারিয়ে গেছল কোনও অপরিচিত সুরলোকে। তোমরা একে পুর্বরাগ আখ্যা দিতে পার, কিন্তু আমি বলব এ আমার তুর্বলতা। তবে এ থেকে আমার অনুভূতির কিছু উন্নতি সাধন হল। কিন্তু এ ঘটনার পর আমি কোনও প্রেমের কবিতা লিখি নি, কারণ প্রেমে পড়ে কবিতা লেখা আমার কাছে ন্যক্কারজনক বলে মনে হয়। আমার কথা তো অনেক বললাম, এবার তোমার খবর কি তাই বল। থিয়েটারের রিহার্সাল পুরোদমে চলছে তো?… …তারপর সঙ্গে নিয়ত দেখা হচ্ছে নিশ্চয়ই? তার মনোভাব তোমার প্রতি প্রসন্ন, অন্যথায় প্রসন্ন করবার প্রাণপণ চেষ্টা করবে। তোমার প্রেমের মৃদুশীতলধারায় তার নিত্যস্নানের ব্যবস্থা কর, আর তোমার সান্নিধ্যের উষ্ণতায় তাকে ভরিয়ে তুলো। তুমি চলে যাবার পর আমি তারাশঙ্করের ‘ধাত্রীদেবতা’, বুদ্ধদেব প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্যর ‘বনশ্রী’, প্রবোধের ‘কলরব’, মণীন্দ্রলাল বসুর ‘রক্তকমল’ ইত্যাদি বইগুলি পড়লাম। প্রত্যেকখানিই লেগেছে খুব ভাল। আর অনাবশ্যক চিঠির কলেবব বৃদ্ধির কি দবকার? আশা করি তোমরা সকলে, তোমাব মা-বাবা-ভাই-বোন… … ইত্যাদি সকলেই দেহে ও মনে সুস্থ। তুমি কি লিখলে-টিখলে? তোমার মা গল্প-সল্প কিছু লিখছেন তো? তাহলে আজকের মতো লেখনী কিন্তু চিঠির কাগজের কাছে বিদায় নিচ্ছে। ২১শে পৌষ, ’৪৮ —সুকান্ত ভট্টাচার্য . দুই বেলেঘাটা কলকাতা ৩৪, হরমোহন ঘোষ লেন —ফাগুনের একটি দিন। অরুণ, তোর অতি নিরীহ চিঠিখানা পেয়ে তোকে ক্ষমা করতেই হল, কিন্তু তোর অতিরিক্ত বিনয় আমাকে আনন্দ দিল এইজন্যে যে, ক্ষমাটা তোর কাছ থেকে আমারই প্রাপ্য; কারণ তোর আগের ‘ডাক-বাহিত’ চিঠিটার জবাব আমারই আগে দেওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, উল্টে আমাকেই দেখছি ক্ষমা করতে হল। তোর চিঠিটা কাল পেয়েছি, কিন্তু পড়লুম আজকে সকালে; কারণ পরে ব্যক্ত করছি। বাস্তবিক, তোর দুটো চিঠিই আমাকে প্রভূত আনন্দ দিল। কারণ চিঠির মতো চিঠি আমাকে কেউ লেখে না এবং এটুকু বলতে দ্বিধা করব না যে, তোর প্রথম চিঠিটাই আমার জীবনের প্রথম একখানি ভাল চিঠি, যার মধ্যে আছে সাহিত্য-প্রধানতা। তোর প্রথম চিঠির উত্তর দেওয়া হয় নি তোর মতোই অলসতায় এবং একটু নিশ্চিন্ত নির্ভরতাও ছিল তার মধ্যে। এবারে চিঠি লিখছি এইজন্যে যে, এতদিন ভয় পেয়ে পেয়ে এবার মরিয়া হয়ে উঠেছি মনে মনে। কাল বিকেলে তোর বাবা ঠিকানা খুঁজে খুঁজে অবশেষে তোর চিঠিখানা আমার হাতে দিলেন এবং আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তোর মা-র কাছে। কিন্তু তুই বোধ হয় এ খবর পাস নি যে, তোদের আগের সেই লতাচ্ছাদিত, তৃণশ্যামল, সুন্দর বাড়িটি ত্যাগ করা হয়েছে। যেখানে তোরা ছিলি গত চার বছর নিরবচ্ছিন্ন নীরবতায়, যেখানে কেটেছে তোদের কত বর্ষণ-মুখর সন্ধ্যা, কত বিরস দুপুর, কত উজ্জল প্রভাত, কত চৈতালি হাওয়ায়-হাওয়ায় রোমাঞ্চিত রাত্রি, তোর কত উষ্ণ কল্পনায়, নিবিড় পদক্ষেপে বিজড়িত সেই বাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হল আপাত নিম্প্রয়োজনতায়। তোর মা এতে পেয়েছেন গভীরতম বেদনা, তার ঠিক আপন জায়গাটিই যেন তিনি হারালেন। এক আকস্মিক বিপর্যয়ে যেন এক নিকটতম আত্মীয় সুদূর হয়ে উঠল প্রকৃতির প্রয়োজনে। শত শত জন-কোলাহল-মথিত ইস্কুল বাড়িটি আজ নিস্তব্ধ নিঝুম। সদ্য বিধবা নারীর মতো তার অবস্থা। তোদের অজস্র-স্মৃতি-চিহ্নিত তার প্রতিটি প্রত্যঙ্গ যেন তোদেরই স্পর্শের জন্য উন্মুখ; সেখানে এখনও বাতাসে বাতাসে পাওয়া যায় তোদের স্মৃতির সৌরভ। কিন্তু সে আর কতদিন? “তবু বাড়িটি যেন আজ তোদেরই ধ্যান করছে। তোদের নতুন বাড়িটায় গেলুম। এ বাড়িটাও ভাল, তবে ও-বাড়ির তুলনায় নয়। সেখানে রাত প্রায় পৌনে এগারোটা পর্যন্ত তোর বাবা এবং মা-র সঙ্গে প্রচুর গল্প হল। তাদের গত জীবনের কিছু-কিছু শুনলাম; শুনলাম সুন্দরবনের কাহিনী। কালকের সন্ধ্যা কাটল একটি পবিত্র, সুন্দর কথালাপের মধ্যে দিযে, তারপর তোর বাবা-মা, তোর ছোট ভাই আর আমি গিয়েছিলাম তোদের সেই পরিত্যক্ত বাড়িতে এবং এইজন্তেই ঐ সম্বন্ধে অমাব এত কথা লেখা। দেখলাম স্তব্ধ বিস্মযে চেয়ে চেয়ে, সদ্যবিয়োগ-ব্যথাতুর বিরহিণীর মতো বাড়িটার এক অপূর্ব মুহামানতা। তারপর ফিরে এসে হল আরও কথা। কালকের কথাবার্তায় আমার তোর বাবা এবং মা-র ওপর আরও নিবিড়তম শ্রদ্ধার উদ্রেক হল। (কথাটা চাটুবাদ নয়)। তোদের (তোর এবং তোর মা-র) দুজনের লেখা গানটা পড়লুম; বেশ ভাল। কালকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলুম ‘পাঁচটি ফাগুনসন্ধ্যা ও একটি কোকিল’৪ গল্পটি। আজ দুপুরে সেটি পড়লুম। বাস্তবিক, এ রকম এবং এ ধরনের গল্প আমি খুব কম পড়েছি (ভালর দিক থেকে), কারণ ভাব এবং ভাষায় মুগ্ধ হয়ে গেছি আমি। পাঁচটি ফাগুনসন্ধ্যার সঙ্গে একটি কোকিলের সম্পর্ক একটি নতুন ধরনের জিনিস। গল্পটা বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাবার যোগ্য। যাই হোক, এখন তোর খবর কি? তুই চলে আয় এখানে, কাল তোদের বাড়িতে তোর অভাব বড় বেশী বোধ হচ্ছিল, তাই চলে আয় আমাদের সান্নিধ্যে। অজিতের সঙ্গে পথে মাঝে মাঝে দেখা হয়, তোর কথা সে জিজ্ঞাসা করে। ভুপেন৫ আজ এসেছিল—একটা চিঠি দিল তোকে দেবার জন্যে—আর একটু আগে তাকে এগিয়ে দিয়ে এলাম বাড়ির পথে। উপক্রমণিকার মোহ প্রায় মুছে আসছে। শ্যামবাজার প্রায়ই যাই। তুই আমাকে তোদের ওখানে যেতে লিখেছিস, আচ্ছা চেষ্টা করব। চিঠিটা লিখেই তোর মা-র কাছে যাব। বাস্তবিক, তোর মা তোর জীবনে স্বগীয় সম্পদ। তোর জীবনে যা কিছু, তা যে তোর এই মা-কে অবলম্বন করেই—এই গোপন কথাটা আজ জেনে ফেলেছি। তুই কিসের ঝগড়া পাঠালি, বুঝতে পারলুম না। তুই চলে আয়, আমি ব্যাকুল স্বরে ডাকছি, তুই চলে আয়। প্রীতি-ট্রিতি নেওয়ার ব্যাপার যখন আমাদের মধ্যে নেই, তখন বিদায়। —সুকান্ত ভট্টাচার্য। . তিন বেলেঘাটা, ২২শে চৈত্র, ১৩৪৮। সবুরে মেওয়াফল-দাতাসু, অরুণ, তোর কাছ থেকে চিঠির প্রত্যাশা করা আমার উচিত হয় নি, সে জন্য ক্ষমা চাইছি। বিশেষত তোর যখন রয়েছে অজস্র অবসর—সেই সময়টা নিছক বাজে খরচ করতে বল কি আমার উচিত? সুতরাং তোর কাছ থেকে চিঠি প্রাপ্তির দুরাশা আমায় বিচলিত করে নি। কোনো একটা চিঠিতে আমার ব্যক্তিগত অনেক কিছু বলার থাকলেও আজ আমি শুধু আমার পারিপার্শ্বিকের বর্ণনা দেব। প্রথমে দিচ্ছি কলকাতার বর্ণনা—কলকাতা এখন আত্মহত্যার জন্যে প্রস্তুত, নাগরিকরা পলায়ন-তৎপর। নাগরিকরা যে পলায়ন-তৎপর তার প্রধান দৃষ্টান্ত তোমার মা, যদিও তিনি নাগরিক নন, নিতান্ত গ্রামের। তবু এ থেকে অনুমান করা যায় যে, কত দ্রুত সবাই করছে প্রস্থান আর শহরটি হচ্ছে নির্জন। তবে এই নির্জনতা হবে উপভোগ্য—কারণ এর জনাকীর্ণতায় আমরা অভ্যস্ত, সুতরাং এর নব্য পরিচয়ে আমরা একটা অচেনা কিছু দেখার সৌভাগ্যে সার্থক হব। আর কলকাতার ভীষণতার প্রয়োজন এই জন্যে যে, এত আগন্তুকের স্থান হয়েছিল এই কলকাতায়, তার ফলে কলকাতা কাদের তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। একজন বিদেশী এলে সে বুঝতেই পারবে না, যতক্ষণ না তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে দেশটা কাদের। কারণ, যা ভীড়—তাতে মনে হয় দেশটা সকলের না-হোক, শহরটা সার্বজনীন। আজকাল রাত একটায় যদি কলকাতা ভ্রমণ কর তাহলে তোমার ভয়ঙ্কর সাহস আছে বলতে হবে। শুধু চোর-গুণ্ডার নয়, কলকাতার পথে এখন রীতিমত ভূতের ভয়ও করা যেতে পারে। সন্ধ্যার পর কলকাতায় দেখা যায় গ্রাম্য বিষণ্ণতা। সেই আলোকময়ী নগরীকে আজকাল স্মরণ করা কঠিন; যেমন একজন বৃদ্ধা বিধবাকে দেখলে মনে করা কঠিন তার দাম্পত্য-জীবন। আর বিবাহের পূর্বে বিবাহোম্মুখ বধূর মতো কলকাতার দেখা দিয়েছে প্রতীক্ষা—অন্য দেশের বিবাহিতা সখীর মতো দেখবে ঘটিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আজ আমার ভাইয়েরা চলে গেল মুর্শিদাবাদ—আমারও যাবার কথা ছিল, কিন্তু আমি গেলাম না মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়াবার এক দুঃসাহসিক আগ্রহাতিশয্যে, এক ভীতি-সংকুল, রোমাঞ্চকর, পরম মুহূর্তের সন্ধানে। তবু আমার ক্লাস্তি আসছে, ক্লান্তি আসছে এই অহেতুক বিলম্বে। এ ক’দিন তোর মা-র সান্নিধ্য লাভ করলুম গভীরভাবে এবং আর যা লাভ করলুম তা এই চিঠিতে প্রকাশ করা অসম্ভব। অনেক আলোচনায় অনেক কিছুই জানলাম যা জানার দরকার ছিল আমার। আর তোর বাবার সরল স্নেহে আমি মুগ্ধ। আমার খবর আর কী দেব? তবে উপক্রমণিকাকে আমি একেবারে মুছে ফেলেছি মন থেকে, তার জায়গায় যে আসন নিয়েছে তার পরিচয় দেব পরের চিঠিতে। ভূপেন বিরহ-বিধুর মন নিয়ে ভালই আছে এবং কলকাতাতেই আছে। তাকে অন্তত একখানা চিঠি দিস—এতদিন পরে। ঘেলু৫ এখানে নেই, কয়েক দিনের জন্যে ঘাটাল, ঝাড়গ্রাম প্রভৃতি জায়গায় গেছে ভ্রমণোদ্দেশে, সুকুমার রায়ের বাড়ি। তোর খবর সমস্ত আমার জানা, সুতরাং কোনো প্রশ্ন করব না। আমার এই চিঠির উত্তর যতদিন পবে খুশি দিস—তবে না-দিলেও ক্ষতি নেই। ইতি— সুকান্ত ভট্টাচার্য . চার বেলেঘাটা—চৈত্র সংক্রান্তি ‘৪৮ কলকাতা। প্রভূতআনন্দদায়কেষু— অরুণ, তোর আশাতীত, আকস্মিক চিঠিতে আমি প্রথমটায় বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম—আর আরও পুলকিত হয়েছিলাম আর একটুকরো কাগজে কয়েক টুকরো কথা পেয়ে। তারপর কৃতসংকল্প হলাম পত্রপাঠ চিঠির জবাব দিতে। আজ খুব বেশী বাজে কথা লিখব না,—আর আমার চিঠি সাধারণত একটু উচ্ছ্বাসবর্জিতই, সুতরাং আজকে প্রধান কথাটি বলতে, সাধারণ জবাবগুলো একটু সংক্ষেপে সারব। এতে আপত্তি করলে চলবে না।  তুই যে খুব সুখে আছিস তা বুঝতেই পারছি, আর তোর অপূর্ব দিনগুলির গন্ধ পেলাম তোর চিঠির মধ্যে দিয়ে। তুই আমাকে তোদের কাছে যেতে লিখেছিস, কিন্তু আমার ভয় হয় পাছে কলকাতার ভয়ঙ্কর দিনগুলো হারিয়ে ফেলি। তবে আশা রইল, বৈশাখ মাসেই হয়তো লাভ করব তোর সামীপ্য। তবে তা দ্বিতীয় সপ্তাহে কিনা বলতে পারি না। আর তোদের ওখানে যাবার একটা ‘নীট খরচ’ যদি জানিয়ে দিতে পারিস, তবে আমার কিছু সুবিধা হয়। তোব একাকীত্ব ভাল লাগে না এবং ভাল লাগে না আমারো এই প্রাণস্পর্শহীন আত্মমগ্নতা। তবে একাকীত্ব অনুকূল নিজের সত্তাকে উপলব্ধি করার পক্ষে। একাকী মানুষ যা চিন্তা করে সেইটাই তার নিজের চিন্তা। নিঃসঙ্গ মানুষ নিজের প্রকৃতিকে পায়। সেই জন্যেই, একাকীত্বের একটা উপকারিতা আছে বলে আমার মনে হয়। তা দীর্ঘ হলেও ক্ষতি নেই। তোর কথামত অজিতকে৭ শুধু জানিয়েছি তোকে লেখার কথা। আর কাজগুলো সবই ধীরে সুস্থে সম্পন্ন করব—সন্দেহ নেই। তোর চিঠি পড়তে-পড়তে একটা জায়গায় থমকে গিয়েছিলাম আমার চিঠির প্রশংসা দেখে, কারণ তোর কাছে আমার চিঠির মূল্য হয়তো কিছুটা থাকতে পারে, কিন্তু অন্যের কাছে প্রশংসনীয় জেনে নিজের সম্বন্ধে আমার বিস্ময় বেড়ে গেল, বিশেষত আমার মতো জলীয়, লঘুপাক চিঠিগুলো যদি প্রশংসা পেতে থাকে, তবে চিঠির ভালত্ব বিচার করা কঠিন হয়ে পড়বে মনে হচ্ছে। আমার সমগ্র জীবনের লেখা তোদের ওখানে নিয়ে যাওয়া অসাধ্য-সাধন সাপেক্ষ। কারণ লেখা আমি সঞ্চয় করি না কখনও, যেহেতু লেখবার জন্য আমিই যখন যথেষ্ট, তখন আমার সঙ্গে একট। অহেতুক বোঝা থাকা রীতিমত অন্যায়। তবে প্রকৃতির প্রয়োজন বাঁচিয়ে যেগুলো এখানে-ওখানে বিক্ষিপ্ত, সেগুলো সংগ্রহ করে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারি।  তুই আমাকে গ্রহ-বিচ্ছিন্ন উল্কার সঙ্গে তুলনা করেছিস-কিন্তু গ্রহটা কু-গ্রহ, যেহেতু তার আগ্রহ আমায় নিক্ষেপ করা কোনো এক প্রশংসা-মুখর ক্ষেত্রে। যাই হোক, তোর এই চিঠিটা যেন নতুন জন্মের আভাস দিয়ে গেল। এখন শোন, যে “আমার জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করছে দান” তার পরিচয়: এই পরিচয়পত্রের প্রারম্ভেই তোর কাছে ক্ষমা চাইছি, তোর কাছে একদিন ছলনার প্রয়োজন হয়েছিল বলে। কিন্তু আর নয়, এই জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাড়িয়ে আর কপটতার আশ্রয় নিলুম না এই জন্যই যে, কথাটা গোপন হলেও ব্যথাটা আর গোপন থাকতে চায় না, তোর কাছে—উলঙ্গ, উন্মুক্ত হয়ে পড়তে চায়। এ-ব্যাপারটা আমার প্রাণের সঙ্গে এমন অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ যে, তোর কাছেও তা গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আবেগের বেগে সংযমের কঠিনতা গলে তা পানীয়রূপে প্রস্তুত হল তোর কৌতুহলে। তুই এ-প্রেমে ফেনায়িত কাহিনী-সুধা কি পান করবি না?—এই সুরার মূল্য যে শুধু সহানুভূতি ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস। কে তুই চিনিস,—যদি ‘না চিনি না’ বলিস তবে তাকে চিনিয়ে দিচ্ছি, সে উপক্রমণিকার অন্তরঙ্গ বন্ধু। সর্বোপরি সে আমার আবাল্যের সঙ্গিনী, সঙ্গিনী ঠিক নয়, বান্ধবী। যখন আমরা পরস্পরের সমুখে উলঙ্গ হতে দ্বিধা বোধ করতুম না, সেই সুদূর শৈশব হতে সে আমার সাথী। সব কিছু মনে পড়ে না, তবু এইটুকু মনে পড়ে যে, আমরা একত্র হলে আনন্দ পেতুম এবং সে আনন্দ ছিল নানারকমের কথা বলায়। একটা কথা বলে রাখা ভাল যে, আমাদের উভয়ের দেখা হত, কোনো কারণে প্রায়ই। সে আমায় শ্রদ্ধা করত এবং আমার সান্নিধ্যে খুশি হত। একবার আমাদের উভয়কেই… …যেতে হয়, সেখানেই আমরা আরো অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি এবং আমি সেখানে থেকেই লাভ করি ওর সান্নিধ্যের আকর্ষণ। তখন আমার বয়স ১১, তার ৯। তারপর আমাদের দেখা হতে লাগল দীর্ঘদিন পরে পরে।… … সেখানে আমি ঘনঘন যেতে লাগলুম।… …ওর আকর্ষণে অবিশ্যি নয়। বাস্তবিক আমাদের সম্পর্ক তখনও অন্য ধরনের ছিল, সম্পূর্ণ অকলঙ্ক, ভাই-বোনের মতোই। তখন ওকে নিয়ে যেতাম পার্কে বেড়াতে, উপক্রমণিকার বাড়ি ওকে পৌঁছে দিতাম দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। একত্রে আহার করতাম, পাশাপাশি শুয়ে বই পড়ে শোনাতাম ওকে, রাত্রেও পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোতাম। ঘুমের মধ্যে ওর হাতখানি আমার গায়ে এসে পড়ত, কিন্তু শিউরে উঠতাম না, ওর নিঃশ্বাস অনুভব কবতাম বুকের কাছে। তখনো ভালবাসা কি জানতাম না আর ওকে যে ভালবাসা যায় অন্যভাবে, এতো কল্পনাতীত। কোনো আবেগ ছিল না, ছিল না অতুভূতির লেশমাত্র। শেষে একদিন, যখন সবে এসে দাঁড়িয়েছি যৌবনের সিংহদ্বারে, এমনি একদিন, দিনটার তারিখ জানি না, পাশাপাশি শুয়েছিলাম, ঘুমিয়ে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি ভোর হচ্ছে আর সেই ভোরের আলোয় দেখলাম পার্শ্ববতিনীর মুখ। সেই নবপ্রভাতের পাণ্ডুর আলোয় মুখখানি অনির্বচনীয়, অপূর্ব সুন্দর মনে হল। কেঁপে উঠল বুক, যৌবনের পদধ্বনিতে। হঠাৎ দেখি ও চাইল আমার দিকে চোখ মেলে, তারপর পাশ ফিরে শুল। আর আমি যেন চোরের মতো অপরাধী হয়ে পড়লাম ওর কাছে। লজ্জায় সেই থেকে আর কথা বলতে পারলাম না—আজ পর্যন্ত। জিজ্ঞাসা করল, সুকান্ত কথা বলছে না কেন আমার সঙ্গে?… …বহুবার চেষ্টা করল আমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে—কিন্তু আমারই বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল ওর ওপর, কেন জানি না। (আমার বয়স তখন ছিল ১৩/১৪)। এই বিতৃষ্ণা ছিল বহুদিন পর্যন্ত। আমিও কথা বলি নি।  তারপর গত দু বছর আস্তে আস্তে যা গড়ে উঠেছে, সে ওর প্রতি আমার প্রেম। নতুন করে ভালবাসতে শুরু করলাম ওকে। বহুদিন থেকেই উপক্রমণিকাকে নিয়ে … …রা আমাকে ঠাট্টা করত। আমার কাছে হঠাৎ একদিন প্রস্তাব করল, উপক্রমণিকাকে তোর সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। আমি আপত্তি করলেও খুব বেশী আপত্তি করলাম না এই জন্যে যে, ভেবে দেখলাম, আমার এই নব যৌবনে ভাল একজনকে যখন বাসতেই হবে তখন… …র চেয়ে বৈধ উপক্রমণিকাকে হৃদয়দান, স্বতরাং সম্মত হওয়াই উচিত। কেন জানি না,… ..নিজে আমাদের মিলন সংঘঠনের দায়িত্ব নিল। উপক্রমণিকাও একবার আমার সঙ্গে আলাপ করতে রাজী হয়েও রাজী হল না। আমিও দু’তিন বার ওর প্রেমে পড়ে শেষে মোহমুক্ত হলাম তুই চলে যাবার পর। অর্থাৎ সম্প্রতি কয়েক মাস। এখন… ..কেই সম্পূর্ণ ভালবাসি।… …কে যে ভালবাসা যায় তা জানলাম,… …প্রতি আমার এক নির্দোষ চিঠি এক বৌদির কাছে সন্দেহিত হওয়ায়। চিঠিটার উচ্ছ্বাস ছিল সন্দেহ নেই, তাতে ছিল ওর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপন। কিন্তু তাতে সন্দেহ করা যায় দেখে বুঝলুম আমি ওকে ভালবাসতে পারি। যদিও আমার বোন ছিল না বলে ওর ভাইফোটা নিয়েছি দু’বার, আমাদের কথা বন্ধ হওয়ার পরও। আমি ওকে এখন ভালবাসি পরিপূর্ণ ও গভীরভাবে। ওর কথা আরও লিখব পরের চিঠিতে। আজ এই পর্যন্ত। এখন অন্যান্য খবর দিচ্ছি, শৈলেন৮ ও মিণ্টু৯ দুজনেই কলকাতা ছেড়েছে বহুদিন। আর বারীনদার১০ B. A. Examination ১লা মার্চ। সুতরাং তিনি ব্যস্ত আছেন পড়াশুনায়। ইতি— সুকান্ত ভট্টাচার্য পুনশ্চ: উপক্রমণিকার পরিবর্তে যে দেবীর শুভপ্রতিষ্ঠার কথা লিখেছিস, তিনি দেবী হতে পারেন, কিন্তু সৌভাগ্যবতী আখ্যা দিয়েছিস তাকে কি জন্যে? আমি যে তাঁর উপযুক্ত নই। সু. ভ. এই চিঠির উত্তর সত্বর দিবি, আমিও তৎক্ষণাৎ তার উত্তর দেব। আজ তোদের ওখানে নববর্ষ—সুতরাং তার প্রীতি গ্রহণ কর। . পাঁচ বেলেঘাটা ১৭।৪।৪২ আশানুরূপেষু, অরুণ, আজ আবার চিঠি লিখতে ইচ্ছে হল তোকে। আজকের চিঠিতে আমার কথাই অবিশ্যি প্রধান অংশ গ্রহণ করবে। এ জন্য ক্ষুব্ধ হবি না তো? কারণ আজকে আমি তোকে জানাব আমার সমস্যার কথা, আমার বিপ্লবী অন্তর্জগতের কথা। এই চিঠির আরম্ভ এবং শেষ … …র কথাতেই পরিপূর্ণ থাকবে। একবার যখন আদি-অন্ত জানতে কৌতুহল প্রকাশ করেছিস, তখন তোর এ-চিঠি ধৈর্য ধরে পড়তেই হবে এবং আমার জন্যে মতামত আর উপদেশ পাঠাতে হবে। আজকে এইমাত্র … …র কথা ভাবছিলুম, ভাবতে-ভাবতে ভাবলুম তোকেই ডাকা যাক পরামর্শ এবং সমস্যা-সমাধানের জন্যে। কিন্তু তার আগে জিজ্ঞাসা করব, আমার এই প্রেমের ওপর আস্থা ও সহানুভূতি তোর মনের কোণে বাসা বেঁধেছে কি? যদি না-বেঁধে থাকে, তবে এই চিঠি পড়া এখানেই বন্ধ করতে পারিস। যদিও তুই একবার আমাকে কৌতূহল জানিয়ে আমার মনের চোরা কুঠুরীর দ্বার ইতিমধ্যেই ভেঙে দিয়েছিস, তবুও তোকে জিজ্ঞাসা করছি, আমার এই সমস্যার ওপর তোর কিছুমাত্র দরদ জেগেছে কি না। যদি জেগে থাকে তবে শোন: আমার প্রধান সমস্যা, আমি আজও জানি না ও আমায় ভালবাসে কি না। কতদিন আমি ভেবেছি, ওর কাছে গিয়ে মুখোমুখি জিজ্ঞাসা করব, এই কথার উত্তর চাইব; কিন্তু সাহস হয় নি। একদিন এগিয়েও ছিলাম, কিন্তু ওর শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমার কথা বলবার শক্তি হারিয়ে গেছল, অসাড়তা লাভ করেছিল চেতন। ভাল ও আমায় বাসে কি না জানি না, তবে সমীহ করে, এটা ভালরকম জানি। আমার সন্দেহ হয়, হয়তো ও আমায় ভালবাসে এবং আমি যে ওকে ভালবাসি এটা ও জানে। কিন্তু যুক্তি দিয়ে অতুভব করি ওর প্রেমহীনতা। বাস্তবিক আমার প্রেমের বেদনা বড় অভিনব। হয়তো আমি যে সিঁডি দিয়ে উঠছি দেখি সেই সিঁড়ি দিয়েই ও নামছে, অবতরণকালীন ওর ক্ষণিক দৃষ্টি আমার চোখের ওপর পড়ে আমার বুকে স্নিগ্ধমধুর শিহরণ জাগিয়ে যায়। একটু আনন্দ, কিন্তু পরক্ষণেই বেদনায় মুষড়ে পড়ি। একটি ঘরে অনেক লোক, তার মধ্যে আমি যখন কথা বলি, তখন যদি দেখি ও আমার মুখের দিকে চেয়ে আমারই কথা শুনছে, তাহলে আমার কথা বলার চাতুর্য বাড়ে আরও বেশি, আমি আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ি, এমনি ওর প্রতি আমার প্রেম। কিন্তু বড় ব্যথা। বছর খানেক আগে আমার ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ঘটেছিল এবং আমিও সে সুযোগ অপব্যয়িত করি নি। অবিশ্যি ইতিপূর্বেই … …র চেষ্টায় অস্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা আমাদের করতে হয়েছিল। ঘটনাটা তোকে একবার বলেছি, তবু বলছি আর একবার; একটা সভামতো করা হল, তাতে উপস্থির্ড থাকল … …। সেই সভায় আমাদের কথা বলতে হল। প্রথমে সে তো লজ্জায় কথা বলতেই চায় না, শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করল, সিগারেট খাওয়ার অপকারিতা কী? আমি এতক্ষণ উদাস হয়ে (অর্থাৎ ভান করে) ওদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিলুম, এইবার অতিকষ্টে জবাব দিতে থাকলুম। কিন্তু সেদিন আর আলাপ এগোয় নি। এদিকে আমি উপলব্ধি করলুম ওর সঙ্গে কথা বলার অমৃতময়তা। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার কথা বলার তৃষ্ণা অসীম হয়ে দেখা দিল এবং সে তৃষ্ণা আজও দূরীভূত হয় নি। এর মাস খানেক পরে এল আর এক সুযোগ। আমাদের বেলেঘাটায় এল ও, কোনো কারণে। সারাদিন ও রইল কিন্তু কোনো কথা বললাম না ওর সঙ্গে। কিন্তু সন্ধ্যার পর এমন এক সময় এল যখন আমরা দুজনেই একটি ঘরে একা পড়ে গেলাম। দু জনেই শুনছিলাম রেডিও। রেডিওতে গান হচ্ছিল, “প্রিয় আজো নয়, আজো নয়।” কিন্তু গানটাকে আমি লক্ষ্য করি নি এবং লক্ষ্য করার মতো মনের অবস্থাও তখন আমার ছিল না। কারণ কাছে, অতি কাছে ও বসেছিল, বোধহয় অন্যদিকে চেয়ে নিবিষ্ট মনে গানই শুনছিল, আর আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম ওকে, অত্যন্ত সুন্দর পোশাক-সজ্জিতা ওকে আমার বড় ভাল লাগল। ভেবে দেখলাম এক ঘরে থেকেও দুজনে কথা না-বলা লোকচক্ষে নিতান্ত অশোভন। তাই অনেকক্ষণ ধরে মনে বল সঞ্চয় করে ডাকলুম—’.. ..’! কিন্তু গলা দিয়ে অত্যন্ত ক্ষীণ কম্পিত স্বর বেরুল, ও তা শুনতে পেল না। এবার বেশ জোর দিয়েই ডাকলুম, ও তা শুনতে পেল। চমকে উঠে আমার দিকে চাইল। এবং আমিও এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত মুখস্থ করা কথাটা কোনো রকমে বলে ফেললাম, “ইচ্ছে হলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পার।”  ও মাথা নিচু করলে, কিছুই বললে না। মনে হল ও যেন রীতিমত ঘামছে। সেদিন আমার জীবনের শুভদিন ছিল, প্রাণভরে সেদিন ওর কথা পান করেছিলাম। তারও মাস খানেক পরে এসেছিল শেষ শুভদিন—সেদিন আমাদের কলকাতার প্রায় মাইল খানেক পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। মোটরে করে আমরা উপক্রমণিকার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওর ইচ্ছা ছিল, আমার সঙ্গে ও সেদিন উপক্রমণিকার আলাপ করিয়ে দেবে। সৌভাগ্যবশত মোটরটা আমাদের সেখানে নামিয়েই ফিরে যায়। আর আমরাও ফিরতি পথে দুজনের সঙ্গ অনুভব করলুম। সেদিন নেশা লেগে গিয়েছিল ওর সঙ্গে চলতে, কথা বলতে। মনে করে দেখ, কলকাতার রাজপথে একজন সুন্দরী-সুবেশ মেয়ের পাশে-পাশে চলা কি কম সৌভাগ্যের কথা! ওর পাশে চলে, ওর এত কাছে থেকে, যে আনন্দ সেদিন আমি পেয়েছি, তা আমার বাকী জীবনের পাথেয় হয়ে থাকল। ও এখন বিমান আক্রমণের ভয়ে চলে গেছে সুদূর… …তে। আর আমি তাই বিরহ-বিধুর হয়ে তোকে চিঠি লিখছি আর ভাবছি রবীন্দ্রনাথের দুটো লাইন,— “কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া দূরে যবে গেল তারি লাগিল হাওয়া।” আমার দ্বিতীয় সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর। যদি আমার আত্মীয়রা জানতে পারে এ কথা, তবে আমার লাঞ্ছনার অবধি থাকবে না। বিশেষত, আমার বিশ্বাসঘাতকতায়… …নিশ্চয়ই আমার সংস্পর্শ ত্যাগ করবে। অতএব এখন আমার কি করা কর্তব্য চিঠি পাওয়া মাত্র জানাস। ইতি— সুকান্ত ভট্টাচার্য।  পুনশ্চ—মা-কে বলিস এবার আর তাঁকে লিখলাম না বটে, কিন্তু শীগগিরই একখানা বৃহৎ লিপি তাঁর সমুখে উপনীত হবে। আর তিনি নিশ্চয়ই তার বপু দেখে চমকে যাবেন। . ছয় সৎসঙ্গশরণম্ শ্রীশ্রীশ্রী১০৮ অর্ণব-স্বামী১১ গুরুজীমহারাজ সমীপেষু, শতশত সেলামপূর্বক নিবেদন, পরমারাধ্য বাবাজী, আপনার আকস্মিক অধঃপতনে আমি বড়ই মর্মাহত হইলাম। ইতোমধ্যে শ্রবণ করিয়াছিলাম আপনি সন্ন্যাস অবলম্বন করিয়াছেন, তখন মানসপটে এই চিন্তাই সমুপস্থিত হইয়াছিল যে ইহা সাময়িক মত্ততা মাত্র; কিন্তু অধুনা উপলব্ধি করিতেছি আমার ভ্রম হইয়াছিল। এমতাবস্থায় ইহাই অনুমিত হইতেছে যে কাহারও সুমন্ত্রণায় আপনি এই পথবর্তী হইয়াছেন। অতএব আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, বৃদ্ধ পিতা এবং অসুস্থা মাতার প্রতি ঐহিক কর্তব্যসকল পদাঘাতে দূরীভূত করিয়া কোন নীতিশাস্ত্রানুযায়ী পারলৌকিক চরমোন্নতি সাধনের নিমিত্ত আপনি এক মোহমার্গ সাধনা করিতেছেন? এক্ষেত্রে আমার নিবেদন এই যে, অচিরে এই সৎসঙ্গ পরিত্যাগপূর্বক আপনার এই অস্বাভাবিকতা বর্জন করিয়া স্বীয় কর্তব্যকরণে প্রবৃত্ত হউন। আপনার পিতাঠাকুরের নির্দেশমত আপনার কলিকাতায় আসিয়া থাকাই আমার অভিপ্রায়। এ স্থানেও সৎসঙ্গের অনটন হইবে না, উপরন্তু আমার মতো অসতের সহিত দুই-চারিটা কথোপকথনের সুবিধাও মিলিবে, অবশ্য ইহা আমারই সৌভাগ্যজনক হইবে। যদিচ এ আশা নিতান্তই অকল্পেয়, তথাপি চিন্তা করিতে দোষ কি? আমার দুইখানি পত্রে যে সকল আবেগময় গোপন কথা লিখিয়াছিলাম, তাহার উত্তরের আশা বিসর্জন দিয়াছি; কিন্তু এ পত্রের বিস্তৃত উত্তর না পাইলে ইহাই আমার শেষ চিঠি জানিবেন। ইতি— দাসানুদাস, সেবক—শ্রীসুকান্ত। . সাত অরুণ, প্রথমে বিজয়ার সম্ভাষণ জানিয়ে রাখছি। এরপর একে একে প্রতি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। প্রথমে কথা হচ্ছে জীবু ‘কবিতা’ শেষ পর্যন্ত দিল না—চেয়েছিলাম, তা সত্ত্বেও। তবে আগের ক’খানা রেখে দিয়েছি, সামনের সপ্তাহ থেকে সেগুলি ক্রমান্বয়ে পাঠাবার সঙ্কল্প রইল। আর পেনুর ওখানে গেলাম না নিজের নিতান্ত অনিচ্ছায়, বইখানা ওর অজ্ঞাতসারে ওকে দান করলুম, তুই বরঞ্চ ওকে আর একখানা চিঠি ডাক মারফৎ পাঠাস। সুভাষের কাছে যাই-যাই করে যাওয়া হয় নি, তবে যাবার ইচ্ছা আছে। এখানে সপ্তমীর দিন সারাদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টির পর রাত্রে ভয়াবহ ঝড় সমস্ত কলকাতায় অল্পবিস্তর ক্ষতচিহ্ন রেখে গিয়েছিল। কাল শ্যামবাজারে গিয়ে প্রভূত আনন্দ পেলুম ওদের উচ্ছল সাহচর্যে—শিল্পী সুধাংশু চৌধুরীর সঙ্গে কোলাকুলি কালকের দিনের স্মরণীয় ঘটনা। আজ দুপুরে আমাদের উপন্যাসখানা১২ শামবাজারে নিয়ে গিয়েছিলুম—তোর অংশটুকুর ওরা খুব প্রশংসা করল, আমি এখনো হাত দিই নি, এর পরের পরিচ্ছেদ লিখছে ঘেলু, তোর ঘরটায় আজকাল আমাদের অফিস বসছে। আচ্ছা তোর সেই মেয়েটিকে মনে আছে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীলা? সহসা শ্যামবাজারে তাঁর সঙ্গে দেখা, আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের একটি বই ছিল, সেটি দিয়ে লাভ করলুম মোমবাতির আলোর মতো তাঁর স্নিগ্ধ ব্যবহার। তোর শরীর ভাল আছে জেনে নিশ্চিন্ত হলুম, ফিরছিস কবে? ভাইবোনেরা ভাল আছে? বাবা-মাকে আমার বিজয়ার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাস—তাঁরা বোধ করি ভাল আছেন? আমার বই বেরোবে, তবে নতেদা-রা১৩ দাজিলিং থেকে ফিরে না-এলে নয়। —সুকান্ত। রাত ১০-১০ ২০শে অক্টোবব ১৯৪২ আট ৮।১১।৪২ অরুণ, তোর খবর শুনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছি। আমার পুরো একখানা চিঠি পরে পাঠাচ্ছি। যথাসত্বর তোদের সার্বজনীন কুশল প্রার্থনা করি।১৪ —সু নয় ২০, নারিকেলডাঙ্গা মেন রোড ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৪২ বেলেঘাটা সোমবার, বেলা ২টো। অরুণ! দৈবক্রমে এখনও বেঁচে আছি, তাই এতদিনকার নৈঃশব্দ্য ঘুচিয়ে একটা চিঠি পাঠাচ্ছি—অপ্রত্যাশিত বোমার মতোই তোর অভিমানের ‘সুরক্ষিত’ দুর্গ চূর্ণ করতে। বেঁচে থাকাটা সাধারণ দৃষ্টিতে অনৈসর্গিক নয়, তবুও তা দৈবক্রমে কেন, সে রহস্য ভেদ করে কৃতিত্ব দেখাব তার উপায় নেই, যেহেতু সংবাদপত্র বহু পূর্বেই সে কাজটি সেরে রেখেছে। যাক, এ সম্বন্ধে নতুন করে আর বিলাপ করব না, যেহেতু গত বছরে এমনি সময়কার একখানা চিঠিতে আমার ভীরুতা যথেষ্টই ছিল, ইচ্ছা হলে পুরনো চিঠির তাড়া খুঁজে দেখতে পারিস। এখন আর ভীরুতা নয়, দৃঢ়তা। তখন ভয়ের কুশলী বর্ণনা দিয়েচি, কারণ সে সময়ে বিপদের আশঙ্কা ছিল, কিন্তু বিপদ ছিল না। তাই বর্ণনার বিলাস আর ভাষার আড়ম্বর প্রধান অংশ গ্রহণ করেছিল, এখন তো বর্ষমান বিপদ। কাল রাত্রিতেও আক্রমণ হয়ে গেল, ব্যাপারটা ক্রমশ দৈনন্দিন জীবনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে, আর এটা একরকম ভরসারই কথা। গুজবের আধিপত্যও আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। তোরা এখানকার সঠিক সংবাদ পেয়েছিস কিনা জানি না। তাই আক্রমণের একটা ছোটখাটো আভাস দিচ্ছি। প্রথম দিন খিদিরপুরে, দ্বিতীয় দিনও খিদিরপুরে, তৃতীয় দিন হাতীবাগান ইত্যাদি বহু অঞ্চলে—(এই দিনকার আক্রমণ সবচেয়ে ক্ষতি করে), চতুর্থ দিন ড্যালহৌসি অঞ্চলে—(এইদিন তিন ঘণ্টা আক্রমণ চলে আর নাগরিকদের সবচেয়ে ভীতি উৎপাদন করে, পরদিন কলকাতা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়) আর পঞ্চম দিনে অর্থাৎ গতকালও আক্রমণ হয়। কালকের আক্রান্ত স্থান আমার এখনও অজ্ঞাত। ১ম, ৩য় আর ৫ম দিন বাড়িতে কেটেছে, কৌতূহলী আনন্দের মধ্যে দিয়ে। ২য় দিন বালীগঞ্জে মামার বাড়িতে মামার১৫ সঙ্গে আডডা দিয়ে কেটেছে, ৪র্থ দিন সদ্য স্থানান্তরিত দাদা-বৌদির১৬ সীতারাম ঘোষ ষ্ট্রীটের বাডিতে কেটেছে সবচেয়ে ভয়ানক ভাবে। সেদিনকার ছোট্ট বর্ণনা দিই, কেমন? সেদিন সকাল থেকেই মেজাজটা বেশ অতিমাত্রায় খুশি ছিল, একটা সাধু সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সেই চিঠি গোপনকারিণী বৌদির কাছে, কারণ কয়েক দিন আগে দাদার নতুন বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ অগ্রাহ করে নিজের পৌরুষের ওপর ধিক্কার এসেছিল, তাই ঠিক করলাম, নাঃ, আজ বৌদির সঙ্গে আলাপ করে ফিরবই, যে বৌদির সঙ্গে আগে এত প্রীতি ছিল, যার সঙ্গে কতদিন লুকোচুরি খেলেছি, সাঁতার কেটেছি, রাতদিন এবং বহু রাতদিন বকবক করেছি, সেই বৌদির সঙ্গে কি আর সামান্য দরজা খোলার ব্যাপার নিয়ে রাগ করে থেকে লাভ আছে? অবিশ্যি এতখানি উদারতার মূলে ছিল সেদিনকার কর্মহীনতা, যেহেতু Examination হয়ে গেছে, রাজনৈতিক কাজও সেদিন খুব অল্পই ছিল, সুতরাং মহানুভব (!) সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর বৌদির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। প্রথমে, দাদা না-থাকায় বৌদিই প্রথম কথা কয়ে লজ্জা ভেঙে দিয়ে অনেক সুবিধা করে দিলেন, তারপর ক্রমশ অল্পে-অল্পে বহু কথা কয়ে, অন্তরঙ্গ হয়ে, বৌদির স্বহস্তে প্রস্তুত অন্নব্যঞ্জনে পরিতোষ লাভ করে, তারপর কিছু রাজনৈতিক কাজ ছিল, সেগুলো সেরে সন্ধ্যায় বৌদির ওখানে পুনর্গমন করলুম এবং সদ্য আলাপের খাতিরে বৌদির পরিবেশিত চা পান করে আবার বকবক করতে লাগলুম। ৮॥টার সময় বাড়ি যাব ভেবে উঠলাম এবং সেদিন সেখানে থাকব না শুনে বৌদি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু দাদা এসে পড়ায় সেদিন আর বাড়ি ফেরা হল না। কিছুক্ষণ গল্প করার পর, ৯-১০ এমনি সময় সেদিনকার সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটল, বৌদি সহসা বলে উঠলেন, বোধহয় সাইরেন বাজছে; রেডিও চলছিল, বন্ধ করতেই সাইরেনের মর্মভেদী আর্তনাদ কানে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দাদা তাড়াহুড়ো করে সবাইকে নীচে নিয়ে গেলেন এবং উৎকণ্ঠায় ছুটোছুটি, হৈ-চৈ করে বাড়ি মাৎ করে দিলেন। এমন সময় রঙ্গমঞ্চে জাপানী বিমানের প্রবেশ। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু স্তব্ধ। আর শুরু হয়ে গেল দাদার ‘হায়’, ‘হায়’, বৌদির থেকে থেকে সভয় আর্তনাদ, আর আমার আবিরাম কাঁপুনি। ক্রমাগত মন্থর মুহূর্তগুলো বিহ্বল মুহ্যমানতায়, নৈরাশ্যে বিঁধে-বিঁধে যেতে থাকল, আর অবিশ্রান্ত এরোপ্লেনের ভয়াবহ গুঞ্জন, মেসিনগানের গুলি আর সামনে পিছনে বোমা ফাটার শব্দ। সমস্ত কলকাতা একযোগে কান পেতে ছিল সভয় প্রতীক্ষায়, সকলেই নিজের নিজের প্রাণ সম্পর্কে ভীষণ রকম সন্দিগ্ধ। দ্রুতবেগে বোমারু এগিয়ে আসে, অত্যন্ত কাছে বোমা পড়ে আর দেহে মনে চমকে উঠি, এমনি করে প্রাণপণে প্রাণকে সামলে তিনঘণ্টা কাটাই। তখন মনে হচ্ছিল, এই বিপদময়তার যেন আর শেষ দেখা যাবে না। অথচ বিমান আক্রমণ তেমন কিছু হয় নি, যার জন্য এতটা ভয় পাওয়া উচিত। কালকের আক্রমণে অবশ্য অত্যন্ত সুস্থ ছিলাম। বোমার ব্যাপার বর্ণনা করতে দু’পাতা লাগল। কাগজের এত দাম সত্ত্বেও আরও দু’পাতা লিখছি। তোর শেষ চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের১৭ সঙ্গে ‘আলাপ করা’ ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছিলি, কিন্তু তার আগেই বোধহয় একদিন ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউটে P. C. Joshi-র এক বক্তৃতা-সভায় সুভাষ নিজেই এসে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল এবং আমার ‘কোনো বন্ধুর প্রতি’ কবিতাটির প্রশংসা করে দুঃখের সঙ্গে জানায় কবিতাটি তার পকেট থেকে হারিয়ে গেছে নচেৎ তা ছাপা হত। তারপর অনেকদিন পরে স্বভাষের কথামতো একটা সংকলন গ্রন্থের জন্য রচিত কবিতা নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেদিন প্রায় দু’ঘণ্টা সেখানে থেকে স্বভাষের অন্তরঙ্গ হয়েছিলাম, স্বর্ণকমলের১৮ সঙ্গেও বেশ গল্প জুড়ে ছিলাম। সেদিন সুভাষ আমার এত প্রশংসা করেছিল যা সহসা চাটুকারিতা বলে ভ্রম হতে পারত, সুভাষও আমাকে বই ছাপাতে বললে। তোর কবিতাটির ব্যবস্থা তোর চিঠির ইচ্ছামতোই হয়েছে। সংকলন গ্রন্থটি ‘এক সূত্রে’ নাম নিয়ে বুদ্ধদেব, বিষ্ণু, প্রেমেন্দ্র, অজিত দত্ত, সমর সেন, অচিন্ত্য, অন্নদাশঙ্কর, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ বাংলার ৫৫ জন কবির কবিতা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এবং তার মধ্যে আমার একটি কবিতাও সসংকোচে স্থান পেয়েছে। ভাল কথা, জীবুর একখানা ‘কবিতা’ তোর কাছে ছিল, কিন্তু তোর বাবার কাছ থেকে সেখানা এখনও পাই নি, তাই অপর ক’খানাও দেওয়া হয় নি;—অত্যন্ত লজ্জার কথা! এবার ‘আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীলা মেয়েটির কথা বলছি। তোকে চিঠিতে জানান ঘটনার পর একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে দেখেই বিস্ময়ে উচ্ছ্বাসে মর্মরিত হয়ে উঠলেন। আমিও আবেগের বন্যায় একটা নমস্কার ঠুকে দিলাম, তিনিও প্রতিনমস্কার করে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এসে দরজা খুলে দিলেন। আমি রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-স্মৃতি’ সঙ্গে এনেছিলাম তাকে দেবার জন্যে, সেখানা দিয়ে গল্প শুরু করে দিলাম এবং অনেকক্ষণ গল্প করার পর বিদায় নিয়েছিলাম। সেদিন তাঁর প্রতি কথায় বুদ্ধিমত্তা, সৌহার্দ্য এবং সারল্যের গভীর স্পর্শ পেয়েছিলাম এবং বিদায় নেবার পর পথ চলতে-চলতে বারবার মনে হয়েছিল, সেদিন যে কথোপকথন আমাদের মধ্যে হয়েছিল তার মতো মূল্যবান কথোপকথনের সুযোগ আমার জীবনে আর আসে নি। মেয়েটি স্নিগ্ধতার একটি অপরূপ বিকাশ, তাঁর মধ্যে শহুরে চটুলতা, কুটিলতা, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্র আবিলতার কোনো আভাস পেলাম না। অথচ তাঁর মধ্যে সুরুচি ও সংস্কৃতির অভাব নেই, সর্বোপরি পরিপূর্ণতার এক গভীর নীরবতা গ্রাম্য আবেষ্টনীর মতো সর্বদা বিরাজমান। তবুও সেদিন সুস্থ হয়ে কথা বলতে পারি নি। যেহেতু আমি পুরুষ, তিনি নারী। এইবার আমার প্রেম-কাহিনীর শেষ অধ্যায় বিবৃত করছি। কিছুদিন আগে, কতদিন আগে তা মনে নেই—বোধহয় দু’মাস হবে, একদিন… …কে… …দের বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়েছিল। পথে নেমে বহুক্ষণ চলতে থাকলুম গুনগুন করতে করতে, যতদূর মনে পড়ে ‘চাদ উঠেছিল গগনে’। প্রায় অর্ধেক রাস্তা সকৌতুকে আমাদের অবস্থা অনুভব করার পর ভাবলুম, আর নয়, ব্যাপারটাকে এইখানেই শেষ করে দেওয়া যাক। একটা দম নিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম: একটা কথা বলব? প্রথমবার শুনতে পেল না। দ্বিতীয় বার বলতেই, মৃদু হেসে, ঔদ্ধত্যভরে, মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। বললাম: কিছুদিন আগে আমার একখানা চিঠি পেয়েছিলে? ভ্রূকুটি হেনে ও বললে: কলকাতায়? আমি বললুম: না, বেনারসে। ও মাথা নেড়ে প্রাপ্তি সংবাদ জ্ঞাপন করল। আবার একটু দম নিয়ে বললাম: অত্যন্ত অসতর্ক অবস্থায়, আবেগের মাথায় পাগলামি করে ফেলেছিলাম। সেজন্য আমি এখন অনুতপ্ত এবং এইজন্যে আমি ক্ষমা চাইছি। ও তখন অত্যন্ত ধীরভাবে বিজ্ঞের মতো বললে—না-না, এজন্যে ক্ষমা চাইবার কিছু নেই, ঐ রকম মাঝে-মাঝে হয়ে থাকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ চলবার পর জিজ্ঞাসা করলুম: আচ্ছা আমার চিঠিখানার জবাব দেওয়া কি খুব অসম্ভব ছিল? ও অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে বললে: উত্তর তো আমি দিয়েছিলাম। আমি তখন অত্যস্ত ধীরে-ধীরে বললাম, চিঠিখানা তাহলে আমার বৌদির হস্তগত হয়েছে। ও বিষণ্ণ হেসে বললে: তাহলে তো বেশ মজাই হয়েছে। কিছুক্ষণ আবার নিঃশব্দে কাটল। তারপর ও হঠাৎ বললে: আচ্ছা এ রকম দুর্বলতা আসে কেন? অত্যন্ত বিরক্তিকর প্রশ্ন। বললাম: ওটা কাব্যরোগের লক্ষণ। মানুষের যখন কোনো কাজ থাকে না, তখন কোনো একটা চিন্তাকে আশ্রয় করে বাঁচতে সে উৎসুক হয়, তাই এই রকম দুর্বলতা দেখা দেয়। তোমার চিঠি না পেয়ে আমার উপকারই হয়েছিল, আমি অন্য কাজ পেয়েছিলাম। ধর, তোমার চিঠিতে যদি সন্তোষজনক কিছু থাকত, তাহলে হয়তো আমার কাব্যের ধারা তোমাকে আশ্রয় করত। ও তাড়াতাড়ি শুধরে নিল, চিঠিটা কিন্তু সন্তোষজনক ছিল না। আমি বললুম: আমার কাব্যের ধারাও সঠিক পথে চলেছে। এরপর… …বাড়ি এসে পড়েছিল। এখন তোর খবর কি? শরীর কেমন? গ্রাম্য জীবন কি ধাতস্থ হয়েছে? তোর বাবা যে কবে এখান থেকে গেলেন, আমি জানতেও পারি নি। তোর ভাই-বোন-বাবা-মা’র কুশল সংবাদ সমেত একখানা চিঠি, যদি খুব তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় তো পাঠাস; নতুবা দেরি করে পাঠাস নি। কারণ বোমারু বিমান সর্বদাই পৃথিবীর নশ্বরতা ঘোষণা করছে। তোর উপন্যাসখানার বাকী কত? —সুকান্ত ভট্টাচার্য . দশ 20, Narkeldanga Main Road Calcutta 15. 2. 43 প্রতিভাজনেষু, আমি কিছুদিন আগে একটা বিপুলবপু চিঠিতে অজস্র বাজে কথা লিখে পাঠিয়েছিলাম—নেহাৎ চিঠি লেখার জন্যেই। সেখানা হস্তগত হয়েছে শুনে নির্ভয় হলাম। ও চিঠির উত্তর না-পাওয়া আমায় বিচলিত করে নি, যেহেতু ঐ চিঠিটার উত্তর দেবার মতো মূল্য ছিল না। আমার খবর আমি এক কথায় জানাচ্ছি—পরিবর্তনহীনভাবে রাজনীতি নিয়ে কালক্ষয় করছি। তোরা একটা ‘পত্রিকা’১৯ বার করছিস। ভাল কথা। কিন্তু প্রশ্ন এই, হাতের-লেখা পত্রিকা বার করবার মতো মনের অপরিপক্বতা তোর আজো আছে? কথাটা নীরস হলেও একথা বলবই যে, এই ধরনের ‘খই ভাজায়’ এই দুর্দিনে কাগজ ও সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই হবে না। নিজের সম্বন্ধে তোর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে, নিজেকে নানাভাবে সৎশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা এবং সেইজন্যে পত্রপাঠ কলকাতায় এসে বাবার সাহায্য নেওয়া। কথাটা গুরুমশাইয়ের উপদেশ অথবা বাবার নিবেদনের মতো তিক্ত ও অনাবশ্যক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু কথাটা সত্যি। কথাটার তাৎপর্য আমি মর্মে-মর্মে অনুভব করছি এবং যথাসাধ্য সে সম্বন্ধে চেষ্টা ও আয়োজন করছি। অতএব আমার কথাটা ভাল করে ভেবে দেখবার জন্যে অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করি, মা এবং ভাই-বোন সহ তুই ভাল আছিস; তোর প্রীতি প্রাপ্তরা ভাল আছে, চিঠির উত্তর চাই না। —সুকান্ত ভট্টাচার্য। এগারো 20, Narkeldanga Main Road 3. 3. 43 প্রিয়বরেষু, অরুণ! তোর কাছ থেকে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ চিঠি ইতিপূর্বে আর কখনও পাই নি। তার কারণ বিবৃত করছি। প্রথমত চিঠিটা নৈহাটি, দৌলৎপুর, ডোঙ্গাঘাটা, পাঁজিয়া—এই চার জায়গায় fountain pen, pcncil এবং কলমে লেখা বলে এত বিচিত্র! দ্বিতীয়ত সমস্ত চিঠিটায় একজন কেজো লোকের ব্যস্ততার সাড় পাওয়া গেল। তৃতীয় কারণ, চিঠিটার অপ্রত্যাশিততা। চিঠির উত্তর দিতে তোকে নিষেধ করেছিলাম, তবুও তোর চিঠি পেয়ে আশান্বিত হযে পড়ে দেখলাম চিঠিটা নেহাৎ নৈর্ব্যক্তিক অর্থাৎ Official। যদিও সৎশিক্ষা সম্বন্ধে একটা কৈফিয়ৎ আছে, তবুও সেটা গৌণ—মুখ্য হচ্ছে ‘ত্রিদিব’। এজন্যে আমি দুঃখিত হই নি বরং কৌতুক অনুভব করেছি। অবিশ্যি খামখানাই এজন্যে দায়ী। ‘ত্রিদিবে’র ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমার আশা গভীর হল যশোহরের সংকীর্ণতা থেকে সারা বাংলাদেশেই এর পরিব্যাপ্তি ও সম্প্রসারণ দেখে। পত্রিকাটি নতুন লেখক ও শিল্পীদের প্রাণরসে পরিপুষ্ট ও পরিপক্ব হয়ে একদিন সারা বাংলার ক্ষুধা মেটানোর জন্যে পরিবেশিত হবে, সূচনা দেখে এ-অনুমান করা খুব সম্ভবত আমার অদূরদর্শিতায় পর্যবসিত হবে না। তুই যে আমার আন্তরিকতায় দিন-দিন সন্দিহান হচ্ছিস, ক্রমশ তার পরিচয় পাচ্ছি। কারণ ও প্রমাণ মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলে দেখাব। তুই কবে আসছিস—এইটা জানবার জন্যে উৎসুক আছি। আর এইটাই আমার কাছে সবচেয়ে জরুরী। তুই বোধহয় কোনো কার্যব্যপদেশে এখানে আসছিস, তার কারণ তুই অধুনা কাজের লোক হয়ে পড়েছিস, কিন্তু আমি চাই বেশ কিছু সময় হাতে নিয়ে তুই আসবি। তোর সদ্যলব্ধ দিদি আর কাকীমার সম্বন্ধে রীতিমত কৌতূহল দেখা দিয়েছে। আর, কিছু পরিচয় পেলাম তোর সূক্ষ্ম বর্ণনায়, তারা যে সাহিত্য-রসিক তার নমুনা পাওয়া গেল পাঠস্পৃহা থেকে। তোদের (থুড়ি) আমাদের ‘ত্রিদিব’ সম্বন্ধে একটা বড় সত্য অনুমান করছি যে, আমরা এই পাপ-দুঃখ-কষ্ট আকীর্ণ ধরণীর নগণ্য লোক কর্মদোষে ‘ত্রিদিবে’র দর্শন পাচ্ছি না। আশা করি তোর সঙ্গলাভের পুণ্যে হয়তো পাপস্থলন হবে এবং তখন এক সংখ্যার দর্শনলাভও হবে। তুই লিখেছিস, ‘অভাবে স্বভাব নষ্ট’ (স্বভাব নষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজের সম্বন্ধে একটা সত্যি কথা বলেছিস দেখে তৃপ্ত হলুম), সত্যিই তোর স্বভাবের এতদূর অধঃপতন হয়েছে যে দুটো বাজে লেখা তুলে দিয়ে স্বচ্ছন্দে নিজের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি করে নিশ্চিন্ত হলি? ভাল! আর একটা গুরুতর কথা। তুই নিজে না ‘সম্পাদক’ হয়ে কোন এক সুনীল বসুকে ‘সম্পাদক’ করেছিস কেন? তোর চেয়ে যোগ্য লোক ডোঙ্গাঘাটা তথা সারা যশোরে আছে নাকি? এটা একটা আশাভঙ্গের কথা। কবিতা পাঠাচ্ছি। ‘আহ্নিক’ বলে যে কবিতাটা লিখেছিলাম সেটা দিতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু সেটা এখন পাচ্ছি না, পেলে পরে পাঠাব। এখন অন্য একটা লেখা (দার্শনিক বা মনস্তাত্ত্বিক২০) পাঠালুম। বইয়ের লিস্ট২১ পাঠালুম—তবে সংক্ষিপ্ত। বিস্তৃত পরে পাঠাব। চিঠির উত্তরের পরিবর্তে তোকে পেতে চাই। তোদের সকলের কুশল কামনা করি। চিঠিখানা চেষ্টা করে বড় করলুম না, আর তোর যে-যে অনুরোধ, তার সব পালন করা হয়েছে। ইতি— —সুকান্ত  আরো একটু—চিঠিখানা ৩রা মার্চ লেখা হলেও, পোস্ট অফিসে পয়সা নিয়ে গিয়েও নানা কারণে বিতাড়িত হয়েছিলাম দিন কয়েক। তা ছাড়া শুনলাম, তুই নাকি আবার সফরে বেরিয়েছিস। তাই মনে হচ্ছে, পত্রপাঠ চিঠিটা পাঠাতে না-পারলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। আর কবিতা যেটা পাঠালুম সেটা প্রধানত অতিরিক্ত সহজবোধ্য বলেই আমার মতে (বোধহয় তোর মতেও) অত্যন্ত খারাপ, সেজন্যে দুঃখ করিস নি। সবুরে মেওয়া ফলবে। তুই আজকাল ছবিটবি আঁকছিস আশা করি, কবিতা বোধহয় খুব ভাল লিখছিস। সু কা ন্ত। . বারো অরুণ! নানা রকম সঙ্কটের জন্য তোর চিঠিটার জবাব দিই নি, পরে একটা বড় চিঠি পাঠাব। তুই এখানে আসবি বলেছিলি, কিন্তু তার কোনো উদ্যোগ দেখছি না। অবিলম্বে তোর এখানে এসে স্থায়ীভাবে পড়াশুনা আরম্ভ করা দরকার। তুই তোর পরমহিতাকাঙ্ক্ষী বাবার অবর্ণনীয় এবং অবিরাম পরিশ্রমের কথা ভুলে, তাঁর চিঠির উত্তর না দিয়ে, স্বচ্ছন্দে ‘ত্রিদিব’ নিয়ে কাল কাটাচ্ছিস? তার প্রতি এতবড় অকৃতজ্ঞতা অসহনীয়।২২ সুকান্ত তেরো চিঠিটার উত্তর দিতে বেশ একটু দেরি হল, বোধহয় কুড়ি-বাইশ দিন, কিন্তু সেজন্যে আমি এতটুকু দুঃখিত নই—যেহেতু আর্থিক প্রতিকূলতা (শুধু অর্থনৈতিক অরাজকতার জন্যে নয়, পারিবারিক আভ্যন্তরীণ গোলযোগের দরুন) ভীষণভাবে আক্রমণ করেছে আমাকে, এমন কি আমার ভবিষ্যৎকে পর্যন্ত। অবিশ্যি আর কিছু পরিবর্তন পরিবারের আর কোথাও হয় নি, কেবল আমার পৃথিবীতেই দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। বেশ স্কুলে যাচ্ছিলাম, রাজনীতির চর্চা করছিলাম, এমন সময় এল কালবৈশাখীর মতো বিনা নোটিশে এক ঝড়, যা আমার চোখে ধুলো ছিটিয়ে দিল, আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম, আর সে বিভ্রান্তির ঘোর এখনো কাটে নি। যাক, চিঠির প্রথমেই করুণ রসের অবতারণা করা অরসিকের পরিচয়। আমার অবস্থা অনেকটা কবি বলে যে গল্পটা লিখেছিলাম সেই গল্পটার নায়কের মতো হয়েছে, আশা করি এ দুদিন দূরীভূত হবে। সম্পাদনার জন্যে তোর চেয়ে যোগ্য লোক আছে কিনা, তোদের বর্তমান যশোরে, (অর্থাৎ যেখানে অরুণ মিত্র, সরোজ দত্ত২৩ উপস্থিত নেই) এ প্রশ্ন তুলে তোকে আঘাত দিয়েছি জেনে আমিও প্রত্যাঘাত পেলাম। তোর ভুল বোঝবার এই অপচেষ্টা দেখে আমার জ্ঞানচক্ষু উন্মেষিত হল। আমার উচিত ছিল মনোজ বসু কোন ছার, মাইকেলকে স্মরণ করা। তারা ‘ত্রিদিব’ সম্পাদনা করতে পারুন, আর নাই পারুন, জন্ম তো নিয়েছেন যশোহরে। ভাল কথা, এর আগে যে চিঠিটা তোর বাবার চিঠির সঙ্গে গেছে সেটা অনেকটা ফজলুল হকের মতোই বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়ে লেখা, সুতরাং তার রসহীনতায় ক্ষুব্ধ হ’স নি। তবে চিঠির কথাগুলো অত্যন্ত সার কথা, একবার ভাল করে ভেবে দেখিস। আর গল্প বা প্রবন্ধ সম্বন্ধে কথা হচ্ছে যে, ওগুলো অন্তত এখন অর্থাৎ সাময়িকভাবে, পাঠান সম্ভবপর নয়, কারণ আমার পক্ষে অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। তবে কবিতা পাঠাতে পারি, যা চাস। মামাকে২৪ গল্প লিখতে বলেছি, সে লিখে চলেছে; শেষ হলেই পাঠিয়ে দেবে আর মহিলা লেখিকা সংগ্রহ করেছি একজন, তিনি অসুস্থ, সুস্থ হলেই লেখা দেবেন। মহিলা লেখিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে এক মজার কাণ্ড করেছিলাম। ব্যাপারটা হচ্ছে, ভূপেনের এক বৌদি আছেন, অত্যন্ত ভালমানুষ। তাকে একদিন এমন চেপে ধরেছিলাম সাঁড়াশির মতো লেখা আদায়ের জন্য, যে তিনি কেঁদে ফেলবার উপক্রম করেছিলেন। কারণ প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে নাছোড়বান্দার মতো ব্যাকুল হয়ে লেখা চাইছিলাম, পরিশেষে পায়ে ধরার যখন আয়োজন করলাম তখন দেখি তার অবস্থা শোচনীয়, কাজেই আখমাড়াই কলের মতো অলেখিকার কাছ থেকে লেখা আদায়ের দুশ্চেষ্টা ছেড়ে দিলাম। তোর ত্রিদিবের দিন দিন উন্নতি হচ্ছে জেনে সুখী হলাম, কিন্তু তার তুলনায় তোর যদি ঐ সঙ্গে ঐ রকম উন্নতি হত তবে আহলাদে আটখানা হতাম। তুই কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, এমন কি লেখাপড়া পর্যন্ত ছেড়ে দিলি? তোর চিঠি থেকে অকুমান করা যায় তুই ত্রিদিবের সঙ্গে খুব বেশী জড়িত নোস্। অথচ এত ব্যস্ত কেন? কিছুই বোঝবার উপায় নেই; এ সবের রহস্য এক তুই জনিস আর জানে তোর ত্রিদিব। আমরা মর্ত্যের লোক ত্রিদিবের ব্যাপার কী বুঝব? আর একটা ব্যাপারে বিস্মিত ও বিচলিত হলাম, তুই নাকি আমাকে বিভাগীয় সম্পাদক করেছিস? এ ব্যাপারে কিন্তু গোপাল ভাড়ের বাঁশের মাথায় হাড়ি চড়িয়ে ভাত রান্নার গল্প অত্যন্ত অন্যায়ভাবে মনে পড়ে গেল। এর মধ্যে কোনো নতুনতর অভিসন্ধি আছে নাকি? না, এ বন্ধুত্ব বজায় রাখবার অভিনব কৌশল? অমূল্যদ্বার শোকে আমিও দুঃখিত হলাম এবং তা মৌখিক নয়। অমূল্যদার সঙ্গে দেখা হলে বলিস তিনি যদি কখনো কলকাতায় আসেন আমার সঙ্গে যেন দেখা করেন, তাঁকে আমার ঠিকানা দিস। তুই লিখেছিল, আমার লেখা না পেলে তোর কাগজ বন্ধ হয়ে যাবে, যখন লিখেছিস, তখন হয়তো ঐ অবস্থা ছিল, এখন সে দুর্ভিক্ষ কেটে গেছে। এই ভেবে ভরসা করে ব্যয়ের নিপীড়ন থেকে নিজেকে রক্ষা করলুম। এই মাসের ‘পরিচয়ে’ আমার কবিতা আর গত সংখ্যা (অর্থাৎ ত্রিংশ সংখ্যা) ‘অরণি’তে আমার গল্প বেরিয়েছে। ‘পরিচয়’ বোধহয় তোদের ওখানে কেউ নেয় না, কিন্তু ‘অরণি’ নেয় জানি, সুতরাং ঐ সংখ্যা ‘অরণি’ জোগাড় করে তুই পড়িস এবং মাকে পড়াস আর এই চিঠির উত্তরে গল্পটা সম্বন্ধে মূল্যবান মতামত জানাস। পরিশেষে এই বলে বিদায় নিচ্ছি যে, একদিকে বাইরের খ্যাতি, সম্মান প্রতিপত্তি লাভ করছি, অন্যদিকে… …আমার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ভবিষ্যৎকে চূর্ণ করে দিচ্ছে। আমার শিক্ষা জীবনের ওপর এতবড় আঘাত আর আসে নি, তাই বোধহয় এত নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে এই স্বাভাবিকতাকে, তাই সমস্ত শিরা—শিরার রক্তে রক্তে ধ্বনিত হচ্ছে প্রতিবাদ! চিঠির উত্তর দিস।২৫ ইতি— সুকান্ত ভট্টাচার্য [২৭শে চৈত্র ১৩৪৮] চৌদ্দ ১২ অনন্তপুর, পোঃ হিনু, রাঁচি অরুণ, অনেক ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে অনেক অবিশ্বাস আর অসম্ভবকে অগ্রাহ্য করে শেষে সত্যিই রাঁচি এসে পৌঁছেছি। আসার পথে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখি নি, কেবল পুর্ণিমার অস্পষ্ট আলোয় স্তব্ধ গভীর বরাকর নদীকে প্রত্যক্ষ করেছি। তখন ছিল গভীর রাত—(বোধহয় রাত শেষ হয়েই আসছে) আর সেই রাত্রির গভীরতা প্রতিফলিত হচ্ছিল সেই মৌন মূক বরাকরের জলে। কেমন যেন ভাষা পেয়েছিল সব কিছুই। সেই জল আর অদূরবর্তী একটা বিরাট গম্ভীর পাহাড় আমার চোখে একটা ক্ষণিক স্বপ্ন রচনা করেছিল। বরাকর নদীর এক পাশে বাঙলা, অপর পাশে বিহার আর তার মধ্যে স্বয়ং-স্ফুর্ত বরাকর; কী অদ্ভুত, কী গম্ভীর? আর কোনো নদী (বোধহয়, গঙ্গাও না) আমার চোখে এত মোহ বিস্তার করতে পারে নি। আর ভাল লেগেছিল গোমো স্টেশন। সেখানে ট্রেন বদল করার জন্যে শেষ রাতটা কাটাতে হয়েছিল। পূর্ণিমার পরিপূর্ণতা সেখানে উপলব্ধি করেছি। স্তব্ধ স্টেশনে সেই রাত আমার কাছে তার এক অস্ফুট সৌন্দর্য নিয়ে বেঁচে রইল চিরকাল। তারপর সকাল হল। অপরিচিত সকাল। ছোট ছোট পাহাড়, ছোট ছোট বিশুষ্কপ্রায় নদী আর পাথরের কুচি-ছিটানো লালপথ, আশেপাশে নাম-না-জানা গাছপালা ইত্যাদি দেখতে দেখতে ট্রেনের পথ ফুরিয়ে গেল। তারপর রাঁচি রোড ধরে বাসে করে এগোতে লাগলুম। বাসের কী শিংভাঙা গোঁ! সে বিপুল বেগে ধাবমান হল পাহাড়ী পথ ধরে। হাজার-হাজার ফুট উঁচু দিয়ে চলতে-চলতে আবেগে উছলে উঠেছি আর ভেবেছি এ-দৃশ্য কেবল আমিই দেখলুম; এই বেগ আর আবেগ কেবল আমাকেই প্রমত্ত করল! হয়তো অনেকেই দেখেছে এই দৃশ্য কিন্তু তা এমন করে অভিভূত করেছে কাকে? রাঁচি এসে পৌঁছলাম। আমরা যেখানে থাকি, সেটা রাঁচি নয়, রাঁচি থেকে একটু দূরে—এই জায়গার নাম ডুরাণ্ডা। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে ক্ষীণস্রোতা সুবর্ণরেখা নদী। আর তারই কুলে দেখা যায় একটা গোরস্থান। যেটাকে দেখতে দেখতে আমি মাঝে মাঝে আত্মহারা হয়ে পড়ি। সেই গোরস্থানে একটা বটগাছ আছে, যেটা শুধু আমার নয় এখানকার সকলের প্রিয়। সেই বটগাছের ওপরে এবং তলায় আমার কয়েকটি বিশিষ্ট দুপুর কেটেছে। গত শুক্রবার সকাল থেকে সোমবার দুপুর পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণ আমাদের অনির্বচনীয় আনন্দে কেটেছে—কারণ, এই সময়টা আমরা দলে ভারি ছিলাম। রবিবার দুপুরে আমরা রাঁচি থেকে ১৮ মাইল দূরে ‘জোন্‌হা প্রপাত দেখতে বেরুলাম। ট্রেনে চাপার কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমুল বৃষ্টি নামল এবং ট্রেনে বৃষ্টির আনন্দ আমার এই প্রথম। দুধারে পাহাড়-বন ঝাপসা করে, অনেক জলধারার সৃষ্টি করে বৃষ্টি আমাদের রোমাঞ্চিত করল। কিন্তু আরো আনন্দ বাকী ছিল—প্রতীক্ষা করে ছিল আমাদের জন্যে জোন্‌হা পাহাড়ের অভ্যন্তরে। বৃষ্টিতে ভিজে অনেক পথ হাঁটার পর সেই পাহাড়ের শিখরদেশে এক বৌদ্ধ-মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। মন্দির-রক্ষক এসে আমাদের দরজা খুলে দিল। মন্দিরের সৌম্য গাম্ভীর্যের মধ্যে আমরা প্রবেশ করলাম নিঃশব্দে, ধীর পদক্ষেপে। মন্দির-সংলগ্ন কয়েকটি লোহার দুয়ার এবং গবাক্ষবিশিষ্ট কক্ষ ছিল। সেগুলি আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম, ফুল তুললাম, মন্দিরে ঘণ্টাধ্বনি করলাম। সেই ধ্বনি পাহাড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল, বাইরের পৃথিবীতে পৌঁছলো না। সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। সেই অরণ্যলঙ্কুল পাহাড়ে বাঘের ভয় অত্যন্ত বেশী। আমরা তাই মন্দিরে আশ্রয় নিলাম। তারপর গেলাম অদূরবর্তী প্রপাত দেখতে।—গিয়ে যা দেখলাম তা আমার স্নায়ুকে, চৈতন্যকে অভিভূত করল। এতদিনকার অভ্যস্ত গতানুগতিক বৃষ্টির ওপর এ একটা সত্যিকারের প্রলয় হিসেবে দেখা দিল। মুগ্ধ সুকান্ত তাই একটা কবিতা না-লিখে পারল না। সে-কবিতা আমার কাছে আছে, ফিরে গিয়ে দেখাব। জোন্‌হা যে দেখেছে, তার ছোটনাগপুর আসা সার্থক। যদিও হুড়ু খুব বিখ্যাত প্রপাত, কিন্তু হুড়ুতে ‘প্রপাত’ দর্শনের এবং উপভোগের এত সুবিধা নেই—একথা জোর করেই বলব। এবং জোন্‌হা যে দেখেছে সে আমার কথায় অবিশ্বাস করবে না। জোন্‌হা সব সময়েই এত সুন্দর, এত উপভোগ্য, তা নয়; এমন কি আমরা যদি তার আগের দিনও পৌঁছতাম তা হলেও এ-দৃশ্য থেকে বঞ্চিত থাকতাম নিশ্চিত। প্রপাত দেখার পর সন্ধ্যার সময় আমরা বুদ্ধদেবের বন্দনা করলাম। তারপর গল্পগুজব করে, সবশেষে নৈশ-ভোজন শেষ করে আমরা সেই স্তব্ধ নিবিড় গহন অরণ্যময় পাহাড়ে জোন্‌হার দূর-নিঃসৃত কলধ্বনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। জোন্‌হা সারারাত বিপুল বেগে তার গৈরিক জলধারা নিষ্ঠুরভাবে আছড়ে-আছড়ে ফেলতে লাগল কঠিন পাথরের ওপর, আঘাত-জর্জর জলধারার বুকে জেগে রইল রক্তের লাল আর রুদ্ধ ঘরে শোনা যেতে লাগল আমাদের ক্লান্ত নিঃশ্বাস। প্রহরীর মতো জেগে রইল ধ্যানমগ্ন পাহাড় তার অকৃপণ বাৎসল্য নিয়ে, আর আমাদের সমস্ত ভাবনা ঢেলে দিলাম সেই বিরাটের পায়ে। পরদিন আর একবার দেখলাম রহস্যময়ী জোন্‌হাকে। তার সেই উচ্ছল রূপের প্রতি জানালাম আমার গভীরতম ভালবাসা। তারপর ধীরে-ধীরে চলে এলাম অনিচ্ছাসত্ত্বেও। আসবার সময় যে-বেদনা জেগেছিল, বিদায়ের জন্যে তা আর ঘুচল না—সেইদিনই দুপুরে আমাদের দলের অর্ধেককে বিদায় দিয়ে সেই বেদনা দীর্ঘস্থায়ী হল। জোনহার ফিরতিপথে, ফেরার সময় মনে-মনে প্রার্থনা করেছিলাম, আমাদের এই যাত্রা যেন অনন্ত হয়। কিন্তু পথও ‘ফুরাল, আর আমরাও জোন্‌হাকে ফেলে, সেই আশ্রয়দাতা বুদ্ধমন্দিরকে ফেলে রাঁচি চলে এলাম। এ-থেকে বুঝলাম, কোনো কিছুর আসাটাই স্বপ্ন—আর যাওয়াটা কঠোর বাস্তব। খুব কম জিনিসই কাছে আসে; কিন্তু যায় প্রায় সব কিছুই। জোন্‌হাই তার বড় প্রমাণ। রাঁচি ফেরার পর আমাদের দলের অর্ধাঙ্গ হানি হওয়ায় আনন্দও প্রায় সেই সঙ্গে বিদায় নিয়েছে। তবু এরই মধ্যে দুদিন রাঁচিপাহাড়ে গেছি এবং উল্লসিত হয়েছি। এই পাহাড় থেকে রাঁচি শহরকে দেখায় ভারি সুন্দর। মনে হয়, ‘লিলিপুটিয়ান’রা গড়েছে তাদের সাম্রাজ্য। শহরের মধ্যে একটি ‘লেক’ আছে, আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দৃশ্যপটও ঘন-ঘন বদলায়, এবং শহরের সৌন্দর্যের জন্যে আমার মনে হয় লেকটিই অনেকখানি দায়ী। রাঁচি পাহাড়ের মাথায় আছে একটি ছোট্ট শিবের মন্দির। সেই মন্দিরে দাঁড়িয়েই দেখা যায় ছোটনাগপুরের দিগন্ত যেন পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আর আছে একটি গুহা, সেটিও কম উপভোগ্য নয়। আর সব মিলিয়ে দেখা যায় রাঁচির অখণ্ড সত্তাকে, যা একমাত্র রাঁচিপাহাড় থেকেই দেখা সম্ভব। ‘ডুরাণ্ডার বাঁধ’ বলে একটি জিনিস আছে, যেটিতে আমি একদিন স্নান করেছি এবং এক সন্ধ্যায় যাকে হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি দিয়ে অনুভব করেছি। এটিকে পুকুর বলাই ভাল, বড় জোর দীঘি। কিন্তু সবাই একে ‘লেক’ বলে থাকে। যাই হোক, জলাশয় হিসেবে এটিকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আর, তা ছাড়া ডুরাণ্ডার পথ, মাঠ, বন সবই ভাল। এক কথায়, ভাল এখানকার সবই। কেবল ভাল নয় এখানকার প্রতিবেশী, বাজারের দূরত্ব আর মিলিটারীদের আধিপত্য। এখানে এখন মাঝে-মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। যদিও বৃষ্টিটা এখানে ঠিক খাপ খাচ্ছে না, তবুও এই বৃষ্টি কাল অসাধ্য সাধন করেছে—ক্ষীণস্রোতা সুবর্ণরেখার বুকে এনেছে যৌবন। তার কল্লোলময় জলোচ্ছ্বাসে তার স্রোতের বেগে আর ঢেউয়ের মাতামাতিতে আমরা শিহরিত হয়েছি। কারণ, কাল সকালেও সুবর্ণরেখার মাঝখানে দাঁড়ালে পায়ের পাতা ভিজত না। যাই হোক, রাঁচির অনেক কিছুই এখনো দেখি নি। কিন্তু যা-দেখেছি তাতেই পরিতৃপ্ত হয়েছি—অর্থাৎ রাঁচি আমার ভাল লেগেছে। যদিও রাঁচির বৈচিত্র্য ক্রমশ আমার কাছে কমে আসছে, আর আজকাল সব দিনগুলোর চেহারাই প্রায় একরকম ঠেকছে। অতএব বিদায়— সুকান্ত ভট্টাচার্য পুনশ্চ: আমার ফিরতে বেশ দেরি হবে। ততদিন… …ভাইকে তদারক করিস দয়া করে। কারণ, এখানকার প্রাকৃতিক আকর্ষণের চেয়ে পারিবারিক আকর্ষণ বেশি; কবে যাব, তার ঠিক নেই। ‘বন্যা’র কাজ কতদূর? চিঠির উত্তর দিস।২৬ সু. ভ. পনেরো শ্যামবাজার, কলকাতা অরুণ, আমি এখনও এখানেই আছি। অথচ ‘আমি কেমন আছি’ এই খবরটা নেবার যে তোর দরকার হয় না, এইটাই আমাকে বিস্মিত করেছে। যদিও বুঝি যে এর পেছনে রয়েছে তোর Duty-র প্রতিকূলতা। (তোর কোনো অসুখ হয় নি তো?) তাই তোর ঔদাসীন্যকে সহজেই ক্ষমা করা যায়। যাই হোক, কাল (২২।১২।৪৩) তুই তোর ‘Duty’ ৩টেয় শেষ করে অন্যান্য কাজ আধ ঘণ্টায় সেরে ৪টের মধ্যে এখানে আসবি বাসে চেপে। সঙ্গে Govt. Art School-এ Exhibition দেখতে যাবার মতো গাড়িভাড়াও আনিস। তোর অসুখ না-হয়ে থাকলে আশা করি, আমার এ-অনুরোধ পালিত হবে। ২১।১২।৪৩ —সুকান্ত . ষোল অরুণ! বিয়ের দিন২৭ সকাল বেলায় তোর চিঠি পেলাম। তোর কথা মতো শুধু বিশ্বনাথকে ‘জনযুদ্ধ’ দেওয়ার সুযোগ পেলাম না বিয়ের কাজের চাপে। অন্য অনুরোধগুলো রাখবার চেষ্টা করব। এই চিঠির প্রধান আলোচ্য বিষয় বিয়ে এবং বিয়েও হয়ে গেল দুদিন হল। আজ ফুলশয্যা। বিয়েটা আমার ভাল লাগে নি, বরং খুব নিরানন্দেই কেটেছে। বিশেষ করে আদর এবং সম্মান পাওয়ায় অভ্যস্ত আমি, মোটেই সম্মান পাই নি কোথাও, ভাঁড়ের মতো আমার অবস্থা। বিয়ের দিন বিকেলে এসে রাত্রিতে ফিরে গিয়েছিল। আবার কাল সন্ধ্যায এসে ‘যাই-যাই’ করেও রয়ে গেছে। এইমাত্র ও এই ঘরে শুয়ে লেনিনের জীবনী পড়তে পড়তে উঠে গেল। (ওর নম্রতায় আমি মুগ্ধ!) ও আবার ঘরের দরজার কাছে এসে দাড়াল! তারপর চলে গেল। আমার ডানপাশে খাটের ওপর ঘুমিয়ে নববধূ (মন্দ নয়)। মেঝেতে মেজবৌদি২৮ এবং ভূপেন। বেলা প্রায় পাঁচটা। এই আবহাওয়ায় লেখা খুব অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। কয়েক দিন বিয়ের জন্যে পার্টির কাজের কামাই হয়ে গেল। হয়তো তোদের ওখানে যেতে পারব না ছুটি না পেয়ে। না গেলে কি ক্ষমা করতে পারবি না? সুকান্ত ভট্টাচার্য ৯।৬।৪৪ আমি যাই আর না-যাই ১৫ তারিখের মধ্যে তুই কলকাতায় ফিরিস। ১৫ই A. I. S. F. Conference! . সতেরো দোস্ত, কয়েকট কারণে আমার তোর ওখানে যাওয়া হল না। যেমন (১) কিশোর বাহিনীর দুধের নতুন আন্দোলন শুরু হল। (১৪ই জুনের ‘জনযুদ্ধ’ দ্রষ্টব্য।) (২) ১৫ই জুন A. I. S. F. Conf.  (৩) কিশোর বাহিনীর কার্ড এখনো ছাপা হয় নি। ছাপাব। (৪) ১৩ই জুন I. P. T. A.-এর অভিনয় শ্রীরঙ্গমে। (৫) ১১ই জুন কিশোর বাহিনীর জরুরী মিটিং। (৬) কিশোর বাহিনীর ৪নং চিঠি এ-সপ্তাহে লিখতে হবে। (৭) ১৬ই জুন আমাদের বাড়িতে বৌভাত। (৮) এখন আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ। তোদের ওখানকার কিশোর বাহিনীকে আমায় ক্ষমা করতে বলিস। নতুন আন্দোলনের জন্যে রমাকৃষ্ণ২৯ আমায় ছাড়লো না। তোর মা আমায় ক্ষমা করবেন না জানি, কিন্তু তুই এ বিশ্বাসঘাতকের প্রতি কি রকম ব্যবহার করবি সেটাই লক্ষণীয়। তুই অনেকদিন কলকাতা ছেড়েছিস। লক্ষ্মীবাবু৩০ এবং আমার মতে তোর এখন ফেরার সময় হয়েছে। ১৫ তারিখের মধ্যে তোর কলকাতা আসা পার্টির বাঞ্ছনীয়।৩১ . আঠারো অরুণ, মনে আছে তো আজ কিশোর-বাহিনীর শারদীয় উৎসব? অশোক৩২ যেতে চায়, ওকে নিয়ে তুই চারটের মধ্যে ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশন হলে পৌঁছস, আমি একটু ঘুরে যাব কিনা৩৩ —সুকান্ত ঊনিশ বেনারস সিটি অরুণ, যে-ম্যালেরিয়া তোকে প্রায় নির্জীব করে তুলেছে, আমি এখানে আসার পঞ্চম দিনে তারই কবলে পড়ে সম্প্রতি আরোগ্যলাভ করার পথে―তাই এতদিন চিঠি দিই নি। আজ অন্নগ্রহণ করলুম। তুই এখন কোথায়? কোডারমায় না কলকাতায়? দুদিন মাত্র সুযোগ পেয়েছিলাম কাশী দেখবার, তাতেই অনেকখানি দেখে নিয়েছি। কাশী ভাল লাগছে না: অনেকদিন পর ফিরে পাওয়া তামার পয়সার মতো ম্লান লাগছে। আর শরীর এখন খুবই দুর্বল, কারণ এ-কদিন সাংঘাতিক কষ্ট গেছে। তোকে রীতিমত কষ্ট করেই লিখতে হচ্ছে। আর লিখতে পারছি না। সকলের কুশলসহ এই চিঠির আশু বিস্তৃত জবাব চাই। সুকান্ত ভট্টাচার্য ২৮।১০।৪৪ পুনশ্চ: হঠাৎ এখানে অন্নদার৩৪ সঙ্গে দেখা হয়েছিল। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। কুড়ি S. B. C/o Haradas Bhattacherjee 279 Agastya Kundu Benares City ২০.১১.৪৪ অরুণ, তোর চিঠি অনেকদিন হল পেয়েছি, পেয়ে তোকে হতাশই করলুম। অর্থাৎ উত্তর দিতে দেরিও করলুম অথচ কাশীর বর্ণনামূলক ব্যক্তিগতভাবে চিঠিটা লিখলুম না। লিখলুম না এইজন্যে যে, কাশীর একটানা নিন্দে করতে আর ইচ্ছে করছে না; ওটা মুখোমুখিই করব, তাই আপাতত স্থগিত রাখলুম। শুনে বোধহয় দুঃখিত হবি যে, আমি আবার অসুখে পড়েছি; তবে এবারে বোধহয় অল্পের ওপর দিয়ে যাবে। তা ছাড়া যদি ভাল হযে উঠতে পারি, তা হলে আশা করা যায়, আগামী ২৯ তারিখে তোর সঙ্গে কলকাতায় আমার সাক্ষাৎ হবে। কিন্তু বেলেঘাটায় ফিরে যেতে আশঙ্কা হচ্ছে। কেননা বেলেঘাটাই এখন ম্যালেরিয়া-সাম্রাজ্যের রাজধানী। আর আমি ম্যালেরিয়ার রোগী হয়ে কি সেখানে প্রবেশ করতে পারি? বিশেষত আমি যখন ম্যালেরিয়া-সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করতে আর রাজী নই। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, তুই চিরকেলে ম্যালেরিয়া রোগী, তুই কি করে এখনো টিকে আছিস? (অবিশ্যি এখনো কিনা—ঠিক বলতে পারছি না)। কেবল মঙ্গলেরিয়ার কথাই বলে চলেছি, এখন কাশীর কথা কিছু বলি। কাশীর আমি প্রায় সব দ্রষ্টব্যই দেখেছি। ভাল লেগেছে কেবল ইতিহাসখ্যাত চৈত সিংহের যুদ্ধঘটনাজড়িত প্রাসাদের প্রত্যক্ষ বাস্তবতা, আর রাজা মানসিংহ স্থাপিত Observatory মানমন্দির। অবিশ্যি বিখ্যাত বেণীমাধবের ধ্বজ থেকে কাশী শহর খুব সুন্দর দেখায়, কিন্তু সেটা বেণীমাধব বা কাশীর গুণ নয়, দূরত্বের গুণ। কাশীর গঙ্গা এবং উপাসনার মতো স্তব্ধ তার শ্যামল পরপার, এ দুটোই উপভোগ্য। কাশী শহর হিসেবে খুব বড় সন্দেহ নেই; বিশেষত আজকের দিনে আলো-ঝলমল শহর হিসেবে। অথাৎ এখানে ‘ব্লাক-আউট’ নেই। আর পথে পথে এখানে দেখা যায় লোকের ভিড় কলকাতার মতোই। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ছাত্র-নিবাস-মূলক’ বিশ্ববিদ্যালয়। আর দেখলাম গান্ধীজী পরিকল্পিত ভারতমাতার মন্দির। দুটোতেই ভাল লাগার অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও ধর্মের লেবেল আঁটা বলে বিশেষ ভাল লাগল না। আর সবচেয়ে ভাল লাগল সারনাথ। তার ঐতিহাসিকতায়, তার নির্জনতায়, তার স্থাপত্যে আর ভাস্কর্যে, তার ইটপাথরে খোদিত কর্মগাথায় সে মহিমময়। —সুকান্ত ভট্টাচার্য এখন জ্বর আবার আসছে! . একুশ কলকাতা ২০।১।৪৫ অরুণ, তোর খবর কি? এক মাস তোর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ নেই। অবিশ্যি দেখা-সাক্ষাৎ করাটা তোর কাছে অধুনা অবাস্তব। আমি কিন্তু এই এক মাসের মধ্যে বার দুই-তিন বেলেঘাটায় গেছি তোর খোঁজে। যাই হোক, তোর খবরের জন্যে আমি কি রকম উৎসুক তা ‘রিপ্লাই কার্ড’ দেখেই আশা করি আন্দাজ করতে পারবি, এর পর যেন আর উত্তর দিতে দেরি করিস নি। অসুখ করে নি তো? কেননা, আমি ইতিমধ্যে আবার অসুখে পড়েছিলাম। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য আমার দুশ্চিন্তা ও অবহেলার সীমা নেই, যদিচ তোড়জোড় করছি খুব। তাই উত্তর দিতে অবহেলা করে আর দুশ্চিন্তা বাড়াস নি। কলকাতায় কবে ফিরবি? বাড়ির অন্য সব কে-কেমন আছে জানাস। —সুকান্ত . বাইশ কলকাতা ২.২.২৫ অরুণ, কাল-পরশু-তরশু, যেদিন হয় শৈলেনের কাছ থেকে সংস্কৃত নোটখানা নিয়ে বেলা পাঁচটার মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করিস। বেলেঘাটার হৃষীদা’দের৩৫ কি বক্তব্য জেনে আসিস, আমি তার কৈফিয়ৎ দেবার চেষ্টা করব। দেখাটা ৪-৫টার মধ্যে হলেই ভাল হয়। মনে রাখিস, অন্যথা অক্ষমনীয়। —সুকান্ত তেইশ অরুণ, কবিতা পাঠালুম। সেদিন৩৬ লাঞ্ছনা কমই হয়েছিল। কেননা সে সন্ধ্যায় সহপাঠিনীও ফাঁকি দিয়ে আমার মুখরক্ষার সুবিধা করে দিয়েছিল। আমার সাম্প্রতিক মনোভাব শোচনীয়। অবস্থাটা কবিতায় বলি: কেবল আঘাত দেয় মূর্খ চতুর্দিক, তবুও এখনো আমি নিষ্ক্রিয় নির্ভীক, ভারাক্রান্ত মন আজ অবিশ্রান্ত যায়, তবু নিকটস্থ ফুল সুগন্ধে মাতায়। —সু . চব্বিশ ২১।৯।৪৫ অরুণচন্দ্র! কলকাতায় এত কাণ্ড, এত মিটিং অথচ তোর পাত্তা নেই, বাড়িতে এসে সেখানেও নেই, পাত্তাটা কোথায় মিলবে? সুভাষ আগামী বুধবার এখানে আসতে রাজী হয়েছে। তার জন্য আয়োজন করতে থাক। আমার তাড়া থাকায় আমি চললাম। ২.৫৫ মিঃ দুপুর। —সুকান্ত পঁচিশ (ক) ৮ই, ডেকার্স লেন: ‘স্বাধীনতা’ ২৪.৫.৪৬ প্রিয় বয়স্য, তোর আবেগের কারণটা ঠিক বুঝলাম না, কেমন যেন হেঁয়ালী। এই হেঁয়ালীকে ব্যঙ্গ করব, না সহানুভূতি জানাব তাও বুঝছি না। আমি খুলনা যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছি এক মুহূর্তের লজ্জায়। কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী৩৭ নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন, আমি হঠাৎ ‘না’ বলে ফেলেছিলাম। যাই হোক, তুই তাড়াতাড়ি ফিরিস। তোর চিঠির থলি এখুনি ঘাড়ে করে বেরুব। ‘কার্টুন’ ভাল হলে পাঠাস। ভূপেনের লেখা মন্দ হয় নি। ‘কবিতা’ পত্রিকায় এবারও তোর আর আমার লেখা প্রকাশিত হয় নি। যেতে পারলুম না বলে দুঃখ করিস নি। —সুকান্ত (খ) স্বামী অরুণাচল মহারাজ সমীপেষু, বাবাজী! আপনি গাঁজার ঘোরে ভুল দেখিয়াছেন। আপনার ‘নাম-চিহ্ন’ নকল করা হয় নাই। ছবিটি বিখ্যাত শিল্পী অহিনকুল মুখোপাধ্যায়ের৩৮ আঁকা। নামচিহ্ন অনেকটা আপনার ন্যায় হইলেও স্বাতন্ত্র্য আছে। সুতরাং ডায়ালেক্‌টিকাল আদালতের৩৯ কী ভয় দেখাইতেছেন! ব্যাপারটি মেটাফিজিক্স৪০ তাই বুঝিতে পারেন নাই৪১। দুর্বিনীত: সুকান্ত শর্মা ছাবিবশ “তোমার হলো শুরু: আমার হলো সারা” ২০, নারকেলডাঙ্গা মেইন রোড ২৮শে জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৩ দুপুর, কলিকাতা অরুণ, তোর চিঠি পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছি। ভেবেছিলাম খুব দুরবস্থার মধ্যে আছিস, চিঠি পেয়ে বুঝলাম, মা-র কোলে সুখেই দিনাতিপাত করছিস এবং মনের আহলাদে স্মৃতির জাবর কাটছিস—সুতরাং আমি এখন নির্ভয়। তোর তৃতীয় (!?) প্রেমের ইতিবৃত্ত পড়লাম, প’ড়ে খুশিই হলাম। –বরাবরই তোর এই নূতনত্বের প্রীতি আমাকে আনন্দ দিয়েছে। এবারও দিল। ভয় নেই তোর এই ব্যাপারে আমি তোকে নিরুৎসাহ করতে চাই না। কারণ তোর মতো বঞ্চিত জীবনে এই রকম নায়িকার আবির্ভাব বরাবর হওয়া দরকার। যদিও এ জাতীয় প্রেমোপাখ্যানের স্থায়িত্ব সম্বন্ধে আমি বরাবর অতি-সতর্কতার দরুন সন্দিহান, তবুও এর উপকারিতাকে আমি অস্বীকার করি না। তবে, এই ব্যাপারে উৎসাহ দিতে গিয়েও আমি তোকে একটা প্রশ্ন করছি—এইভাবে এগোলে জীবনের জটিলতা কি আরো বেড়ে যাবে না? অবশ্য ভাল-মন্দ বিবেচনার ভার তোর ওপর এবং পারিপার্শ্বিক বিচারও তুই-ই করবি, সুতরাং আমার এ বিষয়ে বলা অনর্থক। চিঠির সমালোচনা করতে বলেছিস, কিন্তু সমালোচনা করার বিশেষ কিছুই নেই। ভাষা সংযত এবং পূর্বাপেক্ষা ভাল, চিঠিতে আবেগ কম, তথ্য বেশী এবং চিঠিট বিরাট হয়েও বিরক্তিকর তো নয়ই বরং কৌতুহলোদ্দীপক, একমাত্র “উপলব্ধি” বানান ছাড়া আর সব বানানই শুদ্ধ। হাতের লেখা তেমন ভাল নয়। বিষয়বস্তু: একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম•••? ••• হোক আর ছাই না-ই হোক, মেয়েটির যে অনেক গুণ আছে সে পরিচয় পেয়েছি; ••• কেমন জানতে পারি নি। অবশ্য সে যদি •••হয় তবে রূপ বর্ণনার প্রয়োজন নেই, কারণ সেটা অজ্ঞাত নয়। একটি মেয়ের প্রেম এই চিঠির বৈশিষ্ট্য, তাই এই চিঠি সরস এবং উত্তেজনাময়। মানুষ চিরকালই প্রেমের গল্প পড়তে ভালবাসে। সেই হিসাবে দেখলেও চিঠিটা Interesting. সবকিছু ছাপিয়ে এই চিঠিতে ফুটে উঠেছে তোর ভবিষ্যৎ; যে ভবিষ্যৎ হয়তো সুখের অথবা বঞ্চনার হবে; যে ভবিষ্যৎ লাঞ্ছনার অথবা মুক্তির হবে। বন্ধু হিসাবে আমি তোর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশান্বিত। সমালোচক হিসাবে সন্দিগ্ধ। সুতরাং এ বিষয়ে আমার মতামতের কোনো দাম নেই। তোদের কবিতা “দ্বৈত” যেমন ছেলেমাতুষিতে ভরা, তেমনি চমৎকার পন্থা পরস্পরের মন জানার। তোর আর্থিক সুরাহা যদি হয় তবে আমিই সর্বাপেক্ষ খুশী হব। নিঃস্বার্থ খুশী। তোর শরীর খারাপ লিখেছিস অথচ ভাল হওয়ার ব্যাপারে “জিদবশত” সিদ্ধহস্ত, এই গর্বও প্রকাশ করেছিস। তাই আমি তোর শরীর খারাপের ব্যাপারে চিন্তিত, গর্বের ব্যাপারে মুচকি-হাসিত। আমি কেবল কামনা করছি মনেপ্রাণে সুস্থ হয়ে ওঠ; সত্যিকারের শিল্পী হয়ে ওঠ। তোর বিজয় ঘোষিত হোক। আমার খবর: শরীর মন দুই-ই দুর্বল। অবিশ্রাস্ত প্রবঞ্চনার আঘাতে আঘাতে মানুষ যে সময় পৃথিবীর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে, ঠিক সেই সময় এসেছে আমার জীবনে। হয়তো এইটাই মহত্তর সাহিত্য স্মৃষ্টির সময় (ভয় নেই, আঘাতটা প্রেমঘটিত নয়)। আজকাল চারিদিকে কেবল হতাশার শকুনি উড়তে দেখছি। হাজার হাজার শকুনি ছেয়ে ফেলেছে আমার ভবিষ্যৎ আকাশ। গত বছরের আগের বছর থেকে শরীর বিশেষভাবে স্বাস্থ্যহীন হবার পর আর বিশ্রাম পাই নি ভালমতো। একান্ত প্রয়োজনীয় বায়ু “পরিবর্তনও” ঘটে নি আমার সময় ও অর্থের অভাবে। পার্টি আর পরীক্ষার জন্যে উঠে দাঁড়ানোর পর থেকেই খাটতে আরম্ভ করেছি; তাই ভেতরে অনেক ফাঁক থেকে গিয়েছিল। পরীক্ষা দিয়ে উঠেই গত তিন মাস ধরে খাটছি। বুঝতে পারি নি স্বাস্থ্যের অযোগ্যতা। হঠাৎ গত সপ্তাহে হৃদযন্ত্রের দুর্বলতায় শয্যা নিলুম। একটু দাঁড়াতে পেরেই গত দেড় মাস ধরে ••• ••• ••• জন্যে অবিরাম আন্তরিক খাটুনির পুরস্কার হিসাবে••• কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পেলুম যাতায়াতী খরচের জন্যে পাঁচটি টাকা। আর পেলুম চারদিনের জন্যে পার্টি হাসপাতালের “ওষুধপথ্যিহীন” কোমল শয্যা। এতবড় পরিহাসের সম্মুখীন জীবনে আর কখনো হই নি। আমার লেখকসত্তা অভিমান করতে চায়, কর্মীসত্তা চায় আবার উঠে দাঁড়াতে! দুই সত্তার দ্বন্দ্বে কর্মীসত্তাই জয়ী হতে চলেছে; কিন্তু কি করে ভুলি, দেহে আর মনে আমি দুর্বল: একান্ত অসহায় আমি? আমার প্রেম সম্পর্কে সম্প্রতি আমি উদাসীন। অথোপার্জন সম্পর্কেই কেবল আগ্রহশীল। কেবলই অনুভব করছি টাকার প্রয়োজন। শরীর ভাল করতে দরকার অর্থের, ঋণমুক্ত হতে দরকার অর্থের; একখানাও জামা নেই, সেজন্যও যে বস্তুর প্রয়োজন তা হচ্ছে অর্থ। সুতরাং অর্থের অভাবে কেবলই নিরর্থক মনে হচ্ছে জীবনটা। আমাদের উপন্যাসটা চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গেল এবং সেজন্যে আমাদের তিনজনের অভিশাপ যদি কেউ পায় তো সে অরুণাচল বসুই পাবে। সে যদি জোর করে ত্রিভুজের মধ্যে মাথা না গলাতো তা হলে এমনটি হ’ত না। তোর বদলে•••কে লিখতে দেওয়া হয়েছিল। সে বিশ্বাসঘাতকতা করল। তিন সপ্তাহ আগে তাকে খাতা দেওয়ার পর আজো সে কিছুই লেখে নি এবং বোধহয় খাতাও ফেরত দেয় নি ভূপেনকে। তোর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে সে আমায় পাগল করে রেখেছিল, দেখা হলে কৈফিয়ৎ দিল: আমার আশ্রয় নেই তাই লিখতে পারি নি, গৃহহীন আমি Advance অফিসেই রাত্তির কাটাই। দেবব্রতের খবর রাখি না অনেকদিন হল। তুই যে ঝি দিতে চাস্ তা আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয়। বাবা-দাদা উভয়েই আগ্রহ দেখিয়েছে। যদি “তার” পাথেয় একান্তই যোগাড় না হয় তা হলে আমাকে লিখিস, পাঠিয়ে দেবার চেষ্টা করব। —সুকান্ত ৩১শে জ্যৈষ্ঠ ৫৩। . সাতাশ 10 Rawdon Street Calcutta. বন্ধুবৎসলেষু … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … … —সুকান্ত ২৭।৬।৪৬ আঠাশ ৩।৭।৪৬ অরুণ, তুই কবে আসছিস? আমার চতুর্দিকে দুর্ভাগ্যের ঝড়। এ-সময তোর উপস্থিতি আমার পক্ষে নির্ভরযোগ্য হবে। তোর খবর ভাল তো? আমাদের ঝি চলে গেছে। আসার সময় তুই যে ঝি দিবি বলেছিলি, তাকে আনা চাই-ই। আমার ১৩৫২-ব বৈশাখের ‘পরিচয়’ খানাও অনিস। আর সবার খবর ভাল। মা-র খবর কী? —সুকান্ত . উনত্রিশ বুধবার, সকাল ১১টা অরুণ, তোকে কাল যে ওষুধটা পাঠিয়েছি ভাত খাওয়ার পর দু’চামচ করে খাচ্ছিস তো? ওটা তোর পক্ষে অমোঘ ওষুধ। দিন-তিনেকের মধ্যেই জ্বর বন্ধ হয়ে যাবে, আশা করছি। তোর কথামতো তোর জন্যে দুখানা টিকিট এনে ফেলেছি। তা ছাড়া আরো দুটো টিকিট এনেছি”…তোর ভক্তদের কাছে বিক্রি করার জন্যে। টিকিট চারটে পাঠালাম (দাম প্রতিটি এক টাকা)। ডাক্তার আমাকে শয্যাগত করে রেখেছে, কাজেই তুই একমাত্র ভরসা। যেমন করে হোক, টিকিট চারটে বিক্রি করে শনিবারের মধ্যে দামগুলো আমার বাড়িতে পৌছে দিবি। এট। হুকুম নয়, অনুরোধ।  তা ছাড়া শনিবার তোরু বাড়িতে ‘চতুভুজ’ বৈঠকের কথা ছিল। সেটা আমার বাড়িতেই করতে হবে। আমি নিরুপায়। ভূপেনকে সেই অনুরোধ জানিয়েই আজ চিঠি দেব। আশা করছি, তুই আমার অবস্থাটা বুঝবি।৪৩ —সুকান্ত . ত্রিশ অরুণ, সন্ধ্যে সাতটা থেকে ন’টার মধ্যে যে-করে হোক আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার বাড়িতে আসিস। এই রকম জরুরী দরকার খুব কম হয়েছে এ পর্যন্ত। মনে রাখিস; অত্যন্ত জরুরী ৪৪ —সুকান্ত একত্রিশ ৫ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৭ সকাল অরুণ, আমি পরশু শ্যামবাজার যাচ্ছি। কাজেই দু-একটা কাজের ভার তোকে দিচ্ছি, আগামীকাল রাত্তিরের মধ্যে কাজগুলো করে তুই আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই কাল দেখা করবি। কাজগুলো হচ্ছে (১) শিশির চ্যাটার্জির৪৫ কাছ থেকে ‘খবর’ ইত্যাদি কবিতাগুলো জোর করে আনবি। (২) দেবব্রতবাবুর৪৬ কাছ থেকে আমার ছড়ার বইয়ের পাণ্ডুলিপি যে-করে হোক সংগ্রহ করা চাই। (৩) যে জিনিসটার জন্যে তোকে নিত্য তাগাদা দিচ্ছি, পারিস তো সেটাও আনিস। কাজগুলো খুবই জরুরী। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওপরের তিনদফা জিনিসগুলো হস্তগত করে আমার সঙ্গে দেখা করবি। অনেক সুখবর আছে। —সুকান্ত . বত্রিশ যাদবপুর.টি-বি-হাসপাতাল অরুণ! সাতদিন হয়ে গেল এখানে এসেছি। বড় এক-একা ঠেকছে এখানে। সারাদিন চুপচাপ কাটাতে হয়। বিকেলে কেউ এলে আনন্দে অধীর হয়ে পড়ি। মেজদা৪৭ নিয়মিত আসে, কিন্তু মুভাষ নিয়মিত আসে না। কাল মেজবৌদি-মাসিমকে৪৮ নিয়ে মেজদা এসেছিল। চলে যাবার পর মন বড় খারাপ হয়ে গেল। বাস্তবিক শ্যামবাজারের ঐ পরিবেশ ছেড়ে এসে রীতিমত কষ্ট পাছি। তুই কি এখনো দাঙ্গার অবরোধের মধ্যে আছিস? না কলকাতায় যাতায়াত করতে পারছিস? যাই হোক, সুযোগ পেলেই আমার সঙ্গে দেখা করবি। দেখা করবার সময়—বিকাল চারটে থেকে ছ’টা। শিয়ালদা দিয়ে ট্রেনে করে আসতে পারিস, কিম্বা ৮এ বাসে। এখানে ‘লেডী মেরী হাৰ্বাট ব্লক’ এক নম্বর বেডে আছি। আশা করি আমার চিঠি পাবি। দেখা করতে দেরি হলে চিঠি দিস।৪৯ ৮।৪।১৯৪৭ —সুকান্ত . তেত্রিশ শ্রদ্ধাস্পদাসু,৫০ মা, আপনার ছোট্ট মৌচাকটি আমার হস্তগত হল। কিন্তু কৃপণতার জন্য দুঃখ পেলাম। আপনি আমায় যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি যেতে বলেছেন। আপনার আগ্রহ আমায় লজ্জা দিচ্ছে তাড়াতাড়ি যেতে পারছি না বলে। আপনার আগ্রহ উপেক্ষা করতে পারব বলে মনে হয় না। আমার মুর্শিদাবাদ যাবার ইচ্ছে নেই। তবে ঝাঝায় যাবার কথা হচ্ছে দাদা-বৌদির—সেখানে যেতে পারি। তবে আপনাদের ওখানকার “আমন্ত্রণ সেরে। সেদিন আপনাদের ট্ৰেইনখানা আমার সামনে দিয়ে গেল, পিছন থেকে অমূল্যবাবুকে দেখেছিলাম, আর দেখেছিলাম আপনার কয়েকজন সহযাত্রীকে, কিন্তু আপনাকে দেখলাম না দুঃখের বিষয়। —কিছুদিন মনে হ’ত, আজ সন্ধ্যায় কোথাও যেতে হবে না! আজকাল সে-ভাব থেকে মুক্ত। আপনারা নিশ্চয়ই ভাল আছেন? আপনি আমার,—থাক কিছুই জানাব না —এমন একজন যে আপনার বাবা হতে পারবে না; কারণ, তার বড় ভয়, পাছে সে বাবা হলে বাবার কর্তব্য হতে বিচু্যত হয়। আর আপনার অরুণ-বাবা’টি তো মেয়ের আবদারে নাকি কলের পুতুল ব’নে আছে। সুতরাং উল্টোটাই হোক। আপনার কৃপণতার প্রতিশোধ নিলুম, ছোট চিঠি দিয়ে। ইতি— —সুকান্ত . চৌত্রিশ শ্রদ্ধাস্পদামু,৫১ বিস্তারিত বর্ণনা আগামী পত্রে প্রাপ্তব্য। আপনি এবং আপনার পুত্র আশা করি কুশলময়। অরুণকে বলবেন আমার চিঠির জবাব দিতে, তার ব্যাপার দুঃখপ্রদ। আমরা কুশলে। ইতি— —সুকান্ত পঁয়ত্রিশ কলকাতা শ্রদ্ধাস্পদাসু,৫২ মা, প্রথমেই আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাখা ভাল। কারণ অপরাধ আমার অসাধারণ—বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ আপনার স্বপক্ষে। আর আমার প্রতিবাদ করবার কিছুই যখন নেই, তখন এই উক্তি আপনার কাছে মেলে ধরছি যে, পারিবারিক প্রতিকূলতা আমাকে এখানে আবদ্ধ করে রেখেছে; নইলে আপনার কাছে ক্ষমা চাইবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার অপরাধ যে হয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য। তবু উপায় যখন নেই, তখন ক্ষমা ভিক্ষা করা ছাড়া আর আমার গতি রইল না। বাড়ির কেউ আমায় এই দুর্দিনে চোখের আড়াল করতে চায় না। অথচ এখানটাও যে নিরাপদ নয়, সেট। ওরা বুঝতে পারে এবং পেরেও বলে, মরতে হলে সবাই একসঙ্গে মরব। কী যুক্তি! আসল ব্যাপার হচ্ছে সমুলে বিনাশ হলেও আমি যেন না এই সংসার-বৃক্ষচ্যুত হই। “যেখানে যাই সেখানেই দেখি কুগ্রীতা মলিনতা— এক দুর্নিবার গ্লানিতে আমি ডুবে আছি। আপনাকে এত কথা বলছি এর কারণ আপনার কাছে সান্তনা, আশ্বাস চাই বলে; আপনার আশীৰ্বাদ চাই যাতে এই দুষিত আবহাওয়া কাটিয়ে উঠতে পারি। আজকাল আপনাকে খুব বেশী করে—ঠিক এই সময়ে আপনার পবিত্র সান্নিধ্য পেলে আমি নিজেকে এতটা অসহায় মনে করতুম না—এই কথা ভেবে মনে পড়ে। চিঠি লেখার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই। বাস্তবিক, আমি কোথাও চলে যেতে চাই, নিরুদেশ হয়ে মিলিয়ে যেতে চাই “কোঁনো গহন অরণ্যে কিংবা অন্য যে-কোন নিভৃততম প্রদেশে; যেখানে কোনো মানুষ নেই, আছে কেবল সূর্যের আলোর মতো স্পষ্ট-মনা হিংস্র আর নিরীহ জীবেরা, আর অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। এতোরও দরকার নেই, নিদেনপক্ষে আপনাদের ওখানে যেতে পারলেও গভীর আনন্দ পেতাম, নিস্কৃতির বন্য আনন্দ; সমস্ত জগতের সঙ্গে আমার নিবিড় অসহযোগ চলছে। এই পার্থিব কৌটিল্য আমার মনে এমন বিস্বাদন এনে দিয়েছে, যাতে আমার প্রলোভন নেই জীবনের ওপর। …এক অননুভূত অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করেছে। সমস্ত পৃথিবীর ওপর রুক্ষতায় ভরা বৈরাগ্য এসেছে বটে, কিন্তু ধর্মভাব জাগে নি। আমার রচনাশক্তি পর্যন্ত ক্ষীণ হয়ে এসেছে মনের এই শোচনীয় দুরবস্থায়। প্রত্যেককে ক্ষমা করে যাওয়া ছাড়া আজ আর আমার অন্য উপায় নেই। আচ্ছা, এই মনোভাব কি সবার মধ্যেই আসে এক বিশিষ্ট সময়ে? যাক আর বাজে বকে আপনাকে কষ্ট দেব না। আমার আবার মনে ছিল না, আপনি অমৃস্থ। আপনার ছেলে কি পাবনায় গেছে? তাকে একটা চিঠি দিলাম। সে যদি না গিয়ে থাকে, তবে সেখানা দেবেন এই বলে যে, “এ-খানাই তোমার প্রতি সুকান্তর শেষ চিঠি।”—আচ্ছা, কিছুদিন আগে একখানা চিঠি (Post card) এসেছিল। চিঠিখানার ঠিকানার জায়গায় কাগজ মেরে দেওয়া হয়েছিল আর তার ওপর ঠিকানা লেখ ছিল। সেই চিঠিখানা বেয়ারিং হয়। সেখানা কি আপনাদের কারুর চিঠি? বেয়ারিং করার মুর্খতার জন্য চিঠিটা আমি না-দেখে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম; তবে সেখানা আপনাদের হলে অকুতাপের বিষয়। আমার আপনাদের ওখানে যাবার ইচ্ছা আছে সর্বক্ষণ, তবে সুযোগ পাওয়াই দুষ্কর। আর সুযোগ পেলেই আমায় দেখতে পাবেন আপনার সমক্ষে। চিঠির উত্তর দিলে খুশী হব। না দিলে দুঃখিত হব না। আপনি আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন। এখানকার আর সবাই ভাল। ইতি। শ্রদ্ধাবনত— সুকাস্ত ভট্টাচার্য সর্বাগ্রে আপনার ও অপরের কুশল প্রার্থনীয়। –সুঃ ভঃ ছত্রিশ দোল-পূর্ণিমা কলকাতা শ্রদ্ধাস্পদাসু,৫৩ মা, আপনার পত্রাংশ ঠিক সময়েই পেয়েছিলাম। উত্তর দিতে দেরি হল! কারণ, সেই সময়ে আমি অত্যন্ত অনুস্থ ছিলাম।••• আর দিনরাত পেটে যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলাম। এখন ওষুধ খেয়ে অনেকটা ভাল আছি। শীগগিরই যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তি হব। আপনি কেমন আছেন? অরুণ আমার কাছে মোটেই আসে না। স্নেহাধীন সুকান্ত . সাঁইত্রিশ ১১ডি, রামধন মিত্র লেন পোঃ শ্যামবাজার কলকাতা-৪ শ্রদ্ধাস্পদাসু, মা, আপনার চিঠি কয়েকদিন হল পেয়েছি। চিঠিতে বসস্তের এক ঝঁলক আভাস পেলাম। আপনার কথামতো পাতাটা সঙ্গে-সঙ্গেই রেখেছি, তবে বেটে-খাওয়া সম্ভব হল না। আবার আমার পেটের অসুখ ও পেট্রের যন্ত্রণ। শুরু হয়েছে। তবে আজ একটু ভাল আছি। দিন সাতেকের মধ্যেই হাসপাতালে যাব। সেখান থেকে পরে যাব আজমীর। অরুণ মধ্যে দিন-দুই এসেছিল। আপনার খবর কী? ২০।৩।৪৭ —সুকান্ত আটত্রিশ বেলেঘাট ১।২।৪৯ শ্রদ্ধাস্পদেষু—৫৪ আপনার এখান থেকে চলে যাবার দিন কথা দেওয়া সত্ত্বেও কেন আপনার অফিসে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করি নি তার কৈফিয়ৎ স্বরূপ এই চিঠি উপস্থিত করলাম। সেদিন রাত ৮-৩০ এমনি সময় যথাস্থানে গিয়ে শুনলাম আপনি চলে গেছেন। সুতরাং দুঃখিত মনে বাড়ি ফিরেছিলাম। তারপর কর্তব্যবোধে এই চিঠি লিখলাম। অরুণকে এবং মাকে নিশ্চয়ই আমার না-যাবার নিরুপায়তা সম্বন্ধে বিশদভাবে বুঝিয়েছেন। আর আমি চেষ্টা করছি যথাসত্বর আপনাদের সামনে উপনীত হতে। কিন্তু এরা আমাকে যেতে দিতে রাজী তো নয়ই, যাবার বিপক্ষে নানান অবাস্তর ও হাস্যকর যুক্তি দর্শাচ্ছে; তবু চেষ্টা চালাচ্ছি। দরকার হলে পালিয়ে গিয়ে উপস্থিত হব। অরুণ, এবং মা উভয়কে জানাবেন তাদের অবিলম্বে পত্র দেব। আপনার অবস্থিতিতে আশা করি সব অমঙ্গল দূরীভূত হয়েছে। আপনাদের কুশল কাম্য। বিনীত— —সুকান্ত উনচল্লিশ বেলেঘাটা ১৬ই এপ্রিল [ ১৯৩৯? ] ভূপেন,৫৫ একটা চিঠি লিখছি। অত্যন্ত অনিচ্ছায় কিংবা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে না হলেও খুব মন দিয়ে লিখছি না। একটা সুযোগের প্রলোভনে চিঠিটা লিখতে বাধ্য হলুম; কেন জানি না। তোমাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছা করে তাকে দমন করতে পারি না। তবুও লিখে তৃপ্তি পায় না মন আর লোভও বেড়ে যায়। এইতো চিঠি লিখলাম। আবার একটু পরে হয়তো তোমায় দেখতে ইচ্ছা করবে। আগুনের মধ্যে পতঙ্গ হয়তো ঝাপ দিতে চাইবে; চঞ্চল মনের অঞ্চল হয়তো বসন্তের বাতাসে একটু দুলতে চাইবে; মনের মাদকতা হয়তো একটু বাড়বে কিন্তু শীর্ণ শাখায় সে দোলা মুখের দিনগুলিকে ঝরিয়ে দেবে। আজকাল মাঝে মাঝে অব্যক্ত স্পৃহা সরীসৃপের মতো সমস্ত গা বেয়ে সুস্থ মনকে আক্রান্ত করতে চায়। আমি এ সমস্ত সহ্য করতে পারি না। আমার চারিদিকের বিষাক্ত নিঃশ্বাসগুলো আমাকেই দগ্ধ করতে ছুটে আসে আর তার সে রোমাঞ্চকর বিশ্বাস আমাকে লুব্ধ করে। আশার চিতায় আমার মৃত্যুর দিন সন্নিকট। তাই চাই আজ আমার নির্বাসন। তোমাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে চাই, তোমাদের ভুলতে চাই; দীন হয়ে বাঁচতে চাই। তাই মুখের দিনগুলোকে ভুলে, তোমাদের কাছে শেখা মরণ-মন্ত্রকে ভুলে, ধ্বংসের প্রতীক স্বপ্নকে ভুলে মৃত্যুমুখী আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু পারব না, তা আমি পারব না;– আমার ধ্বংস—অনিবার্য। আজ বুঝেছি কেন এত লোক হুঃখ পায়, সঠিক পথে চলতে পারে না। আলেয়া-যৌবন তার দিক্-ভ্রান্তি ঘটায়। হঠাৎ স্বপ্নাকাশে বাস্তবের মেঘগুলো জড়ো হয়ে দাঁড়ায় ভিড় করে, হাতে থাকে বুভূক্ষার শাণিত-খড়গ আর অক্ষমতার হাঁড়ি-কাঠে তাদের মাথা কাটা পড়ে। এই তো জীবন। প্রথম যৌবনের অলস অসতর্ক মুহূর্তে আমরাই আমাদের শ্মশানের চিতা সাজাই হাস্যমুখর দিনের পরিবেশনে। অশিক্ষিত আমাদের দেশে যৌবনে দুর্ভিক্ষ আসবেই। আর তারই বহ্নিময় ক্ষুধা আমাদের মনকে তিক্ত, অতৃপ্ত, বিকৃত করে তোলে। জীবনে আসে অনিত্যতা, জীবনীশক্তি যায় ফুরিয়ে, কাজে আসে অবহেলা, ফাঁকি আমরা তখনই দিতে শিখি আর তখনই আসে জীবনকে ছেড়ে চুপি চুপি সরে পড়বার দুরস্ত দুরভিসন্ধি। আমার কর্মশক্তিও যাত্রার প্রারম্ভেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ছে এই ধূলিধূসরিত কুয়াশাচ্ছন্ন পথেই। অবসাদের শূন্যতা জানিয়ে দেয় পথ অনেক কিন্তু পেট্রোল নেই। তোমরা দিতে পার এই পেট্রোলের সন্ধান? বহু দিন অব্যবহৃত ষ্টীয়ারিংএ মরচে পড়ে গেছে, সে আর নড়তে চায় না, ঠিক পথে চালায় না—আমাকে। তোমরা মুছিয়ে দিতে পার সেই মলিনতা, ঘুচিয়ে দিতে পার তার অক্ষমতা? যাক, আগের চিঠির উত্তর দাও নি কেন? পায়ে পড়ে মিনতি জানাই নি বলে, না আমার মতে অভাজনের এ আশাতিরিক্ত বলে? রবীনের চিঠির সঙ্গে চিঠি দিলাম তারই খরচায়। আমার চিঠির উত্তর না দাও রবীনেরটা দিও। আমাদের Examination ২৮শে এপ্রিল। প্রাইজ ১৯শে; সেদিন আসতে পার। খোকনকে৫৬ আমায় চিঠি দিতে ব’লো। ঘেলুর খবর কী? ইতি সুকান্ত চল্লিশ রেড-এড কিওর হোম ১২.৯.৪৬ ভূপেন, •••এবার আমার কথা বলি। তিন সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছি। গত এক সপ্তাহ ধরে পার্টির হাসপাতালে কাটাচ্ছি—আরো কতদিন কাটাতে হবে কে জানে। যদিও অঞ্চলটা পার্ক-সার্কাস তবুও দাঙ্গা সংক্রান্ত ভয় নেই। একরকম বৈচিত্র্যহীন ভাবেই দিন কাটছে, যদিও বৈচিত্র্যের অভাব নেই। অনন্ত সিং গণেশ ঘোষ ছাড়া পেয়ে আমাদের এখানে এসেছিলেন—সেই একটা বৈচিত্র্য। সেদিন ডাইনিং রুমে খাচ্ছি এমন সময় কমরেড জোশী সেই ঘরে ঢুকে আমাদের খাওয়া পরীক্ষা করলেন। এটাকেও বৈচিত্র্য বলা যেতে পারে। তবে কাল আমার জীবনে সব থেকে স্মরণীয় দিন গেছে। মুক্ত বিপ্লবীরা সদলবলে (অনন্ত সিং বাদে) সবাই আমাদের এখানে এসেছিলেন। অনুষ্ঠানের পর তাঁরা আমাদের কাছে এলেন আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে। বিপ্লবী সুনীল চ্যাটার্জী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আর একজন বিপ্লবী তাঁর গলার মালা খুলে পরিয়ে দিলেন আমায়। গণেশ ঘোষ বললেন—’আমি আপনাকে ভীষণভাবে চিনি’। অম্বিকা চক্রবর্তী ও অন্যান্য বন্দীরা সবাই আমাকে অভিনন্দন জানালেন— আমি তো আনন্দে মুহ্যমান প্রায়। সত্যি কথা বলতে কি এতখানি গর্বিত কোনো দিনই নিজেকে মনে করি নি। ফ্রান্সে আর আমেরিকায় আমার জীবনী বেরুবে যেদিন শুনলাম সেদিনও এত সার্থক মনে হয় নি আমার এই রোগজীর্ণ অশিক্ষিত জীবনকে। কাল সন্ধ্যার একটি ঘণ্টা পরিপূর্ণতায় উপচে পড়েছিল। ১১ই সেপ্টেম্বরের এই সন্ধ্যা আমার কাছে অবিস্মরণীয়।  হাসপাতালের ছককাটা দিন ধীর মন্থর গতিতে কেটে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে সকালের ঝকমকে রোদ্দুরকে দুপুরে দেবদারু গাছের পাতায় খেলা করতে দেখি।ঝিরঝির করে হাওয়া বয় সারাদিন। রাত্তিরে চাঁদের আলো এসে লুটিয়ে পড়ে বিছানায়, ডালহাউসী স্কোয়ারের অপিসে বসে কোনো দিনই অনুভব করতে পারবি না এই আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। এখন দুপুর—কিন্তু চারিদিকে এখন রাত্রির নৈঃশব্দ্য; শুধু মাঝে মাঝে মোরগের ডাক স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, এটা রাত্রি নয়—দিন। রেডিও, বই, খেলাধুলো—সময় কাটানোর অনেক উপকরণই আছে, আমার কিন্তু সবচেয়ে দেবদারু গাছে রোদের ঝিকিমিকিই ভাল লাগছে। উড়ে যাওয়া বাইরের খণ্ড খণ্ড মেঘের দিকে তাকিয়ে বাতাসকে মনে হয় খুবই উপভোগ্য। এমনি চুপ ক’রে বোধহয় অনেক যুগ অনেক শতাব্দী কাটিয়ে দেওয়া যায়। যাক, আর নয়। অসুস্থ শরীরের চিঠিতে আমার ভয়ঙ্কর উচ্ছ্বাস এসে পড়ে, কিছু মনে করিস নি। মেজদার মুখে শুনলাম —তুই নাকি প্রায়ই “স্বাধীনতা” কিনে পড়ছিস? শুনে খুব আনন্দ হল। নিয়মিত “স্বাধীনতা” রাখলে আরো খুশী হবো।… —সুকান্ত একচল্লিশ Red-aid Cure Home 10 Rawdon Street Park Street P. O. Calcutta-16 ৩।১০।৪৬ ভূপেন দারোয়ানজীকে ধন্যবাদ-ধন্যবাদ পোস্ট অফিসের কর্তৃপক্ষ আর পিওনকে। তোর ১লা তারিখের চিঠি আজ ৩রা তারিখে পেলাম। কলকাতা কি স্বাভাবিক হচ্ছে? অসুখের মধ্যে চিঠি পেতে ও চিঠি লিখতে ভালই লাগে। যদিও আমার এখন একশ’র ওপর জ্বর তবুও বেশ উপভোগ্য লাগছে এই শুয়ে শুয়ে চিঠি লেখা। তুই যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসিস নি এতে আমি খুশীই হয়েছি। আমি যখন তোকে চিঠিটা পাঠাই তখনো কলকাতার অবস্থা এত সাংঘাতিক হয় নি; খবরের কাগজও বন্ধ হয়ে যায় নি এমন অতর্কিতে। আমি তোকে ডেকেছিলাম শুধুমাত্র তোর সান্নিধ্য পেতে নয়, সদ্যমুক্ত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের বীর কালী চক্রবর্তীর সঙ্গে তোর আলাপ করিয়ে দেবার জন্যে। শিশুর মতো সরল ঐ লোকটির সঙ্গে পরিচয় তোর পক্ষে আনন্দের হ’ত। আমার সঙ্গে তো এঁর রীতিমত বন্ধুত্বই হয়ে গেছে। বাস্তবিক এইসব বীরদের প্রায় প্রত্যেকেই শিশুর মতো হাসি-খুশি, সরল, আমোদপ্রিয়। এ ছাড়াও বিখ্যাত শ্রমিক এবং কৃষক নেতারা এখানে এখন অসুস্থ অবস্থায় জড়ো হয়েছেন, তাদের সঙ্গেও তোর আলাপ করিয়ে দেবার লোভ আমার ছিল। যাই হোক, কলকাতা সুস্থ না হলে আর তোর দেখা পেতে চাই॥ ইতিমধ্য হয়তো আমিই হঠাৎ একদিন ছাড়া পাবার পর তোদের ওখানে গিয়ে হাজির হব। কিছুই বলা যায় না। বেশ কাটছে এখানে। সবাই এখানে আপন হয়ে উঠছে, ভালবাসতে আরম্ভ করেছে আমাকে। ডাক্তার রোগী সবারই আনন্দ আমার সঙ্গে রসিকতায় এক এক সময় মনে হয় বেশ আছি- শহরের রক্তাক্ত কোলাহলের বাইরে এই নির্জন, শ্যামল ছোট্ট একটু দ্বীপের মতো জায়গায় বেশ আছি। কিন্তু তবুও আমার শিকড় গজিয়ে উঠতে পারে নি, বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-সমৃদ্ধ হাতছানি সকাল সন্ধ্যায় ঝলক দিয়ে ওঠে তলোয়ারের মতো। এখন আছি বদ্ধ-দীঘির জগতে; সেখান থেকে লাফ দিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে মাছের মতো, কর্মচাঞ্চল্যময় পৃথিবীর স্রোতে। সকালের আশ্চর্য অদ্ভুত রোদ্দর কোনো কোনো দিন সারাদিন ধরে কেবলই মন্ত্রণা দেয় বেরিয়ে পড়তে; শহর-বন্দর ছাড়িয়ে অনেক দূরের গ্রামাঞ্চলের সবুজে মুখ লুকোতে দেয় অযাচিত পরামর্শ। সত্যিই অসহ্য লাগে কলকাতাকে মনের এইসব মুহূর্তে। উপন্যাসের ব্যাপারে তোর দুঃসাহসিক ধৈর্য আমাকে সত্যিই অনুপ্রাণিত করল। পুজোয় কোথায় কোথায় লিখেছি জানতে চেয়েছিস? একমাত্র পূজোসংখ্যা ‘স্বাধীনতা ও পরিচয় এবং কিশোরদের বার্ষিকী ‘শতাব্দীর লেখা’য় লেখা বেরিয়েছে জানি। তা ছাড়া এইসব কাগজ ও সংকলনে লেখা বেরুনোর কথা আছে: (১) শারদীয়া বসুমতী (২) শারদীয়া আজকাল (৩) উজ্জয়িনী—সংকলন (৪) মেঘনা সংকলন ৫) ক্রান্তি—সংকলন (৬) বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত একটি সংকলন ও (৭) পুজোয় ‘রংমশাল’। তুই কেমন আছিস কোনো চিঠিতেই তা জানাস না, তাই আর ও প্রশ্নটা করলুম না। তোদের এবারে পুজো কি রকম জমলো লিখিস। খোকন এ রকম চুপচাপ কেন? আমার মামার পদ থেকে তো তাকে পদচ্যুত করা হয় নি। বিজয়ার শুভেচ্ছা ও ভালবাসাসহ সুকান্ত . বিয়াল্লিশ রবিবার সকাল ন’টা [ ৪.১১:৪৬ ] ভূপেন, সেদিন যেমন কারো প্রভাবে বা ইঙ্গিতে প্ররোচিত না হয়েই নিজের বিবেকবুদ্ধির ওপর নির্ভর করে তোকে রাগিয়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম, আজো তেমনি বিবেকের পীড়নে এখন বাড়িতে বসে রয়েছি, যখন খোকনের ওখানে যাবার কথা। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও ক’দিন ধরে খুব ঘোরাফেরা করেছি এখানে ওখানে, যার ফলে কাল রাত্তিরে অনেকদিন পরে জ্বর এল। তাই আমাকে এখন সাবধান হতে হবে। ডাক্তারের কথামত পরিপূর্ণ বিশ্রামই আমার দরকার। তাই আবার বন্ধ করে দিলুম সুস্থ লোকের মতো ঘোরাফেরা। আশা করছি, দু’ব্যাপারেই তুই আমাকে নির্দোষ মনে করবি। —সুকান্ত তেতাল্লিশ Calcutta-11 ৪।১২।৪৬ ভূপেন, আমার রোগ এমন একটা বিশেষ সন্দেহজনক অবস্থায় পৌচেছে, যা শুনলে তুই আবার ‘চোখে বিশেষ এক ধরনের ফুল’ দেখতে পারিস। ডাক্তারের নির্দেশে সম্পূর্ণ শয্যাগত আছি। কাজেই আগামী ‘চতুর্ভুজ বৈঠক’ আমার বাড়িতে বসবে, অরুণের বাড়িতে নয়। আমি সেইমতো ব্যবস্থা করেছি। তুই শনিবার সোজা আমার বাড়িতেই আসবি। আর একটা কথা: আমি খোকনকে চিঠি দিতে ভুলে গিয়েছিলাম, রোগের ঝামেলায়; তুই দিয়েছিস তো? সুকান্ত . চুয়াল্লিশ কলকাতা এবারকার বসন্তের প্রথম দিন মঙ্গলবার ১৩৫১ মেজ বৌদি, চিঠিখানা পেয়েই মেজদা ও নতেদাকে যা যা কঁহতব্য ছিল বলেছি। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমাকে হাসতে হয়েছে—সেটা কাশী থেকে ফেরার জন্যে সংকোচ দেখে। আমার আর নতেদার নির্জনতা-প্রীতির গঙ্গাজল কখনো অপবিত্র হতে পারে না। আর, আমরা নির্জনতাপ্রিয় একথা সম্পূর্ণ মিথ্যে। সাময়িকভাবে নির্জনতা ভাল লাগলে যে চিরকালই ভাল লাগবে এমন কথা আমরা বলি না। নতেদা যে নির্জনতাপ্রিয় নয়, অধুনা নতেদার প্রাত্যহিক সান্ধ্যবৈঠকগুলোই তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। আর আমি কবি বলে নির্জনতাপ্রিয় হব, আমি কি সেই ধরনের কবি? আমি যে জনতার কবি হতে চাই, জনতা বাদ দিলে আমার চলবে কি করে? তা ছাড়া কবির চেয়ে বড় কথা আমি কমিউনিস্ট, কমিউনিস্টদের কাজ-কারবার সব জনতা নিয়েই। সুতরাং সংকোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান। সংকোচ কাটিয়ে ওঠার জন্যে নেমন্তন্নের লাল চিঠি পাঠিয়ে দিলাম। আমার কিছু নেবার আছে কিনা এ প্রশ্নের জবাবে জানাচ্ছি আমি একটি পোড়ামুখ বাঁদর চাই। কেননা ঐ জিনিসটার প্রাচুর্য কাশীতে এখনো যথেষ্ট। তা ছাড়া, স্মৃতি হিসাবেও জীবন্ত থাকবে। আর আমার সঙ্গেও মিলবে ভাল। এদিকে মেজদার চেষ্টায় বাড়ি বদল হচ্ছে। এই পরিবর্তন খুব সময়োপযোগী হয় নি, এইটুকু বলতে পারি। আশা করি শ্বেত-স্নাত নতুন বাড়ি প্রত্যেকের কাছেই ভাল লাগবে। শুনলাম আসন্ন বিচ্ছেদের ভয়ে কাশীস্থ সবাই নাকি ম্রিয়মান? হওয়া অনুচিত নয় এইটুকু বেশ বুঝতে পারি। আজকাল ভালই আছি বলা উচিত, কিন্তু একেবারে ভাল থাকা আমাকে মানায় না। তাই ঘাড়ের ওপর উদগত একটা বিষফোড়ায় কষ্ট পাচ্ছি। পড়াশুনায় হঠাৎ কয়েকদিন হল ভয়ানক ফাকি দিতে শুরু করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফাঁকিবাজ হিসাবে নাম ক্রয় করেছি। পড়াশুনা করে না হোক না করে যে ফার্স্ট হয়েছি এইটাই আমার গর্বের বিষয় হয়েছে। অস্তি বারাণসী নগরে সব ভাল তো? এখানকার সবাই, বিশেষ করে মেজদা ডবল মামলার মামলেট খাওয়া সত্ত্বেও শরীরে ও মেজাজে বেশ শরিফ। বিপক্ষের বেহুদার সুযোগ নিয়ে তাদের লবেজান করা হবে, একেবারে জেরবার না হওয়া পর্যন্ত সবাই নাছোড়বান্দা, সকলের কাছে তাদের খিল্লাৎ খুলে ভবিষ্যতের খিল বন্ধ করে দেওয়া হবেই। ফ্যা-পর্কাইকে৫৭আমার শুভেচ্ছা ও তদীয় জনক-জননীকে চিঠিতে ভরে প্রণাম পাঠিয়ে দিলাম। সাবধান হারায় না যেন। আর জুজুল, টুটুল, গোবিন্দ৫৮ (মার৫৯) বাহিনীর জন্যে তো দোরগোড়ায় ভালবাসার কামান পেতে রেখেইছি; তারা একবার এলে হয়। কাশীতে চালান করা এই আমার বোধহয় শেষ চিঠি। সুতরাং একটা দীর্ঘ ইতি। অকৃত্রিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপনান্তে স্নেহানুগত সুকান্ত পঁয়তাল্লিশ সময়োচিত নিবেদন, আগামী•••• তারিখে মদীয় পরীক্ষাৎসব সম্পন্ন হইবে। এতদুপলক্ষে মহাশয়া ১১ডি রামধন মিত্র লেনস্থিত ভবনে আগমনপূর্বক উৎসব সম্পূর্ণ করিতে সহায়তা করিবেন।৬০ বিনীত সু. ভ. বিঃ দ্রঃ লৌকিকতার পরিবর্তে তিরষ্কার প্রার্থনীয়। ছেচল্লিশ Jadabpur T. B. Hospital L. M. H. Block. Bed no-1. P. O. Jadabpur College 24 Parganas. বন্ধুবরেষু, সাতদিন কেটে গেল এখানে এসেছি। বড় একা একা ঠেকছে এখানে। সারাদিন চুপচাপ কাটাতে হয়। বিকেলের প্রতীক্ষায় থাকি, যদি কেউ আসে। সুভাষদা নিয়মিত আসছেন না, কেবল আমার জ্যাঠতুতো দাদাই নিয়মিত আসছেন। আপনি কবে আমার সঙ্গে দেখা করছেন? এখানে এলে “লেডী মেরী হার্বাট” ব্লকে আমার খোঁজ করবেন, আমার বেডের নম্বর ‘এক। শিয়ালদা দিয়ে ট্রেনে অথবা কলেজ স্ট্রীটের মোড় থেকে ৮এ বাসে করে আসতে পারেন।৬১ ৮/৪/৪৭ —সুকান্ত ভট্টাচার্য সাতচল্লিশ ৮-২ ভবানী দত্ত লেন ১২. ৫. ৪৪ প্রিয় বন্ধু, তোমাদের প্রথম চিঠি পাই নি; তারপর দুটো চিঠি পেয়েছি। অনেক চিঠি জমেছিল তাই উত্তর দিতে দেরি হল। রাগ করো না। তোমাদের কাজের বিপোর্ট খুব প্রশংসা করবার মতো। এমনি কাজ করলেই একদিন তোমরা বাংলা দেশের শ্রেষ্ঠ কিশোর বাহিনী হয়ে উঠবে। তোমরা মেম্বারের পয়সা মাথা পিছু এক আনা পাঠিয়ে দিলেই আমরা সভ্য কার্ড পাঠিয়ে দেব। তোমর এই রকম নিয়মিত চিঠি দিও। তা হলে খুব আনন্দ পাব। তোমরা জানো না তোমাদের চিঠি পেলে আমাদের কত আনন্দ হয়। তবে উত্তর দিতে একটু দেরি হবেই। তোমাদের কিশোর বাহিনী সব নিয়ম মেনে চলে তো?৬২ কিশোর অভিনন্দন সুকান্ত ভট্টাচার্য, কর্মসচিব। . আটচল্লিশ বাংলার কিশোর বাহিনী কেন্দ্রীয় অফিস ৮-২, ভবানী দত্ত লেন, কলিকাতা ৭. ১০. ৪৪ প্রিয় বন্ধু, তোমরা কী ধরনের কাজ করবে জানতে চেয়েছ তাই জানাচ্ছি, তোমরা প্রথমে নিজেদের লেখাপড়া ও আচার ব্যবহার—চরিত্রের উন্নতির দিকে নজর দেবে। নিজেদের স্বাস্থ্য ও খেলাধুলার দিকেও নজর দেবে সেই সঙ্গে। তোমরা গরীব ও অসুস্থ ছেলেদের সব সময় সাহায্য এবং সেবা করার চেষ্টা করবে, নিজের পাড়ার বা গ্রামের উন্নতির জন্য প্রাণপণ খাটবে। আর এই সমস্ত কাজ দেখিয়ে অভিভাবকদের মন জয় করার চেষ্টা করবে। কার্ড এখনও অনেক আছে। যে ক’খানা দরকার জানিও আর কার্ড পিছু এক আনা পাঠিয়ে দিও। সব সময় চিঠি পাঠাবে।৬৩ কিশোর অভিনন্দন নিও কর্মসচিব। . ঊনপঞ্চাশ ৪।৭।৪৬ প্রিয় কমরেড, আপনার অভিযোগ যথার্থ। কিন্তু মফস্বল জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞ লেখকরা কিশোর সভায় লেখা দিতে চান না; কি করব বলুন? কিশোর বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা আপাতত আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। রসিদ বই ফুরিয়ে গেছে।৬৪ অভিনন্দনসহ সুকান্ত ভট্টাচার্য
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চৈত্রদিনের গান সুকান্ত ভট্টাচার্য চৈতীরাতের হঠাৎ হাওয়া আমায় ডেকে বলে, “বনানী আজ সজীব হ’ল নতুন ফুলে ফলে৷ এখনও কি ঘুম-বিভোর? পাতায় পাতায় জানায় দোল বসন্তেরই হাওয়া৷ তোমার নবীন প্রাণে প্রাণে, কে সে আলোর জোয়ার আনে? নিরুদ্দেশের পানে আজি তোমার তরী বাওয়া; তোমার প্রাণে দোল দিয়েছে বসন্তেরই হাওয়া৷ ওঠ্ রে আজি জাগরে জাগ সন্ধ্যাকাশে উড়ায় ফাগ ঘুমের দেশের সুপ্তহীনা মেয়ে৷ তোমার সোনার রথে চ’ড়ে মুক্তি-পথের লাগাম ধ’রে ভবিষ্যতের পানে চল আলোর গান গেয়ে৷ রক্তস্রোতে তোমার দিন, চলেছে ভেসে সীমানাহীন৷ তারে তুমি মহান্ ক’রে তোল, তোমার পিছে মৃত্যুমাখা দিনগুলি ভোল॥”
সুকান্ত ভট্টাচার্য
জবাব সুকান্ত ভট্টাচার্য আশংকা নয় আসন্ন রাত্রিকে মুক্তি-মগ্ন প্রতিজ্ঞায় চারিদিকে হানবে এবার অজস্র মৃত্যুকে; জঙ্গী-জনতা ক্রমাগত সম্মুখে৷ শত্রুদল গোপনে আজ, হানো আঘাত এসেছে দিন; পতেঙ্গার রক্তপাত আনে নি ক্রোধ, স্বার্থবোধ দুর্দিনে? উষ্ণমন শাণিত হোক সঙ্গীনে৷ ক্ষিপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক তুচ্ছ প্রাণ কাস্তে ধরো, মুঠিতে এক গুচ্ছ ধান৷ মর্ম আজ বর্ম সাজ আচ্ছাদন করুক : চাই এদেশে বীর উৎপাদন৷ শ্রমিক দৃঢ় কারখানায়, কৃষক দৃঢ় মাঠে, তাই প্রতীক্ষা, ঘনায় দিন স্বপ্নহীন হাটে৷ তীব্রতর আগুন চোখে, চরণপাত নিবিড় পতেঙ্গার জবাব দেবে এদেশের জনশিবির॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দেবদারু গাছে রোদের ঝলক সুকান্ত ভট্টাচার্য দেবদারু গাছে রোদের ঝলক, হেমন্তে ঝরে পাতা, সারাদিন ধ’রে মুরগীরা ডাকে, এই নিয়ে দিন গাঁথা৷ রক্তের ঝড় বাইরে বইছে, ছোটে হিংসার ঢেউ, খবরে কাগজ জানায় সেকথা, চোখে দেখি নাকো কেউ॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পটভূমি সুকান্ত ভট্টাচার্য অজাতশত্রু, কতদিন কাল কাটলো : চিরজীবন কি আবাদ-ই ফসল ফলবে? ওগো ত্রিশঙ্কু, নামাবলী আজ সম্বল টংকারে মূঢ় স্তব্ধ বুকের রক্ত৷ কখনো সন্ধ্যা জীবনকে চায় বাঁধতে, সাদা রাতগুলো স্বপ্নের ছায়া মনে হয়, মাটির বুকেতে পরিচিত পদশব্দ, কোনো আতঙ্ক সৃষ্টি থেকেই অব্যয়৷ ভীরু একদিন চেয়েছিল দূর অতীতে রক্তের গড়া মানুষকে ভালবাসতে; তাই বলে আজ পেশাদারী কোন মৃত্যু! বিপদকে ভয়? সাম্যের পুনরুক্তি৷ সখের শপথ গলিতে কালের গর্ভে— প্রপঞ্চময় এই দুনিয়ার মুষ্ঠি, তবু দিন চাই, উপসংহারে নিঃস্ব নইলে চটুল কালের চপল দৃষ্টি৷ পঙ্গু জীবন; পিচ্ছিল ভীত আত্মা,— রাত্রির বুকে উদ্যত লাল চক্ষু; শেষ নিঃশ্বাস পড়ুক মৌন মন্ত্রে, যদি ধরিত্রী একটুও হয় রক্তিম॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পত্র সুকান্ত ভট্টাচার্য কাশী গিয়ে হু হু ক’রে কাটলো কয়েক মাস তো, কেমন আছে মেজাজ ও মন, কেমন আছে স্বাস্থ্য? বেজায় রকম ঠাণ্ডা সবাই করছে তো বরদাস্ত? খাচ্ছে সবাই সস্তা জিনিস, খাচ্ছে পাঁঠা আস্ত? সেলাই কলের কথাটুকু মেজদার দু’কান স্পর্শ ক’রে গেছে বলেই আমার অনুমান৷ ব্যবস্থাটা হবেই, করি অভয় বর দান; আশা করি, শুনে হবে উল্লসিত প্রাণ৷ এতটা কাল ঠাকুর ও ঝি লোভ সামলে আসতো, এবার বুঝি লোভের দায়ে হয় তারা বরখাস্ত৷ চারুটাও হয়ে গেছে বেজায় বেয়াড়া, মাথার ওপরে ঝোলে যা খুশির খাঁড়া৷ নতেদা’র বেড়ে গেছে অঙ্গুলি হাড়া, ঘেলুর পরীক্ষাও হয়ে গেছে সারা; এবার খরচ ক’রে কিছু রেল-ভাড়া মাতিয়ে তুলতে বলি রামধন পাড়া৷ এবার বোধহয় ছাড়তে হল কাশী, ছাড়তে হল শৈলর মা, ইন্দু ও ন’মাসি৷ দুঃখ কিসের, কেউ কি সেথায় থাকে বারোমাসই? কাশী থাকতে চাইবে তারা যারা স্বর্গবাসী, আমি কিন্তু কলকাতাতেই থাকতে ভালবাসি৷ আমার যুক্তি শুনতে গিয়ে পাচ্ছে কি খুব হাসি? লেখা বন্ধ হোক তা হলে, এবার আমি আসি॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পরিচয় সুকান্ত ভট্টাচার্য ও পাড়ার শ্যাম রায় কাছে পেলে কামড়ায় এমনি সে পালোয়ান, একদিন দুপুরে ডেকে বলে গুপুরে ‘এক্ষুনি আলো আন্’৷ কী বিপদ তা হ’লে মার খাব আমরা? দিলে পরে উত্তর রেগে বলে ‘দুত্তর, যত সব দামড়া’৷ কেঁদে বলি, শ্রীপদে বাঁচাও এ বিপদে— অক্ষম আমাদের৷ হেসে বলে শাম-দা নিয়ে আয় রামদা ধুবড়ির রামাদের॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ব্যর্থতা সুকান্ত ভট্টাচার্য আজকে হঠাৎ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হ’তে সাধ জাগে, মনে হয় তবু যদি পক্ষপাতের বালাই না নিয়ে পক্ষীরাজ, চাষার ছেলের হাতে এসে যেত হঠাৎ আজ৷ তা হলে না হয় আকাশবিহার হ’ত সফল, টুকরো মেঘেরা যেতে-যেতে ছুঁয়ে যেত কপোল; জনারণ্যে কি রাজকন্যার নেইকো ঠাঁই? কাস্তেখানাকে বাগিয়ে আজকে ভাবছি তাই৷ অসি নাই থাক, হাতে তো আমার কাস্তে আছে, চাষার ছেলের অসিকে কি ভালবাসাতে আছে? তাই আমি যেতে চাই সেখানেই যেখানে পীড়ন, যেখানে ঝলসে উঠবে কাস্তে দৃপ্ত-কিরণ৷ হে রাজকন্যা, দৈত্যপুরীতে বন্দী থেকে নিজেকে মুক্ত করতে আমায় নিয়েছ ডেকে৷ হেমন্তে পাকা ফসল সামনে, তবু দিলে ডাক; তোমাকে মুক্ত করব, আজকে ধান কাটা থাক৷ রাজপুত্রের মতন যদিও নেই কৃপাণ, তবু মনে আশা, তাই কাস্তেতে দিচ্ছি শান, হে রাজকুমারী, আমাদের ঘরে আসতে তোমার মন চাইবে তো? হবে কষ্টের সমুদ্র পার? দৈত্যশালায় পাথরের ঘর, পালঙ্ক-খাট, আমাদের শুধু পর্ণ-কুটির, ফাঁকা ক্ষেত-মাঠ; সোনার শিকল নেই, আমাদের মুক্ত আকাশ, রাজার ঝিয়ারী! এখানে নিদ্রাহীন বারো মাস৷ এখানে দিন ও রাত্রি পরিশ্রমেই কাটে সূর্য এখানে দ্রুত ওঠে, নামে দেরিতে পাটে৷ হে রাজকন্যা, চলো যাই, আজ এলাম পাশে, পক্ষীরাজের অভাবে পা দেব কোমল ঘাসে৷ হে রাজকন্যা সাড়া দাও, কেন মৌন পাষাণ? আমার সঙ্গে ক্ষেতে গিয়ে তুমি তুলবে না ধান? হে রাজকন্যা, ঘুম ভাঙলো না? সোনার কাঠি কোথা থেকে পাব, আমরা নিঃস্ব, ক্ষেতেই খাটি৷ সোনার কাঠির সোনা নেই, আছে ধানের সোনা, তাতে কি হবে না? তবে তো বৃথাই অনুশোচনা॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভবিষ্যতে সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বাধীন হবে ভারতবর্ষ থাকবে না বন্ধন, আমারা সবাই স্বরাজ-যজ্ঞে হব রে ইন্ধন! বুকের রক্ত দিব ঢালি স্বাধীনতারে, রক্ত পণে মুক্তি দের ভারত-মাতারে৷ মূর্খ যারা অজ্ঞ যারা যে জন বঞ্চিত তাদের তরে মুক্তি-সুধা করব সঞ্চিত৷ চাষী মজুর দীন দরিদ্র সবাই মোদের ভাই, একস্বরে বলব মোরা স্বাধীনতা চাই॥ থাকবে নাকো মতভেদ আর মিথ্যা সম্প্রদায় ছিন্ন হবে ভেদের গ্রন্থি কঠিন প্রতিজ্ঞায়৷ আমরা সবাই ভারতবাসী শ্রেষ্ঠ পৃথিবীর আমরা হব মুক্তিদাতা আমরা হব বীর॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভারতীয় জীবনত্রাণ-সমাজের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে শোকোচ্ছ্বাস সুকান্ত ভট্টাচার্য (শচীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য-কে) অকস্মাৎ মধ্যদিনে গান বন্ধ ক’রে দিল পাখি, ছিন্নভিন্ন সন্ধ্যাবেলা প্রাত্যহিক মিলনের রাখী; ঘরে ঘরে অনেকেই নিঃসঙ্গ একাকী৷ ক্লাব উঠে গিয়েছে সফরে, শূন্য ঘর, শূন্য মাঠ, ফুল ফোটা মালঞ্চ প’ড়ে ত্যক্ত এ ক্লাবের কক্ষে নিষ্প্রদীপ অন্ধকার নামে৷ সূর্য অস্ত গিয়েছে কখন, কারো আজ দেখা নেই— কোথাও বন্ধুর দল ছড়ায় না হাসি, নিষ্প্রভ ভোজের স্বপ্ন; একটি কথাও শব্দ তোলে না বাতাসে— ক্লাব-ঘরে ধুলো জমে, বিনা গল্পে সন্ধ্যা হয়; চাঁদ ওঠে উন্মুক্ত আকাশে৷ খেলোয়াড় খেলে নাকো, গায়কেরা গায় নাকো গান— বক্তারা বলে না কথা সাঁতারুর বন্ধ আজ স্নান৷ সর্বস্ব নিয়েছে গোরা তারা মারে ঊরুতে চাপড়, যে পথে এ ক্লাব গেছে কে জানে সে পথের খবর? সন্ধ্যার আভাস আসে, জ্বলে না আলোক ক্লাব কক্ষের কোলে, হাতে হাতে নেই সিগারেট— তর্কাতর্কি হয় নাকো বিভক্ত দু’দলে; অযথা সন্ধ্যায় কোনো অচেনার পদশব্দে মালীটি হাঁকে না৷ মনে পড়ে লেকের সে পথ? মনে পড়ে সন্ধ্যাবেলা হাওয়ার চাবুক৷ অনেক উজ্জ্বল দৃশ্য এই লেকে করেছিল উৎসাহিত বুক৷ কেরানী, বেকার, ছাত্র, অধ্যাপক, শিল্পী ও ডাক্তার সকলের কাছে ছিল অবারিত দ্বার, কাজের গহ্বর থেকে পাখিদের মতো এরা নীড় সন্ধানে, সন্ধ্যায় ডেকে এনেছিল এইখানে ভিড়৷ রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সিনেমার কথা, এদের রসনা থেকে প্রত্যহ স্খলিত হ’তে অলক্ষ্যে অযথা; মাঝে মাঝে অনর্থক উচ্ছ্বসিত হাসি, বাতাসে ছড়াত নিত্য শব্দ রাশি রাশি৷ তারপর অকস্মাৎ ভেঙে গেল রুদ্ধশ্বাস মন্ত্রমুগ্ধ সভা, সহসা চৈতন্যোদয়; প্রত্যেকের বুকে ফোটে ক্ষুব্ধ রক্তজবা; সমস্ত গানের শেষে যেন ভেঙে গেল এক গানের আসর, যেমন রাত্রির শেষে নিঃশ্বেষে কাঙাল হয় বিবাহ-বাসর৷ ‘জীবন-রক্ষক’ এই সমাজের দারুণ অভাবে, এদের ‘জীবন-রক্ষা’ হয়তো কঠিন হবে, হয়তো অনেক প্রাণ যাবে॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মার্শাল তিতোর প্রতি সুকান্ত ভট্টাচার্য কমরেড, তুমি পাঠালে ঘোষণা দেশান্তরে, কুটিরে কুটিরে প্রতিধ্বনি,— তুলেছে মুক্তি দারুণ তুফান প্রাণের ঝড়ে তুমি শক্তির অটুট খনি৷ কমরেড, আজ কিষাণ শ্রমিক তোমার পাশে তুমি যে মুক্তি রটনা করো, তারাই সৈন্য : হাজারে হাজারে এগিয়ে আসে তোমার দু’পাশে সকলে জড়ো৷ হে বন্ধু, আজ তুমি বিদ্যুৎ অন্ধকারে সে আলোয় দ্রুত পথকে চেনা : সহসা জনতা দৃপ্ত গেরিলা—অত্যাচারে, দৃঢ় শত্রুর মেটায় দেনা৷ তোমার মন্ত্র কোণে কোণে ফেরে সংগোপনে পথচারীদের ক্ষিপ্রগতি; মেতেছে জনতা মুক্তির দ্বার উদঘাটনে : —ভীরু প্রস্তাবে অসম্মতি৷ ফসলের ক্ষেতে শত্রু রক্ত-সেচন করে, মৃত্যুর ঢেউ কারখানাতে— তবুও আকাশ ভরে আচমকে আর্তস্বরে : শত্রু নিহত স্তব্ধ রাতে৷ প্রবল পাহাড়ে গোপন যুদ্ধ সঞ্চারিত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা মুখর গানে, বিপ্লবী পথে মিলেছে এবার বন্ধু তিতো : মুক্তির ফৌজ আঘাত হানে৷ শত্রু শিবিরে লাগানো আগুনে বাঁধন পোড়ে —অগ্নি ইশারা জনান্তিকে! ধ্বংসস্তূপে আজ মুক্তির পতাকা ওড়ে ভাঙার বন্যা চতুর্দিকে৷ নামে বসন্ত, পাইন বনের শাখায় শাখায় গাঢ়-সংগীত তুষারপাতে, অযুত জীবন ঘনিষ্ঠ দেহে সামনে তাকায় : মারণ-অস্ত্র সবল হাতে৷ লক্ষ জনতা রক্তে শপথ রচনা করে— ‘আমরা নই তো মৃত্যুভীত, তৈরি আমরা; যুগোশ্লাভের প্রতিটি ঘরে তুমি আছ জানি বন্ধু তিতো৷’ তোমার সেনানী পথে প্রান্তরে দোসর খোঁজে : ‘কোথায় কে আছ মুক্তিকামী?’ ক্ষিপ্ত করেছে তোমার সে ডাক আমাকেও যে তাইতো তোমার পেছনে আমি॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মেজদাকে : মুক্তির অভিনন্দন সুকান্ত ভট্টাচার্য তোমাকে দেখেছি আমি অবিচল, দৃপ্ত দুঃসময়ে ললাটে পড়ে নি রেখা ক্রূরতম সংকটেরও ভয়ে; তোমাকে দেখেছি আমি বিপদেও পরিহাস রত দেখেছি তোমার মধ্যে কোনো এক শক্তি সুসংহত৷ দুঃখ শোকে, বারবার অদৃষ্টের নিষ্ঠুর আঘাতে অনাহত, আত্মমগ্ন সমুদ্যত জয়ধ্বজা হাতে৷ শিল্প ও সাহিত্যরসে পরিপুষ্ট তোমার হৃদয় জীবনকে জানো তাই মান নাকো কোনো পরাজয়; দাক্ষিণ্যে সমৃদ্ধ মন যেন ব্যস্ত ভাগীরথী জল পথের দু’ধারে তার ছড়ায় যে দানের ফসল, পরোয়া রাখে না প্রতিদানের তা এমনি উদার, বহুবার মুখোমুখি হয়েছে সে বিশ্বাসহন্তার৷ তবুও অক্ষুণ্ণ মন, যতো হোক নিন্দা ও অখ্যাতি সহিষ্ণু হৃদয় জানে সর্বদা মানুষের জ্ঞাতি, তাইতো তোমার মুখে শুনে বাণপ্রস্থের ইঙ্গিত মনেতে বিস্ময় মানি, শেষে হবে বিরক্তির জিত? পৃথিবীকে চেয়ে দেখ, প্রশ্ন ও সংশয়ে থরো থরো, তোমার মুক্তির সঙ্গে বিশ্বের মুক্তিকে যোগ করো॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সুচিকিৎসা সুকান্ত ভট্টাচার্য বদ্যিনাথের সর্দি হল কলকাতাতে গিয়ে, আচ্ছা ক’রে জোলাপ নিল নস্যি নাকে দিয়ে। ডাক্তার এসে, বল্ল কেশে, “বড়ই কঠিন ব্যামো, এ সব কি সুচিকিৎসা ? —আরে আরে রামঃ। আমার হাতে পড়লে পড়ে ‘এক্‌সরে’ করে দেখি, রোগটা কেমন, কঠিন কিনা–আসল কিংবা মেকি। থার্মোমিটার মুখে রেখে সাবধানেতে থাকুক, আইস–ব্যাগটা মাথায় দিয়ে একটা দিন তো রাখুক। ‘ইনজেক্‌শন’ নিতে হবে ‘অক্সিজেন’টা পরে তারপরেতে দেখব এ রোগ থাকে কেমন ক’রে।” পল্লীগ্রামের বদ্যিনাথ অবাক হল ভারী, সর্দি হলেই এমনতর? ধন্য ডাক্তারী!!
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সুহৃদবরেষু সুকান্ত ভট্টাচার্য কাব্যকে জানিতে হয়, দৃষ্টিদোষে নতুবা পতিত শব্দের ঝঙ্কার শুধু যাহা ক্ষীণ জ্ঞানের অতীত। রাতকানা দেখে শুধু দিবসের আলোক প্রকাশ, তার কাছে অর্থহীন রাত্রিকার গভীর আকাশ। মানুষ কাব্যের স্রষ্টা, কাব্য কবি করে না সৃজন, কাব্যের নতুন জন্ম, যেই পথ যখনই বিজন। প্রগতির কথা শুনে হাসি মোর করুণ পর্যায় নেমে এল (স্বেচ্ছাচার বুঝি বা গর্জায়)। যখন নতুন ধারা এনে দেয় দুরন্ত প্লাবন স্বেচ্ছাচার মনে করে নেমে আসে তখনি শ্রাবণ; কাব্যের প্রগতি–রথ? (কারে কহে বুঝিতে অক্ষম, অশ্বগুলি ইচ্ছামত চরে খায়, খুঁজিতে মোক্ষম!) সুজীর্ণ প্রগতি–রথ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উইয়ের জ্বালায় সারথি–বাহন ফেলি ইতস্তত বিপথে পালায়। নতুন রথের পথে মৃতপ্রায় প্রবীণ ঘোটক, মাথা নেড়ে বুঝে, ইহা অ–রাজযোটক॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কিশোরের স্বপ্ন সুকান্ত ভট্টাচার্য রবিবার দুপুরে রিলিফ কিচেনের কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে জয়দ্রথ বাড়ি ফিরে ‘বাংলার কিশোর আন্দোলন’ বইটা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়ল, পড়তে পড়তে ক্রমশ বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে এল, আর সে ঘুমের সমুদ্রে ড়ুবে গেল। চারিদিকে বিপুল-ভীষণ অন্ধকার। সে-অন্ধকারে তার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, কিন্তু তা বেশীক্ষণ নয়, একটু পরেই জ্বলে উঠল। সহস্ৰ সহস্ৰ শিখায় এক বিরাট চিতা; আর শোনা গেল লক্ষ লক্ষ কণ্ঠের আর্তনাদ-ভয়ে জয়দ্রথের হাত পা হিম হয়ে যাবার উপক্রম হতেই সে পিছনের দিকে প্ৰাণপণে ছুটতে লাগল-অসহ্যু সে আর্তনাদ; আর সেই চিতার আগুনে তার নিজের হাত পা-ও আর একটু হলে ঝলসে যাচ্ছিল। আবার অন্ধকার। চারিদিকে মৃত্যুর মতো নিস্তব্ধতা। হঠাৎ সেই অন্ধকারে কে যেন তার পিঠে একটি শীর্ণ, শীতল হাত রাখল। জয়দ্রথ চমকে উঠল : ‘কে?’ তার সামনে দাঁড়িয়ে সারা দেহ শতচ্ছিন্ন কালো কাপড়ে ঢাকা একটি মেয়ে-মূর্তি। মেয়েটি একটু কেঁপে উঠল, তারপর ক্ষীণ, কাতর স্বরে গোঙাতে গোঙাতে বলল : আমাকে চিনতে পারছ না? তা পারবে কেন, আমার কি আর সেদিন আছে? তুমি আমার ছেলে হয়েও তাই আমার অবস্থা বুঝতে পারছ না…দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললে; আমি তোমার দেশ!… বিস্ময়ে জয় আর একটু হলে মূৰ্ছা যেত : ‘তুমি?’ –হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না? ম্লান হাসে বাংলা দেশ। –তোমার এ অবস্থা কেন? জয়ের দরদ মাখান কথায় ড়ুকরে কেঁদে উঠল বাংলা। –খেতে পাই না বাবা, খেতে পাই না… –কেন, সরকার কি তোমায় কিছু খেতে দেয় না? বাংলার এত দুঃখেও হাসি পেল : কোন দিন সে দিয়েছে খেতে? আমাকে খেতে দেওয়া তো তার ইচ্ছা নয়, চিরকাল না খাইয়েই রেখেছে আমাকে; আমি যাতে খেতে না পাই, তার বাঁধনের হাত থেকে মুক্তি না পাই, সেজন্যে সে আমার ছেলেদের মধ্যে দলাদলি বাধিয়ে তাকে টিকিয়েই রেখেছে। আজ যখন আমার এত কষ্ট, তখনও আমার উপযুক্ত ছেলেদের আমার মুখে এক ফোটা জল দেবারও ব্যবস্থা না রেখে আটকে রেখেছে-তাই সরকারের কথা জিজ্ঞাসা করে আমায় কষ্ট দিও না… জয় কিছুক্ষণ চুপ ক’রে সেই কাপড়ে ঢাকা রহস্যময়ী মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বলে : তোমার ঘোমটা-টা একটু খুলবে? তোমায় আমি দেখব। বাংলা তার ঘোমটা খুলতেই তীক্ষ্ম আর্তনাদ ক’রে উঠল জয় : উঃ, কী ভয়ঙ্কর চেহারা হয়েছে তোমার। আচ্ছা তোমার দিকে চাইবার মতো কেউ নেই দেশের মধ্যে? –না, বাবা। সুসন্তান ব’লে, আমার মুখে দুটি অন্ন দেবে ব’লে যাদের ওপর ভরসা করেছিলুম, সেই ছেলেরা আমার দিকে তাকায় না, কেবল মন্ত্রী হওয়া নিয়ে দিনরাত ঝগড়া করে, আমি যে এদিকে মরে যাচ্ছি, সেদিকে নজর নেই, চিতার ওপর বোধহয় ওরা মন্ত্রীর সিংহাসন পাতবে… –তোমাকে বাঁচাবার কোনো উপায় নেই? –আছে। তোমরা যদি সরকারের ওপর ভরসা না করে, নিজেরাই একজোট হয়ে আমাকে খাওয়াবার ভার নাও, তা হলেই আমি বাঁচব… হঠাৎ জয় ব’লে উঠল : তোমার মুখে ওগুলো কিসের দাগ? –এগুলো? কতকগুলো বিদেশী শত্রুর চর বছর খানেক ধরে লুটপাট ক’রে, রেল-লাইন তুলে, ইস্কুল-কলেজ পুড়িয়ে আমাকে খুন করবার চেষ্টা করছিল, এ তারই দাগ। তারা প্ৰথম প্ৰথম টআমার’ ভাল হবে বলে আমার নিজের ছেলেদেরও দলে টেনেছিল, কিন্তু তারা প্ৰায় সবাই তাদের ভুল বুঝেছে, তাই এখন ক্রমশ আমার ঘা শুকিয়ে আসছে। তোমরা খুব সাবধান!…এদের চিনে রাখ; আর কখনো এদের ফাঁদে পা দিও না। আমাকে খুন করতে… জয় আর একবার বাংলার দিকে ভাল ক’রে তাকায়, ঠিক যেন কলকাতার মরো মরো ভিখারীর মতো চেহারা হয়েছে। হঠাৎ পায়ের দিকে তাকিয়েই সে চীৎকার ক’রে ওঠে : এ কী? দেখে পা দিয়ে অনর্গল রক্ত পড়ছে। –তোমার এ অবস্থা কে করলে? হঠাৎ বাংলার ক্লান্ত চোখে বিদ্যুৎ খেলে গেল, বললে :-জাপান।…খিদের হাত থেকে যদিও বা বাঁচতুম, কিন্তু এর হাত থেকে বোধহয় বাঁচতে পারব না… জয় বুক ফুলিয়ে বলে : আমরা, ছোটরা থাকতে তোমার ভয় কী? ‘–পারবে? পারবে আমাকে বাঁচাতে?’ বাংলা দুর্বল হাতে জয়কে কোলে তুলে নিল। বাংলার কোলে উঠে জয় আবেগে তার গলা জড়িয়ে ধরল। –তুমি কিছু ভেব না। বড়রা কিছু না করে তো আমরা আছি। বাংলা বলে : তুমি যদি আমাকে বাচাতে চাও, তা হলে তোমায় সাহায্য করবে, তোমার পাশে এসে দাঁড়াবে, তোমার মজুর কিষাণ ভাইরা। তারা আমায় তোমার মতোই বাঁচাতে চায়, তোমার মতোই ভালবাসে। আমার কিষাণ ছেলেরা আমার মুখে দুটি অন্ন দেবার জন্যে দিনরাত কী পরিশ্রমই না করছে; আর মজুর ছেলেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আমার কাপড় যোগাবার জন্যে। জয় বলে : আর আমরা? তোমার ছোট্ট দুষ্টু ছেলেরা? বাংলা হাসল, ‘তোমরাও পাড়ায় পাড়ায় তোমাদের ছোট্ট হাত দিয়ে আমায় খাওয়াবার চেষ্টা করছ।’ জয় আনন্দে বাংলার বুকে মুখ লুকোয়। হঠাৎ আকাশ-কাঁপা ভীষণ আওয়াজ শোনা গেল। বাংলার কণ্ঠস্বরে কেমন যেন ভয় ফুটে উঠল। ‘–ঐ, ঐ তারা আসছে…সাবধান! শক্রকে ক্ষমা ক’রো না-তা হলে আমি বাঁচব না।’ জয় তার ছোট্ট দু’হাত দিয়ে বাংলাকে জড়িয়ে ধরল। কী যেন বলতে গেল সে, হঠাৎ শুনতে পেল তার দিদি তিস্তা তাকে ডাকছে : –ওরে জয়, ওঠ, ওঠ, চারটে বেজে গেছে। তোর কিশোরবাহিনীর বন্ধুরা, তোর জন্যে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। জয় চোখ মেলে দেখে ‘বাংলার কিশোর আন্দোলন’ বইটা তখনো সে শক্তি ক’রে ধরে আছে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ক্ষুধা সুকান্ত ভট্টাচার্য দুপুরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হল; আর ভঙ্গ হল কালো মিত্তিরের বহু সাধনালব্ধ ঘুম। বাইরে মোক্ষদা মাসির ক্ষুরধার কণ্ঠস্বর এক মুহুর্তে সমস্ত বস্তিকে উচ্চকিত করে তুলল, কাউকে করল বিরক্ত আর কাউকে করল। উৎকৰ্ণ; তবু সবাই বুঝল একটা কিছু ঘটেছে। মাসির গর্জন শুনে নীলু ঘোষের পাঁচ বছরের ছেলে তিনু কান্না জুড়ে দিল, আর তার মা যশোদা তাকে চুপ করাবার জন্যে ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠল এবং সন্তৰ্পণে কান পেতে রইল মাসির স্বর-সন্ধানের প্রতি। সকলের মধ্যেই একাগ্র হয়ে রইল আগ্রহ ও উত্তেজনা, কিন্তু কেউ ব্যস্ত নয়। কোনো প্ৰশ্নই কেউ করল না। করতে হয়ও না। কারণ সবাই জানে মাসি একাই একশো— এবং এই একশো জনের প্রচারবিভাগ আজ পর্যন্ত কারো প্রশ্নের প্রত্যাশা বা অপেক্ষা করে নি। মাসি এক নিঃশ্বাসে এক ঘটি জল নিঃশেষ ক’রে শুরু করল : —ঝাঁটা মারো, ঝাঁটা মারো কণ্টোরালির মুখে। মরণ হয় না রে তোদের? পয়সা দিয়ে চাল নেব, অত কথা শুনতে হবে কেন শুনি? আমরা কি তোদের খাস।তালুকের পেরাজা? আগুন লেগে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে চালের গুদোম রে। দু’মুঠো চালের জন্যে আমার মানসম্ভোম সব গেল গো! আবার টিকিট ক’রেছেন, টিকিট; বলি ও টিকিটের কী দাম আছে শুনি?-লক্ষ্মী পিসিকে সম্মুখবর্তী দেখে মাসির স্বর সপ্তমে উঠল। :-ও টিকিটে কিছু হবে না গো, কিছু হবে না। সোমাত্ত বয়েস, সুন্দর মুখ না হলে কি চাল পাবার যে আছে? আমি হেন মানুষ ভোর থেকে বসে আছি টিকিট আঁকড়ে তিন প’র বেলা পৰ্যন্ত, আর আমাকে চাল না দিয়ে চাল দিলে কিনা ও বাড়ির মায়া সুন্দরীকে। কেন? তোর সাথে কি মায়ার পিরীত চলছে নাকি? (তারপর একটা অশ্লীল মন্তব্য)।… বিনয় এতক্ষণ মাসির বাক্যঝড়কে একরকম উপেক্ষা করেই লিখে চলছিল, কিন্তু মায়ার নাম এবং সেই সঙ্গে ওর। প্ৰতি একটা ইত্যর উক্তি শুনে তার কলম তার অজ্ঞাতসারেই শ্লথ এবং মন্থর হয়ে এল। সে একটু আশ্চর্য হল। সে-আশ্চৰ্যবোধ মাসির চাল না পাওয়ার জন্যে নয়; বরং এতে সবচেয়ে আশ্চৰ্য না হওয়ারই কথা, কারণ এ একটা দৈনন্দিন ঘটনা। কিন্তু সে আশ্চৰ্য হল এই ভেবে যে, মায়া কিনা শেষ পর্যন্ত চাল আনতে গেছল। বিনয় হয়তো ভাবতে পারল চাল না পাওয়া একটা নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, কিন্তু মাসির কাছে এ একেবারে নতুন ও অপ্ৰত্যাশিত; কারণ এতদিন পর্যন্ত সে নির্বিবাদে ও নিরঙ্কুশ ভাবে চাল পেয়ে এসেছে এবং আজই তার প্রথম ব্যতিক্রম বলেই সে এতটা মৰ্মাহত। অন্যান্য দিন যারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে মাসির কাছে দুঃখ জানিয়েছে, মুখে তাদের কাছে সমবেদন জ্ঞাপন করলেও মনে মনে মাসি এদের অকৃতকাৰ্যতায় হোসেছে; কিন্তু আজ মাসি ব্যর্থতার দুঃখ অনুভব করলেও যারা তারই মতো ব্যর্থ হয়েছে তাদের প্রতি তার সহানুভূতি দূরে থাক উপরন্তু রাগ দেখা দিল। তাই লক্ষ্মী পিসির উদ্দেশ্যে সে বলল : -তুই চাল পেলি না কেন রে পোড়ারমুখী? লক্ষ্মী পিসি মাসির চেয়ে বয়সে ছোট এবং তার প্রতাপে জড়োসড়োও বটে, তাই সে জবাব দিল : কী করব, বল? মাসি দাঁত খিঁচিয়ে উঠল এবং তারপর কণ্ট্রোলের শাপান্ত এবং বাপান্ত করতে করতে দুপুরটা নষ্ট করতে উদ্যত দেখে বিনয় ঘরে তালা বন্ধ করে বেরিয়ে গেল। বিনয় এ. আর. পি. সুতরাং সকলের অবজ্ঞেয় এবং গভৰ্ণমেণ্টের পোষ্য জীব বলে উপহাসিত। প্ৰধানত সেই কারণে, আর তা ছাড়া বিনয়ের রহস্যজনক চলাফেরায় সকলে বিনয়কে এড়িয়ে চলে এবং বিনয় সকলকে এড়িয়ে যায়। কাজেই বিনয়কে বেরোতে দেখে সমবেত নারীমণ্ডলী অর্থাৎ মোক্ষদা, লক্ষ্মী, যশোদা, আশার মা, পুট, রেণু, হারু ঘোষ এবং ননী দত্তের স্ত্রী প্ৰভৃতি চঞ্চল হয়ে ঘোমটা টেনে স’রে গেল। তারপর আবার যথারীতি ক্ষুধিত, বঞ্চিত এবং উৎপীড়িত নারীদের সভা চলতে লাগল। কেউ কণ্ট্রোলের পক্ষপাতিত্ব সম্বন্ধে, কেউ সিভিকগার্ডের অত্যাচারের সম্বন্ধে, কেউ গভর্ণমেণ্টের অবিচার সম্বন্ধে উঁচু-নীচু গলায় আলোচনা করতে লাগল। মাসি এ-সভার প্রধান বক্তা, যেহেতু সে সদ্যব্যর্থ এবং সর্বাপেক্ষা আহত, সর্বোপরি তার কণ্ঠস্বরই বিশেষভাবে তীক্ষ্ণ এবং মার্জিত। ক্ৰমে আলোচনা কণ্ট্রোল থেকে মায়া-বিনয়ের সম্পর্ক এবং তা থেকে ক্রমশ চুরি-ডাকাতির উপদ্রবে পৰ্যবসিত হল দেখে যশোদা তার কোলের ছেলেটাকে ঘুম পাড়াতে ঘরে ঢুকল, আর তার পেছনে পেছনে তিনু ‘মা খেতে দিবি না?’ ‘কখন ভাত রাধবি?’ ইত্যাদি বলতে বলতে যশোদার আঁচল ধরে টানতে থাকল। আর তার ছোট ছোট মুঠির অজস্র আঘাতে মাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো; নীলু ঘোষ আজও কন্টোল থেকে চাল পায় নি, তাই ব্যর্থমনোরথ হয়ে ঘরে ফিরেছিল, কিন্তু তিমুর অবিরাম কান্না তাকে বাধ্য করল আর কোথাও চাল পাওয়া যায় কিনা সন্ধান করে দেখতে। তাই সে গামছা হাতে বেরিয়ে পড়ল দূরের কোনো কণ্ট্রোল্ড দোকানের উদ্দেশ্যে। আর ঘরের মধ্যে যশোদা ক্ষুধার্ত সন্তানের হাতে নিপীড়িত হতে লাগল। যশোদা এবং নীলু আজ দু’দিন উপবাসী। নীলু ঘোষ একটা প্রেসে কম্পোজিটরের কাজ করত, মাইনে ছিল পনেরো টাকা। যদিও একমণ চালের দাম কুড়ি টাকা, তবুও নীলু ঘোষ কণ্ট্রোল্ড দোকানের উপর নির্ভর করে চালাতে পারত, যদি চালের প্রত্যাশায় কণ্ট্রোল্ড দোকানে ধর্ণা দিয়ে পর পর কয়েক দিন দেরি ক’রে তার চাকরীটা না যেত। আজ মাসখানেক হল নীলু ঘোষের চাকরী নেই, কিন্তু এতদিন যে সে না-খেয়ে আছে এমন নয়, তবে সম্প্রতি আর চলছে না, আর সেইজন্যেই সে এবং যশোদা দু’দিন ধরে অনশনে কাটাচ্ছে। যশোদার যা কিছু গোপন সম্বল ছিল তাই দিয়ে গত দু’দিন সে তিনুর ক্ষুধাকে শান্ত করেছে আর কোলের ছেলেটাকে বঁচিয়ে রেখেছে বুকের পানীয় দিয়ে। কিন্তু আজ? আজ তার সম্বল ফুরিয়েছে, বক্ষস্থিত পানীয় নিঃশেষিত; আর নিজে সে তীব্ৰ বুভুক্ষায় শীর্ণ এবং দুর্বল। অনশন ক’রে সে নিজের প্রতিই যে শুধু অবিচার করেছে, তা নয়, অবিচার করেছে আর একজনের প্রতিসে আছে তার দেহে, সে পুষ্ট হচ্ছে তার রক্তে, সে প্ৰতীক্ষা করছে এই আলো-বাতাসময় পৃথিবীর মুক্তির। তার প্রতি যশোদার দায়িত্ব কি পালিত হল? ভয়ে এবং উৎকণ্ঠায় সে চোখ বুজিলো, কোলের শিশুটিাকে নিবিড় করে চেপে ধরল আতঙ্কিত বুকে। যশোদা ভেবে পায় না কী প্ৰয়োজন এই আসন্ন দুর্ভিক্ষের ভয়ে ভীত পৃথিবীতে একটি নতুন শিশুর জন্ম নেবার? অথচ তার আত্মপ্ৰকাশের দিন নিকটবর্তী। হারু ঘোষ নীলুর অগ্রজ এবং সে এই বাড়িতেই পৃথক ভাবে থাকে, চাকরী করে চটকলে, মাইনে পঁচিশ টাকা। নীলুর কাছে সে অবস্থাপন্ন, তাই নীলু। তাকে ঈর্ষার চোখে দেখে এবং সম্বোধন করে “বড়লোক’ বলে। দিন সাতেক আগে তিনুর কাছে ঠিক এই রকম উৎপীড়িত হয়ে যশোদা তার সঙ্গতি থেকে একসের চাল কেনবার মতো পয়সা নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়েছিল কট্রোন্ড দোকানের দিকে। এই প্ৰথম সে একাকী পথে বেরুল। লজ্জায়, সংকোচে, অনভ্যাসের জড়তায় শোচনীয় হয়ে উঠল তার অবস্থা। সে আরো সংকটাপন্ন হল যখন কোলের শিশুটি রাস্তার মাঝখানে চীৎকার ক’রে কেঁদে উঠল। তবু সে ঘোমটার অন্তরালে আত্মরক্ষা করতে করতে কণ্ট্রোল্ড দোকানে উপস্থিত হয়েছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল। সেখানে তার মতো ক্ষুধার্ত নারী একজন নয়, দু’জন নয়, শত-শত এবং ক্ষুধার তাড়নায় তাদের লজ্জা নেই, দ্বিধা নেই, আব্রু নেই, সংযম নেই, নেই কোন কিছুই; শুধু আছে ক্ষুধা আর আছে সেই ক্ষুধা নিবৃত্তির আদিম প্ৰবৃত্তি। যার কিছু নেই সেও আহাৰ্য চায়, তারো বাঁচবার অদম্য লিপ্সা। সবকিছু দেখেশুনে যশোদা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল, চেষ্টা করেছিল শিশুটাকে শান্ত করবার আর ডাকছিল সেই ভগবানকে যে-ভগবান অন্তত একসের চাল তাকে দিতে পারে। কিন্তু ঘটনাস্থলে ভগবানের বদলে উপস্থিত হল হারু ঘোষ। সে কারখানায় ধর্মঘট ক’রে বাড়ি ফিরছিল, এমন সময় পথের মধ্যে ভ্রাতৃবধূকে ঐ অবস্থায় দেখে কেমন যেন বেদনা বোধ করল। খানিকক্ষণ চুপ ক’রে থেকে যশোদার কাছে গিয়ে ডাকল : বৌমা, এসো। ঠিক এই রকম দুরবস্থার মধ্যে সহসা ভাশুরের হাতে ধরা পড়ে যশোদার অবস্থা হল অবৰ্ণনীয়। তার ইচ্ছা হল সীতার মতো ভূগর্ভে মিলিয়ে যেতে অথবা সতীর মতো দেহত্যাগ করতে। কিন্তু তা যখন হল না। তখন বাধ্য হয়ে ফিরতে হল হারু ঘোষের পেছনে পেছনে। ঘরে ফিরে হারু ঘোষ স্ত্রীর কাছ থেকে একসের চাল নিয়ে যশোদাকে দিল। বলল : নীলুকে বলো, পুরুষ মানুষ হয়ে যে বৌ-বেটাকে খেতে দিতে পারে না তার গলায় দড়ি দেওয়া উচিত। সারাদিন ঘোরাঘুরি ক’রে চাকরী অথবা চাল কোনটাই যোগাড় করতে না পেরে নীলু ঘোষ নিরাশ এবং সন্ত্রস্ত মনে বাড়ি ফিরল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে-পথে পথে নিরন্ধ অন্ধকার। স্যাঁৎসেঁতে গলিটার মধ্যে প্ৰবেশ করতেই মূৰ্তিময় আতঙ্ক যেন তাকে ঠাণ্ডা হাত দিয়ে স্পর্শ করল। নীলু ঘোষ এক মুহুর্ত থামল, কী যেন ভাবল, তারপর নিঃশব্দে অগ্রসর হল। চুপি চুপি ঘরে ঢুকে সে যা দেখল তাতে সে অবাক হল না, এবং এটাই সে আশা করেছিল। যশোদা তিনুকে ভাত খাওয়াচ্ছে। নীলু নিজের বুদ্ধিকে তারিফ করল। ভাগ্যিস সে চুপি চুপি ঘরে ঢুকেছিল, তাই এমন গোপন ব্যাপারটা সে জানতে পারল। তা হলে এই ব্যাপার? এরা জমানো চাল লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছে, আর সে কিনা সারাদিন না খেয়ে ঘুরছে? সে আড়াল থেকে অনেকক্ষণ লণ্ঠনের আলোয় যশোদার ভালমানুষের মতো মুখখানা দেখল, আর রাগে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। ইচ্ছা হল ছুটে গিয়ে একটি লাথিতে তাকে ধরাশায়ী করতে। কিন্তু সেজিঘাংসা অতি কষ্টে সে দমন করল; কারণ সে জানে, তারই একজন অদৃশ্য সন্তান যশোদার দেহকে আশ্রয় করে আছে। নীলু। ঘরে ঢুকল। নীলুকে দেখে যশোদা তিনুকে আঁচিয়ে নীলুর জন্যে জায়গা করে ভাত বাড়তে বসল। যশোদাকে ধরা পড়ে। এই ভালমানুষী করতে দেখে প্ৰচণ্ড রাগের মধ্যেও নীলুর হাসি পেল। কিন্তু তবুও সে খেতে বসল, কারণ খাওয়া তার দরকার। ভাতে হাত দিয়েই সে তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করল; এ-চাল ছিল কোথায়? যশোদা সংক্ষেপে উত্তর দিল : আজকে বিকেলে তোমার দাদা দিয়েছেন। মুহুর্তে সব ওলট-পালট হয়ে গেল নীলুর মধ্যে। কিছুক্ষণ যশোদার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করল : দিয়ে কী বললে? কতদিনের জন্যে চালটা ধার দিল সে-সম্বন্ধে কিছু বলেছে কী? অতর্কিতে যশোদার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল : না, সে সম্বন্ধে কিছু বলে নি। শুধু বলেছে, যে-পুরুষমানুষ বৌ-বেটাকে খেতে দিতে পারে না তার গলায় দড়ি দেওয়া উচিত। যে-কথাটা যশোদা এতক্ষণ ধরে বলবে না বলে ভেবে রেখেছিল সেই কথাটা অসাবধানে বলে ফেলেই সে বিপুল আশঙ্কায় নীলুর মুখের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে নীলু হুংকার দিয়ে উঠল : -কী, আমাকে যে এতবড় অপমান করল তার দেওয়া চাল তুই আমাকে খাওয়াতে বসেছিস, হতভাগী? কে বলেছিল তোকে ঐ বড়লোকের দেওয়া চাল আনতে, এ্যাঁ? তুই আমার বৌ হয়ে কিনা ওর কাছে ভিক্ষে করতে গেছিলি? হারামজাদী, খা, তোর ভিক্ষে করে আন চাল তুই খা– বলেই ভাতের থালাটা পদাঘাতে দূরে সরিয়ে নীলু ঘোষ হাত ধুয়ে ঘরে এসে যশোদাকে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে চললো : –বেরো পোড়ারমুখী, বেরো আমার ঘর থেকে, তোকে পাশে ঠাঁই দিতেও আমার ঘেন্না করে। যা, তোর পেয়ারের লোকের কাছে শুগে যা–তোর মুখ দেখতে চাই না। নীলু যশোদাকে বের করে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। আর যশোদা অত্যন্ত সাবধানে এবং নীরবে এইটুকু সহ্য করল। বারান্দায় ভিজে মাটির ওপর শুয়ে শুয়ে আকাশের অজস্র তারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যশোদার চোখ জলে ভরে এল, ঠোঁট থরথর করে কেঁপে উঠল। আর হারু ঘোষ ঘরে শুয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল; কারণ অপরাধ তো তারই, সেই তো ওদের কষ্টে ব্যথিত হয়ে এই কাণ্ডটা ঘটাল। তার পরদিনই কোথা থেকে যেন নীলু। পাঁচ সের চাল নিয়ে এল। সেই চালে ক’দিন চলার পর দু’দিন হল ফুরিয়ে গেছে, তাই দু’দিন ধরে যশোদা অনাহারে আছে। এ ক’দিন সবই হয়েছে, কেবল নীলু এবং যশোদার মধ্যে কোনো কথোপকথন হয় নি। শুধু নীলু মাঝে মাঝে চুপি চুপি তিনুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছে: হ্যাঁ রে খোকা, তোর মা ভাত খেয়েছে তো রে? অজ্ঞ তিনু খুশিমত কখনো ‘হ্যাঁ’ বলেছে, কখনো ‘না’ বলেছে। কাল নীলু পরিমিত পয়সা নিয়ে গিয়েও কণ্ট্রোল্ড দোকান থেকে বেলা হয়ে যাওয়ার জন্যে চাল না নিয়ে ফিরে এসেছিল। নীলুর ওপর যশোদার এজন্যে রাগই হয়েছিল, কিন্তু আজ মোক্ষদা মাসির কাছ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে তিনুর অজস্র মুষ্টিবৰ্ষণকে অগ্ৰাহ করে সে ভাবতে লাগল, দোষ নীলুর নয়, তার ভাগ্যের নয়, দোষ মুষ্টিমেয় লোকের, যাদের হাতে ক্ষমতা আছে অথচ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে না তাদের। এদিকে হারু ঘোষের মিলের কর্তৃপক্ষ তাদের দাবী না মানায় হারুর জীবনযাত্রাও কষ্টকর হয়েছে। তার চাল ফুরিয়ে গেছে চার পাঁচ দিন হল। রোজ এর-ওর কাছ থেকে ধার করে চলছে, তাকেও কণ্ট্রোল্ড দোকানের মুখাপেক্ষী হতে হয়েছে। আজ প্ৰভাত হবার আগে হারু এবং নীলু উভয়েই বেরিয়ে পড়েছিল, উভয়ের ঘরেই চাল নেই। উভয়েই তাই কণ্টোন্ড দোকানের লাইনের প্রথমে দাঁড়াবার জন্যে গিয়ে দেখে, তারা প্ৰতিযোগিতায় হেরে গেছে। তার আগেই বহু লোক সমবেত। কাল পর্যন্ত যা ছিল সম্বল তাই দিয়েই যশোদা তিনুকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু আজ যখন ক্ষুধার জ্বালায় তিনু মাকে মারা ছেড়ে দিয়ে মাটি খেতে শুরু করল তখন আর সহ্য হল ন যশোদার। তিনুকে কোলে নিয়ে ছুটে গেল হারু ঘোষের স্ত্রীর কাছে, গিয়ে চীৎকার করে কেঁদে উঠল : –দিদি আমার ছেলেকে বাঁচাও, দু’মুঠো চাল দিয়ে রক্ষা কর একে, তোমার তো ছেলেমেয়ে নেই, তুমি তো ইচ্ছা করলে আর একবেলা না খেয়ে থাকতে পার, কিন্তু এর শিশুরা প্ৰাণ আর সইতে পারছে না দিদি। দিদি, এর মুখের দিকে একবার তাকাও। তোমার শ্বশুরকুলের প্রদীপটিকে নিভতে দিও না। বলেই যশোদা তার দিদির পায়ে লুটিয়ে পড়ল। তিনুও তার মা’র কাণ্ড দেখে কান্না ভুলে গেল। যথেষ্ট কঠোরতা অবলম্বন করার পরও দিদির নারী সুলভ হৃদয় উদ্ধৃত্তি তণ্ডুলাংশটুকু না দিয়ে পারল না। সেইদিন রাত্রে। সমস্ত দিন হাঁটাহাঁটি করেও ভ্রাতৃদ্বয় চাল অথবা পয়সা কিছুই যোগাড় করতে না পেরে ক্ষুন্ন মনে বাড়িতে ফিরল। বাড়িতে ঢুকে নীলু ঘোষ সব চুপচাপ দেখে বারান্দায় বসে বিড়ি টানছিল, এমন সময় হারু ঘোষের প্রবেশ। বাড়িতে পদাৰ্পণ করেই এই ঘটনা শুনে ক্ষুধিত হারু ঘোষ স্ত্রীর নিবুদ্ধিতায় জ্বলে উঠল : -কে বলেছিল ওদের দয়া করতে? ওদের ছেলে মারা গেলে আমাদের কী? নিজেরাই খেতে পায় না, তায় আবার দান-খয়রাত, ওদের চাল দেওয়ার চেয়ে বেড়াল-কুকুরকে চাল দেওয়া ঢের ভাল, ওই বেইমান নেমক-হারামের বৌকে আবার চাল দেওয়া! ও আমার ভাই! ভাই না শত্তুর। চাল কি সস্তা হয়েছে, না, বেশী হয়েছে যে তুমি আমায় না বলে চাল দাও! সঙ্গে সঙ্গে হারু ঘোষের ফুলিঙ্গ নীলু ঘোষের বারুদে সঞ্চারিত হল। মুখের বিড়িটা ফেলে বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়াল নীলু ঘোষ। চকিতে ঘরের মধ্যে ঢুকে স্ত্রীর চুলের মুঠি ধরে চীৎকার করে উঠল– কী, আবার? বড্ড খিদে তোর, না? দাঁড়া তোর খিদে ঘুচিয়ে দিচ্ছি…বলেই প্ৰচণ্ড এক লাথি। বিকট আর্তনাদ করে যশোদা লুটিয়ে পড়ল। নীলু ঘোষের পায়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল হারু ঘোষ, মোক্ষদা মাসি, লক্ষ্মী পিসি, হারুর স্ত্রী, আশার মা, পুট, রেণু, কালো মিত্তির, বিনয়, মায়া ইত্যাদি সকলে। ডাক্তার, আলো, পাখা, জল, এ্যাম্বুলেন্স, টেলিফোন প্ৰভৃতি, লোকজন শব্দকোলাহল নীলুকে কেমন যেন আচ্ছন্ন এবং বিমূঢ় করে ফেলল। সে স্তব্ধ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল। যশোদাকে কখন যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল নীলুর অচৈতন্য মনের পটভূমিতে তার চিহ্ন রইল না। ঘর ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর নীলুর মন কেমন যেন শূন্যতায় ভরে গেল, আস্তে আস্তে মনে পড়ল একটু আগের ঘটনা। একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল। যশোদার পরিত্যক্ত জীর্ণ বিছানায়, যশোদার চুলের গন্ধময় বালিশটাকে আঁকড়ে ধরল সজোরে। সব চুপচাপ। শুধু তার হৃৎপিণ্ডের দ্রুততালে ধ্বনিত হতে থাকল বুভুক্ষর ছন্দ আর আসন্ন মৃত্যুর দ্রুততর পদধ্বনি। সমস্ত আশা এবং সমস্ত অবলম্বন আজ দারিদ্র্য ও অনশনের বলিষ্ঠ দুই পায়ে দলিত, নিঃশেষিত। …সুতরাং? অন্ধকারে নীলু ঘোষের দু’চোখ একবার শ্বাপদের মতো জ্বলে উঠে নিভে গেল; আকাশে শোনা গেল মৃদু গুঞ্জন-প্রহরী বিমানের নৈশ পরিক্রম। আর হারু ঘোষ? শ্ৰান্ত, অবসন্ন হারু ঘোষের মনেও দেখা দিয়েছে বিপৰ্যয়! ক্ষুধিত হারু ঘোষ অন্ধকারে নিশাচরের মতো নিঃশব্দ পদচারণায় সারা উঠোনময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। দেওয়ালে নিজের ছায়া দেখে থমকে দাঁড়ায় – তারপর আবার ঘুরতে থাকে। একে একে প্ৰত্যেক ঘরের আলো নিভে যায়, অন্ধকার নিবিড় হয়ে আসে, রাত গভীরতর হয়, তবু হারু ঘোষের পদচারণার বিরাম নেই। অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে হারু ঘোষ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সমস্ত শরীরে অনুভব করতে থাকে কিসের যেন অশরীরী আবির্ভাব। অত্যন্ত ভীত, অত্যন্ত অসহায় ভাবে তাকায় আকাশের দিকে, সেখানে লক্ষ লক্ষ চোখে আকাশ ভৎসনা জানায়-ক্ষমা নেই। হারু ঘোষ উন্মাদ হয়ে উঠল -আকাশ বলে ক্ষমা নেই, দেওয়ালের ছায়া বলে ক্ষমা নেই, তার হৃদস্পন্দন দ্রুতস্বরে ঘোষণা করতে থাকে ক্ষমা নেই। তার কানে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ স্বরে ধ্বনিত হতে থাকে-ক্ষমা নেই।… ভোরের দিকে মোক্ষদা মাসি ফিরে এল হাসপাতাল থেকে। অত্যন্ত সন্তৰ্পণে ফিস ফিস করে হারু ঘোষ জিজ্ঞাসা করল— কী খবর? মোক্ষদা মাসির মতো মুখরাও মূক, মুহ্যমান–দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে জানালে, বেঁচে নেই। তারপর ধীরে ধীরে চলে গেল তার ঘরের দিকে। হারু ঘোষের সারা দেহে চাবুকের মতো চমকে উঠল আর্তনাদ; শরীর-মন এক সঙ্গে টলে উঠল, সমস্ত চেতনার ওপর দিয়ে বয়ে গেল অগ্নিময় প্লাবন। রাত শেষ হতে আর বেশী দেরী নেই। পাণ্ডুর আকাশের দিকে তাকিয়ে হারু ঘোষ নিজেও এবার অনুভব করল : ক্ষমা নেই। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই বিনয় সবিস্ময়ে চেয়ে দেখে, মায়া অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে তাকে ডাকছে। বেশ বেলা যে হয়ে গেছে চারিদিকের তীব্র রোদ্দুর তারই বিজ্ঞাপন। কালকের দুর্ঘটনার জন্যে তার ঘুম আসতে বেশ দেরী হয়েছিল, সুতরাং বেলায় যে ঘুম ভাঙবে এটা জানা কথা, কিন্তু সেজন্যে মায়ার এত ব্যস্ত হবার কোন কারণ নেই; তবু একটা ‘কারণ’ মনে মনে সন্দেহ করে বিনয় পুলকিত হল। মৃদু হেসে বলল : দাঁড়াও, উঠছি—তুমি যে একেবারে ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে এসেছি দেখছি। -উঃ, কী কুঁড়ে আপনি, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না দেখছি, এদিকে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেছে তা তো জানেন না– বিনয় কৃত্রিম গাম্ভীৰ্য ও বিস্ময়ের ভান করে বলল : বটে? কী রকম? মায়া এক নিঃশ্বাসে বলে গেল : যশোদা কাকীমা কাল রাত্তিরে হাসপাতালে মারা গেছে, আর আজ সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখে, হারু কাকা, নীলু কাকা গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। প্ৰচণ্ড বিস্ময়ের বিদ্যুৎ-তাড়নায় বিনয় এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল : এ্যা। বল কি? তারপর দ্রুত হাতে এ. আর. পি.-র নীল কোর্তাটা গায়ে চড়িয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। অগণিত কৌতূহলী জনতা উঠোন-বারান্দা ভরিয়ে তুলেছে। পুলিশ, জমাদার, ইন্সস্পেক্টরের অপ্ৰতিহত প্ৰতাপ। তারই মধ্যে দিয়ে বিনয় চেয়ে দেখল, হারু ঘোষ বারান্দায় আর নীলু ঘোষ ঘরে দারিদ্র্য ও বুভুক্ষকে চিরকালের মতো ব্যঙ্গ করে বীভৎসভাবে ঝুলছে, যেন জিভ ভেঙচাচ্ছে আসন্ন দুৰ্ভিক্ষকে। বিপুল জনতা আর ঐ অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে বিনয় বস্তি ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল, আপন মনে পথ চলতে শুরু করল, ভাবতে লাগল; দুৰ্ভিক্ষ যে লেগেছে তার সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃষ্টান্ত কি এই নয়? আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরের লাভার মতোই তলে তলে উত্তপ্ত হচ্ছে দুৰ্ভিক্ষ, প্ৰতীক্ষা করছে বিপুল বিস্ফোরণের; সেই অনিবাৰ্য অণুৎপাতের সূচনা দেখা গেল কাল রাত্রে। অথচ প্রত্যেকে গোপন করে চলেছে সেই অগ্নি-উদগীরণের প্রকম্পনকে আর তার সম্ভাবনাকে। আস্তে আস্তে ধ্বসে যাচ্ছে জীবনের ভিত্তি, ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে ক্ষুধার নগ্নরূপ। তবু অদ্ভুত ধৈৰ্য মানুষের; সমাজকে সভ্যতাকে বাঁচাবার চেষ্টাও প্ৰশংসনীয়। বিনয় এক সময়ে এসে দাঁড়াল পাড়ার কণ্ট্রোল্ড দোকানের সামনে। অন্যমনস্কতা ভেঙে গেল তার; দেখল, মোক্ষদা মাসি, লক্ষ্মী পিসি, মায়া সবাই সেখানে লাইনবন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে। বিনয় বিস্মিত হল। আর একটু আগে মোক্ষদা মাসিকে সে শোক করতে দেখে এসেছিল, অথচ নিয়তির মতো ক্ষুধা সুযোগ পর্যন্ত দিল না পরিপূর্ণ শোক করবার। মায়ার সঙ্গে চোখাচৌখি হতে লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল সে। অদ্ভূত ক্ষুধার মাহাত্ম্য! বিনয় ভাবতে থাকল : ক্ষুধা শোক মানে না, প্ৰেম মানে না, মানে না পৃথিবীর যে-কোন বিপর্যয়, সে আদিম, সে অনশ্বর। লাইনবন্দী প্ৰত্যেকে প্ৰতীক্ষা করছে চালের জন্যে। বিনয় ভাবল, এ-প্ৰতীক্ষা চালের জন্যে, না বিপ্লবের জন্যে? বিনয় স্পষ্ট অনুভর করল এরা বিপ্লবকে পরিপুষ্ট করছে, অনিবাৰ্য করে তুলছে প্ৰতিদিনকার ধৈর্যের মধ্যে দিয়ে। আর এদের অপরিতৃপ্ত ক্ষুধা করছে তারই পূর্ণ আয়োজন। এরা একত্ৰ, অথচ এক নয়; এরা প্ৰতীক্ষ্ণমান, তবু সচেষ্ট নয়, এরা চাইছে এতটুকু চেতনার আগুন— এদের মধ্যে আত্মগোপনকারী, ছদ্মবেশী ক্রমবর্ধমান ক্ষুধাকে প্ৰত্যক্ষ করে বিনয় এদের সংহত, সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত করে সেই আগুন জ্বালার প্রতিজ্ঞা নিল।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দরদী কিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য দোতলার ঘরে পড়ার সময় শতদ্রু আজকাল অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। জানলা দিয়ে সে দেখতে পায় তাদের বাড়ির সামনের বস্তিটার জন্যে যে নতুন কট্রোলের দোকান হয়েছে, সেখানে নিদারুণ ভৗড়, আর চালের জন্যে মারামারি কাটাকাটি। মাঝে মাঝে রক্তপাত আর মূৰ্ছিত হওয়ার খবরও পাওয়া যায়। সেইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সে স্কুলের পড়া ভুলে যায়, অন্যায় অত্যাচার দেখে তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে, তবু সে নিরুপায়, বাড়ির কঠোর শাসন আর সতর্ক দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে কিছু করা অসম্ভব। যারা চাল না পেয়ে ফিরে যায় তাদের হতাশায় অন্ধকার মুখ তাকে যেন চাবুক মারে, এদের দুঃখ মোচনের জন্য কিছু করতে শতদ্রু উৎসুক হয়ে ওঠে, চঞ্চল হয়ে ওঠে। মনেপ্ৰাণে। তারই সহপাঠী শিবুকে সে পড়া ফেলে প্ৰতিদিন চালের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দ্যাখে। বেচারার আর স্কুলে যাওয়া হয় না, কোনো কোনো দিন চাল না। পেয়েই বাড়ি ফেরে, আর বৃদ্ধ বাপের গালিগালাজ শোনে, আবার মাঝে মাঝে মারও খায়। ওর জন্যে শতদ্রুর কষ্ট হয়। অবশেষে ঐ বস্তিটার কষ্ট ঘোচাতে শতদ্রু একদিন কৃতসংকল্প হল। কিছুদিনের মধ্যেই শতদ্রুর সহপাঠীরা জানতে পারল শতদ্রুর পরিবর্তন হয়েছে। সে নিয়মিত খেলার মাঠে আসে না, কারুর কাছে এ্যাডভেঞ্চারের বই ধার চায় না, এমন কী ‘হাফ-হলি-ডে’তে ‘ম্যাটিনি শো’-এ সিনেমায় পৰ্যন্ত যায় না। একজন ছেলে, শতদ্রু দল ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে, তলে তলে খোঁজ নিয়ে জানলে শতদ্রু কী এক ‘কিশোর-বাহিনী’ গ’ড়ে তুলেছে। তারা প্ৰথমে খুব একচোট হাসল, তারপর শতদ্রুকে পেয়েই অনবরত খ্যাপাতে শুরু করল। কিন্তু শতদ্রু আজকাল গ্ৰাহ করে না, সে চুপি চুপি তার কাজ করে যেতে লাগল। বাস্তবিক, আজকাল তার মন থেকে এ্যাডভেঞ্চারের, ক্লাবের আর সিনেমার নেশা মুছে গেছে। সে আজকাল বড় হবার স্বপ্ন দেখছে। তা ছাড়া সবচেয়ে গোপন কথা, সে একজন কমু্যনিস্টের সঙ্গে মিশে অনেক কিছুই জানতে পারছে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে একটা কিশোর-বাহিনীর ভলান্টিয়ার দল গ’ড়ে, বাড়ির সতর্ক দৃষ্টিকে ফাকি দিয়ে কাজ করতে লাগল। প্ৰতি মুহুর্তে ধরা পড়ার আশঙ্কা তাকে নিরস্ত করতে পারল না, বরং সে গোপনে কাজ করতে করতে অনুভব করল, সে-ও তো একজন দেশকমী। শতদ্রু ভবিষ্যৎ নেতা হবার স্বপ্নে রাঙিয়ে উঠল আর সে খুঁজতে লাগল। কঠিন কাজ, আরো কঠিন কাজ, তার যোগ্যতা সম্বন্ধে সে নিঃসন্দেহ। সে আজকাল আর আগের কালের ‘শতু’ নয়, সে এখন ‘কমরেড শতদ্রু রায়’। রুশ-কিশোরদের আত্মত্যাগ আর বীরত্ব শতদ্রুকে অস্থির ক’রে তোলে; সে মুখে কিছু বলে না বটে। কিন্তু মনে মনে পাগলের মতো খুঁজতে লাগল একটা কঠিন কাজ, একটা আত্মত্যাগের সুবর্ণ সুযোগ। অবশেষে সে আত্মত্যাগ করল, কিন্তু ফল হল মারাত্মক। শতদ্রুর কাছ থেকে খবর পেয়ে ভলান্টিয়াররা শতদ্রুদের বাড়িতে উপস্থিত হল। শতদ্রুর বাবা অফিস যাবার আগে খবরের কাগজে শেয়ার মার্কেটের খবর দেখছিলেন, একপাল ছেলেকে ঢুকতে দেখে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। —আমরা ‘কিশোর-বাহিনী’র ভলান্টিয়ার। আপনার ছেলের মুখে শুনলাম আপনি নাকি ষাট মণ চাল বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন, সেগুলো বস্তির জন্য দিতে হবে। আমরা অবিশ্যি আধা দরে আপনার চাল বিক্রি করে ষাট মণের দাম দিয়ে দেব। আর তাতে রাজী না হলে আমরা পুলিশের সাহায্য নিতে ভ হব না। -আমার ছেলে, এ খবর দিয়েছে, না? -আজ্ঞে, হ্যাঁ। -আচ্ছা, নিয়ে যাও। ছেলেরা হৈ হৈ করতে করতে চাল বের করে আনল। তারা লক্ষ্য করল না, শতদ্রুর বাবার কী জ্বলন্ত চোখ। শতদ্রুর বাবা সেদিন অফিস না গিয়ে পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। সেইদিন দুপুরে একটা আর্ত-চিৎকার ভেসে এল বস্তির লোকদের কানে। তারা বুঝল না কিসের আর্তনাদ। বুঝতে পারলে হয়তো সমবেদনায় ব্যথিত হত, কিন্তু তারা সদ্য পাওয়া চাল নিয়েই ব্যস্ত রইল। বহুক্ষণ ধরে অমানুষিক অত্যাচারের পর, শতদ্রুকে তার পড়ার ঘরে তালা বন্ধ করে রাখা হল। কিন্তু শতদ্রু এতে এতটুকু দুঃখিত নয়, এতটুকু অনুশোচনা জাগল না তার মনে। সে ভাবল : এতো তুচ্ছ, এতো সামান্য নিপীড়ন, রুশিয়ার বীরদের অথবা কায়ুর কমরেডদের তুলনায় তার আত্মত্যাগ এমন কিছু নয়। তবু একটা কিছু করার আনন্দে সে শিউরে উঠল, আর এই কান্নায় তার মন পবিত্ৰ শুচিস্নিগ্ধ হল। জানাল দিয়ে সে চেয়ে দেখল যে-বাড়িতে আজ দুদিন উনুনে আগুন পড়েনি সেখান থেকে উঠছে ধোঁয়া; বহুদিন পরে শিবু স্কুল থেকে ফিরছে, আর কণ্ট্রোলের দোকানের লাইনে দেখা যাচ্ছে অদ্ভুত শৃঙ্খলা। কোথাও চাল না-পাওয়ার খবর নেই। সকলের মুখেই হাসি-যেন শতদ্রুর প্রতি অকৃপণ আশীৰ্বাদ। একটু পরে কান্নার বদলে শতদ্রুর কণ্ঠে গুনগুন করে উঠল ‘কিশোর-বাহিনী’র গান।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দুর্বোধ্য সুকান্ত ভট্টাচার্য সহর ছাড়িয়ে যে-রাস্তাটা রেল-স্টেশনের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তার উপরে একটা তেঁতুল গাছের তলায় লোকটিকে প্ৰতিদিন একভাবে দেখা যায়- যেমন দেখা যেতে পাঁচ বছর আগেও। কোনো বিপর্যয়ই লোকটিকে স্থানচ্যুত করতে পারে নি— যতদূর জানা যায়। এই স্থাণু বৃদ্ধ লোকটি অন্ধ, ভিক্ষাবৃত্তি তার একমাত্র জীবিকা। তার সামনে মেলা থাকে একটা কাপড়, যে কাপড়ে কিছু না কিছু মিলতই এতকাল- যদিও এখন কিছু মেলে না। লোকটি অন্ধ, সুতরাং যে তাকে এই জায়গাটা বেছে দিয়েছিল তার কৃতিত্ব প্ৰশংসনীয়, যেহেতু এখানে জন-সমাগম হয় খুব বেশী এবং তা রেল-স্টেশনের জন্যেই। সমস্ত দিনরাত এখানে লোক-চলাচলের বিরাম নেই, আর বিরাম নেই লোকের কথা বলার। এই কথা বলা যেন জনস্রোতের বিপুল কল্লোলধ্বনি, আর সেই ধ্বনি এসে আছড়ে পড়ে অন্ধের কানের পর্দায়। লোকটি উন্মুখ হয়ে থাকে-কিছু মিলুক আর নাই মিলুক, এই কথাশোনাই তার লাভ। নিস্তব্ধতা তার কাছে ক্ষুধার চেয়েও যন্ত্রণাময়। লোকটি সারাদিন চুপ করে বসে থাকে মূৰ্তিমান ধৈর্যের মতো। চিৎকার করে না, অনুযোগ করে না, উৎপীড়িত করে না কাউকে। প্ৰথম প্ৰথম, সেই বহুদিন আগে, লোকে তার নীরবতায় মুগ্ধ হয়ে অনেক কিছু দিত। সন্ধ্যাবেলায় অর্থাৎ যখন তার কাছে সূর্যের তাপ আর লোকজনের কথাবার্তার অস্তিত্ব থাকত না, তখন সে বিপুল কৌতূহল আর আবেগের সঙ্গে কাপড় হাতড়ে অনুভব করত চাল, পয়সা, তরকারী…। তৃপ্তিতে তার অন্ধ দু’চোখ অন্ধকারে জ্বল জ্বল করে উঠত। তারপরে সেই অন্ধকারেই একটা নরম হাত এসে তার শীর্ণ হাতটাকে চেপে ধারত- যে-হাত আনতো অনেক আশ্বাস আর অনেক রোমাঞ্চ। বৃদ্ধ তার উপার্জন গুছিয়ে নিয়ে সেই নরম হাতে আত্মসমৰ্পণ করে ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যেত। তারপর ভোর হবার আগেই সেই হাতেই ভর করে গাছের তলায় এসে বসত। এমনি করে কেটেছে পাঁচ বছর। কিন্তু দুৰ্ভিক্ষ এল অবশেষে। লোকের আলাপ-আলোচনা আর তার মেলে-ধরা কাপড়ের শূন্যতা বৃদ্ধকে সে-খবর পৌঁছে দিল যথা সময়ে। –কুড়ি টাকা মণ দরেও যদি কেউ আমাকে চাল দেয় তো আমি এক্ষুণি নগদ কিনতে রাজি আছি পাঁচ মণ—বুঝলে হে– উত্তরে আর একটি লোক কি বলে তা শোনা যায় না, কারণ তারা এগিয়ে যায় অনেক দূর… –আরে ভাবতিছ কী ভজহরি, এবার আর বৌ-বেটা নিয়ে বাঁচতি অবে না— –তা যা বলিছ নীলমণি… বৃদ্ধ উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু আর কিছু শোনা যায় না। শুধু একটা প্রশ্ন তার মন জুড়ে ছটফট করতে থাকে-কেন, কেন? বৃদ্ধের ইচ্ছা করে একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতে-কেন চালের মণ তিরিশ টাকা, কেন যাবে না বাঁচা-কিন্তু তার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? কে এই অন্ধ বৃদ্ধকে বোঝাবে পৃথিবীর জটিল পরিস্থিতি? শুধু বৃদ্ধের মনকে ঘিরে নেমে আসে আশংকার কালে ছায়া। আর দুর্দিনের দুর্বোধ্যতায় সে উন্মাদ হয়ে ওঠে দিনের পর দিন। অজন্ম নয়- প্লাবন নয়।–তবু দুর্দিন, তবু দুৰ্ভিক্ষ? শিশুর মতো সে অবুঝ হয়ে ওঠে; জানতে চায় না-কেন দুর্দিন, কেন দুৰ্ভিক্ষ—শুধু সে চায় ক্ষুধার আহাৰ্য। কিন্তু দিনের শেষে যখন কাপড় হাতড়ে সে শুকনো গাছের পাতা ছাড়া আর কিছুই পায় না, তখন সারাদিনের নিস্তব্ধতা ভেঙে তার আহত অবরুদ্ধ মন বিপুল বিক্ষোভে চিৎকার করে উঠতে চায়, কিন্তু কণ্ঠস্বরে সে-শক্তি কোথায়? খানিক পরে সেই নরম হাতে তার অবসন্ন শিথিল হাত নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তুলে দেয়। আর ক্রমশ অন্ধকার তাদের গ্রাস করে। একদিন বৃদ্ধের কানে এল; ফেণীতে যে আবার বোমা পড়ছে, ত্ৰিলোচন– উত্তরে আর একটি লোকের গলা শোনা যায়; বল কী হে, ভাবনার কথা– দ্বিতীয় ব্যক্তির দুশ্চিন্তা দেখা দিলেও অন্ধ বৃদ্ধের মনে কোনো চাঞ্চল্য দেখা দিল না। তার কারণ সে নিৰ্ভীক নয়, সে অজ্ঞ। কিন্তু সে যখন শুনল : –ঘনশ্যামের বৌ চাল কিনতে গিয়ে চাল না পেয়ে জলে ড়ুবে মরেছে, সে-খবর শুনেছি শচীকান্ত? তখন শচীকান্তের চেয়ে বিস্মিত হল সে। শূন্য কাপড় হাতড়ে হাতড়ে দুর্দিনকে মর্মে মৰ্মে অনুভব করে বৃদ্ধ, আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে অনেক বেশী ক্লান্ত করে তোলে; প্ৰতিদিন। তারপর একদিন দেখা গেল বৃদ্ধ তার নীরবতা ভঙ্গ করে ক্ষীণকাতর স্বরে চিৎকার করে ভিক্ষা চাইছে আর সেই চিৎকার আসছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে; সেই চিৎকারে বিরক্ত হয়ে কেউ কিছু দিল, আর কেউ বলে গেল : –নিজেরাই খেতে পাই না, ভিক্ষে দেব কী করে? একজন বলল : আমরা পয়সা দিয়ে চাল পাই না, আর তুমি বিনি পয়সায় চাল চাইছ? বেশ জোচ্চুরি ব্যবসা জুড়েছ, বাবা। আবার কেউ বলে গেল : চাইছ। একটা পয়সা, কিন্তু মনে মনে জানো এক পয়সা মিলবে না, কাজেই ডবল পয়সা দেবে, বেশ চালাক যা হোক। এইসব কথা শুনতে শুনতে সেদিন কিছু পয়সা পাওয়া গেল এবং অনেকদিন পর এই রোজগার তার মনে ভরসা আর আনন্দ এনে দিল। কিন্তু অনেক রাত পৰ্যন্ত প্ৰতীক্ষার পরও সেইদিন আর সেই কোমল হাত তার হাতে ধরা দিল না। দুর্ভাবনায় আর উৎকণ্ঠায় বহু সময় কাটার পর অবশেষে সে ঘুমিয়ে পড়ল। মাঝে মাঝে চমকে উঠে সে হাতড়াতে লাগল, আর খুঁজতে লাগল একটা কোমল নির্ভরযোগ্য হাত। আস্তে আস্তে একটা আতঙ্ক দেখা দিলঅপরিসীম বেদনা ছড়িয়ে পড়ল তার মনের ফসলকাটা মাঠে। বহুদিন পরে দেখা দিল তার অন্ধতাজনিত অক্ষমতার জন্যে অনুশোচনা। রোরুদ্যমান মনে কেবল একটা প্রশ্ন থেকে থেকে জ্বলে উঠতে লাগল : পাঁচ বছর আগে যে এইখানে এনে বসিয়েছে পাঁচ বছর পরে এমন কী কারণ ঘটেছে যার জন্যে সে এখান থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে না?–তার অনেক প্রশ্নের মতোই এ প্রশ্নের জবাব মেলে না। শুধু থেকে থেকে ক্ষুধার। যন্ত্রণা তাকে অস্থির করে তোলে। তারপর আরো দুদিন কেটে গেল। চিৎকার করে ভিক্ষা চাইবার ক্ষমতা আর নেই, তাই সেই পয়সাগুলো আঁকরে ধ’রে সে ধুকতে থাকল। আর দু-চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ফোটা ফোটা জল। দু-হাতে পেট চেপে ধ’রে তার সেই গোঙানী, কারো কানে পৌছুলো না। কারণ কারুর কাছেই এ দৃশ্য নতুন নয়। আর ভিখারীকে করুণা করাও তাদের কাছে অসম্ভব। যেহেতু দুৰ্ভিক্ষ কত গভীর, আর কত ব্যাপক! বিকেলের দিকে যখন সে নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল অবসন্ন হয়ে, তখন একটা মিলিত আওয়াজ তার দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল; ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হল। তার অতি কাছে হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত হতে লাগল। : অন্ন চাই-বস্ত্ৰ চাই…। হাজার হাজার মিলিত পদধ্বনি আর উন্মত্ত আওয়াজ তার অবসন্ন প্ৰাণে রোমাঞ্চ আনলঅদ্ভুত উন্মাদনায় সে কেঁপে উঠল থর্‌থর্‌ করে। লোকের কথাবার্তায় বুঝল : তারা চলেছে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে চাল আনতে। অন্ধ বিস্মিত হ’ল—তারই প্ৰাণের কথা হাজার হাজার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে–তারই নিঃশব্দ চিৎকার এদের চিৎকারে মূর্ত হচ্ছে! তা হলে এত লোক, প্ৰত্যেকেই তার মতো ক্ষুধার্ত, উপবাসখিন্ন? একটা অজ্ঞাত আবেগ তার সারাদেহে বিদ্যুতের মতো চলাফেরা করতে লাগল, সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। এত লোক, প্ৰত্যেকের ক্ষুধার যন্ত্রণা সে প্ৰাণ দিয়ে অনুভব করতে লাগল, তাই অবশেষে সে বিপুল উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সে পারল না, কেবল একবার মাত্র তাদের সঙ্গে “অন্ন-চাই” বলেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সেই রাত্রে একটা নরম হাত বৃদ্ধের শীতল হাতকে চেপে ধরল; আর সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে সে তার কেঁচড়ে ভরা চাল দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভদ্ৰলোক সুকান্ত ভট্টাচার্য “শিয়ালদা–জোড়-মন্দির–শিয়ালদা” তীব্র কণ্ঠে বার কয়েক চিৎকার করেই সুরেন ঘণ্টি দিল ‘ঠন্‌ ঠন্‌’ করে। বাইরে এবং ভেতরে, ঝুলন্ত এবং অনন্ত যাত্রী নিয়ে বাসখানা সুরেনের ‘যা-ওঃ, ঠিক হ্যায়’ চিৎকার শুনেই অনিচ্ছক ও অসুস্থা নারীর মতো গোঙাতে গোঙাতে অগ্রসর হল। একটানা অস্বস্তিকর আওয়াজ ছড়াতে লাগল উঁ-উঁ-উঁ-উঁ-উঁ-উঁ-উঁ। “টিকিট, বাবু, টিকিট আপনাদের”—অপরূপ কৌশলের সঙ্গে সেই নিশ্চিছদ্র ভিড়ের মধ্যে দিয়ে সুরেন প্ৰত্যেকের পয়সা আদায় করে বেড়াতে লাগল। আগে ভিড় তার পছন্দ হ’ত না, পছন্দ হ’ত না অনর্থক খিটির-মিটির আর গালাগালি। কিন্তু ড্রাইভারের ক্রমাগত প্ররোচনায় আর কমিশনের লোভে আজকাল সে ভিড় বাড়াতে ‘লেট’-এরও পরোয়া করে না। কেমন যেন নেশা লেগে গেছে তার : পয়সা— আরো পয়সা; একটি লোককে, একটি মালকেও সে ছাড়বে না বিনা পয়সায়। অথচ দু’মাস আগেও সুরেন ছিল সামান্য লেখাপড়া-জানা ভদ্রলোকের ছেলে। দু’মাস আগেও সে বাসে চড়েছে কন্‌ডাকটার হয়ে নয়, যাত্রী হয়ে। দু’মাসে সে বদলে গেছে। খাকির জামার নীচে ঢাকা পড়ে গেছে ভদ্রলোকের চেহারাটা। বাংলার বদলে হিন্দী বুলিতে হয়েছে অভ্যস্ত। হাতের রিস্টওয়াচটাকে তবুও সে ভদ্রলোকের নিদর্শন হিসাবে মনে করে; তাই ওটা নিয়ে তার একটু গৰ্বই আছে। যদিও কন্‌ডাকটারী তার সয়ে গেছে, তবুও সে নিজেকে মজুর বলে ভাবতে পারে না। ঘামে ভেজা খাকির জামাটার মতোই অস্বস্তিকর ঐ ‘মজুর’ শব্দটা। —এই কন্‌ডাকটার, বাঁধো, বাঁধো। একটা অতিব্যস্ত প্যাসেঞ্জার উঠে দাঁড়াল। তবুও সুরেন নির্বিকার। বাস ‘স্টপেজ’ ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। লোকটি খাপ্পা হয়ে উঠল : কী শুনতে পাওনা না কি তুমি? সুরেনও চোখ পাকিয়ে বলল : আপনি ‘তুমি’ বলছেন কাকে? —তুমি বলব না তো কি ‘হুজুর’ বলব? লোকটি রাগে গজগজ করতে করতে রাস্তায় লাফিয়ে পড়ল। প্যাসেঞ্জারদেরও কেউ কেউ মন্তব্য করল : কন্‌ডাকটাররাও আজকাল ভদরলোক হয়েছে, কালে কালে কতই হবে। একটি পান-খেকো লুঙ্গিপরা লোক, বোধহয় পকেটমার, হেসে কথাটা সমর্থন করল। বলল : মার না খেলে ঠিক থাকে না শালারা, শালাদের দেমাক হয়েছে আজকাল। আগুন জ্বলে উঠল সুরেনের চোখে। নাঃ, একদিন নিৰ্ঘাৎ মারামারি হবে।…একটা প্যাসেঞ্জার নেমে গেল। ধাঁই-ধাঁই বাসের গায়ে দু’তিনটে চাপড় মেরে চেঁচিয়ে উঠল সুরেন; যা-ওঃ। রাগে গরগর করতে করতে সুরেন ভাবল : ওঃ, যদি মামা তাকে না তাড়িয়ে দিত বাড়ি থেকে। …তা হলে কি আর…কি এমন আর অপরাধ করেছিল সে। ভাড়াটেদের মেয়ে গৌরীর সঙ্গে প্ৰেম করা কি গো-মাংস খাওয়ার মতো অপরাধ? উনিশ বছর বয়সে থার্ড ক্লাশে উঠে প্ৰেম করে না কোন মহাপুরুষ? -এই শালা শুয়ার কি বাচ্চা, ড্রাইভারের সঙ্গে সুরেনও চেঁচিয়ে উঠল। একটুকুর জন্যে চাপা পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল লোকটা। আবার ঘন্টি দিয়ে সুরেন চেঁচিয়ে উঠল : যা-ও, ঠিক হ্যায়। লোকটার ভাগ্যের তারিফ করতে লাগল সমস্ত প্যাসেঞ্জার। সুরেনকে কিছুতেই মদ খাওয়াতে পারল না রামচরণ ড্রাইভার। সুরেন বোধহয় এখনো আবার ভদ্রলোক হবার আশা রাখে। এখনো তার কাছে কুৎসিত মনে হয় রামচরণদের ইঙ্গিতগুলো। বিশেষ করে বীভৎস লাগে রাত্ৰিবেলার অনুরোধ। ওরা কত করে গুণ ব্যাখ্যা করে মদের : মাইরি মাল না টানলে কি দিনভোর এমন গাড়ি টানা যায়? তুই খেয়ে দেখ, দেখবি সারাদিন কত ফুর্তিতে কাজ করতে পারবি। তাই নয়? কি বল গো পাঁড়েজী? পাঁড়েজী ড্রাইভার মাথা নেড়ে রামচরণের কথা সমর্থন করে। অনুরোধ ক’রে ক’রে নিষ্ফল হয়ে শেষে রামচরণ রুখে উঠে ভেঙচি কেটে বলে : এঃ শালা আমার গুরু-ঠাকুর এয়েছেন। সুরেন মৃদু হেসে সিগারেট বার করে। যথারীতি সেদিনও “জোড়-মন্দির-জোড়-মন্দির” বলে হাঁকার পর গাড়ি ছেড়ে দিল। উঁ-উঁ-উঁ শব্দ করতে করতে একটা স্টপেজে এসে থামতেই সুরেন চেঁচিয়ে উঠল : জলদি করুন বাবু, জলদি করুন। এক ভদ্রলোক উঠলেন স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে ইত্যাদি নিয়ে। সুরেন অভ্যাস মতো “লেডিস সিট ছেড়ে দিন আপনারা” বলেই আগন্তুকদের দিকে চেয়ে চমকে উঠল—একি, এরা যে তার মামার বাড়ির ভাড়াটেরা। গৌরীও রয়েছে এদের সঙ্গে। সুরেনের বুকের ভিতরটা ধ্বক্‌-ধ্বক্‌ কাঁপতে লাগল বাসের ইঞ্জিনটার মতো। ভাড়াটেবাবু সুরেনকে এক নজর দেখে নিলেন। তাঁর বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুটো হৈ-চৈ বাঁধিয়ে দিল : মা, মা, আমাদের সুরেন-দা, ঐ দ্যাখো সুরেন-দা। কী মজা! ও সুরেন-দা, বাড়িতে যাওনা কেন? এ্যাঁ? গাড়ি শুদ্ধ লোকের সামনে সুরেন বিব্রত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ টিকিট দিতেই মনে রইল না তার। ভদ্রলোক ধমকে নিরস্ত করলেন তার ছেলেমেয়েদের। কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল সবকিছুই–বন্ধ হয়ে গেল সুরেনের হাঁক ডাক। একবার আড়চোখে তাকাল সে গৌরীর দিকে–সে তখন রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। আস্তে আস্তে সে বাকী টিকিটের দামগুলো সংগ্ৰহ করতে লাগল। বাসের একটানা উঁ-উঁ-উঁ শব্দকে এই প্ৰথম তার নিজের বুকের আর্তনাদ বলে মনে হল। কন্‌ডাকটারীর দুঃসহ গ্লানি ঘাম হয়ে ফুটে বেরুল তার কপালে। গৌরীর বিমুখ ভাব সুরেনের শিরায় শিরায় বইয়ে দিল তুষারের ঝড়; দ্রুত, অত্যন্ত দ্রুত মনে হল বাসের ঝাঁকুনি-দেওয়া গতি। বহুদিনের রক্ত-জাল-করা পরিশ্রম আর আশা চুড়ান্ত বিন্দুতে এসে কাঁপতে লাগল স্পিডোমিটারের মতো। একটু চাহনি, একটু পলক ফেলা আশ্বাস, এরই জন্যে সে কাঁধে তুলে নিয়েছিল কন্‌ডাকটারের ব্যাগ। কিন্তু আজ মনে হল বাসের সবাই তার দিকে চেয়ে আছে, সবাই মৃদু মৃদু হাসছে, এমন কি গৌরীর বাবাও। ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছা হল সুরেনের টাকাকড়ি-শুদ্ধ কাঁধে ঝোলান ব্যাগটা। ওরা নেমে যেতেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ঘন্টি মেরে দুর্বল স্বরে হাঁকল : যা-ওঃ। কিন্তু ‘ঠিক হ্যায়’ সে বলতে পারল না। কেবল বার বার তার মনে হতে লাগল : নেহি, ঠিক নেহি হ্যায়। সেদিন রাত্রে সুরেন মদ খেল, প্রচুর মদ। তারপর রামচরণকে অনুসরণ করল। যাত্রীদের গন্তব্যস্থলে পোঁছে দেওয়াই রামচরণের কাজ। সে আজ সুরেনকে পৌঁছে দিল সৌখিন ভদ্রসমাজ থেকে ঘা-খাওয়া ছোটলোকের সমাজে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমরা জেগেছি আমরা লেগেছি কাজে সুকান্ত ভট্টাচার্য আমরা জেগেছি আমরা লেগেছি কাজে আমরা কিশোর বীর । আজ বাংলার ঘরে ঘরে আমরা যে সইনিক মুক্তির । সেবা আমাদের হাতের অস্ত্র দুঃখীকে বিলাই অন্ন বস্ত্র দেশের মুক্তি-দূত যে আমরা স্ফুলিংগ শক্তির । আমরা আগুন জ্বালাব মিলনে পোড়াব শত্রুদল আমরা ভেঙেছি চীনে সোভিয়েটে দাসত্ব-শৃঙ্খল । আমার সাথীরা প্রতি দেশে দেশে আজো উদ্যত একই উদ্দেশে— এখানে শত্রুনিধনে নিয়েছি প্রতিজ্ঞা গম্ভীর বাঙলার বুকে কালো মহামারী মেলেছে অন্ধপাখা আমার মায়ের পঞ্জরে নখ বিঁধেছে রক্তমাখা তবু আজো দেখি হীন ভেদাভেদ ! আমরা মেলাব যত বিচ্ছেদ; আমরা সৃষ্টি করব পৃথিবী নতুন শতাব্দীর ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
জনযুদ্ধের গান সুকান্ত ভট্টাচার্য জনগণ হও আজ উদ্বুদ্ধ শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ, জাপানী ফ্যাসিস্টদের ঘোর দুর্দিন মিলেছে ভারত আর বীর মহাচীন । সাম্যবাদীরা আজ মহাক্রুদ্ধ শুরু করো প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ ।। জনগণ শক্তির ক্ষয় নেই, ভয় নেই আমাদের ভয় নেই । নিষ্ক্রিয়তায় তবে কেন মন মগ্ন কেড়ে নাও হাতিয়ার, শুভলগ্ন । করো জাপানের আজ গতি রুদ্ধ; শুরু করো, প্রতিরোধ, জনযুদ্ধ ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বর্ষ-বাণী সুকান্ত ভট্টাচার্য যেমন করে তপন টানে জল তেমনি করে তোমায় অবিরল টানছি দিনে দিনে তুমি লও গো আমায় চিনে শুধু ঘোচাও তোমার ছল ।। জানি আমি তোমায় বলা বৃথা তুমি আমার আমি তোমার মিতা, রুদ্ধ দুয়ার খুলে তুমি আসবে নাকো ভুলে থামবে নাকো আমার চলাচল ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
যেমন ক’রে তপন টানে জল সুকান্ত ভট্টাচার্য যেমন করে তপন টানে জল তেমনি করে তোমায় অবিরল টানছি দিনে দিনে তুমি লও গো আমায় চিনে শুধু ঘোচাও তোমার ছল ।। জানি আমি তোমায় বলা বৃথা তুমি আমার আমি তোমার মিতা, রুদ্ধ দুয়ার খুলে তুমি আসবে নাকো ভুলে থামবে নাকো আমার চলাচল ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
শৃঙ্খল ভাঙা সুর বাজে পায়ে সুকান্ত ভট্টাচার্য শৃঙ্খল ভাঙা সুর বাজে পায়ে ঝন্‌ ঝনা ঝন্‌ ঝন্‌ সর্বহারার বন্দী-শিবিরে ধ্বংসের গর্জন । দিকে দিকে জাগে প্রস্তুত জনসৈন্য পালাবে কোথায় ? রাস্তা তো নেই অন্য হাড়ে রচা এই খোঁয়াড় তোমার জন্য হে শত্রু দুষমন ! যুগান্ত জোড়া জড়রাত্রির শেষে দিগন্তে দেখি স্তম্ভিত লাল আলো, রুক্ষ মাঠেতে সবুজ ঘনায় এসে নতুন দেশের যাত্রীরা চমকালো । চলতি ট্রেনের চাকায় গুঁড়ায়ে দম্ভ পতাকা উড়াই : মিলিত জয়স্তম্ভ । মুক্তির ঝড়ে শত্রুরা হতভম্ব । আমরা কঠিন পণ
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ছন্দ ও আবৃত্তি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা ছন্দ সম্পর্কে এ কথা স্বচ্ছন্দে বলা যেতে পারে যে, সে এখন অনেকটা সাবালক হয়েছে। পয়ার-ত্রিপদীর গতানুগতিকতা থেকে খুব অল্প দিনের মধ্যেই বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের প্রগতিশীলতায় সে মুক্তি পেয়েছে। বলা বাহুল্য, চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির আমল থেকে ঈশ্বর গুপ্ত পর্যন্ত এতকাল পয়ার-ত্রিপদীর একচেটিয়া রাজত্বের পর রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাবই বাংলা ছন্দে বিপ্লব এনেছে। মধুসূদনের ‘অমিত্রাক্ষর’ মিলের বশ্যতা অস্বীকার করলেও পয়ারের অভিভাবকত্ব ঐ একটি মাত্র শর্তে মেনে নিয়েছিল, কিন্তু বিহারীলাল প্রভৃতির হাতে যে-সম্ভাবনা লোহা ছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে তা ইস্পাতের অস্ত্র হল। রবীন্দ্রনাথের হাতে ছন্দের ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষতার পরিচয় দেওয়া এখানে সম্ভব নয়, তবু একটি মাত্র ছন্দ রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কাব্য জীবনে অদ্ভুত ও চমকপ্রদ ভাবে বিকাশ লাভ করে এবং ঐ ছন্দেরই উন্নত পর্যায় শেষের দিকের কবিতায় খুব বেশী রকম পাওয়া যায়। সম্ভবত এই ছন্দই রবীন্দ্রনাথকে গদ্য-ছন্দে লেখবার প্রেরণা দেয় এবং তার ফলেই বাংলা ছন্দ বাঁধা নিয়মের পর্দা ঘুচিয়ে আজকাল স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছে। বোধহয়, একমাত্র এই কারণেই বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে বলাকা-ছন্দ ঐতিহাসিক। সত্যেন দত্তের কাছেও বাংলা ছন্দ চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে। নজরুল ইস্‌লামও স্মরণীয়। নজরুলের ছন্দে ভাদ্রের আকস্মিক প্লাবনের মতো যে বলিষ্ঠতা দেখা গিয়েছিল তা অপসারিত হলেও তার পলিমাটি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে সোনার ফসল ফলানোয় সাহায্য করবে। এঁরা দু’জন বাদে এমন কোনো কবিই বাংলা ছন্দে কৃতিত্বের দাবি করতে পারেন না, যাঁরা নিজেদের আধুনিক কবি বলে অস্বীকার করেন। অথচ কেবলমাত্র ছন্দের দিক থেকেই যে আধুনিক কবিতা অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে এ কথা অমান্য করার স্পর্ধা বা প্রবৃত্তি অন্তত কারো নেই বলেই আমার মনে হয়। আধুনিক কবিদের মধ্যে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য প্রেমেন্দ্র মিত্র। প্রমাণের আবশ্যক বোধহয় নেই। তারপরেই উল্লেখযোগ্য বিষ্ণু দে, বিশেষ করে আজকাল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছন্দের ঘোড়ায় একজন পাকা ঘোড়-সওয়ার, যদিও সম্প্রতি নিষ্ক্রিয়। অমিয় চক্রবর্তী খুব সম্ভব একটা নতুন ছন্দের সূত্রপাত করবেন, কিন্তু তিনি এখনো পর্যন্ত গবেষণাগারে। গদ্য-ছন্দে সমর সেন-ই দেখা যাচ্ছে আজ পর্যন্ত অদ্বিতীয়। ইতিমধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একখানা চটি বইয়ে ছড়ার ছন্দের উন্নত-ক্রম কত উপভোগ্য হতে পারে তার একটা দৃষ্টান্ত পাওয়া গেল। বিমলচন্দ্র ঘোষের ঐ ধরনের একখানা বই ঐ কারণেই অতি সুপাঠ্য হয়েছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত অধুনা আত্ম-সম্বরণ করেছেন, কিন্তু অজিত দত্তের খবর কী? বুদ্ধদেব বসুর ছন্দের ধার দিন দিন কমে যাচ্ছে। তিনি গদ্য-ছন্দে লেখেন না কেন ? অতঃপর অভিযোগ-প্রসঙ্গ—ভাল ছন্দ ক্রমশ দুষ্প্রাপ্য মনে হচ্ছে। এর প্রতিকারের কোনো উপায় কি নেই? আহার্যের সঙ্গে সঙ্গে ভাল ছন্দ দুর্লভ হওয়ায় দুটোর মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনে দুরভিসন্ধি মনের মধ্যে অদম্য হয়ে উঠছে, সুতরাং ভীতি-বিহ্বল-চিত্তে কবিদের ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ লক্ষ্য করব। কোনো কোনো কবির ছন্দের আশঙ্কাজনক প্রভাব অধিকাংশ নবজাত কবিকে অজ্ঞাতসারে অথবা জ্ঞাতসারে আচ্ছন্ন করছে, অতএব দুঃসাহস প্রকাশ করেই তাঁদের সচেতন হতে বলছি। খ্যাতনামা এবং অখ্যাতনামা প্রত্যেক কবির কাছেই দাবি করছি, তাঁদের সমস্তটুকু সম্ভাবনাকে পরিশ্রম করে ফুটিয়ে তুলে বাংলা ছন্দকে সমৃদ্ধ করার জন্যে। এ কথা যেন ভাবতে না হয় রবীন্দ্রনাথের পরে কারো কাছে আর কিছু আশা করবার নেই। এইবার আবৃত্তির কথায় আসা যাক। ছন্দের সঙ্গে আবৃত্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, অথচ ছন্দের দিক থেকে অগ্রসর হয়েও বাংলা দেশ আবৃত্তির ব্যাপারে অত্যন্ত অমনোযোগী। আমি খুব কম লোককেই ভাল আবৃত্তি করতে দেখেছি। ভাল আবৃত্তি না করার অর্থ ছন্দের প্রকৃতি না বোঝা এবং তারও অর্থ হচ্ছে ছন্দের প্রতি উদাসীনতা। ছন্দের প্রতি পাঠকের ঔদাসীন্য থাকলে ছন্দের চর্চা এবং উন্নতি যে কমে আসবে, এতো জানা কথা। সুতরাং বাংলা ছন্দের উন্নতির জন্য সুষ্ঠু আবৃত্তির প্রচলন হওয়া দরকার এবং এ বিষয়ে কবিদের সর্বপ্রথম অগ্রণী হতে হবে। অনেক প্রসিদ্ধ কবিকে আবৃত্তি করতে দেখেছি, যা মোটেই মর্মস্পর্শী হয় না। বিশুদ্ধ উচ্চারণ, নিখুঁত ধ্বনি-বিন্যাস, কণ্ঠস্বরের সুনিপুণ ব্যঞ্জনা এবং সর্বোপরি ছন্দ সম্বন্ধে সতর্কতা, এইগুলি না হলে আবৃত্তি যে ব্যর্থ হয় তা তাঁদের ধারণায় আসে না। আগে আমাদের বাংলা দেশে কবির লড়াই, পাঁচালি, কথকতা ইত্যাদির মধ্যে ছন্দ-শিক্ষার কিছুটা ব্যবস্থা ছিল, যদিও তার মধ্যে ভুল-ত্রুটি ছিল প্রচুর, কিন্তু তার ব্যাপকতা সত্যিই শ্রদ্ধেয় এবং উপায়টাও ছিল সহজ। এখন যদি সেই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন না-ও হয়, তবুও কবিরা সভা-সমিতিতে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে সাধারণকে ছন্দ সম্বন্ধে জ্ঞান-বিতরণ করতে অনায়াসেই পারেন। এ ব্যবস্থা যে একেবারেই নেই তা নয়, তবে খুবই কম। রেডিও-কর্তৃপক্ষ যদি প্রায়ই কবিদের আমন্ত্রণ ক’রে (নিজেদের মাইনে করা লোক দিয়ে নয়, যাদের থিয়েটারী ঢঙে আবৃত্তি করাই চাকরি বজায় রাখার উপায়) আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে ছন্দ-শিক্ষার ব্যবস্থা করেন তা হলেও জনসাধারণ উপকৃত হয়। সিনেমায় যদি নায়ক-নায়িকা বিশেষ মুহুর্তে দু’চার লাইন রবীন্দ্রনাথের কি নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে তা হলে কি রসভঙ্গ হবে? যদি সত্যিই ছন্দ সম্বন্ধে কাউকে সচেতন করতে হয় তা হলে তা কিশোরদের। তারা ছড়ার মধ্যে দিয়ে তা শিখতে পারে। আর তারা যদি তা শেখে তা হলে ভবিষ্যতে কাউকে আর আবৃত্তি-শিক্ষার জন্যে পত্রিকায় লেখা লিখতে হবে না। কাজেই ভাল আবৃত্তি ও ছন্দের জন্যে একেবারে গোড়ায় জল ঢালতে হবে এবং সেইজন্যে মায়েদের দৃষ্টি এই দিকে দেওয়া দরকার। তাঁরা ঘুম-পাড়ানি গানের সময় কেবল সেকেলে ‘ঘুম-পাড়ানি মাসি পিসি’ না ক’রে রবীন্দ্রনাথ কি সুকুমার রায়ের ছড়া আবৃত্তি ক’রে জ্ঞান হবার আগে থেকেই ছন্দে কান পাকিয়ে রাখতে পারেন। এ হবে এস্‌রাজ বাজানোর আগে ঠিক সুরে তার বেঁধে নেওয়ার মতো। প্রত্যেক বিদ্যায়তনের শিক্ষকের দায়িত্ব আরো বেশী, কেবলমাত্র তাঁরাই পারেন এ ব্যাপারে সঠিক শিক্ষা দিতে। প্রতিদিন কবিতা মুখস্থ নেওয়ার মধ্য দিয়ে, পুরস্কার বিতরণ কি সরস্বতী পূজো উপলক্ষ্যে ছাত্রদের আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে কি করে ছন্দ পড়তে হয়, আবৃত্তি করতে হয় তা তাঁরা শিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষার মতো এ শিক্ষায়ও তাঁরা ফাঁকি দেন। পরিশেষে আমার মন্তব্য হচ্ছে, গদ্য-ছন্দের যে একটা বিশিষ্ট সুর আছে, সেটাও যে পদ্যের মতোই পড়া যায়, তা অনেকেই জানেন না। কেউ কেউ গল্প পড়ার মতোই তা পড়েন। সুতরাং উভয়বিধ ছন্দ সম্বন্ধে যত্ন নিতে হবে লেখক ও পাঠক উভয়কেই। কবিরা নতুন নতুন আবৃত্তি-উপযোগী ছন্দে লিখলে (যা আধুনিক কবিরা লেখেন না) এবং পাঠকরা তা ঠিকমতো পড়লে তবেই আধুনিক কবিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে, উপেক্ষিত আধুনিক কবিতা খেচর অবস্থা থেকে ক্রমশ জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর হবে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
নেপথ্যে (গান) সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্ষুধিতের সেবার সব ভার লও লও কাঁধে তুলে – কোটি শিশু নরনারী মরে অসহায় অনাদরে, মহাশ্মশানে জাগে মহামানব আগুয়ান হও ভেদ ভুলে। বৈজয়ন্ত নগর। সকাল। (দূরে কে যেন বলছে) হে পুরবাসী ! হে মহাপ্রাণ, যা কিছু আছে করগো দান, অন্ধকারের হোক অবসান করুণা-অরুণোদয়ে ! বালকদলের প্রবেশ উদয়ন ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, আসে ওই আয় তোরা, ওর সাথে কথা কই। ইন্দ্রসেন নগরে এসেছে এক অদ্ভুত মেয়ে পরের জন্য শুধু মরে ভিখ্ চেয়ে। সত্যকাম শুনেছি ও থাকে দূর দেশে, সেইখান থেকে হেঁটে এসে দেশের জন্য ভিখ্ চায় আমাদের খোলা দরজায়। উদয়ন শুনেছি ওদের দেশে পথের ধারে মরছে হাজার লোক বিনা আহারে, নানান ব্যাধিতে দেশ গিয়েছে ছেয়ে, তাইতো ভিক্ষা মাগে ওদের মেয়ে। সংকলিতার প্রবেশ (গান ধরল) গান শোনো, শোনো, ও বিদেশের ভাই, এসেছি আজ বন্ধুজনের ঠাঁই ; দেশবাসী মরছে অনশনে তোমরা কিছু দাও গো জনে জনে, বাঁচাব দেশ অন্ন যদি পাই। উদয়ন শোনো ওগো বিদেশের কন্যা ব্যাধি দুর্ভিক্ষের বন্যা আমরাই প্রাণ দিয়ে বাঁধব – তোমাদের কান্নায় আমরাও যোগ দিয়ে কাঁদব। ইন্দ্রসেন আমরা তোমায় তুলে দেব অন্ন বস্ত্র অর্থ তুমি কেবল গান শোনাবে এই আমাদের শর্ত। সত্যকাম ওই দ্যাখ আসে হেথা রাজ্যের কোতোয়াল ইয়া বড় গোঁফ তার, হাতে বাঁকা তরোয়াল ; ওর কাছে গিয়ে তুমি পাতো দুই হস্ত ও দেবে অনেক কিছু ও যে লোক মস্ত ! কোতোয়ালের প্রবেশ সংকলিতা (আঁচল তুলে) ওগো রাজপ্রতিনিধি, তুমি রাজ্যের বিধি। তুমি দাও আমাদের অন্ন, আমরা যে বড়ই বিপন্ন। কোতোয়াল য চ’লে ভিখারী মেয়ে যা চ’লে দেব না কিছুই তোর আঁচলে। সংকলিতা তুমি যদি না দেবে তো কে দেবে এ রাজ্যে ? সবারে রক্ষা করা তোমাদের কাজ যে। কোতোয়াল চুপ কর হতভাগী, বড় যে সাহস তোর ? এখুনি বুঝিয়ে দেব আমার গায়ের জোর। সংকলিতা তোমরা দেখাও শুধু শক্তি, তাইতো করে না কেউ ভক্তি ; করো না প্রজার কোনো কল্যাণ, তোমরা অন্ধ আর অজ্ঞান। কোতোয়াল চল তবে মুখপুড়ী, বেড়েছিস বড় বাড় – কপালে আছে রে তোর নির্ঘাত কারাগার। (সংকলিতাকে পাকড়াও করে গমনোদ্যত, এমন সময় জনৈক পথিকের প্রবেশ) পথিক শুনেছ হে কোতোয়াল – নগরে শুনছি যে গোলমাল ? উদয়, ইন্দ্র ও সত্য (একযোগে) ছাড়, ছাড়, ছাড় ওকে – ছেড়ে দাও। কোতোয়াল ওরে রে ছেলের দল, চোপরাও ! সংকলিতা কখনো কি তোমরা ন্যায়ের ধারটি ধারো ? বন্দী যদি করো আমায় করতে পারো, করি নি তো দেশের আঁধার ঘুচিয়ে আলো কারাগারে যাওয়াই আমার পক্ষে ভালো। পথিক ওগো নগরপাল ! রাজপুরীতে এদিকে যে জমলো প্রজার পাল। পথিকের প্রস্থান ইন্দ্রসেন অত্যাচারী কোতোয়ালের আজকে একি অত্যাচার ? এমনিতর খেয়ালখুশি করব না বরদাস্ত আর। কোতোয়াল (তরবারি উঁচিয়ে) হারে রে দুধের ছেলে, এতটুকু নেই ডর ? মাথার বিয়োগব্যথা এখুনি বুঝবে ধড়। রাজদূতের প্রবেশ রাজদূত (চিৎকার করে) রাখো অস্ত্রের চাকচিক্য এদেশে লেগেছে দুর্ভিক্ষ প্রজাদল হয়েছে অশান্ত মহারাজ তাই বিভ্রান্ত। কোতোয়াল একি শুনি আজ তোমার ভাষ্য ? মনে হয় যেন অবিশ্বাস্য, মহামন্বন্তরের হাস্য, এখানেও শেষে হল প্রকাশ্য ? উদয়ন আমরা তো পূর্বেই জানি, লাঞ্ছিতা হলে কন্যা কল্যাণী এদেশেও ঘটবে অমঙ্গল উঠবেই মৃত্যুর কল্লোল। কোতোয়াল বুঝলাম, সামান্যা নয় এই মেয়ে, নৃপতিকে সংবাদ দাও দূত যেয়ে। রাজদূতের প্রস্থান (সংকলিতার প্রতি) আজকে তোমার প্রতি করেছি যে অন্যায় তাইতো ডুবছে দেশ মৃত্যুর বন্যায় ; বলো তবে দয়া করে কিসে পাব উদ্ধার ঘুচবে কিসের ফলে মৃত্যুর হাহাকার ? সংকলিতা নই আমি অদ্ভুত, নই অসামান্যা, ধ্বনিত আমার মাঝে মানুষের কান্না – যেখানে মানুষ আর যেখানে তিতিক্ষা আমার দেশের তরে সেথা চাই ভিক্ষা। আমার দেশের সেই মহামন্বন্তর ঘিরেছে তোমার দেশও ধীরে অভ্যন্তর। মহারাজ ও পিছনে কুবের শেঠের প্রবেশ মহারাজ কে তুমি এসেছ মেয়ে আমার দেশে, এসেছ কিসের তরে, কার উদ্দেশে ? সংকলিতা আমার দেশেতে আজ মরে লোকে অনাহারে, এসেছি তাদের তরে মহামানবের দ্বারে – লাখে লাখে তারা আজ পথের দুধার থেকে মৃত্যুদলিত শবে পথকে ফেলেছে ঢেকে। চাষী ভুলে গেছে চাষ, মা তার ভুলেছে স্নেহ, কুটিরে কুটিরে জমে গলিত মৃতের দেহ ; উজার নগর গ্রাম, কোথাও জ্বলে না বাতি, হাজার শিশুরা মরে, দেশের আগামী জাতি। রোগের প্রাসাদ ওঠে সেখানে প্রতিটি ঘরে, মানুষ ক্ষুধিত আর শেয়ালে উদর ভরে ; এখনো রয়েছে কোটি মরণের পথ চেয়ে তাই তো ভিক্ষা মাগি এদেশে এ-গান গেয়ে – গান ওঠো জাগো ও দেশবাসী, আমরা যে রই উপবাসী, আসছে মরণ সর্বনাশী। হও তবে সত্বর – দুয়ারে উঠল মহাঝড়। সংকলিতা কিন্তু তোমার এই এতবড় রাজ্য এখানে পেলাম নাকো কোনোই সাহায্য। রাজদূতের প্রবেশ রাজদূত প্রজারা সহসা ক্ষিপ্ত হয়েছে যে মহারাজ – রাজপ্রাসাদের পাশে ভিড় ক’রে আছে আজ। প্রস্থান মহারাজ বলো মেয়ে তাদের আমি শান্ত করি কী দিয়ে ? সংকলিতা ধনাগার আজ তাদের হাতে এখুনি দাও ফিরিয়ে। মহারাজ তাও কখনো সম্ভব ? অবশেষে ছাড়ব বিপুল বৈভব ? কুবের শেঠ (করজোড়ে) শ্রীচরণে নিবেদন করি সবিনয় – কখনই নয়, প্রভু কখনই নয়। মহারাজ কিন্তু কুবের শেঠ, বড়ই উতলা দেখি এদের ক্ষুধিত পেট। কুবের শেঠ এ এদের ছল, মহারাজ ! নতুবা নির্ঘাত দুষ্ট চাষীদের কাজ ! মহারাজ তুমিই যখন এদের সমস্ত, এদের খাওয়ার সকল বন্দোবস্ত তোমার হাতেই করলাম আজ ন্যস্ত। কুবের শেঠ (বিগলিত হয়ে) মহারাজ ন্যায়পরায়ণ ! তাইতো সদাই সেবা করি ও চরণ ! মহারাজের সঙ্গে কুবের শেঠের প্রস্থান ইন্দ্রসেন বাঘের ওপর দেওয়া হল ছাগ পালনের ভার, কোতোয়াল হে ! তোমাদের যে ব্যাপার চমৎকার ! কোতোয়াল বটে ! বটে ! বড় যে সাহস ? গর্দান যাবে তবে রোস্ ! সংকলিতা ছেলের দলের সামনে সাহস ভারি, যোগ্য লোকের কাছে গিয়ে ঘোরাও তরবারি। কোতোয়াল চুপ করে থাক্ মেয়ে, চুপ করে থাক্, তুই এনেছিস দেশে ভীষণ বিপাক। যেদিন এদেশে তুই এলি ভিখারিণী অশুভ তোরঈ সাথে এল সেই দিনই। সত্যকাম কে বলে একথা কোতোয়াল ? ও হেথা এসেছে বহুকাল ; এতদিন ছিল না আকাল। প্রজার ফসল করে হরণ, তুমিই ডেকেছ দেশে মরণ, সে কথা হয় না কেন স্মরণ ? জমানো তোমার ঘরে শস্য, তবু তুমি করো ওকে দূষ্য ? কোতোয়াল কে হে তুমি ? দেখছি চোরের পকেটকাটা সাক্ষী বলছ কেবল বৃহৎ বৃহৎ বাক্যি ? ইন্দ্রসেন কোতোয়ালজী, আজকে হঠাৎ রাগের কেন বৃদ্ধি ? তোমার কি আজ খাওয়া হয় নি সিদ্ধি ? কোতোয়াল চুপ্ কর, ওরে হতভাগা ! এটা নয় তামাসার জা’গা। (দাঁতে দাঁত ঘষে সংকলিতার প্রতি) এই মেয়ে বাড়িয়েছে ছেলেদের বিক্রম, তাইতো আমাকে কেউ করে নাকো সম্ভ্রম। সংকলিতা চিরদিনই তরুণেরা অন্যায়ের করে নিবারণ, এদের এ সাহসের আমি তাই নয়কো কারণ। কোতোয়াল আমি রামদাস কোতোয়াল – চটাস্‌নি ভুলে, কাটিস্‌নি কুমিরের খাল। সংকলিতা ছি ! ছি ! ছি! ওগো কোতোয়ালজী, আমি কি তোমাকে পারি চটাতে ? শত্রুও পারে না তা রটাতে। কোতোয়াল জানে বাতাস, জানে অন্তরীক্ষ, জানে নদী, জানে বনের বৃক্ষ, তুই এনেছিস এদেশে দুর্ভিক্ষ। সংকলিতা ক্ষমা করো ! আমি সর্বনেশে ! পরের উপকারের তরে এসে – মন্বন্তর ছড়িয়ে গেলাম তোমাদের এই দেশে। উদয়ন অমন ক’রে বলছ কেন ভগ্নী ! জ্বালছ মনে কেন ক্ষোভের অগ্নি ? রাঘব বোয়াল এই কোতোয়াল হানা দেয় এ রাজ্যে একে তুমি এনোই না গেরাহ্যে। কোতোয়াল আমার শাসন-ছায়ায় হয়ে পুষ্ট রাঘব বোয়াল বলিস আমায় দুষ্ট ? ইন্দ্রসেন বলা উচিত সহস্রবার যেমন তুমি নির্দয়। নির্দোষকে পীড়ন করায় যেমন তোমার নেই ভয়। কোতোয়াল বার বার করেছি তো সাবধান, এইবার যাবে তোর গর্দান। সংকলিতা চুপ করে থাক ভাই, কথায় নেইকো ফল, আমার জন্যে কেন ডাকছ অমঙ্গল ? রাজা ধনাগার যদি দেন প্রজাদের হাতে ওর যে সমূহ ক্ষতি, ভেবে ও ক্ষুব্ধ তাতে। কোতোয়াল ওরে ওরে রাক্ষসী, ওরে ওরে ডাইনী, তোর কথা আমি যেন শুনতেই পাই নি, তোর যে ঘনাল দিন, সাহস ভয়ংকর, দুঃসাহসের কথা বলতে নেইকো ডর ? সত্যকাম তোমার মতো দুর্জনকে করতে হলে ভয় পৃথিবীতে বেঁচে থাকা মোটেই উচিত নয়। কোতোয়াল তোদের মুখে শুনছি যেন ভাগবতের টীকা, নিজের হাতে জ্বালছিস আজ নিজের চিতার শিখা। ইন্দ্রসেন একটি তোমার তলোয়ারের জোরে ভাবছ বুঝি চিরকালটাই যাবে শাসন করে ? সেদিন তো আজ অনেক কালই গত, তোমার মুখের ফাঁকা আওয়াজ শুনছি অবিরত। কোতোয়াল (ইন্দ্রসেনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে) বুঝলে এঁচোড়পাকা, আওয়াজ আমার নয়কো মোটেই ফাঁকা। সংকলিতা (আর্তনাদ করে) দরিদ্রের রক্ত ক’রে শোষণ বিরাট অহংকারকে করে পোষণ, তুমি পশু, পাষণ্ড, বর্বর অত্যাচারী, তোমার ও হাত কাঁপে না থরথর ! কোতোয়াল (হুংকার দিয়ে) আমাকে বলিস পশু, বর্বর ? ওরে দুর্মতি তুই তবে মর ! (তলোয়ারের আঘাতে আর্তনাদ ক’রে সংকলিতার মৃত্যু) প্রজাদলের প্রবেশ ও কোতোয়াল পলায়নোদ্যত জনৈক পথিক কোথায় সে কন্যা, অপরূপ কান্তি, যার বাণী আমাদের দিতে পারে শান্তি ; দেশে আজ জাগরণ যার সংগীতে, আমরা যে উৎসুক তাকে গৃহে নিতে। (সংকলিতার মৃতদেহের দিকে চেয়ে আর্তনাদ ক’রে) এ যে মহামহীয়সী, এ যে কল্যাণী ধূলায় লুটায় কেন এর দেহখানি ? ইন্দ্রসেন (কোতোয়াল্কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) ওই দেখ, ভাই সব, ওই অপরাধী সবার বিচার হোক ওর প্রতিবাদী – জনৈক প্রজা ওরে রে স্পর্ধিত পশু, কী সাহস তোর, তুই করেছিস আজ অন্যায় ঘোর ; কল্যাণীকে হেনে আজ তোর আর পৃথিবীতে বাঁচবার নেই অধিকার। ইন্দ্রসেন রাজার ওপরে আর করব না নির্ভর – আমাদের ভাগ্যের আমরাই ঈশ্বর। সকলে চলবে না অন্যায়, খাটবে না ফন্দি, আমাদের আদালতে আজ তুই বন্দী !!! (কোতোয়ালকে প্রজারা বন্দী করল) যবনিকা
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রান্তিক সুকান্ত ভট্টাচার্য (আবৃত্তি) বেলাশেষে শান্তছায়া সন্ধ্যার আভাসে বিষন্ন মলিন হয়ে আসে, তারি মাঝে বিভ্রান্ত পথিক তৃপ্তিহীন খুঁজে ফিরে পশ্চিমের দিক। পথপ্রান্তে প্রাচীন কদম্বতরুমূলে, ক্ষণতরে স্তদ্ধ হয়ে যাত্রা যায় ভুলে। আবার মলিন হাসি হেসে চলে নিরুদ্দেশে। রজনীর অন্ধকারে একটি মলিন দীপ হাতে কাদের সন্ধান করে উষ্ণ অশ্রুপাতে কালের সমধিতলে। স্মৃতিরে সঞ্চয় করে জীবন-অঞ্চলে; মাঝে মাঝে চেয়ে রয় ব্যথা ভরা পশ্চিমের দিকে, নির্নিমিখে। যেথায় পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে অমর অরে সেথায় কাদের আর্তনাদ বারংবার বৈশাখীর ঝড়ে। আবার সম্মুখপানে যাত্রা করে রাত্রির আহ্বানে। ক্ষীণদীপ উর্বর আলোতে চিরন্তন পথের সংকেত রেখে যায় প্রভাতের কানে। অকস্মাৎ আত্মবিস্মৃতির অন্তঃপুরে, ভেসে ওঠে মানসকমুকুরে উত্তরকালের আর্তনাদ,- “কবিগুরু আমাদের যাত্রা শুরু কালের অরণ্য পথে পথে পরিত্যক্ত তব রাজ-রথে আজি হতে শতবর্ষ আগে অস্ত গোধূলির সন্ধ্যারাগে যে দিগন্ত হয়েছে রক্তিম, সেথা আজ কারো চিত্তবীণা তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজে কিনা সে কথা শুধাও? শুধু দিয়ে যাও ক্ষণিকের দক্ষিণ বাতাসে তোমার সুবাস বাণীহীন অন্তরের অন্তিম আভাস। তাই আজ বাধামুক্ত হিয়া অজস্র উপেক্ষাভারে বিস্মৃতিরে পশ্চাতে ফেলিয়া ছিন্নবাধা বলাকার মতো মত্ত অবিরত, পশ্চাতের প্রভাতের পুষ্প-কুঞ্জ বনে আজ শূন্য মনে।” তাই উচ্চকিত পথিকের মন অকারণ উচ্ছলিত চঞ্চল পবনে। অনাগত গগনে গগনে! ক্লান্ত আজ প্রভাতের উৎসবের বাঁশি; পুরবাসী নবীন প্রভাতে পুরাতন জয়মাল্য হাতে অস্তাচলে পথিকের মুখে মূর্ত হাসি।। শেষ মিনতি (গান) ও কে যায় চলে কথা না বলে, দিও না যেতে তাহারই তরে আসন ঘরে রেখেছি পেতে। কত কথা আছে তার মনেতে সদাই, তবু কেন রবি কহে আমি চলে যাই; রামধনু রথে বিদায়ের পথে উঠিল মেতে। রঙে রঙে আজ গোধূলি গগন রঙিন কী হল, বিলাপে মগন। আমি কেঁদে কই যেও না কোথাও, সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও বাড়ায়ে বাহু মরণ-রাহু চাহিছে পেতে।। আয়োজন (বর্ণনা) হঠাৎ বুঝি তোমার রথের সাতটি ঘোড়া উঠল হ্রেষা-রবে চঞ্চল হয়ে, যাবার ডাক শুনি? অস্তপথ আজ তোমারই প্রত্যাশায় উন্মুখ, হে কবি, কখন তুমি আসবে? কবে, কখন তুমি এসে দাঁড়ালে অস্তপথের সীমানায়, কেউ জানল না; এমন কী তুমিও না! একবার ভেবে দেখেছ কি, হে ভাবুক, তোমার চলমান ঘোড়ার শেষ পদক্ষেপের আঘাতে কেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠবে আমাদের অন্তরলোক? তোমার রচিত বাণীর মন্দিরে কোন্ নতুন পূজারী আসবে জানি না, তবু তোমার আসন হবে শূন্য আর তোমার নিত্য-নূতন পূজাপদ্ধতি, অর্ঘ্য-উপচার আর মন্দিরের বেদী স্পর্শ করবে না। দেউলের ফাটল দিয়ে কোন্ অশত্থ-তরু চাইবে আকাশ, চাইবে তোমার মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠা, জানি না। তবু একদিন তা সম্ভব, তুমিও জানো। সেই দিনকার কথা ভেবে দেখেছ কি, হে দিগন্ত-রবি? তোমার বেণুতে আজ শেষ সুর কেঁপে উঠল। তুমি যাবে আমাদের মথিত করে। কোন্ মহাদেশের কোন্ আসনে হবে তোমার স্থান? বিশ্ববীণার তারে আজ কোন্ সুর বেজে উঠেছে, জানো? সে তোমারই বিদায় বেদনায় সকরুণ ওপারের সুর। এই সুরই চিরন্তন, সত্য এবং শাশ্বত। যুগের পর যুগ যে সুর ধ্বনিত হয়ে আসছে, আবহমানকালের সেই সুর। সৃষ্টি-সুরের প্রত্যুত্তর এই সুরের নাম লয়। তান-লয় নিয়ে তোমার খেলা চলেছে কতকাল, আজ সেই লয়ের তান রণরণিত হচ্ছে কোন্ অদৃশ্য তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, জানি না। কোন্ যুগান্তরের পারেও ধ্বনিত হবে সেই সুর কতদূর- তা কে জানে। যাত্রা (আবৃত্তি) অমৃতলোকের যাত্রী হে অমর কবি, কোন্ প্রস্থানের পথে তোমার একাকী অভিযান। প্রতিদিন তাই নিজেরে করেছ মুক্ত, বিদায়ের নিত্য-আশঙ্কায় পৃথ্বীর বন্ধন ভিত্তি নিশ্চিহ্ন করিতে বিপুল প্রয়াস তব দিনে দিনে হয়েছে বর্ধিত। এই হাসি গান, ক্ষণিকের অনিশ্চিত বুদ্বুদের মতো; নশ্বর জীবন অনন্তকালের তুচ্ছ কণিকার প্রায় হাসি ও ক্রন্দনে ক্ষয় হয়ে যায় তাই ওরা কিছু নয়, তুমিও জানিতে ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন-ধন-মান’, তবু তুমি শিল্পীর তুলিকা নিয়ে করেছ অঙ্কিত সভ্যতার প্রত্যেক সম্পদ। সুন্দরের সুন্দর অর্চনা। বিশ্বপ্রদর্শনী মাঝে উজ্জ্বল তোমার সৃষ্টিগুলি পৃথিবীর বিরাট সম্পদ, স্রষ্টা তুমি, দ্রষ্টা তুমি নূতন পথের। সেই তুমি আজ পথে পথে, প্রয়াণের অস্পষ্ট পরিহাসে আমাদের করেছ উন্মাদ। চেয়ে দেখি চিতা তব জ্বলে যায় অসহ্য দাহনে, জ্বলে যায় ধীরে ধীরে প্রত্যেক অন্তর। তুমি কবি, তুমি শিল্পী, তুমি যে বিরাট, অভিনব সবারে কাঁদায়ে যাও চুপি চুপি এ কী লীলা তব।। বিদায় (গান) ঝুলন- পূর্ণিমাতে নীরব নিঠুর মরণ সাথে কে তুমি ওগো মিলন-রাখী বাঁধিলে হাতে? শ্রাবণদিনে উদাস হাওয়া কাঁদিল এ কী, পথিক রবির চলে যাওয়া চাহিয়া দেখি, ব্যাকুল প্রাণে সজলঘন নয়ন পাতে – বিদায় নিতে চায় কে ওরে বাঁধরে তারে বজ্রডোরে আলোর স্বপন ভেঙেছে মোর, আঁধার যেথায় শ্রাবণ-ভোর ঘুম টুটে মোর সকল-হারা এই প্রভাতে।। প্রণতি (সমবেত গান) নমো রবি, সূর্য দেবতা জয় অগ্নি-কিরণময় জয় হে সহস্র-রশ্মি বিভাসিত, চির অয় তব পরিচয় হে। জয় ধ্বান্ত-বিনাশক জয় সূর্য, দিকে দিকে বাজে তব জয়-তূর্য অনুক্ষণ কাঁদে মন, অকারণ অকারণ কোথা তুমি মহামঙ্গলময় হে। কোথা সৌম্য শান্ত তব দীপ্ত ছবি কোথা লাবণ্যপু হে ইন্দ্র রবি, তুমি চিরজাগ্রত তুমি পুণ্য রবিহীন আজি কেন মহাশূন্য যুগে যুগে দাও তব আশিস অভয় হে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সূর্যপ্রণাম – উদয়াচল সুকান্ত ভট্টাচার্য আগমনী (সমবেত গান) পুবসাগরের পার হতে কোন পথিক তুমি উঠলে হেসে, তিমির ভেদি ভুবন-মোহন আলোর বেশে। ওগো পথিক, তোমার আলোর ঘুচুক জরা ছন্দে নাচুক বসুন্ধরা গগনপথে যাত্রা তোমার নিরুদ্দেশে। তুমি চিরদিনের দোলে দোলাও অনন্ত আবর্তনে, নৃত্যে কাঁপুক চিত্ত মোদের নটরাজের নর্তনে। আলোর সুরে বাজাও বাঁশি, চিরকালের রূপ-বিকাশি’ আঁধার নাশে সুন্দর হে তোমার বাণীর মূক আবেশে।। আবির্ভাব (আবৃত্তি) সূর্যদেব, আজি এই বৈশাখের খরতপ্ত তেজে পৃথিবী উন্মুক্ত যবে তুমি এলে সেজে কনক-উদয়াচলে প্রথম আবেগে ফেলিলে চরণচিহ্ন, তার স্পর্শ লেগে ধরণী উঠিল কাঁপি গোপন স্পন্দনে সাজাল আপন দেহ পুষ্প ও চন্দনে তব পূজা লাগি। পৃথিবীর চক্ষুদান হল সেই দিন। অন্ধকার অবসান, যবে দ্বার খুলে প্রভাতের তীরে আসি বলিলে, হে বিশ্বলোক তোরে ভালবাসি, তখনি ধরিত্রী তার জয়মাল্যখানি আশীর্বাদসহ তব শিরে দিল আনি- সস্মিত নয়নে। তারে তুমি বলেছিলে, জানি এ যে জয়মাল্য, মোরে কেন দিলে? কতবার তব কানে পঁচিশে বৈশাখ সদূরের তরে শুধু দিয়ে গেল ডাক, তুমি বলেছিলে চেয়ে সম্মুখের পানে “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।” বরণ (বর্ণনা) হঠাৎ আলোর আভাস পেয়ে কেঁপে উঠল ভোরবেলা, কোন্ পুলকে, কোন্ অজানা সম্ভাবনায়? রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করে অন্ধকার। শিউলি বকুল ঝরে পড়ে শেষ রাত্রির কান্নার মতো, হেমন্ত-ভোরের শিশিরের মতো। অস্পষ্ট হল অন্ধকার; স্বচ্ছ আরও স্বচ্ছ মৃতপ্রায়ের আগ্রহের মতো পাণ্ডুর আলো এসে পড়ে আশীর্বাদের মতো ঝরা ফুলের মরা চোখে, শুভ্র কপোলে,- ঘুমন্ত হাসির মতো তার মায়া। পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা এল উচ্ছ্বসিত বন্যার বেগে, হাতে তাদের আহরণী-ডালা; তারা অবাক হয়ে দেখলে একী! নতুন ফুল ফুটেছে তাদের আঙিনায় রবির প্রথম আলো এসে পড়েছে তার মুখে, ওরা বললে, ওতো সূর্যমুখী। পিলু-বারোয়াঁর সুর তখনও রজনীগন্ধার বনে দীর্ঘশ্বাসের মতো সুরভিত- মত্ততায় হা-হা করছে; কিন্তু তাও গেল মিলিয়ে। শুধু জাগিয়ে দিয়ে গেল হাজার সূর্যমুখীকে। সূর্য উঠল। অচেতন জড়তার বুকে ঠিকরে পড়তে লাগল, বন্ধ জানলায় তার কোমল আঘাত, অজস্র দীপ্ততে বিহ্বল। পৃথিবীর ছেলেমেয়েরা ফিরে গেল উজ্জ্বল, উচ্ছল হয়ে বুকে তাদের সূর্যমুখীর অদৃশ্য সুবাস। মঙ্গলাচরণ (গান) ওগো কবি, তুমি আপন ভোলা- আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা, মালিকাটি নিয়ে মোর একী বাঁধিলে অলখ-ডোর নিবেদিত প্রাণে গোপনে তোমার কি সুর তোলা, জেনেছ তো তুমি সকল প্রাণের নীরব কথা, তোমার বাণীতে আমার মনের এ ব্যাকুলতা পেয়েছ কি তুমি সাঁঝের বেলাতে যখন ছিলাম কাজের খেলাতে তখন কি তুমি এসেছিলে, ছিল যে দুয়ার খোলা? আহ্বান (সমবেত গান) আমাদের ডাক এসেছে এবার পথে চলতে হবে, ডাক দিয়েছে গগন-রবি ঘরের কোণে কেই বা রবে। ডাক এসেছে চলতে হবে আজ সকালে বিশ্বপথে সবার সাথে সমান তালে, পথের সাথী আমরা রবির সাঁঝ-সকালে চলরে সবে। ঘুম থেকে আজ সকালবেলা ওঠ রে, ডাক দিল কে পথের পানে ছোট রে, পিছন পানে তাকাস নি আজ চল সমুখে জয়ের বাণী নূতন প্রাতে বল ও-মুখে তোদের চোখে সোনার আলো সফল হয়ে ফুটবে কবে। স্তব (আবৃত্তি) কবিগুরু আজ মধ্যাহ্নের অর্ঘ্য দিলাম তোমায় সাজায়ে, পৃথিবীর বুকে রচেছ শান্তিস্বর্গ মিলনের সুর বাজিয়ে। যুগে যুগে যত আলোক-তীর্থযাত্রী মিলিবে এখানে আসিয়া, তোমার স্বর্গ এনে দেবে মধুরাত্রি তাহাদের ভালবাসিয়া। তারা দেবে নিতি শান্তির জয়মাল্য তোমার কণ্ঠে পরায়ে, তোমার বাণী যে তাহাদের প্রতিপাল্য, মর্মেতে যাবে জড়ায়ে। তুমি যে বিরাট দেবতা শাপভ্রষ্ট ভুলিয়া এসেছ মর্তে; পৃথিবীর বিষ পান করে নাই এখনো তোমার ওষ্ঠ ঝঞ্ঝা-প্রলয়-আবর্তে। আজিকার এই ধূলিময় মহাবাসরে তোমারে জানাই প্রণতি, তোমার পূজা কি শঙ্খঘণ্টা কাঁসরে? ধূপ-দীপে তব আরতি? বিশ্বের আজ শান্তিতে অনাসক্তি, সভ্য মানুষ যোদ্ধা, চলেছে যখন বিপুল রক্তারক্তি, তোমারে জানাই শ্রদ্ধা। অবশেষ (বর্ণনা) কিন্তু মধ্যাহ্ন তো পেরিয়ে যায় সন্ধ্যার সন্ধানে, মেঘের ছায়ায় বিশ্রাম করতে করতে, আকাশের সেই ধূ ধূ করা তেপান্তরের মাঠ। আর সুর্যও তার অবিরাম আলোকসম্পাত ক’রে ঢলে পড়ল সাঁঝ-গগনে। সময়ের পশ্চাতে বাঁধা সূর্যের গতি কী সূর্যের পিছনে বাঁধা সময়ের প্রতি তা বোঝা যায় না। দিন যায় ভাবীকালকে আহ্বান করতে। একটা দিন আর একটা ঢেউ, সময় আর সমুদ্র। তবু দিন যায় সূর্যের পিছনে, অন্ধকারে অবগাহন করতে করতে। যেতে হবে! প্রকৃতির কাছে এই পরাভবের লজ্জায় আর বেদনায় রক্তিম হল সূর্যের মুখ, আর পৃথিবীর লোকেরা; তাদের মুখ পূর্ব-আকাশের মতো কালো হয়ে উঠল। মিনতি (সমবেত গান) দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে, যেও না চলে, অরুণ-আলো কে যে দেবে যাও গো বলে। ফেরো তুমি যাবার বেলা; সাঁঝ-আকাশে রঙের মেলা- দেখছ কী কেমন করে আগুন হয়ে উঠল জ্বলে। পূব-গগণের পানে বারেক তাকাও বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও আঁধার যেন দৈত্য সম আসছে বেগে, শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে। থামো ওগো, যেও না হয় সময় হলে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
এই নিবিড় বাদল দিনে সুকান্ত ভট্টাচার্য এই নিবিড় বাদল দিনে কে নেবে আমায় চিনে, জানিনে তা। এই নব ঘন ঘোরে, কে ডেকে নেবে মোরে কে নেবে হৃদয় কিনে, উদাসচেতা। পবন যে গহন ঘুম আনে, তার বাণী দেবে কি কানে, যে আমার চিরদিন অভিপ্ৰেতা! শ্যামল রঙ বনে বনে, উদাস সুর মনে মনে, অদেখা বাঁধন বিনে ফিরে কি আসবে হেথা?
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ও কে যায় চলে কথা না বলে দিও না যেতে সুকান্ত ভট্টাচার্য ও কে যায় চলে কথা না বলে দিও না যেতে তাহারই তরে আসন ঘরে রেখেছি পেতে। কেন সে সুধার পাত্র ফেলে চলে যেতে চায় আজ অবহেলে রামধনু রথে বিদায়ের পথে উঠিছে মেতে। রঙে রঙে আজ গোধূলি গগন নহেকো রঙিন, বিলাপে মগন। আমি কেঁদে কই যেয়ে না কোথাও, সে যে হেসে কয় মোরে যেতে দাও, বাড়ায়ে বাহু বিরহ-রাহু চাহিছে পেতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ওগো কবি তুমি আপন ভোলা, সুকান্ত ভট্টাচার্য ওগো কবি তুমি আপন ভোলা, আনিলে তুমি নিথর জলে ঢেউয়ের দোলা! মালাখানি নিয়ে মোর একী বাঁধিলে অলখ ডোর! নিবেদিত প্ৰাণে গোপনে তোমার কী সুর তোলা। জেনেছ তো তুমি অজানা প্ৰাণের নীরব কথা। তোমার বাণীতে আমার মনের এ ব্যাকুলতা— পেয়েছ কী তুমি সাঁঝের বেলাতে যখন ছিলাম কাজের খেলাতে তখন কি তুমি এসেছিলে ছিল দুয়ার খোলা।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কঙ্কণ-কিঙ্কিণী মঞ্জুল মঞ্জীর ধ্বনি, সুকান্ত ভট্টাচার্য কঙ্কণ-কিঙ্কিণী মঞ্জুল মঞ্জীর ধ্বনি, মম অন্তর-প্ৰাঙ্গণে আসন্ন হল আগমনী। ঘুমভাঙা উদ্বেল রাতে, আধ-ফোটা ভীরু জ্যোৎস্নাতে কার চরণের ছোঁয়া হৃদয়ে উঠিল রণরণি মেঘ-অঞ্জন-ঘন কার এই আঁখি পাতে লিখা, বন্দন-নন্দিত উৎসবে জ্বালা দীপশিখা। মুকুলিত আপনার ভারে টলিয়া পড়িছে বারে বারে সংগীত হিল্লোলে কে সে স্বপনের অগ্ৰণী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কিছু দিয়ে যাও এই ধূলিমাখা পান্থশালায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য কিছু দিয়ে যাও এই ধূলিমাখা পান্থশালায়, কিছু মধু দাও আমার বুকের ফুলের মালায়। কত জন গেল এ পথ দিয়ে আমার বুকের সুবাস নিয়ে কিছু ধন তারা দিয়ে গেল মোর সোনার থালায়। পথ চেয়ে আমি বসে আছি হেথা তোমার আশে তুমি এলে যদি কাছে বসে প্রিয় আমার পাশে। কিছু কথা বল আমার সনে, ঢেউ তুলে যাও নীরব মনে, এইটুকু শুধু দাও তুমি ওগো আমার ডালায়।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কোন অভিশাপ নিয়ে এল এই সুকান্ত ভট্টাচার্য কোন অভিশাপ নিয়ে এল এই বিরহ বিধুর-আষাঢ়। এখানে বুঝি বা শেষ হয়ে গেছে উচ্ছল ভালবাসার। বিরহী যক্ষ রামগিরি হতে পাঠাল বারতা জলদের স্রোতে প্রিয়ার কাছেতে জানাতে চাহিল সব শেষ সব আশার।। আমার হৃদয়ে এল বুঝি সেই মেঘ, সেই বিহবল পৰ্বত-উদ্বেগ। তাই এই ভরা বাদল আঁধারে মন উন্মন হল বারে বারে হৃদয় তাইতে সমুখীন হল বিপুল সর্বনাশার।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ক্লান্ত আমি, ক্লান্ত আমি কর ক্ষমা, সুকান্ত ভট্টাচার্য ক্লান্ত আমি, ক্লান্ত আমি কর ক্ষমা, মুক্তি দাও। হে এ-মরু তরুরে, প্ৰিয়তমা। ছিন্ন কর এ গ্রন্থিডোর রিক্ত হয়েছে চিত্ত মোর নেমেছে আমার হৃদয়ে শ্রান্তি ঘন-অমা। যে আসব ছিল তোমার পাত্রে, শোষণ করেছি দিনে ও রাত্রে। রসের সিন্ধু মন্থন শেষে, গরল উঠেছে তব উদ্দেশে, তুমি আর নিহ আমার অতীত, হে মনোরম।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
গানের সাগর পারি দিলাম সুকান্ত ভট্টাচার্য গানের সাগর পারি দিলাম সুরের তরঙ্গে, প্ৰাণ ছুটেছে নিরুদ্দেশে ভাবের তুরঙ্গে। আমার আকাশ মীড়ের মূর্ছনাতে উধাও দিনে রাতে; তান তুলেছে। অন্তবিহীন রসের মৃদঙ্গে। আমি কবি সপ্তসুরের ডোরে, মগ্ন হলাম অতল ঘুম-ঘোরে; জয় করেছি জীবনে শঙ্কারে, মোর বীণা ঝংকারে : গানের পথের পথিক আমি সুরেরই সঙ্গে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
গুঞ্জরিয়া এল অলি সুকান্ত ভট্টাচার্য গুঞ্জরিয়া এল অলি; যেথা নিবেদন অঞ্জলি। পুষ্পিত কুসুমের দলে গুন্‌গুন্‌ গুঞ্জিয়া চলে দলে দলে যেথা ফোটা-কলি। আমার পরাণে ফুল ফুটিল যবে, তখন মেতেছি আমি কী উৎসবে। আজ মোর ঝরিবার পালা, সব মধু হয়ে গেছে ঢালা; আজ মোরে চলে যেও দলি।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে সুকান্ত ভট্টাচার্য দাঁড়াও ক্ষণিক পথিক হে যেয়ে না চলে, অরুণ-আলো কে যে দেবে যাও গো বলে। ফেরো তুমি যাবার বেলা, সাঁঝ আকাশে রঙের মেলা দেখেছি কী কেমন ক’রে আগুন হয়ে উঠল জ্বলে। পুব গগনের পানে বারেক তাকাও বিরহেরই ছবি কেন আঁকাও? আঁধার যেন প্লাবন সম আসছে বেগে শেষ হয়ে যাক তারা তোমার ছোঁয়াচ লেগে। থামো ওগো, যেয়ে না হয়। সময় হলে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ফোটে ফুল আসে যৌবন সুকান্ত ভট্টাচার্য ফোটে ফুল আসে যৌবন সুরভি বিলায় দোঁহে বসন্তে জাগে ফুলবন অকারণে যায বহে।। কোনো এককাল মিলনে, বিশ্বেরে অনুশীলনে কাটে জানি জানি অনুক্ষণ অতি অপরূপ মোহে।। ফুল ঝরে আর যৌবন চলে যায়, বার বার তারা ‘ভালবাসো’ বলে যায় তারপর কাটে বিরহে, শূন্য শাখায় কী রহে সে কথা শুধায় কোন মন? ‘তুমি বৃথা’ যায় কহে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভুল হল বুঝি এই ধরণীতলে সুকান্ত ভট্টাচার্য ভুল হল বুঝি এই ধরণীতলে, তাই প্ৰাণে চিরকাল আগুন জ্বলে তাই আগুন জ্বলে। দিনের শেষে এক প্লাবন এসে জানি ঘিরিবে আমার মন কৌতূহলে, নব কৌতূহলে। আমার জীবনে ভুল ছিল না বুঝি, তাই বারে বারে সে আমারে গিয়াছে খুঁজি। দিনের শেষে আজ বাউল বেশে ঘূচাব মনের ভুল নয়ন জলে, মোর নয়ন জলে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মুখ তুলে চায় সুবিপুল হিমালয় সুকান্ত ভট্টাচার্য মুখ তুলে চায় সুবিপুল হিমালয়, আকাশের সাথে প্ৰণয়ের কথা কয়, আকাশ কহিছে ডেকে, কথা কও কোথা থেকে? তুমি যে ক্ষুদ্র মোর কাছে মনে হয়।। হিমালয় তাই মুর্ছিত অভিমানে, সে কথা কেহ না জানে। ব্যর্থ প্রেমের ভারে দীর্ঘ নিশাস ছাড়ে— হিমালয় হতে তুষারের ঝড় বয়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মেঘ-বিনিন্দিত স্বরে সুকান্ত ভট্টাচার্য মেঘ-বিনিন্দিত স্বরে– কে তুমি আমারে ডাকিলে শ্রাবণ বাতাসে? তোমার আহবান ধ্বনি পরশিয়া মোরে গরজিল দূর আকাশে। বেদনা বিভোল আমি ক্ষণেক দুয়ারে থামি বাহিরে ধূসর দিনে— ছুটে চলি পথে মন্দির-বিবশ নিশাসে। মেঘে মেঘে ছাওয়া মলিন গগনে, কোন আয়োজন ছিল আনমনে। বাহিরে কী ঘনঘটা, ভিতরে বিজলী-ছটা মত্ত ভিতরে বাহিরে– আজ কি কাটিবে বিরহ বিধুর হতাশে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
শীতের হাওয়া ছুয়ে গেল ফুলের বনে সুকান্ত ভট্টাচার্য শীতের হাওয়া ছুয়ে গেল ফুলের বনে, শিউলি-বকুল উদাস হল ক্ষণে ক্ষণে, ধূলি-ওড়া পথের প’রে বনের পাতা শীতের ঝড়ে যায় ভেসে ক্ষীণ মলিন হেসে আপন মনে রাতের বেলা বইল বাতাস নিরুদ্দেশে, কাঁপনটুকু রইল শুধু বনের শেষে। কাশের পাশে হিমের হাওয়া, কেবল তারি আসা-যাওয়া— সব-ঝরাবার মন্ত্রণা সে দিল শুধু সংগোপনে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
শয়ন শিয়রে ভোরের পাখির রবে সুকান্ত ভট্টাচার্য শয়ন শিয়রে ভোরের পাখির রবে তন্দ্ৰা টুটিল যবে। দেখিলাম আমি খোলা বাতায়নে তুমি আনমনা কুসুম চয়নে অন্তর মোর ভরে গেল সৌরভে। সন্ধ্যায় যবে ক্লান্ত পাখিরা ধীরে, ফিরিছে আপন নীড়ে, দেখিলাম তুমি এলে নদীকূলে চাহিলে আমায় ভীরু আঁখি তুলে হৃদয় তখনি উড়িল অজানা নভে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সাঁঝের আঁধার ঘিরল যখন সুকান্ত ভট্টাচার্য সাঁঝের আঁধার ঘিরল যখন শাল-পিয়ালের বন, তারই আভাস দিল আমায় হঠাৎ সমীরণ। কুটির ছেড়ে বাইরে এসে দেখি আকাশকোণে তারার লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে বহুক্ষণ। আজকে আমার মনের কোণে কে দিল যে গান, ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠি রোমাঞ্চিত প্ৰাণ। আকাশতলে বিমুক্ত প্ৰান্তরে, উধাও হয়ে গেলাম ক্ষণ তরে! কার ইশারায় হলাম অন্যমন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হে পাষান, আমি নির্ঝরিণী সুকান্ত ভট্টাচার্য হে পাষান, আমি নির্ঝরিণী তব হৃদয়ে দাও ঠাঁই। আমার কল্লোলে নিঠুর যায় গ’লে ঢেউয়েতে প্ৰাণ দোলে, —তবু নীরব সদাই! আমার মৰ্মেতে কী গান ওঠে মেতে জানো না তুমি তা, তোমার কঠিন পায় চির দিবসই হায় রহিনু অবনতা। যতই কাছে আসি আমারে মৃদু হাসি করিছ পরবাসী, তোমাতে প্ৰেম নাই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হে মোর মরণ, হে মোর মরণ সুকান্ত ভট্টাচার্য হে মোর মরণ, হে মোর মরণ! বিদায় বেলা আজ একেলা দাও গো শরণ। তুমি আমার বেদনাতে দাও আলো আজ এই ছায়াতে ফোটার গন্ধে অলস ছন্দে ফেলিও চরণ।। তোমার বুকে অজানা স্বাদ, ক্লান্তি আনো, দাও অবসাদ; তোমায় আমি দিবসযামী করিনু বরণ। তোমার পায়ে কী আছে যে, জীবনবীণা উঠেছে বেজে? আমায় তুমি নীরব চুমি করিও হরণ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অদ্বৈধ সুকান্ত ভট্টাচার্য নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল? দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য; ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য এখনো বিপদ অগ্রাহ্য? পৃথিবী, এ পুরাতন পৃথিবী দেখ আজ অবশেষে নিঃস্ব স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য। রুক্ষ মরুর দুঃস্বপ্ন হৃদয় আজকে শ্বাসরুদ্ধ, একলা গহন পথে চলতে জীবন সহসা বিক্ষুব্ধ। জীবন ললিত নয় আজকে ঘুচেছে সকল নিরাপত্তা, বিফল স্রোতের পিছুটানকে শরণ করেছে ভীরু সত্তা। তবু আজ রক্তের নিদ্রা, তবু ভীরু স্বপ্নের সখ্য; সহসা চমক লাগে চিত্তে দুর্জয় হল প্রতিপক্ষ! নিরুপায় ছিঁড়ে গেল দ্বৈদ নির্জনে মুখ তোলে অঙ্কুর, বুঝে নিল উদ্যোগী আত্মা জীবন আজকে ক্ষণভঙ্গুর। দলিত হৃদয় দেখে স্বপ্ন নতুন, নতুনতর বিশ্ব, তাই আজ স্বপ্নের ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অনন্যোপায় সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক গড়ার চেষ্টা ব্যর্থ হল, ব্যর্থ বহু উদ্যম আমার, নদীতে জেলেরা ব্যর্থ, তাঁতী ঘরে, নিঃশব্দ কামার, অর্ধেক প্রাসাদ তৈরী, বন্ধ ছাদ-পেটানোর গান, চাষীর লাঙল ব্যর্থ, মাঠে নেই পরিপূর্ণ ধান। যতবার গড়ে তুলি, ততবার চকিত বন্যায়। উদ্যত সৃষ্টিকে ভাঙে পৃথিবীতে অবাধ অন্যায়। বার বার ব্যর্থ, তাই আজ মনে এসেছে বিদ্রোহ, নির্বিঘ্নে গড়ার স্বপ্ন ভেঙে গেছে; ছিন্নভিন্ন মোহ। আজকে ভাঙার স্বপ্ন- অন্যায়ের দম্ভকে ভাঙার, বিপদ ধ্বংসেই মুক্তি, অন্য পথ দেখি নাকো আর। তাইতো তন্দ্রাকে ভাঙি, ভাঙি জীর্ণ সংস্কারের খিল, রুদ্ধ বন্দীকক্ষ ভেঙে মেলে দিই আকাশের নীল। নির্বিঘ্নে সৃষ্টিকে চাও? তবে ভাঙো বিঘ্নের বেদীকে, উদ্দাম ভাঙার অস্ত্র ছুঁড়ে দাও চারিদিকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অবৈধ সুকান্ত ভট্টাচার্য আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল উত্তর মহাসাগরের কূলে আমার স্বপ্নের ফুলে তারা কথা কয়েছিল অস্পষ্ট পুরনো ভাষায় অস্ফুট স্বপ্নের ফুল অসহ্য সূর্যের তাপে অনিবার্য ঝরেছিল মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্‌ভ হতাশায়। হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া সেদিন আর নেই- নেই আর সূর্য-বিকিরণ আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ! শুনি নি স্বপ্নের ডাকঃ থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে। সহসা একদিন আমার দরজায় নেমে এল নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা। সেইদিন বসন্তের পাখি উড়ে গেল যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত । আজ মনে হয় হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে, কী ক’রে সম্ভব হল আমার রক্তকে ভালবাসা! সূর্যের কুয়াশা এখনো কাটে নি ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা। মুহূর্তের সোনা এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়, এরই মদ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর, অন্যমনে এ কী দুর্ঘটনা- হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অভিবাদন সুকান্ত ভট্টাচার্য হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা দিকে দিকে উদ্‌যাপন করছে লগ্ন, পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন। আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন, মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা, ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা। স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য, বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ! হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান? দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান। বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি; তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অলক্ষ্যে সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার মৃত্যুর পর কেটে গেল বৎসর বৎসর; ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতির ব্যর্থ প্রচেষ্টাও আজ অগভীর, এখন পৃথিবী নয় অতিক্রান্ত প্রায়ান্ধ স্থবির; নিভেছে প্রদূম্রজ্বালা, নিরঙ্কুশ সূর্য অনশ্বর ; স্তব্ধতা নেমেছে রাত্রে থেমেছে নির্ভীক তীক্ষ্ণস্বর- অথবা নিরন্ন দিন, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ; উদ্ধত বজ্রের ভয়ে নিঃশব্দে মৃত্যুর আনাগোনা, অনন্য মানবসত্তা ক্রমান্বয়ে স্বল্পপরিসর। গলিত স্মৃতির বাস্প সেদিনের পল্লব শাখায় বারম্বার প্রতারিত অস্ফুট কুয়াশা রচনায়; বিলুপ্ত বজ্রের ঢেউ নিশ্চিত মৃত্যুতে প্রতিহত। আমার অজ্ঞাত দিন নগণ্য উদার উপেক্ষাতে অগ্রগামী শূন্যতাকে লাঞ্চিত করেছে অবিরত তথাপি তা প্রস্ফুটিত মৃত্যুর অদৃশ্য দুই হাতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমরা এসেছি সুকান্ত ভট্টাচার্য কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল, মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল। দুঃখ-যুগের দারায় দারায় যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায় তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল। তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল- কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল, তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল। আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা, হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল- আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল। উধাও আলোর নিচে সমারোহ , মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ! ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল! সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল- একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল, দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল। সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার, থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়, ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল। আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
উদ্বীক্ষণ সুকান্ত ভট্টাচার্য নগরে ও গ্রামে জমেছে ভিড় ভগ্ননীড়,- ক্ষুদিত জনতা আজ নিবিড়। সমুদ্রে জাগে না বাড়বানল, কী উচ্ছল, তীরসন্ধানী ব্যাকুল জল। কখনো হিংস্র নিবিড় শোকে; দাঁতে ও নখে- জাগে প্রতিজ্ঞা অন্ধ চোখে। তবু সমুদ্র সীমানা রাখে, দুর্বিপাকে দিগন্তব্যাপী প্লাবন ঢাকে। আসন্ন ঝড়ো অরণ্যময় যে বিস্ময় ছড়াবে, তার কি অযথা ক্ষয়? দেশে ও বিদেশে লাগে জোয়ার, ঘোড়সোয়ার চিনে নেবে দৃঢ় লোহার, যে পথে নিত্য সূর্যোদয় আনে প্রলয়, সেই সীমান্তে বাতাস বয়; তাই প্রতীক্ষা- ঘনায় দিন স্বপ্নহীন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
একুশে নভেম্বরঃ ১৯৪৬ সুকান্ত ভট্টাচার্য আবার এবার দুর্বার সেই একুশে নভেম্বর- আকাশের কোণে বিদ্যুৎ হেনে তুলে দিয়ে গেল                                     মুত্যুকাঁপানো ঝড়। আবার এদেশে মাঠে, ময়দানে সুদূর গ্রামেও জনতার প্রাণে হাসানাবাদের ইঙ্গিত হানে প্রত্যাঘাতের স্বপ্ন ভয়ঙ্কর। আবার এসেছে অবাধ্য এক একুশে নভেম্বর।। পিছনে রয়েছে একটি বছর, একটি পুরনো সাল, ধর্মঘট আর চরম আঘাতে উদ্দাম, উত্তাল; বার বার জিতে, জানি অবশেষে একবার গেছি হেরে- বিদেশী! তোদের যাদুদণ্ডকে এবার নেবই কেড়ে। শোন্ রে বিদেশী, শোন্ আবার এসেছে লড়াই জেতার চরম শুভক্ষণ। আমরা সবাই অসভ্য, বুনো- বৃথা রক্তের শোধ নেব দুনো একপা পিছিয়ে দু’পা এগোনোর             আমরা করেছি পণ, ঠ’কে শিখলাম– তাই তুলে ধরি দুর্জয় গর্জন। আহ্বান আসে অনেক দূরের, হায়দ্রাবাদ আর ত্রিবাঙ্কুরের, আজ প্রয়োজন একটি সুরের                          একটি কঠোর স্বরঃ “দেশী কুকুর! আবার এসেছে একুশে নভেম্বর।” ডাক ওঠে, ডাক ওঠে- আবার কঠোর বহু হরতালে আসে মিল্লাত, বিপ্লবী ডালে এখানে সেখানে রক্তের ফুল ফোটে। এ নভেম্বরে আবারো তো ডাক ওঠে।। আমাদের নেই মৃত্যু এবং আমাদের নেই ক্ষয়, অনেক রক্ত বৃথাই দিলুম তবু বাঁচবার শপথ নিলুম কেটে গেছে আজ রক্তদানের ভয়! ল’ড়ে মরি তাই আমরা অমর, আমরাই অক্ষয়।। আবার এসেছে তেরোই ফেব্রুয়ারী,             দাঁতে দাঁত চেপে             হাতে হাত চেপে                         উদ্যত সারি সারি , কিছু না হলেও আবার আমরা                                      রক্ত দিতে তো পারি? পতাকায় পতাকায় ফের মিল আনবে ফেব্রুয়ারি। এ নভেম্বরে সংকেত পাই তারি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কবিতার খসড়া সুকান্ত ভট্টাচার্য আকাশে আকাশে ধ্রুবতারায় কারা বিদ্রোহে পথ মাড়ায় ভরে দিগন্ত দ্রুত সাড়ায়,              জানে না কেউ। উদ্যমহীন মূঢ় কারায় পুরনো বুলির মাছি তাড়ায় যারা, তারা নিয়ে ঘোরে পাড়ায় স্মৃতির ফেউ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
কবে সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক স্তব্ধ দিনের এপারে চকিত চুতুর্দিক, আজো বেঁচে আছি মৃত্যুতাড়িত আজো বেঁচে আছি ঠিক। দুলে ওঠে দিন; শপথমুখর কিষাণ শ্রমিকপাড়া, হাজারে হাজারে মাঠে বন্দরে আজকে দিয়েছে সাড়া। জ^লে আলো আজ, আমাদের হাড়ে জমা হয় বিদ্যুৎ, নিহত দিনের দীর্ঘ শাখায় ফোটে বসন্তদূত। মূঢ় ইতিহাস; চল্লিশ কোটি সৈন্যের সেনাপতি। সংহত দিন, রুখবে কে এই একত্রীভূত গতি? জানি আমাদের অনেক যুগের সঞ্চিত স্বপ্নেরা দ্রুত মুকুলিত তোমার দিন ও রাত্রি দিয়েই ঘেরা। তাই হে আদিম, ক্ষতবিক্ষত জীবনের বিস্ময়, ছড়াও প্লাবন, দুঃসহ দিন আর বিলম্ব নয়। সারা পৃথিবীর দুয়ারে মুক্তি, এখানে অন্ধকার, এখানে কখন আসন্ন হবে বৈতরণীর পার?
সুকান্ত ভট্টাচার্য
চিরদিনের সুকান্ত ভট্টাচার্য এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা, সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা। জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া, পচা জল আর মশায় অহংকারী নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া। এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে, গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে। রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ; বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত। দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে, কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে। রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে, কেমন ক’রে সে আকালেতে গতবারে, চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে। এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে, সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে। হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে, ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে, সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ছুরি সুকান্ত ভট্টাচার্য বিগত শেষ-সংশয়; স্বপ্ন ক্রমে ছিন্ন, আচ্ছাদন উন্মোচন করেছে যত ঘৃণ্য, শঙ্কাকুল শিল্পীপ্রাণ, শঙ্কাকুল কৃষ্টি, দুর্দিনের অন্ধকারে ক্রমশ খোলে দৃষ্টি। হত্যা চলে শিল্পীদের, শিল্প আক্রান্ত, দেশকে যারা অস্ত্র হানে, তারা তো নয় ভ্রান্ত। বিদেশী-চর ছুরিকা তোলে দেশের হৃদয়-বৃন্তে সংস্কৃতির শত্রুদের পেরেছি তাই চিনতে। শিল্পীদের রক্তস্রোতে এসেছে চৈতন্য গুপ্তঘাতী শত্রুদের করি না আজ গণ্য। ভুলেছে যারা সভ্য-পথ,সম্মুখীন যুদ্ধ, তাদের আজ মিলিত মুঠি করুক শ্বাসরুদ্ধ, শহীদ-খুন আগুন জ্বালে, শপথ অক্ষুণঃ এদেশ অতি শীঘ্র হবে বিদেশী-চর শূন্য। বাঁচাব দেশ, আমার দেশ, হানবো প্রতিপ, এ জনতার অন্ধ চোখে আনবো দৃঢ় লক্ষ্য। বাইরে নয় ঘরেও আজ মৃত্যু ঢালে বৈরী, এদেশে-জন বাহিনী তাই নিমেষে হয় তৈরী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী সুকান্ত ভট্টাচার্য কত যুগ, কত বর্ষান্তের শেষে              জনতার মুখে ফোটে বিদ্যুৎবাণী; আকাশে মেঘের তাড়াহুড়ো দিকে দিকে              বজ্রের কানাকানি। সহসা ঘুমের তল্লাট ছেড়ে              শান্তি পালাল আজ। দিন ও রাত্রি হল অস্থির              কাজ, আর শুধু কাজ! জনসিংহের ক্ষুদ্ধ নখর              হয়েছে তীক্ষ্ণ, হয়েছে প্রখর              ওঠে তার গর্জন- প্রতিশোধ, প্রতিশোধ! হাজার হাজার শহীদ ও বীর স্বপ্নে নিবিড় স্মরণে গভীর              ভুলি নি তাদের আত্মবিসর্জন। ঠোঁটে ঠোঁটে কাঁপে প্রতিজ্ঞা দুর্বোধঃ              কানে বাজে শুধু শিকলের ঝন্‌ঝন্‌; প্রশ্ন নয়কো পারা না পারার, অত্যাচারীর রুদ্ধ কারার              দ্বার ভাঙা আজ পণ; এতদিন ধ’রে শুনেছি কেবল শিকলের ঝন্‌ঝন্‌ ওরা বীর, ওরা আকাশে জাগাত ঝড়, ওদের কাহিনী বিদেশীর খুনে গুলি, বন্দুক, বোমার আগুনে              আজো রোমাঞ্চকর; ওদের স্মৃতিরা শিরায় শিরায়              কে আছে আজকে ওদের ফিরায় কে ভাবে ওদের পর? ওরা বীর, আকাশে জাগাত ঝড়! নিদ্রায়, কাজকর্মের ফাঁকে ওরা দিনরাত আমাদের ডাকে              ওদের ফিরাব কবে? কবে আমাদের বাহুর প্রতাপে কোটি মানুষের দুর্বার চাপে              শৃঙ্খল গত হবে? কবে আমাদের প্রাণকোলাহলে কোটি জনতার জোয়ারের জলে              ভেসে যাবে কারাগার। কবে হবে ওরা দুঃখসাগর পার? মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি; ওরা আমাদের রক্ত দিয়েছে, বদলে দুহাতে শিকল নিয়েছে              গোপনে করেছে ঋণী। মহাজন ওরা, আমরা ওদের চিনি!              হে খাতক নির্বোধ, রক্ত দিয়েই সব ঋণ করো শোধ! শোনো, পৃথিবীর মানুষেরা শোনো,              শোনো স্বদেশের ভাই, রক্তের বিনিময় হয় হোক              আমরা ওদের চাই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
জনরব সুকান্ত ভট্টাচার্য পাখি সব করে রব, রাত্রি শেষ ঘোষণা চৌদিকে, ভোরের কাকলি শুনি; অন্ধকার হয়ে আসে ফিকে, আমার ঘরেও রুদ্ধ অন্ধকার, ষ্পস্ট নয় আলো, পাখিরা ভোরের বার্তা অকস্মাৎ আমাকে শোনালো। স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠি, অন্ধকারে খাড়া করি কান- পাখিদের মাতামাতি, শুনি মুখরিত ঐকতান; আজ এই রাত্রিশেষে বাইরে পাখির কলরবে রুদ্ধ ঘরে ব’সে ভাবি, হয়তো কিছু বা শুরু হবে, হয়তো এখনি কোনো মুক্তিদূত দুরন্ত রাখাল, মুক্তির অবাদ মাঠে নিয়ে যাবে জনতার পাল; স্বপ্নের কুসুমকলি হয়তো বা ফুটেছে কাননে, আমি কি খবর রাখি? আমি বদ্ধ থাকি গৃহকোণে, নির্বাসিত মন চিরকাল অন্ধকারে বাসা, তাইতো মুক্তির স্বপ্ন আমাদের নিতান্ত দুরাশা। জন-পাখিদের কণ্ঠে তবুও আলোর অভ্যর্থনা. দিকে দিকে প্রতিদিন অবিশ্রান্ত শুধু যায় শোনা; এরা তো নগণ্য জানি, তুচ্ছ বলে ক’রে থাকি ঘৃণা, আলোর খবর এরা কি ক’রে যে পায় তা জানি না। এদের মিলিত সুরে কেন যেন বুক ওঠে দুলে, অকস্মাৎ পূর্বদিকে মনের জানালা দিই খুলেঃ হঠাৎ বন্দর ছাড়া বাঁশি বুঝি বাজায় জাহাজ, চকিতে আমার মনে বিদ্যুৎ বিদীর্ণ হয় আজ। অদূরে হঠাৎ বাজে কারখানার পঞ্চজন্যধ্বনি, দেখি দলে দলে লোক ঘুম ভেঙে ছুটছে তখনি, মনে হয়, যদি বাজে মুক্তি-কারখানার তীব্র শাঁখ তবে কি হবে না জমা সেখানে জনতা লাখে লাখ? জন-পাখিদের গানে মুখরিত হবে কি আকাশ? – ভাবে নির্বাসিত মন, চিরকাল অন্ধকারে বাস। পখিদের মাতামাতি; বুঝি মুক্তি নয় অসম্ভব, যদিও ওঠে নি সূর্য, তবু আজ শুনি জনরব।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দিক্‌প্রান্তে সুকান্ত ভট্টাচার্য ভাঙন নেপথ্য পৃথিবীতে; অদৃশ্য কালের শত্রু প্রচ্ছন্ন জোয়ারে, অনেক বিপন্ন জীব ক্ষয়িষ্ণু খোঁয়াড়ে উন্মুখ নিঃশেষে কেড়ে নিতে, দুর্গম বিষণ্ণ শেষ শীতে। বীভৎস প্রাণের কোষে কোষে নিঃশব্দে ধ্বংসের বীজ নির্দিষ্ট আয়ুতে পশেছে আঁদার রাত্রে- প্রত্যেক স্নায়ুতে;- গোপনে নক্ষত্র গেছে খসে আরক্তিম আদিম প্রদোষে।। দিনের নীলাভ শেষ আলো জানাল আসন্ন রাত্রি দুর্লক্ষ্য সংকেতে। অনেক কাস্তের শব্দ নিঃস্ব ধানেক্ষেতে সেই রাত্রে হাওয়ায় মিলাল; দিক্‌প্রান্তে সূর্য চমকাল।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দিনবদলের পালা সুকান্ত ভট্টাচার্য আর এক যুদ্ধ শেষ, পৃথিবীতে তবু কিছু জিজ্ঞাসা উন্মুখ। উদ্দাম ঢাকের শব্দে সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়? বিজয়ী বিশ্বের চোখ মুদে আসে, নামে এক ক্লান্তির জড়তা। রক্তাক্ত প্রান্তর তার অদৃশ্য দুহাতে নাড়া দেয় পৃথিবীকে, সে প্রশ্নের উত্তর কোথায়? তুষারখচিত মাঠে, ট্রেঞ্চে, শূন্যে, অরণ্যে, পর্বতে অস্থির বাতাস ঘোরে দুর্বোধ্য ধাঁধায়, ভাঙা কামানের মুখে ধ্বংসস্তূপে উৎকীর্ণ জিজ্ঞাসাঃ কোথায় সে প্রশ্নের উত্তর? দিগ্বিজয়ী দুঃশাসন! বহু দীর্ঘ দীর্ঘতর দিন তুমি আছ দৃঢ় সিংহাসনে সমাসীন, হাতে হিসেবের খাতা উন্মুখর এই পৃথিবীঃ আজ তার শোধ করো ঋণ। অনেক নিয়েছ রক্ত, দিয়েছ অনেক অত্যাচার, আজ হোক তোমার বিচার। তুমি ভাব, তুমি শুধু নিতে পার প্রাণ, তোমার সহায় আছে নিষ্ঠুর কামান; জানো নাকি আমাদেরও উষ্ণ বুক, রক্ত গাঢ় লাল, পেছনে রয়েছে বিশ্ব, ইঙ্গিত দিয়েছে মহাকাল, স্পীডোমিটারের মতো আমাদের হৃৎপিণ্ড উদ্দাম, প্রাণে গতিবেগ আনে, ছেয়ে ফেলে জনপদ-গ্রাম, বুঝেছি সবাই আমরা আমাদের কী দুঃখ নিঃসীম, দেখ ঘরে ঘরে আজ জেগে ওঠে এক এক ভীম। তবুও যে তুমি আজো সিংহাসনে আছ সে কেবল আমাদের বিরাট মায়। এখানে অরণ্য স্তব্ধ, প্রতীক্ষা-উৎকীর্ণ চারিদিক, গঙ্গায় প্লাবন নেই, হিমালয় ধৈর্যের প্রতীক; এ সুযোগে খুলে দাও ক্রূর শাসনের প্রদর্শনী, আমরা প্রহর শুধু গনি। পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ, বন্ধ সৈনিকের রক্ত ঢালাঃ ভেবেছ তোমার জয়, তোমার প্রাপ্য এ জয়মালা; জানো না এখানে যুদ্ধ-শুরু দিনবদলের পালা।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
দেওয়ালী সুকান্ত ভট্টাচার্য (ভূপেন্দ্রনাথ ভট্রাচার্য-কে) তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালীর শুভেচ্ছা কামনা পেয়েছি, তবুও আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা, আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব, রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব। এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি, মুমূর্ষু কলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা, কাঁদে নোয়াখালী, সভ্যতাকে পিষে ফেলে সাম্রাজ্য ছড়ায় বর্বরতঃ এমন দুঃসহ দিনে ব্যর্থ লাগে শুভেচ্ছার কথা; তবু তোর রঙচঙে সুমধুর চিঠির জবাবে কিছু আজ বলা চাই, নইলে যে প্রাণের অভাবে পৃথিবী শুকিয়ে যাবে, ভেসে যাবে রক্তের প্লাবনে। যদিও সর্বদা তোর শুভ আমি চাই মনে মনে, তবুও নতুন ক’রে আজ চাই তোর শান্তিসুখ, মনের আঁধারে তোর শত শত প্রদীপ জ্বলুক, এ দুর্যোগ কেটে যাবে, রাত আর কতক্ষণ থাকে? আবার সবাই মিলবে প্রত্যাসন্ন বিপ্লবের ডাকে, আমার ঐশ্বর্য নেই, নেই রঙ, নেই রোশনাই- শুধু মাত্র ছন্দ আছে, তাই দিয়ে শুভেচ্ছা পাঠাই।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
নিভৃত ২ সুকান্ত ভট্টাচার্য বিষণ্ণ রাত, প্রসন্ন দিন আনো আজ মরণের অন্ধ অনিদ্রায়, সে অন্ধতায় সূর্যের আলো হানো, শ্বেত স্বপ্নের ঘোরে যে মৃতপ্রায়। নিভৃত-জীবন-পরিচর্যায় কাটে যে দিনের, আজ সেখানে প্রবল দ্বন্দ্ব। নিরন্ন প্রেম ফেরে নির্জন হাটে, অচল চরণ ললাটের নির্বন্ধ? জীবন মরণে প্রাণের গভীরে দোলা কাল রাতে ছিল নিশীথ কুসুমগন্ধী, আজ সূর্যের আলোয় পথকে ভোলা মনে হয় ভীরু মনের দুরভিসন্ধি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
নিভৃত সুকান্ত ভট্টাচার্য অনিশ্চিত পৃথিবীতে অরণ্যের ফুল রচে গেল ভুল; তারা তো জানত যারা পরম ঈশ্বর তাদের বিভিন্ন নয় স্তর, অনন্তর তারাই তাদের সৃষ্টিতে অনর্থক পৃথক দৃষ্টিতে একই কারুকার্যে নিয়মিত উত্তপ্ত গলিত ধাতুদের পরিচয় দিত। শেষ অধ্যায় এল অকস্মাৎ। তখন প্রমত্ত প্রতিঘাত শ্রেয় মেনে নিল ইতিহাস, অকল্পেয় পরিহাস সুদূর দিগন্তকোণে সকরুণ বিলাল নিঃশ্বাস। যেখানে হিমের রাজ্য ছিল, যেখানে প্রচ্ছন্ন ছিল পশুর মিছিলও সেখানেও ধানের মঞ্জরী প্রাণের উত্তাপে ফোটে, বিচ্ছিন্ন শর্বরী; সূর্য-সহচরী! তাই নিত্যবুভুক্ষিত মন চিরন্তন লোভের নিষ্ঠুর হাত বাড়াল চৌদিকে পৃথিবীকে একাগ্রতায় নিলো লিখে। সহসা প্রকম্পিত সুষুপ্ত সত্তায় কঠিন আঘাত লাগে সুনিরাপত্তায়। ব্যর্থ হল গুপ্ত পরিপাক, বিফল চীৎকার তোলে বুভুক্ষার কাক –পৃথিবী বিস্ময়ে হতবাক।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পঁচিশে বৈশাখের উদ্দেশে সুকান্ত ভট্টাচার্য আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ, আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের। হাতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক, পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা, আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা। পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা। আমি দিব্যচক্ষে দেখি অনাগত সে রবীন্দ্রনাথ; দস্যুতায় দৃপ্তকণ্ঠ (বিগত দিনের) ধৈর্যের বাঁধন যার ভাঙে দুঃশাসনের আঘাত, যন্ত্রণায় রুদ্ধবাক, যে যন্ত্রণা সহায়হীনের। বিগত দুর্ভিক্ষে যার উত্তেজিত তিক্ত তীব্র ভাষা মৃত্যুতে ব্যথিত আর লোভের বিরুদ্ধে খরদার, ধ্বংসের প্রান্তরে বসে আনে দৃঢ় অনাহত আশা; তাঁর জন্ম অনিবার্য, তাঁকে ফিরে পাবই আবার। রবীন্দ্রনাথের সেই ভুলে যাওয়া বাণী                                      অকস্মাৎ করে কানাকানি; ‘দামামা ঐ বাজে, দিন বদলের পালা                                      এ ঝড়ো যুগের মাঝে’। নিষ্কম্প গাছের পাতা, রুদ্ধশ্বাস অগ্নিগর্ভ দিন, বিষ্ফারিত দৃষ্টি মেলে এ আকাশ, গতিরুদ্ধ রায়ু ; আবিশ্ব জিজ্ঞাসা এক চোখে মুখে ছড়ায় রঙিন সংশয় স্পন্দিত স্বপ্ন, ভীত আশা উচ্চারণহীন মেলে না উত্তর কোনো, সমস্যায় উত্তেজিত স্নায়ু। ইতিহাস মোড় ফেরে পদতলে বিধ্বস্ত বার্লিন , পশ্চিম সীমান্তে শান্তি, দীর্ঘ হয় পৃথিবীর আয়ু, দিকে দিকে জয়ধ্বনি, কাঁপে দিন রক্তাক্ত আভায়। রামরাবণের যুদ্ধে বিক্ষত এ ভারতজটায়ু মৃতপ্রায়, যুদ্ধাহত, পীড়নে-দুর্ভিক্ষে মৌনমূক। পূর্বাঞ্চল দীপ্ত ক’রে বিশ্বজন-সমৃদ্ধ সভায় রবীন্দ্রনাথের বাণী তার দাবি ঘোষণা করুক। এবারে নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর বিপ্লবের স্বপ্ন চোখে কণ্ঠে গণ-সংগীতের সুর; জনতার পাশে পাশে উজ্জ্বল পতাকা নিয়ে হাতে চলুক নিন্দাকে ঠেলে গ্লানি মুছে আঘাতে আঘাতে। যদিও সে অনাগত, তবু যেন শুনি তার ডাক। আমাদেরই মাঝে তাকে জন্ম দাও পঁচিশে বৈশাখ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পরিখা সুকান্ত ভট্টাচার্য স্বচ্ছ রাত্রি এনেছে প্লাবন, উষ্ণ নিবিড় ধুলিদাপটের মরুচ্ছায়ায় ঘনায় নীল। ক্লান্ত বুকের হৃৎস্পন্দন ক্রমেই ধীর হয়ে আসে তাই শেষ সম্বল তোলো পাঁচিল। ক্ষণভঙ্গুর জীবনের এই নির্বিরোধ হতাশা নিয়েই নিত্য তোমার দাদন শোধ? শ্রান্ত দেহ কি ভীরু বেদনার অন্ধকূপে ডুবে যেতে কাঁদে মুক্তি মায়ায় ইতস্তত; কত শিখণ্ডী জন্ম নিয়েছে নূতন রূপে? দুঃস্বপ্নের প্রায়শ্চিত্ত চোরের মতো। মৃত ইতিহাস অশুচি ঘুচায় ফল্গু-স্নানে; গন্ধবিধুর রুধির তবুও জোয়ার আনে। পথবিভ্রম হয়েছে এবার, আসন্ন মেঘ। চলে ক্যারাভান ধূসর আঁধারে অন্ধগতি, সরীসৃপের পথ চলা শুরু প্রমত্ত বেগ জীবন্ত প্রাণ, বিবর্ণ চোখে অসম্মতি। অরণ্য মাঝে দাবদাহ কিছু যায় না রেখে। মনকে বাঁচাও বিপন্ন এই মৃত্যু থেকে। সঙ্গীবিহনি দুর্জয় এই পরিভ্রমণ রক্তনেশায় এনেছে কেবলই সুখাস্বাদ, এইবারে করো মেরুদুর্গম পরিখা খনন বাইরে চলুক অযথা অধীর মুক্তিবাদ। দুর্গম পথে যাত্রী সওয়ার ভ্রান্তিবিহীন ফুরিয়ে এসেছে তন্দ্রানিঝুম ঘুমন্ত দিন। পালাবে বন্ধু? পিছনে তোমার ধূমন্ত ঝড় পথ নির্জন, রাত্রি বিছানো অন্ধকারে। চলো, আরো দূরে? ক্ষুদিত মরণ নিরন্তর, পুরনো পৃথিবী জেগেছে আবার মৃত্যুপারে, অহেতুক তাই হয়নি তোমার পরিখা খনন, থেমে আসে আজ বিড়ম্বনায় শ্রান্ত চরণ। মরণের আজ সর্পিল গতি বক্রবধির- পিছনে ঝটিকা, সামনে মৃত্যু রক্তলোলুপ। বারুদের দুম কালো ছায়া আনে, – তিক্ত রুধির ; পৃথিবী এখনো নির্জন নয়- জ্বলন্ত ধূপ। নৈঃশব্দ্যের তীরে তীরে আজ প্রতীক্ষাতে সহস্র প্রাণ বসে আছে ঘিরে অস্ত্র হাতে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
পরিশিষ্ট সুকান্ত ভট্টাচার্য অনেক উল্কার স্রোত বয়েছিল হঠাৎ প্রত্যুষে. বিনিদ্র তারার বে পল্লবিত মেঘ ছুঁয়েছিল রশ্মিটুকু প্রথম আবেগে। অকস্মাৎ কম্পমান অশরীরী দিন, রক্তের বাসরঘরে বিবর্ণ মৃত্যুর বীজ ছড়াল আসন্ন রাজপথে। তবু স্বপ্ন নয়ঃ গোদূলীর প্রত্যহ ছায়ায় গোপন স্বার সৃষ্টি কচ্যুত গ্রহ-উপবনেঃ দিগন্তের নিশ্চল আভাস। ভস্মীভূত শ্মশানক্রন্দনে, রক্তিম আকাশচিহ্ন সবেগে প্রস্থান করে যূথ ব্যঞ্জনায়। নিষিদ্ধ কল্পনাগুলি বন্ধ্যা তবু অলক্ষ্যে প্রসব করে অব্যক্ত যন্ত্রণা, প্রথম যৌবন তার রক্তময় রিক্ত জয়টীকা স্তম্ভিত জীবন হতে নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন ক’রে দিল। তারপরঃ প্রান্তিক যাত্রায় অতৃপ্ত রাত্রির স্বাদ, বাসর শয্যায় অসম্বৃত দীর্ঘশ্বাস বিস্মরণী সুরাপানে নিত্য নিমজ্জিত স্বগত জাহ্নবীজলে। তৃষ্ণার্ত কঙ্কাল অতীত অমৃত পানে দৃষ্টি হানে কত! সর্বগ্রাসী প্রলুব্ধ চিতার অপবাদে সভয়ে সন্ধান করে ইতিবৃত্ত দগ্ধপ্রায় মনে। প্রেতাত্মার প্রতিবিম্ব বার্ধক্যের প্রকম্পনে লীন, অনুর্বর জীবনের সূর্যোদয়ঃ ভস্মশেষ চিতা। কুজ্ঝটিকা মূর্ছা গেল আলোক-সম্পাতে, বাসনা-উদ্গ্রীব চিন্তা উন্মুখ ধ্বংসের আর্তনাদে। সরীসৃপ বন্যা যেন জড়তার স্থির প্রতিবাদ, মানবিক অভিযানে নিশ্চিন্ত উষ্ণীষ! প্রচ্ছন্ন অগ্ন্যুৎপাতে সংজ্ঞাহীন মেরুদণ্ড-দিন নিতান্ত ভঙ্গুর, তাই উদ্যত সৃষ্টির ত্রাসে কাঁপেঃ পণভারে জর্জরিত পাথেয় সংগ্রাম, চকিত হরিণদৃষ্টি অভুক্ত মনের পুষ্টিকরঃ অনাসক্ত চৈতন্যের অস্থায়ী প্রয়াণ। অথবা দৈবাৎ কোন নৈর্ব্যক্তিক আশার নিঃশ্বাস নগণ্য অঙ্গারতলে খুঁজেছে অন্তিম। রুদ্ধশ্বাস বসন্তের আদিম প্রকাশ, বিপ্রলব্ধ জনতার কুটিল বিষাক্ত প্রতিবাদে প্রত্যহ লাঞ্ছিত স্বপ্ন, স্পর্ধিত আঘাত! সুষুপ্ত প্রকোষ্ঠতলে তন্দ্রাহীন দ্বৈতাচারী নর নিজেরে বিনষ্ট করে উৎসারিত ধূমে, অদ্ভুত ব্যাধির হিমছায়া দীর্ণ করে নির্যাতিত শুদ্ধ কল্পনাকে ; সদ্যমৃত-পৃথিবীর মানুষের মতো প্রত্যেক মানবমনে একই উত্তাপ অবসাদে। তবুও শার্দূল-মন অন্ধকারে সন্ধ্যার মিছিলে প্রথম বিস্ময়দৃষ্টি মেলে ধরে বিষাক্ত বিশ্বাসে। বহ্নিমান তপ্তশিখা উন্মেষিত প্রথম স্পর্ধায়- বিষকন্যা পৃথিবীর চক্রান্তে বিহ্বল উপস্থিত প্রহরী সভ্যতা। ধূসর অগ্নির পিণ্ডঃ উত্তাপবিহীন স্তিমিত মত্ততাগুলি স্তব্ধ নীহারিকা, মৃত্তিকার ধাত্রী অবশেষে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
প্রিয়তমাসু সুকান্ত ভট্টাচার্য সীমান্তে আজ আমি প্রহরী। অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক’রে আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি- স্বদেশের সীমানায়। দূসর তিউনিসিয়া থেকে স্নিগ্ধ ইতালী, স্নিগ্ধ ইতালী থেকে ছুটে গেছি বিপ্লবী ফ্রান্সে নক্ষত্রনিয়ন্ত্রিত নিয়তির মতো দুর্নিবার, অপরাহত রাইফেল হাতে; – ফ্রান্স থেকে প্রতিবেশী বার্মাতেও। আজ দেহে আমার সৈনিকের কড়া পোশাক, হাতে এখনো দুর্জয় রাইফেল, রক্তে রক্তে তরঙ্গিত জয়ের আর শক্তির দুর্বহ দম্ভ, আজ এখন সীমান্তের প্রহরী আমি। আজ নীল আকাশ আমাকে পাঠিয়েছে নিমন্ত্রণ, স্বদেশের হাওয়া বয়ে এনেছে অনুরোধ, চোখের সামনে খুলে ধরেছে সবুজ চিঠিঃ কিছুতেই বুঝি না কী ক’রে এড়াব তাকে? কী ক’রে এড়াব এই সৈনিকের কড়া পোশাক? যুদ্ধ শেষ। মাঠে মাঠে প্রসারিত শান্তি, চোখে এসে লাগছে তারই শীতল হাওয়া, প্রতি মুহূর্তে শ্লথ হয়ে আসে হাতের রাইফেল, গা থেকে খসে পড়তে চায় এই কড়া পোশাক, রাত্রে চাঁদ ওঠেঃ আমার চোখে ঘুম নেই। তোমাকে ভেবেছি কতদিন, কত শত্রুর পদক্ষেপ শোনার প্রতীক্ষার অবসরে, কত গোলা ফাটার মুহূর্তে। কতবার অবাধ্য হয়েছে মন, যুদ্ধজয়ের ফাঁকে ফাঁকে কতবার হৃদয় জ্বলেছে অনুশোচনার অঙ্গারে তোমার আর তোমাদের ভাবনায়। তোমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্র্যের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে, ঝড়ে আর বন্যায়, মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে বাব বার বিপন্ন হয়েছে তোমাদের অস্তিত্ব। আর আমি ছুটে গেছি এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর এক যুদ্ধক্ষেত্র। জানি না আজো, আছ কি নেই, দুর্ভিক্ষে ফাঁকা আর বন্যায় তলিয়ে গেছে কিনা ভিটে জানি না তাও। তবু লিখছি তোমাকে আজঃ লিখছি আত্মম্ভর আশায় ঘরে ফেরার সময় এসে গেছে। জানি, আমার জন্যে কেউ প্রতীক্ষা ক’রে নেই মালায় আর পতাকায়, প্রদীপে আর মঙ্গলঘটে; জানি, সম্বর্ধনা রটবে না লোক মুখে, মিলিত খুসিতে মিলবে না বীরত্বের পুরস্কার। তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে সে তোমার হৃদয়। যুদ্ধ চাই না আর, যুদ্ধ তো থেমে গেছে; পদার্পণ করতে চায় না মন ইন্দোনেশিয়ায় আর সামনে নয়, এবার পেছনে ফেরার পালা। পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক, এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে। প্রশ্ন করো যদি এত যুদ্ধ ক’রে পেলাম কী? উত্তর তার- তিউনিসিয়ায় পেয়েছি জয়, ইতালীতে জনগণের বন্ধুত্ব, ফ্রান্সে পেয়েছি মুক্তির মন্ত্র; আর নিষ্কণ্টক বার্মায় পেলাম ঘরে ফেরার তাগাদা। আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বিক্ষোভ সুকান্ত ভট্টাচার্য দৃঢ় সত্যের দিতে হবে খাঁটি দাম, হে স্বদেশ, ফের সেই কথা জানলাম। জানে না তো কেউ পৃথিবী উঠছে কেঁপে ধরেছে মিথ্যা সত্যের টুঁটি চেপে, কখনো কেউ কি ভূমিকম্পের আগে হাতে শাঁখ নেয়, হঠাৎ সবাই জাগে? যারা আজ এত মিথ্যার দায়ভাগী, আজকে তাদের ঘৃণার কামান দাগি। ইতিহাস, জানি নীরব সাক্ষী তুমি, আমরা চেয়েছি স্বাধীন স্বদেশভূমি, অনেকে বিরূপ, কানে দেয় হাত চাপা, তাতেই কি হয় আসল নকল মাপা? বিদ্রোহী মন! আজকে ক’রো না মানা, দেব প্রেম আর পাব কলসীর কণা, দেব, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে, জীন্ ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে। কুয়াশা কাটছে, কাটবে আজ কি কাল, ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল, ততদিনে প্রাণ দেব শত্রুর হাতে মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে। ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ, আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বিদ্রোহের গান সুকান্ত ভট্টাচার্য বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি? এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি, আমরা সবাই যে যার প্রহরী                          উঠুক ডাক। উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে                          ভীরুরা থাক। মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি, চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি রুখবে কে আর এ অগ্রগতি,                          সাধ্য কার? রুটি দেবে নাকো? দেবে না অন্ন? এ লড়াইয়ে তুমি নও প্রসন্ন? চোখ-রাঙানিকে করি না গণ্য                          ধারি না ধার। খ্যাতির মুখেতে পদাঘাত করি, গড়ি, আমরা যে বিদ্রোহ গড়ি, ছিঁড়ি দুহাতের শৃঙ্খলদড়ি,                          মৃত্যুপণ। দিক থেকে দিকে বিদ্রোহ ছোটে, বসে থাকবার বেলা নেই মোটে, রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে                          পূর্বকোণ। ছিঁড়ি, গোলামির দলিলকে ছিঁড়ি, বেপরোয়াদের দলে গিয়ে ভিড়ি খুঁজি কোনখানে স্বর্গের সিঁড়ি,                          কোথায় প্রাণ! দেখব, ওপারে আজো আছে কারা, খসাব আঘাতে আকাশের তারা, সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,                          ছড়াব দান। জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বৈশম্পায়ন সুকান্ত ভট্টাচার্য আকাশের খাপছাড়া ক্রন্দন নাই আর আষাঢ়ের খেলনা। নিত্য যে পাণ্ডুর জড়তা সথীহারা পথিকের সঞ্চয়। রক্তের বুকভরা নিঃশ্বাস, আঁধারের বুকফাটা চীৎকার- এই নিয়ে মেতে আছি আমরা কাজ নেই হিসাবের খাতাতে। মিলাল দিনের কোনো ছায়াতে পিপাসায় আর কূল পাই না; হারানো স্মৃতির মৃদু গন্ধে প্রাণ কভু হয় নাকো চঞ্চল। মাঝে মাঝে অনাহূত আহ্বান আনে কই আলেয়ার বিত্ত? শহরের জমকালো খবরে হাজিরা খাতাটা থাকে শূন্য। আনমনে জানা পথ চলতে পাই নাকো মাদকের গন্ধ! রাত্রিদিনের দাবা চালেতে আমাদের মন কেন উষ্ণ? শ্মশানঘাটেতে ব’ কখনো দেখি নাই মরীচিকা সহসা, তাই বুঝি চিরকাল আঁধারে আমরাই দেখি শুধু স্বপ্ন! বার বার কায়াহীন ছায়ারে ধরেছিনু বাহুপাশে জড়িয়ে, তাই আজ গৈরিক মাটিতে রঙ্গিন বসন করি শুদ্ধ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মণিপুর সুকান্ত ভট্টাচার্য এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি, সহস্র বছর ধ’রে এসে আমি জানি পরিপাটি, জানি এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা, এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা। যদিও দলিত দেশ, তবু মুক্তি কথা কয় কানে, যুগ যুগ আমরা যে বেঁচে থাকি পতনে উত্থানে! যে চাষী কেটেছে ধন, এ মাটিতে নিয়েছে কবর, এখনো আমার মধ্যে ভেসে আসে তাদের খবর। অদৃশ্য তাদের স্বপ্নের সমাচ্ছন্ন এদেশের ধূলি, মাটিতে তাদের স্পর্শ, তাদের কেমন ক’রে ভুলি? আমার সম্মুখে ক্ষেত, এ প্রান্তরে উদয়স্ত খাটি, ভালবাসি এ দিগন্ত, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি। এখানে রক্তের দাগ রেখে গেছে চেঙ্গিস, তৈমুর, সে চিহ্নও মুছে দিল কত উচ্চৈঃশ্রবাদের খুর। কত যুদ্ধ হয়ে গেছে, কত রাজ্য হয়েছে উজাড়, উর্বর করেছে মাটি কত দিগ্বিজয়ীর হাড়। তবুও অজেয় এই শতাব্দীগ্রথিত হিন্দুস্থান, এরই মধ্যে আমাদের বিকশিত স্বপ্নের সন্ধান। আজন্ম দেখেছি আমি অদ্ভুত নতুন এক চোখে, আমার বিশাল দেশ আসমুদ্র ভারতবর্ষকে। এ ধুলোয় প্রতিরোধ, এ হাওয়ায় ঘুর্ণিত চাবুক, এখানে নিশ্চিহ্ন হল কত শত গর্বোদ্ধত বুক। এ মাটির জন্যে প্রাণ দিয়েছি তো কত যুগ ধ’রে রেখেছি মাটির মান কতবার কত যুদ্ধ ক’রে। আজকে যখন এই দিক্প্রান্তে ওঠে রক্ত-ঝড়, কোমল মাটিতে রাখে শত্রু তার পায়ের স্বাক্ষর, তখন চীৎকার ক’ রক্ত ব’ ওঠে ‘ধিক্ ধিক্, এখনো দিল না দেখা দেহে দেহে নির্ভয় সৈনিক! দাসত্বের ছদ্মবেশ দীর্ণ ক’রে উন্মোচিত হোক একবার বিশ্বরূপ- উদ্দাম, হে অধিনায়ক!’ এদিকে উৎকর্ণ দিন, মণিপুর, কাঁপে মণিপুর চৈত্রের হাওয়ায় ক্লান্ত, উৎকণ্ঠায় অস্থির দুপুর- কবে দেখা দেবে, কবে প্রতীক্ষিত সেই শুভক্ষণ ছড়াবে ঐশ্বর্য পথে জনতার দুরন্ত যৌবন? দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে অতর্কিতে শত্রু তার পদচিহ্ন রাখে- এখনো শত্রু ক্ষমা? শত্রু কি করেছে ক্ষমা                                   বিধ্বস্ত বাংলাকে? আজকের এ মুহূর্তে অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতা, কেন তাই মনে মনে আমি প্রশ্ন করি সেই কথা। তুমি কি ক্ষুদিত বন্ধু? তুমি কি ব্যাধিতে জরোজরো? তা হোক , তবুও তুমি আর এক মৃত্যুকে রোধ করো। বসন্ত লাগুক আজ আন্দোলিত প্রাণের শাখায়, আজকে আসুক বেগ এ নিশ্চল রথের চাকায়, এ মাটি উত্তপ্ত হোক, এ দিগন্তে আসুক বৈশাখ, ক্ষুদার আগুনে আজ শত্রুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শত্রুরা নিয়েছে আজ দ্বিতীয় মৃত্যুর ছদ্মবেশ, তবু কেন নিরুত্তর প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা দেশ? এদেশে কৃষক আছে, এদেশে মজুর আছে জানি, এদেশে বিপ্লবী আছে, জনরাজ্যে মুক্তির সন্ধানী। দাসত্বের ধুলো ঝেড়ে তারা আজ আহ্বান পাঠাক ঘোষণা করুক তারা এ মাটিতে আসন্ন বৈশাখ। তাই এই অবরুদ্ধ স্বপ্নহীন নিবিড় বাতাসে শব্দ হয়, মনে হয় রাত্রিশেষে ওরা যেন আসে। ওরা আসে, কান পেতে আমি তার পদধ্বনি শুনি, মৃত্যুকে নিহত ক’রে ওরা আসে উজ্জ্বল আরুণি, পৃথিবী ও ইতিহাস কাঁপে আজ অসহ্য আবেগে, ওদের পায়ের স্পর্শে মাটিতে সোনার ধান, রঙ লেগে মেঘে। এ আকাশ চন্দ্রাতপ, সূর্য আজ ওদের পতাকা, মুক্তির প্রচ্ছদপটে ওদের কাহিনী আজ ঢাকা, আগন্তুক ইতিহাসে ওরা আজ প্রথম অধ্যায়, ওরা আজ পলিমাটি অবিরাম রক্তের বন্যায়; ওদের দুচোখে আজ বিকশিত আমার কামনা, অভিনন্দন গাছে, পথের দুপাশে অভ্যর্থনা। ওদের পতাকা ওড়ে প্রামে গ্রামে নগরে বন্দরে, মুক্তির সংগ্রাম সেরে ওরা ফেরে স্বপ্নময় ঘরে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মহাত্মাজীর প্রতি সুকান্ত ভট্টাচার্য চল্লিশ কোটি জনতার জানি আমিও যে একজন, হাঠাৎ ঘোষণা শুনেছি; আমার জীবনে শুভক্ষণ এসেছে, তখনি মুছে গেছে ভীরু চিন্তার হিজিবিজি। রক্তে বেজেছে উৎসব, আজ হাত ধরো গান্ধীজী। এখানে আমরা লড়েছি, মরেছি, করেছি অঙ্গীকার, এ মৃতদেহের বাধা ঠেলে হব অজেয় রাজ্য পার। এসেছে বন্যা, এসেছে মৃত্যু, পরে যুদ্ধের ঝড়, মন্বন্তর রেখে গেছে তার পথে পথে স্বাক্ষর, প্রতি মুহূর্তে বুঝেছি এবার মুছে নেবে ইতিহাস– তবু উদ্দাম, মৃত্যু-আহত ফেলি নি দীর্ঘশ্বাস; নগর গ্রামের শ্মশানে শ্মশানে নিহিত অভিজ্ঞান; বহু মৃত্যুর মুখোমুখি দৃঢ় করেছি জয়ের ধ্যান। তাইতো এখানে আজ ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের কাছাকাছি, মনে হয় শুদু তোমারই মধ্যে-আমরা যে বেঁচে আছি– তোমাকে পেয়েছি অনেক মৃত্যু উত্তরণের শেষে, তোমাকে গড়ব প্রাচীর, ধ্বংস-বিকীর্ণ এই দেশে। দিক্‌দিগন্তে প্রসারিত হাতে তুমি যে পাঠালে ডাক, তাইতো আজকে গ্রামে ও নগরে স্পন্দিত লাখে লাখ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মুক্ত বীরদের প্রতি সুকান্ত ভট্টাচার্য তোমরা এসেছ, বিপ্লবী বীর! অবাক অভ্যুদয়। যদিও রক্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারা কলকাতাময়। তবু দেখ আজ রক্তে রক্তে সাড়া- আমরা এসেছি উদ্দাম ভয়হারা। আমরা এসেছি চারিদিক থেকে, ভুলতে কখনো পারি! একসূত্রে যে বাঁধা হয়ে গেছে কবে কোন্ যুগে নাড়ী। আমরা যে বারে বারে তোমাদের কথা পৌঁছে দিয়েছি এদেশের দ্বারে দ্বারে, মিছিলে মিছিলে সভায় সভায় উদাত্ত আহ্বানে, তোমাদের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছি জনতার উত্থানে, উদ্দাম ধ্বনি মুখরিত পথেঘাটে, পার্কের মোড়ে, ঘরে, ময়দানে, মাঠে মুক্তির দাবি করেছি তীব্রতর সারা কলকাতা শ্লোগানেই থরোথরো। এই সেই কলকাতা। একদিন যার ভয়ে দুরু দুরু বৃটিশ নোয়াত মাথা। মনে পড়ে চব্বিশে? সেদিন দুপুরে সারা কলকাতা হারিয়ে ফেলেছে দিশে; হাজার হাজার জনসাধারণ ধেয়ে চলে সম্মুখে পরিষদ-গেটে হাজির সকলে, শেষ প্রতিজ্ঞা বুকে গর্জে উঠল হাজার হাজার ভাইঃ রক্তের বিনিময়ে হয় হোক, আমরা ওদের চাই। সফল! সফল! সেদিনের কলকাতা- হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের মাথা। জানি বিকৃত আজকের কলকাতা বৃটিশ এখন এখানে জনত্রাতা! গৃহযুদ্ধের ঝড় বয়ে গেছে- ডেকেছে এখানে কালো রক্তের বান; সেদিনের কলকাতা এ আঘাতে ভেঙে চুরে খান্‌খান্। তোমারা এসেছ বীরের মতন, আমরা চোরের মতো। তোমরা এসেছ, ভেঙেছ অন্ধকার- তোমরা এসেছ, ভয় করি নাকো আর। পায়ের স্পর্শে মেঘ কেটে যাবে, উজ্জ্বল রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়বে বহুদুর-বহুদূর তোমরা এসেছ, জেনো এইবার নির্ভয় কলকাতা- অত্যাচারের হাত থেকে জানি তোমরা মুক্তিদাতা। তোমরা এসেছ, শিহরণ ঘাসে ঘাসেঃ পাখির কাকলি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে, মর্মরধ্বনি তরুপল্লবে শাখায় শাখায় লাগেঃ হঠাৎ মৌন মহাসমুদ্র জাগে অস্থির হাওয়া অরণ্যপর্বতে, গুঞ্জন ওঠে তোমরা যাও যে-পথে। আজ তোমাদের মুক্তিসভায় তোমদের সম্মুখে, শপথ নিলাম আমরা হাজার মুখেঃ যতদিন আছে আমাদের প্রাণ, আমাদের সম্মান, আমরা রুখব গৃহযুদ্ধের কালো রক্তের বান। অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে। তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে, তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে। তোমাদের পথ যদিও কুয়াশাময়, উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো ও কিছুই নয়। তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয় দুর্বার, পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার। আবার জ্বালাব বাতি, হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষযুদ্ধের সাথী।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
রোমঃ ১৯৪৩ সুকান্ত ভট্টাচার্য ভেঙ্গেছে সাম্রাজ্যস্বপ্ন, ছত্রপতি হয়েছে উধাও; শৃঙ্খল গড়ার দুর্গ ভূমিসাৎ বহু শতাব্দীর। ‘সাথী আজ দৃঢ় হাতে হাতিয়ার নাও’ — রোমের প্রত্যেক পথে ওঠে ডাক ক্রমশ অস্থির। উদ্ধত ক্ষমতালোভী দস্যুতার ব্যর্থ পরাক্রম মুক্তির উত্তপ্ত স্পর্শে প্রকম্পিত যুগ যুগ অন্ধকার রোম। হাজার বছর ধ’রে দাসত্ব বেঁদেছে বাসা রোমের দেউলে, দিয়েছে অনেক রক্ত রোমের শ্রমিক– তাদের শক্তির হাওয়া মুক্তির দুয়ার দিল খুলে, আজকে রক্তাক্ত পথ; উদ্ভাসিত দিক। শিল্পী আর মজুরের বহু পরিশ্রম একদিন গড়েছিল রোম, তারা আজ একে একে ভেঙে দেয় রোমের সে সৌন্দর্যসম্ভার, ভগ্নস্তূপে ভবিষ্যৎ মুক্তির প্রচার। রেমের বিপ্লবী হৃৎস্পন্দনে ধ্বনিত মুক্তির সশস্ত্র ফৌজ আসে অগণিত, দুচোখে সংহার স্বপ্ন, বুকে তীব্র ঘৃণা শত্রুকে বিধ্বস্ত করা যেতে পারে কিনা রাইফেলের মুখে এই সংক্ষিপ্ত জিজ্ঞাসা। যদিও উদ্বেগ মনে, তবু দীপ্ত আশা– পথে পথে জনতার রক্তাক্ত উত্থান, বিস্ফোরণে বিস্ফোরণে ডেকে ওঠে বান। ভেঙে পড়ে দস্যুতার, পশুতার প্রথম প্রাসাদ বিক্ষুব্ধ অগ্ন্যুৎপাতে উচ্চারিত শোষণের বিরুদ্ধে জেহাদ। যে উদ্ধত একদিন দেশে দেশে দিয়েছে শৃঙ্খল আবিসিনিয়ার চোখে আজ তার সে দম্ভ নিষ্ফল। এদিকে ত্বরিত সূর্য রোমের আকাশে যদিও কুয়াশাঢাকা আকাশের নীল, তবুও বিপ্লবী জানে, সোভিয়েট পাশে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
রৌদ্রের গান সুকান্ত ভট্টাচার্য এখানে সূর্য ছড়ায় অকৃপণ দুহাতে তীব্র সোনার মতন মদ, যে সোনার মদ পান ক’রে ধন ক্ষেত দিকে দিকে তার গড়ে তোলে জনপদ। ভারতী! তোমার লাবণ্য দেহ ঢাকে রৌদ্র তোমায় পরায় সোনার হার, সূর্য তোমার শুকায় সবুজ চুল প্রেয়সী, তোমার কত না অহংকার। সারাটা বছর সূর্য এখানে বাঁধা রোদে ঝলসায় মৌন পাহাড় কোনো, অবাধ রোদ্রে তীব্র দহন ভরা রৌদ্রে জ্বলুক তোমার আমার মনও। বিদেশকে আজ ডাকো রৌদ্রের ভোজে মুঠো মুঠো দাও কোষাগার-ভরা সোনা, প্রান্তর বন ঝলমল করে রোদে, কী মধুর আহা রৌদ্রে প্রহর গোনা! রৌদ্রে কঠিন ইস্পাত উজ্জ্বল ঝকমক করে ইশারা যে তার বুকে শূন্য নীরব মাঠে রৌদ্রের প্রজা স্তব করে জানি সূর্যের সম্মুখে। পথিক-বিরল রাজপথে সূর্যের প্রতিনিধি হাঁকে আসন্ন কলরব, মধ্যাহ্নের কঠোর ধ্যানের শেষে জানি আছে এক নির্ভয় উৎসব। তাইতো এখানে সূর্য তাড়ায় রাত প্রেয়সী, তুমি কি মেঘভয়ে আজ ভীত? কৌতুকছলে এ মেঘ দেখায় ভয়, এ ক্ষণিক মেঘ কেটে যাবে নিশ্চিত। সূর্য, তোমায় আজকে এখানে ডাকি- দুর্বল মন, দুর্বলতর কায়া, আমি যে পুরনো অচল দীঘির জল আমার এ বুকে জাগাও প্রতিচ্ছায়া।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সব্যসাচী সুকান্ত ভট্টাচার্য অভুক্ত শ্বাপদচক্ষু নিঃস্পন্দ আঁধারে জ্বলে রাত্রিদিন। হে বন্ধু, পশ্চাতে ফেলি অন্ধ হিমগিরি অনন্ত বাধ্যক্য তব ফেলুক নিঃশ্বাস; রক্তলিপ্ত যৌবনের অন্তিম পিপাসা নিষ্ঠুর গর্জনে আজ অরণ্য ধোঁয়ায় উঠুক প্রজ্বলি’। সপ্তরথী শোনে নাকো পৃথিবীর শৈশবক্রন্দন, দেখে নাই নির্বাকের অশ্রুহীন জ্বালা। দ্বিধাহীন চণ্ডালের নির্লিপ্ত আদেশে। আদিম কুক্কুর চাহে ধরণীর বস্ত্র কেড়ে নিতে। উল্লাসে লেলিহ জিহ্‌ব লুব্ধ হায়েনারা- তবু কেন কঠিন ইস্পাত জরাগ্রস্ত সভ্যতার হৃদপিণ্ড জর্জর, ক্ষুৎপিপাসা চক্ষু মেলে মরণের উপসর্গ যেন। স্বপ্নলব্ধ উদ্যমের অদৃশ্য জোয়ারে সংঘবদ্ধ বল্মীকের দল। নেমে এসো-হে ফাল্গুনী, বৈশাখের খরতপ্ত তেজে ক্লান্ত দু’বাহু তব লৌহময় হোক বয়ে যাক শোণিতের মন্দাকিনী স্রোত; মুমূর্ষু পৃথিবী উষ্ণ, নিত্য তৃষাতুরা, নির্বাপিত আগ্নেয় পর্বত ফিরে চায় অনর্গল বিলুপ্ত আতপ। আজ কেন সূবর্ণ শৃঙ্খলে বাঁধা তব রিক্ত বজ্রপাণি, তুষারের তলে সুপ্ত অবসন্ন প্রাণ? তুমি শুধু নহ সব্যসাচী, বিস্মৃতির অন্ধকার পারে ধূসর গৈরিক নিত্য প্রান্তহীন বেলাভুমি ‘পরে আত্মভোলা, তুমি ধনঞ্জয়।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
সূচনা সুকান্ত ভট্টাচার্য ভারতবর্ষে পাথরের গুরুভারঃ এহেন অবস্থাকেই পাষাণ বলো, প্রস্তরীভুত দেশের নীরবতার একফোঁটা নেই অশ্রুও সম্বলও। অহল্যা হল এই দেশ কোন্ পাপে ক্ষুদার কান্না কঠিন পাথরে ঢাকা, কোনো সাড়া নেই আগুনের উত্তাপে এ নৈঃশব্দ্য বেঙেছে কালের চাকা। ভারতবর্ষ! কার প্রতীক্ষা করো, কান পেতে কার শুনছ পদধ্বনি? বিদ্রোহে হবে পাথরেরা থরোথরো, কবে দেখা দেবে লক্ষ প্রাণের খনি? ভারতী, তোমার অহল্যারূপ চিনি রামের প্রতীক্ষাতেই কাটাও কাল, যদি তুমি পায়ে বাজাও ও-কিঙ্কিনী, তবে জানি বেঁচে উঠবেই কঙ্কাল। কত বসন্ত গিয়েছে অহল্যা গো- জীবনে ব্যর্থ তুমি তবু বার বার, দ্বারে বসন্ত, একবার শুধু জাগো দুহাতে সরাও পাষাণের গুরুভার। অহল্যা-দেশ, তোমার মুখের ভাষা অনুচ্চারিত, তবু অধৈর্যে ভরা; পাষাণ ছদ্মবেশকে ছেঁড়ার আশা ক্রমশ তোমার হৃদয় পাগল করা। ভারতবর্ষ, তন্দ্রা ক্রমশ ক্ষয় অহল্যা! আজ শাপমোচনের দিন; তুষার-জনতা বুঝি জাগ্রত হয়- গা-ঝাড়া দেবার প্রস্তাব দ্বিধাহীন। অহল্যা, আজ কাঁপে কী পাসাণকায়! রোমাঞ্চ লাগে পাথরের প্রত্যঙ্গে; রামের পদস্পর্শ কি লাগে গায়? অহল্যা, জেনো আমরা তোমার সঙ্গে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
১লা মে-র কবিতা ‘৪৬ সুকান্ত ভট্টাচার্য লাল আগুন ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে, কী হবে আর কুকুরের মতো বেঁচে থাকায়? কতদিন তুষ্ট থাকবে আর অপরের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট হাড়ে? মনের কথা ব্যক্ত করবে ক্ষীণ অস্পষ্ট কেঁউ-কেঁউ শব্দে? ক্ষুদিত পেটে ধুঁকে ধুঁকে চলবে কতদিন? ঝুলে পড়া তোমার জিভ, শ্বাসে প্রশ্বাসে ক্লান্তি টেনে কাঁপতে থাকবে কত কাল? মাথায় মৃদু চাপড় আর পিঠে হাতের স্পর্শে কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুদা আর গলার শিকলকে? কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ? তার চেয়ে পোষমানাকে অস্বীকার করো, অস্বীকার করো বশ্যতাকে। চলো, শুকনো হাড়ের বদলে সন্ধান করি তাজা রক্তের, তৈরী হোক লাল আগুনে ঝল্‌সানো আমাদের খাদ্য। শিকলের দাগ ঢেকে দিয়ে গজিয়ে উঠুক সিংহের কেশর প্রত্যেকের ঘাড়ে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
১৯৪১ সাল সুকান্ত ভট্টাচার্য নীল সমুদ্রের ইশারা- অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ, আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা; নিঃশব্দ দিনের সেই ভীরু অন্তঃশীল মত্ততাময় পদক্ষেপঃ এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর জীবনের ওপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয় তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে ডাক এল- সভ্যতার ডাক নিষ্ঠুর ক্ষুদার্ত পরোয়ানা আমাকে চিহ্নিত ক’রে গেল। আমার একক পৃথিবী ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে। মনের স্বচ্ছতার ওপর বিরক্তির শ্যাওলা গভীরতা রচনা করে, আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা ইতস্ততঃ ধাবমান। নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল পূর্ণতায় মূর্তি চায়; আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ, আরো অনেকের বিরুদ্ধে বিবক্ষা তাই পরাহত হল। কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক! দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস। যে সব মুহূর্ত-পরমাণু গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা, সে সব মুহূর্ত আজ প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায় অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
অনুভব সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪০ অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন। অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন; অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো– দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো। অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার। হিসেবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে দেখেছি লিখিত–‘রক্ত খরচ’ তাতে। এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম, অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম! ১৯৪৬ বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে, আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে, এত বিদ্রোহ কখনো দেখে নি কেউ, দিকে দিকে ওঠে অবাদ্যতার ঢেউ; স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব– শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব? নয়া ইতিহাস লিখছে ধর্মঘট; রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট। প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত, দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত; তাদেরই দলের পেছনে আমিও আছি, তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি। তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে– বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আগামী সুকান্ত ভট্টাচার্য জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ, আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ; মাটিতে লালিত ভীরু, শুদু আজ আকাশের ডাকে মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে, বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা। আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা; তার পর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে, ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে। সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়; শাখায় শাখায় বাঁধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়; অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে। আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে; জয়ধ্বনি কিশলয়ে; সম্বর্ধনা জানাবে সকলে। ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি, বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তারি তো সম্মতি। সেদিন ছায়ায় এসো; হানো যদি কঠিন কুঠারে তবুও তোমায় আমি হাতছানি দেব বারে বারে; ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আগ্নেয়গিরি সুকান্ত ভট্টাচার্য কখনো হঠাৎ মনে হয়ঃ আমি এক আগ্নেয় পাহাড়। শান্তির ছায়া-নিবিড় গুহায় নিদ্রিত সিংহের মতো চোখে আমার বহু দিনের তন্দ্রা। এক বিস্ফোরণ থেকে আর এক বিস্ফোরণের মাঝখানে আমাকে তোমরা বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছ বারংবার আমি পাথরঃ আমি তা সহ্য করেছি। মুখে আমার মৃদু হাসি, বুকে আমার পুঞ্জীভূত ফুটন্ত লাভা। সিংহের মতো আধ-বোজা চোখে আমি কেবলি দেখছিঃ মিথ্যার ভিতে কল্পনার মশলায় গড়া তোমাদের শহর, আমাকে ঘিরে রচিত উৎসবের নির্বোধ অমরাবতী, বিদ্রূপের হাসি আর বিদ্বেষের আতস-বাজি– তোমাদের নগরে মদমত্ত পূর্ণিমা। দেখ, দেখঃ ছায়াঘন, অরণ্য-নিবিড় আমাকে দেখ; দেখ আমার নিরুদ্বিগ্ন বন্যতা। তোমাদের শহর আমাকে বিদ্রূপ করুক, কুঠারে কুঠারে আমার ধৈর্যকে করুক আহত, কিছুতেই বিশ্বাস ক’রো না– আমি ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার সহোদর। তোমাদের কাছে অজ্ঞাত থাক ভেতরে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠা আমার অগ্ন্যুদ্‌গার, অরণ্যে ঢাকা অন্তর্নিহিত উত্তাপের জ্বালা। তোমার আকাশে ফ্যাকাশে প্রেত আলো, বুনো পাহাড়ে মৃদু-ধোঁয়ার অবগুণ্ঠন: ও কিছু নয়, হয়তো নতুন এক মেঘদূত। উৎসব কর, উৎসব কর– ভুলে যাও পেছনে আছে এক আগ্নেয় পাহাড়, ভিসুভিয়স-ফুজিয়ামার জাগ্রত বংশধর। আর, আমার দিন-পি কায় আসন্ন হোক বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আঠারো বছর বয়স সুকান্ত ভট্টাচার্য আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি, আঠারো বছর বয়সেই অহরহ বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি। আঠারো বছর বয়সের নেই ভয় পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা, এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়– আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা। এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে, প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে। আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা, এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা। আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান, দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ। আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো, এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো। তব আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি, এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে, বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে। এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয় পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়– এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ইউরোপের উদ্দেশে সুকান্ত ভট্টাচার্য ওখানে এখন মে-মাস তুষার-গলানো দিন, এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন; হয়তো ওখানে শুরু মন্থর দক্ষিণ হাওয়া; এখানে বোশেখী ঝড়ের ঝাপ্টা পশ্চাৎ দাওয়া; এখানে সেখানে ফুল ফোটে আজ তোমাদের দেশে কত রঙ, কত বিচিত্র নিশি দেখা দেয় এসে। ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে কত ছেলেমেয়ে এই বসন্তে কত উৎসব কত গান গেয়ে। এখানে তো ফুল শুকনো, ধূসর রঙের ধুলোয় খাঁ-খাঁ করে সারা দেশটা, শান্তি গিয়েছে চুলোয়। কঠিন রোদের ভয়ে ছেলেমেয়ে বন্ধ ঘরে, সব চুপচাপ; জাগবে হয়তো বোশেখী ঝড়ে। অনেক খাটুনি, অনেক লড়াই করার শেষে চারিদিকে ক্রমে ফুলের বাগান তোমাদের দেশে; এদেশে যুদ্ধ মহামারী, ভুখা জ্বলে হাড়ে হাড়ে- অগ্নিবর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে তাই ঘুম কাড়ে বেপরোয়া প্রাণ; জমে দিকে দিকে আজ লাখে লাখে- তোমাদের দেশে মে-মাস; এখানে ঝোড়ো বৈশাখ।।
সুকান্ত ভট্টাচার্য
এই নবান্নে সুকান্ত ভট্টাচার্য এই হেমন্তে কাটা হবে ধান, আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান– পৌষপার্বণে প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান। তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায়ঃ হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দায়; গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন, পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন; নিজের হাতের জমি ধান-বোনা, বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা, কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসেনি শুভক্ষণ– তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন। এবার নতুন জোরালো বাতাসে জয়যাত্রার ধ্বনি ভেসে আসে, পিছে মৃত্যুর ক্ষতির নির্বাচন– এই হেমন্তে ফসলেরা বলেঃ কোথায় আপন জন? তারা কি কেবল লুকোনো থাকবে, অক্ষমতার গ্লানিকে ঢাকবে, প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ করছে উচ্চারণ এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ?
সুকান্ত ভট্টাচার্য
একটি মোরগের কাহিনী সুকান্ত ভট্টাচার্য একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল          বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে, ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়–          আরো দু’তিনটি মুরগীর সঙ্গে। আশ্রয় যদিও মিলল,          উপযুক্ত আহার মিলল না। সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে          গলা ফাটাল সেই মোরগ          ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত– তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত। তারপর শুরু হল তাঁর আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা;          আর্শ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার! তারপর এক সময় আঁস্তাকুড়েও এল অংশীদার–          ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ; কাজেই দুর্বলতার মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।          খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার! অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে          বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে,          প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড। ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে–          ‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’! তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,          একেবারে সোজা চলে এল ধব্‌ধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে ;          অবশ্য খাবার খেতে নয়– খাবার হিসেবে
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ঐতিহাসিক সুকান্ত ভট্টাচার্য আজ এসেছি তোমাদের ঘরে ঘরে– পৃথিবীর আদালতের পরোয়ানা নিয়ে তোমরা কি দেবে আমার প্রশ্নের কৈফিয়ৎ: কেন মৃত্যুকীর্ণ শবে ভরলো পঞ্চাশ সাল? আজ বাহান্ন সালের সূচনায় কি তার উত্তর দেবে? জানি! স্তব্ধ হয়ে গেছে তোমাদের অগ্রগতির স্রোত, তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছ ভবিষ্যৎ আর অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা। কিন্তু ভেবে দেখেছ কি? দেরি হয়ে গেছে অনেক, অনেক দেরি! লাইনে দাঁড়ানো অভ্যেস কর নি কোনোদিন, একটি মাত্র লক্ষ্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মারামারি করেছ পরস্পর, তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ। কেবল বঞ্চিত বিহ্বল বিমূঢ় জিজ্ঞাসাভরা চোখে প্রত্যেকে চেয়েছ প্রত্যেকের দিকেঃ –কেন এমন হল? একদা দুর্ভিক্ষ এল ক্ষুদার মাহীন তাড়নায় পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে ইতর-ভদ্র, হিন্দু আর মুসলমান একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস। চাল, চিনি, কয়লা, কেরোসিন? এ সব দুষ্প্রাপ্য জিনিসের জন্য চাই লাইন। কিন্তু বুঝলে না মুক্তিও দুর্লভ আর দুর্মূল্য, তারো জন্যে চাই চল্লিশ কোটির দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন এক লাইন। মূর্খ তোমরা লাইন দিলেঃ কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু, রক্তয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা। ইতিমধ্যে তোমাদের বিবদমান বিশৃঙ্খল ভিড়ে মুক্তি উঁকি দিয়ে গেছে বহুবার। লাইনে দাঁড়ানো আয়ত্ত করেছে যারা, সোভিয়েট, পোল্যান্ড, ফ্রান্স রক্তমূল্যে তারা কিনে নিয়ে গেল তাদের মুক্তি সর্ব প্রথম এই পৃথিবীর দোকান থেকে। এখনো এই লাইনে অনেকে প্রতীক্ষমান, প্রার্থী অনেক; কিন্তু পরিমিত মুক্তি। হয়তো এই বিশ্বব্যাপী লাইনের শেষে এখনো তোমাদের স্থান হতে পারে– এ কথা ঘোষণা ক’রে দাও তোমাদের দেশময় প্রতিবেশীর কাছে। তারপর নিঃশব্দে দাঁড়াও এ লাইনে প্রতিজ্ঞা আর প্রতীক্ষা নিয়ে হাতের মুঠোয় তৈরী রেখে প্রত্যেকের প্রাণ। আমি ইতিহাস, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখো, মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি। আর মনে ক’রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র, নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ, অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা, আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।।