author
stringclasses
33 values
text
stringlengths
86
1.25M
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমারে যদি জাগালে আজি নাথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমারে যদি জাগালে আজি নাথ, ফিরো না তবে ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত। নিবিড় বন-শাখার 'পরে আষাঢ়-মেঘে বৃষ্টি ঝরে, বাদলভরা আলসভরে ঘুমায়ে আছে রাত। ফিরো না তুমি ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত। বিরামহীন বিজুলিঘাতে নিদ্রাহারা প্রাণ বরষা-জলধারার সাথে গাহিতে চাহে গান। হৃদয় মোর চোখের জলে বাহির হল তিমিরতলে, আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে বাড়ায়ে দুই হাত। ফিরো না তুমি ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি চেয়ে আছি তোমাদের সবাপানে। স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে। নীচে সব নীচে এ ধূলির ধরণীতে যেথা আসনের মূল্য না হয় দিতে, যেথা রেখা দিয়ে ভাগ করা নেই কিছু যেথা ভেদ নাই মানে আর অপমানে, স্থান দাও সেথা সকলের মাঝখানে। যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়, যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়। আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে, এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে, সেথায় দাঁড়ায়ে নিলাজ দৈন্য মম ভরিয়া লইব তাঁহার পরম দানে। স্থান দাও মোরে সকলের মাঝখানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি        বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে। এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভ'রে। না চাহিতে মোরে যা করেছ দান আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ, দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য করে অতি-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে। আমি        কখনো-বা ভুলি, কখনো-বা চলি তোমার পথের লক্ষ্য ধরে; তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে যাও সে সরে। এ যে তব দয়া জানি জানি হায়, নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়, পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন তব মিলনেরই যোগ্য করে আধা-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি হেথায় থাকি শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান, দিয়ো তোমার জগৎসভায় এইটুকু মোর স্থান। আমি তোমার ভুবন-মাঝে লাগি নি নাথ, কোনো কাজে-- শুধু কেবল সুরে বাজে অকাজের এই প্রাণ। নিশায় নীরব দেবালয়ে তোমার আরাধন, তখন মোরে আদেশ কোরো গাইতে হে রাজন্‌। ভোরে যখন আকাশ জুড়ে বাজবে বীণা সোনার সুরে আমি যেন না রই দূরে এই দিয়ো মোর মান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আর আমায় আমি নিজের শিরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর        আমায় আমি নিজের শিরে বইব না। আর        নিজের দ্বারে কাঙাল হয়ে রইব না। এই          বোঝা তোমার পায়ে ফেলে বেড়িয়ে পড়ব অবহেলে-- কোনো খবর রাখব না ওর, কোনো কথাই কইব না। আমায় আমি নিজের শিরে বইব না। বাসনা মোর যারেই পরশ করে সে, আলোটি তার নিবিয়ে ফেলে নিমেষে। ওরে        সেই অশুচি, দুই হাতে তার যা এনেছে চাই নে সে আর, তোমার প্রেমে বাজবে না যা সে আর আমি সইব না আমায় আমি নিজের শিরে বইব না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আর নাই রে বেলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর        নাই রে বেলা, নামল ছায়া ধরণীতে, এখন        চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে। জলধারার কলস্বরে সন্ধ্যাগগন আকুল করে, ওরে               ডাকে আমায় পথের 'পরে সেই ধ্বনিতে। চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে। এখন        বিজন পথে করে না কেউ আসা-যাওয়া, ওরে        প্রেম-নদীতে উঠেছে ঢেউ, উতল হাওয়া। জানি নে আর ফিরব কিনা, কার সাথে আজ হবে চিনা, ঘাটে               সেই অজানা বাজায় বীণা তরণীতে। চল্‌ রে ঘাটে কলসখানি ভরে নিতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আরো আঘাত সইবে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারো, আরো কঠিন সুরে জীবনতারে ঝংকারো। যে রাগ জাগাও আমার প্রাণে বাজে নি তা চরমতানে, নিঠুর মূর্ছনায় সে গানে মূর্তি সঞ্চারো। লাগে না গো কেবল যেন কোমল করুণা, মৃদু সুরের খেলায় এ প্রাণ ব্যর্থ কোরো না। জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ, গর্জি উঠুক সকল বাতাস, জাগিয়ে দিয়ে সকল আকাশ পূর্ণতা বিস্তারো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আলোয় আলোকময় ক'রে হে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোয় আলোকময় ক'রে হে এলে আলোর আলো। আমার নয়ন হতে আঁধার মিলালো মিলালো। সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা, যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো। তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ। তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান। তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে, হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে। একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে, সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে। হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল; সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তুলে ভিজে বনের ফুল। আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্‌ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি, কোন্‌ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে। বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আসনতলের মাটির 'পরে লুটিয়ে রব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসনতলের মাটির 'পরে লুটিয়ে রব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ, চিরজনম এমন করে ভুলিয়ো নাকো, অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব। আমি তোমার যাত্রীদলের রব পিছে, স্থান দিয়ো হে আমায় তুমি সবার নীচে। প্রসাদ লাগি কত লোকে আসে ধেয়ে, আমি কিছুই চাইব না তো রইব চেয়ে; সবার শেষে বাকি যা রয় তাহাই লব। তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধূসর হব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে ওই যে তিনি, ও ই যে বাহির পথে। আয় রে ছুটে, টানতে হবে রশি, ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি। ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে ঠাঁই করে তুই নে রে কোনোমতে। কোথায় কী তোর আছে ঘরের কাজ, সে-সব কথা ভুলতে হবে আজ। টান্‌ রে দিয়ে সকল চিত্তকায়া, টান্‌ রে ছেড়ে তুচ্ছ প্রাণের মায়া, চল্‌ রে টেনে আলোর অন্ধকারে নগর গ্রামে অরণ্যে পর্বতে। ওই যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি, বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি। রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ। গাইছে না মন মরণজয়ী গান? আকাঙক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো ছুটছে নাকি বিপুল ভবিষ্যতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই করেছ ভালো, নিঠুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই করেছ ভালো, নিঠুর, এই করেছ ভালো। এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো। আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে, আমার এ দীপ না জ্বালালে দেয় না কিছুই আলো। যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার আঘাত সে যে পরশ তব সেই তো পুরস্কার। অন্ধকারে মোহে লাজে চোখে তোমায় দেখি না যে, বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই জ্যোৎস্নারাতে জাগে আমার প্রাণ; পাশে তোমার হবে কি আজ স্থান। দেখতে পাব অপূর্ব সেই মুখ, রইবে চেয়ে হৃদয় উৎসুক, বারে বারে চরণ ঘিরে ঘিরে ফিরবে আমার অশ্রুভরা গান? সাহস করে তোমার পদমূলে আপনারে আজ ধরি নাই যে তুলে, পড়ে আছি মাটিতে মুখ রেখে, ফিরিয়ে পাছে দাও হে আমার দান। আপনি যদি আমার হাতে ধরে কাছে এসে উঠতে বল মোরে, তবে প্রাণের অসীম দরিদ্রতা এই নিমেষেই হবে অবসান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই তো তোমার প্রেম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই তো তোমার প্রেম,ওগো হৃদয়হরণ। এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন। এই-যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ-'পরে, এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃত ক্ষরণ। এই তো তোমার প্রেম,ওগো হৃদয়হরণ। প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে। এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে। তোমারি মুখ ওই নুয়েছে, মুখে আমার চোখ থুয়েছে, আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই   মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার-- আমার এই        মলিন অহংকার। দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার। আমার এই        মলিন অহংকার। এখন তো কাজ সাঙ্গ হল দিনের অবসানে, হল রে তাঁর আসার সময় আশা এল প্রাণে। স্নান করে আয় এখন তবে প্রেমের বসন পরতে হবে, সন্ধ্যাবনের কুসুম তুলে গাঁথতে হবে হার। ওরে আয়  সময় নেই যে আর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে তব আনন্দ মহাসংগীতে বাজে। তোমার আকাশ, উদার আলোকধারা, দ্বার ছোটো দেখে ফেরে না যেন গো তারা, ছয় ঋতু যেন সহজ নৃত্যে আসে অন্তরে মোর নিত্য নূতন সাজে। তব আনন্দ আমার অঙ্গে মনে বাধা যেন নাহি পায় কোনো আবরণে। তব আনন্দ পরম দুঃখে মম জ্বলে উঠে যেন পুণ্য আলোকসম, তব আনন্দ দীনতা চূর্ণ করি' ফুটে উঠে ফেটে আমার সকল কাজে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একটি একটি করে তোমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি একটি করে তোমার পুরানো তার খোলো, সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো। ভেঙে গেছে দিনের মেলা, বসবে সভা সন্ধ্যাবেলা, শেষের সুর যে বাজাবে তার আসার সময় হল-- সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো। দুয়ার তোমার খুলে দাও গো আঁধার আকাশ-'পরে, সপ্তলোকের নীরবতা আসুক তোমার ঘরে। এতদিন যে গেয়েছ গান আজকে তারি হোক অবসান, এ যন্ত্র যে তোমার যন্ত্র সেই কথাটাই ভোলো। সেতারখানি নূতন বেঁধে তোলো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একটি নমস্কারে, প্রভু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে। ঘন শ্রাবণ-মেঘের মতো রসের ভারে নম্র নত একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত মন পড়িয়া থাক্‌ তব ভবন-দ্বারে। নানা সুরের আকুল ধারা মিলিয়ে দিয়ে আত্মহারা একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত গান সমাপ্ত হোক নীরব পারাবারে। হংস যেমন মানসযাত্রী, তেমনি সারা দিবসরাত্রি একটি নমস্কারে, প্রভু, একটি নমস্কারে সমস্ত প্রাণ উড়ে চলুক মহামরণ-পারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একলা আমি বাহির হলেম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একলা আমি বাহির হলেম তোমার অভিসারে, সাথে সাথে কে চলে মোর নীরব অন্ধকারে। ছাড়াতে চাই অনেক করে ঘুরে চলি, যাই যে সরে, মনে করি আপদ গেছে, আবার দেখি তারে। ধরণী সে কাঁপিয়ে চলে-- বিষম চঞ্চলতা। সকল কথার মধ্যে সে চায় কইতে আপন কথা। সে যে আমার আমি, প্রভু, লজ্জা তাহার নাই যে কভু, তারে নিয়ে কোন্‌ লাজে বা যাব তোমার দ্বারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একা আমি ফিরব না আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একা আমি ফিরব না আর এমন করে-- নিজের মনে কোণে কোণে মোহের ঘোরে। তোমায়       একলা বাহুর বাঁধন দিয়ে ছোটো করে ঘিরতে গিয়ে আপনাকে যে বাঁধি কেবল আপন ডোরে। যখন আমি পাব তোমায় নিখিলমাঝে সেইখনে হৃদয় পাব হৃদয়রাজে। এই   চিত্ত আমার বৃন্ত কেবল তারি 'পরে বিশ্বকমল; তারি 'পরে পূর্ণ প্রকাশ দেখাও মোরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবার নীরব করে দাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবার  নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে। তার  হৃদয়-বাঁশি আপনি কেড়ে বাজাও গভীরে। নিশীথরাতের নিবিড় সুরে বাঁশিতে তান দাও হে পুরে যে তান দিয়ে অবাক কর' গ্রহশশীরে। যা-কিছু মোর ছড়িয়ে আছে জীবন-মরণে, গানের টানে মিলুক এসে তোমার চরণে। বহুদিনের বাক্যরাশি এক নিমেষে যাবে ভাসি, একলা বসে শুনব বাঁশি অকূল তিমিরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এসো হে এসো, সজল ঘন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসো হে এসো, সজল ঘন, বাদলবরিষনে-- বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে। এসো হে গিরিশিখর চুমি, ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি-- গগন ছেয়ে এসো হে তুমি গভীর গরজনে। ব্যথিয়ে উঠে নীপের বন পুলকভরা ফুলে। উছলি উঠে কলরোদন নদীর কূলে কূলে। এসো হে এসো হৃদয়ভরা, এসো হে এসো পিপাসা-হরা, এসো হে আঁখি-শীতল-করা ঘনায়ে এসো মনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওই যে তরী দিল খুলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই যে তরী দিল খুলে। তোর বোঝা কে নেবে তুলে। সামনে যখন যাবি ওরে থাক্‌ না পিছন পিছে পড়ে, পিঠে তারে বইতে গেলি, একলা পড়ে রইলি কূলে। ঘরের বোঝা টেনে টেনে। পারের ঘাটে রাখলি এনে, তাই যে তোরে বারে বারে ফিরতে হল গেলি ভুলে। ডাক রে আবার মাঝিরে ডাক, বোঝা তোমার যাক ভেসে যাক, জীবনখানি উজাড় করে সঁপে দে তার চরণমূলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওগো আমার এই জীবনের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওগো আমার এই জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা, মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা। সারা জনম তোমার লাগি প্রতিদিন যে আছি জাগি, তোমার তরে বহে বেড়াই দুঃখসুখের ব্যথা। মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা। যা পেয়েছি, যা হয়েছি যা-কিছু মোর আশা। না জেনে ধায় তোমার পানে সকল ভালোবাসা। মিলন হবে তোমার সাথে, একটি শুভ দৃষ্টিপাতে, জীবনবধূ হবে তোমার নিত্য অনুগতা; মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা। বরণমালা গাঁথা আছে, আমার চিত্তমাঝে, কবে নীরব হাস্যমুখে আসবে বরের সাজে। সেদিন আমার রবে না ঘর, কেই-বা আপন, কেই-বা অপর, বিজন রাতে পতির সাথে মিলবে পতিব্রতা। মরণ, আমার মরণ, তুমি কও আমারে কথা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওগো মৌন, না যদি কও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওগো মৌন, না যদি কও না-ই কহিলে কথা। বক্ষ ভরি বইব আমি তোমার নীরবতা। স্তব্ধ হয়ে রইব পড়ে, রজনী রয় যেমন করে জ্বালিয়ে তারা নিমেষহারা ধৈর্যে অবনতা। হবে হবে প্রভাত হবে আঁধার যাবে কেটে। তোমার বাণী সোনার ধারা পড়বে আকাশ ফেটে। তখন আমার পাখির বাসায় জাগবে কি গান তোমার ভাষায়। তোমার তানে ফোটাবে ফুল আমার বনলতা?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ওরে মাঝি, ওরে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরীর মাঝি, শুনতে কি পাস দূরের থেকে পারের বাঁশি উঠছে বাজি। তরী কি তোর দিনের শেষে ঠেকবে এবার ঘাটে এসে। সেথায় সন্ধ্যা-অন্ধকারে দেয় কি দেখা প্রদীপরাজি। যেন আমার লাগছে মনে, মন্দমধুর এই পবনে সিন্ধুপারের হাসিটি কার আঁধার বেয়ে আসছে আজি। আসার বেলায় কুসুমগুলি কিছু এনেছিলেম তুলি, যেগুলি তার নবীন আছে এইবেলা নে সাজিয়ে সাজি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কত অজানারে জানাইলে তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত অজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই-- দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। পুরানো আবাস ছেড়ে যাই তবে মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে, নূতনের মাঝে তুমি পুরাতন সে কথা যে ভুলে যাই। দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই। জীবনে মরণে নিখিল ভুবনে যখনি যেখানে লবে, চিরজনমের পরিচিত ওহে, তুমিই চিনাবে সবে। তোমারে জানিলে নাহি কেহ পর, নাহি কোনো মানা, নাহি কোনো ডর; সবারে মিলায়ে তুমি জাগিতেছ, দেখা যেন সদা পাই। দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কথা ছিল এক-তরীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথা ছিল এক-তরীতে কেবল তুমি আমি যাব   অকারণে ভেসে কেবল ভেসে, ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী কোথায়     যেতেছি কোন্‌ দেশে সে কোন্‌ দেশে। কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে শোনাব গান একলা তোমার কানে, ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা আমার            সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে। আজো সময়  হয় নি কি তার, কাজ কি আছে বাকি। ওগো  ওই-যে সন্ধ্যা নামে সাগরতীরে। মলিন আলোয় পাখা মেলে সিন্ধুপারের পাখি আপন      কুলায়-মাঝে সবাই এল ফিরে। কখন তুমি আসবে ঘাটের 'পরে বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে। অস্তরবির শেষ আলোটির মতো তরী    নিশীথমাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবে আমি বাহির হলেম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে-- সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়। ভুলে গেছি কবে থকে আসছি তোমায় চেয়ে সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়। ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়, তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে-- সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়। কতই নামে ডেকেছি যে, কতই ছবি এঁকেছি যে, কোন্‌ আনন্দে চলেছি, তার ঠিকানা না পেয়ে-- সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়। পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেনে রাত কাটায় জাগি, তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদায় আছে ছেয়ে-- সে তো     আজকে নয় সে আজকে নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কে বলে সব ফেলে যাবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে বলে সব ফেলে যাবি মরণ হাতে ধরবে যবে। জীবনে তুই যা নিয়েছিস মরণে সব নিতে হবে। এই ভরা ভাণ্ডারে এসে শূন্য কি তুই যাবি শেষে। নেবার মতো যা আছে তোর ভালো করে নেই তুই তবে। আবর্জনার অনেক বোঝা জমিয়েছিস যে নিরবধি, বেঁচে যাবি, যাবার বেলা ক্ষয় করে সব যাস রে যদি। এসেছি এই পৃথিবীতে, হেথায় হবে সেজে নিতে, রাজার বেশে চল্‌ রে হেসে মৃত্যুপারের সে উৎসবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোথায় আলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো। বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো। রয়েছে দীপ না আছে শিখা, এই কি ভালে ছিল রে লিখা-- ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো। বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো। বেদনাদূতী গাহিছে, "ওরে প্রাণ, তোমার লাগি জাগেন ভগবান। নিশীথে ঘন অন্ধকারে ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে, দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান। তোমার লাগি জাগেন ভগবান।' গগনতল গিয়েছে মেঘে ভরি, বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি। এ ঘোর রাতে কিসের লাগি পরান মম সহসা জাগি এমন কেন করিছে মরি মরি। বাদল-জল পড়িছে ঝরি ঝরি। বিজুলি শুধু ক্ষণিক আভা হানে, নিবিড়তর তিমির চোখে আনে। জানি না কোথা অনেক দূরে বাজিল প্রাণ গভীর সুরে, সকল গান টানিছে পথপানে। নিবিড়তর তিমির চোখে আনে। কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো। বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো। ডাকিছে মেঘ, হাঁকিছে হাওয়া, সময় গেলে হবে না যাওয়া, নিবিড় নিশা নিকষঘন কালো। পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোন্‌ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস। সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো, ধরায় আস। এই   অকুল সংসারে দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝংকারে। ঘোরবিপদ-মাঝে কোন্‌ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস। তুমি        কাহার সন্ধানে সকল সুখে আগুন জ্বেলে বেড়াও কে জানে। এমন        ব্যাকুল করে কে তোমারে কাঁদায় যারে ভালোবাস। তোমার     ভাবনা কিছু নাই-- কে যে তোমার সাথের সাথি ভাবি মনে তাই। তুমি   মরণ ভুলে কোন্‌ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গর্ব করে নিই নে ও নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গর্ব করে নিই নে ও নাম, জান অন্তর্যামী, আমার মুখে তোমার নাম কি সাজে। যখন সবাই উপহাসে তখন ভাবি আমি আমার কণ্ঠে তোমার নাম কি বাজে। তোমা হতে অনেক দূরে থাকি সে যেন মোর জানতে না রয় বাকি, নামগানের এই ছদ্মবেশে দিই পরিচয় পাছে মনে মনে মরি যে সেই লাজে। অহংকারের মিথ্যা হতে বাঁচাও দয়া করে রাখো আমায় যেথা আমার স্থান। আর-সকলের দৃষ্টি হতে সরিয়ে দিয়ে মোরে করো তোমার নত নয়ন দান। আমার পূজা দয়া পাবার তরে, মান যেন সে না পায় করো ঘরে, নিত্য তোমায় ডাকি আমি ধুলার 'পরে বসে নিত্যনূতন অপরাধের মাঝে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গান গাওয়ালে আমায় তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান গাওয়ালে আমায় তুমি কতই ছলে যে, কত সুখের খেলায়, কত নয়নজলে হে। ধরা দিয়ে দাও না ধরা, এস কাছে, পালাও ত্বরা, পরান কর ব্যথায় ভরা পলে পলে হে। গান গাওয়ালে এমনি করে কতই ছলে যে। কত তীব্র তারে, তোমার বীণা সাজাও যে, শত ছিদ্র করে জীবন বাঁশি বাজাও হে। তব সুরের লীলাতে মোর জনম যদি হয়েছে ভোর, চুপ করিয়ে রাখো এবার চরণতলে হে, গান গাওয়ালে চিরজীবন কতই ছলে যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান দিয়ে যে তোমায় খুঁজি বাহির মনে চিরদিবস মোর জীবনে। নিয়ে গেছে গান আমারে ঘরে ঘরে দ্বারে দ্বারে, গান দিয়ে হাত বুলিয়ে বেড়াই এই ভুবনে। কত শেখা সেই শেখালো, কত গোপন পথ দেখালো, চিনিয়ে দিল কত তারা হৃদ্‌গগনে। বিচিত্র সুখদুখের দেশে রহস্যলোক ঘুরিয়ে শেষে সন্ধ্যাবেলায় নিয়ে এল কোন্‌ ভবনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গাবার মতো হয় নি কোনো গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গাবার মতো হয় নি কোনো গান, দেবার মতো হয় নি কিছু দান। মনে যে হয় সবি রইল বাকি তোমায় শুধু দিয়ে এলেম ফাঁকি, কবে হবে জীবন পূর্ণ করে এই জীবনের পূজা অবসান। আর-সকলের সেবা করি যত প্রাণপণে দিই অর্ঘ্য ভরি ভরি। সত্য মিথ্যা সাজিয়ে দিই যে কত দীন বলিয়া পাছে ধরা পড়ি। তোমার কাছে গোপন কিছু নাই, তোমার পূজায় সাহস এত তাই, যা আছে তাই পায়ের কাছে আনি অনাবৃত দরিদ্র এই প্রাণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
গায়ে আমার পুলক লাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর, হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর। আজিকে এই আকাশতলে জলে স্থলে ফুলে ফলে কেমন করে মনোহরণ ছড়ালে মন মোর। কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে। পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে। আনন্দ আজ কিসের ছলে কাঁদিতে চায় নয়নজলে, বিরহ আজ মধুর হয়ে করেছে প্রাণ ভোর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চাই গো আমি তোমারে চাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাই গো আমি তোমারে চাই তোমায় আমি চাই-- এই কথাটি সদাই মনে বলতে যেন পাই। আর যা-কিছু বাসনাতে ঘুরে বেড়াই দিনে রাতে মিথ্যা সে-সব মিথ্যা ওগো তোমায় আমি চাই। রাত্রি যেমন লুকিয়ে রাখে আলোর প্রার্থনাই-- তেমনি গভীর মোহের মাঝে তোমায় আমি চাই। শান্তিরে ঝড় যখন হানে শান্তি তবু চায় সে প্রাণে, তেমনি তোমায় আঘাত করি তবু তোমায় চাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিত্ত আমার হারাল আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিত্ত আমার হারাল আজ মেঘের মাঝখানে, কোথায় ছুটে চলেছে সে কোথায় কে জানে। বিজুলি তা'র বীণার তারে আঘাত করে বারে বারে, বুকের মাঝে বজ্র বাজে কী মহাতানে। পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে নিবিড় নীল অন্ধকারে জড়াল রে অঙ্গ আমার, ছড়াল প্রাণে। পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি হল আমার সাথের সাথি, অট্টহাসে ধায় কোথা সে-- বারণ না মানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
চিরজনমের বেদনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরজনমের বেদনা, ওহে        চিরজীবনের সাধনা। তোমার আগুন উঠুক হে জ্বলে, কৃপা করিয়ো না দুর্বল ব'লে, যত তাপ পাই সহিবারে চাই, পুড়ে হোক ছাই বাসনা। অমোঘ যে ডাক সেই ডাক দাও আর দেরি কেন মিছে। যা আছে বাঁধন বক্ষ জড়ায়ে ছিঁড়ে প'ড়ে যাক পিছে। গরজি গরজি শঙ্খ তোমার বাজিয়া বাজিয়া উঠুক এবার, গর্ব টুটিয়া নিদ্রা ছুটিয়া জাগুক তীব্র চেতনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়িস নে ধরে থাক এঁটে, ওরে  হবে তোর জয়। অন্ধকার যায় বুঝি কেটে, ওরে  আর নেই ভয়। ওই দেখ্‌ পূর্বাশার ভালে নিবিড় বনের অন্তরালে শুকতারা হয়েছে উদয়। ওরে  আর নেই ভয়। এরা যে কেবল নিশাচর-- অবিশ্বাস আপনার 'পর, নিরাশ্বাস, আলস্য সংশয়, এরা প্রভাতের নয়। ছুটে আয়, আয় রে বাহিরে, চেয়ে দেখ্‌, দেখ্‌ ঊর্ধ্বশিরে, আকাশ হতেছে জ্যোতির্ময়। ওরে  আর নেই ভয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ছিন্ন করে লও হে মোরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিন্ন করে লও হে মোরে আর বিলম্ব নয় ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি এই জাগে মোর ভয়। এ ফুল তোমার মালার মাঝে ঠাঁই পাবে কি, জানি না যে, তবু তোমার আঘাতটি তার ভাগ্যে যেন রয়। ছিন্ন করো ছিন্ন করো আর বিলম্ব নয়। কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে, আসবে আঁধার করে, কখন তোমার পূজার বেলা কাটবে অগোচরে। যেটুকু এর রঙ ধরেছে, গন্ধে সুধায় বুক ভরেছে, তোমার সেবায় লও সেটুকু থাকতে সুসময়। ছিন্ন করো ছিন্ন করো আর বিলম্ব নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ। ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন। নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে, শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন। তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার বাজাই আমি বাঁশি। গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি। এখন সময় হয়েছে কি। সভায় গিয়ে তোমায় দেখি জয়ধ্বনি শুনিয়ে যাব এ মোর নিবেদন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জগৎ জুড়ে উদার সুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে, সে গান কবে গভীর রবে বাজিবে হিয়া-মাঝে। বাতাস জল আকাশ আলো সবারে কবে বাসিব ভালো, হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা বসিবে নানা সাজে। নয়নদুটি মেলিলে কবে পরান হবে খুশি, যে পথ দিয়া চলিয়া যাব সবারে যাব তুষি। রয়েছ তুমি, এ কথা কবে জীবন-মাঝে সহজ হবে, আপনি কবে তোমারি নাম ধ্বনিবে সব কাজে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জননী, তোমার করুণ চরণখানি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জননী, তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে। জননী, তোমার মরণহরণ বাণী নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে। তোমারে নমি হে সকল ভুবন-মাঝে, তোমারে নমি হে সকল জীবন-কাজে; তনু মন ধন করি নিবেদন আজি ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে। জননী, তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জানি জানি কোন্‌ আদি কাল হতে ভাসালে আমারে জীবনের স্রোতে, সহসা হে প্রিয়, কত গৃহে পথে রেখে গেছ প্রাণে কত হরষন। কতবার তুমি মেঘের আড়ালে এমনি মধুর হাসিয়া দাঁড়ালে, অরুণ-কিরণে চরণ বাড়ালে, ললাটে রাখিলে শুভ পরশন। সঞ্চিত হয়ে আছে এই চোখে কত কালে কালে কত লোকে লোকে কত নব নব আলোকে আলোকে অরূপের কত রূপদরশন। কত যুগে যুগে কেহ নাহি জানে ভরিয়া ভরিয়া উঠেছে পরানে কত সুখে দুখে কত প্রেমে গানে অমৃতের কত রসবরষন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবন যখন শুকায়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো। সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো। কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার, হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ, শান্তচরণে এসো। আপনারে যবে করিয়া কৃপণ কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন, দুয়ার খুলিয়া হে উদার নাথ, রাজ-সমারোহে এসো। বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায় ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবনে যত পূজা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনে যত পূজা হল না সারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা। যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে, যে নদী মরুপথে হারালো ধারা, জানি হে জানি তাও হয় নি হারা। জীবনে আজো যাহা রয়েছে পিছে, জানি হে জানি তাও হয় নি মিছে। আমার অনাগত আমার অনাহত তোমার বীণা-তারে বাজিছে তারা-- জানি হে জানি তাও হয় নি হারা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জীবনে যা চিরদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনে যা চিরদিন রয়ে গেছে আভাসে প্রভাতের আলোকে যা ফোটে নাই প্রকাশে, জীবনের শেষ দানে জীবনের শেষ গানে, হে দেবতা, তাই আজি দিব তব সকাশে, প্রভাতের আলোকে যা ফোটে নাই প্রকাশে। কথা তারে শেষ করে পারে নাই বাঁধিতে, গান তারে সুর দিয়ে পারে নাই সাধিতে। কী নিভৃতে চুপে চুপে মোহন নবীনরূপে নিখিল নয়ন হতে ঢাকা ছিল, সখা, সে। প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে। ভ্রমেছি তাহারে লয়ে দেশে দেশে ফিরিয়া, জীবনে যা ভাঙাগড়া সবি তারে ঘিরিয়া। সব ভাবে সব কাজে আমার সবার মাঝে শয়নে স্বপনে থেকে তবু ছিল একা সে। প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে। কত দিন কত লোকে চেয়েছিল উহারে, বৃথা ফিরে গেছে তারা বাহিরের দুয়ারে আর কেহ বুঝিবে না, তোমা সাথে হবে চেনা সেই আশা লয়ে ছিল আপনারি আকাশে, প্রভাতের আলোকে তো ফোটে নাই প্রকাশে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জড়ায়ে আছে বাধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জড়ায়ে আছে বাধা, ছাড়ায়ে যেতে চাই, ছাড়াতে গেলে ব্যথা বাজে। মুক্তি চাহিবারে তোমার কাছে যাই চাহিতে গেলে মরি লাজে। জানি হে তুমি মম জীবনে শ্রেয়তম, এমন ধন আর নাহি যে তোমা-সম, তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা ফেলিয়া দিতে পারি না যে। তোমারে আবরিয়া ধুলাতে ঢাকে হিয়া মরণ আনে রাশি রাশি, আমি যে প্রাণ ভরি তাদের ঘৃণা করি তবুও তাই ভালোবাসি। এতই আছে বাকি, জমেছে এত ফাঁকি, কত যে বিফলতা, কত যে ঢাকাঢাকি, আমার ভালো তাই চাহিতে যবে যাই ভয় যে আসে মনোমাঝে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জড়িয়ে গেছে সরু মোটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জড়িয়ে গেছে সরু মোটা দুটো তারে জীবনবীণা ঠিক সুরে তাই বাজে না রে। এই বেসুরো জটিলতায় পরান আমার মরে ব্যথায়, হঠাৎ আমার গান থেমে যায় বারে বারে। জীবনবীণা ঠিক সুরে আর বাজে না রে। এই বেদনা বইতে আমি পারি না যে, তোমার সভার পথে এসে মরি লাজে। তোমার যারা গুণী আছে বসতে নারি তাদের কাছে, দাঁড়িয়ে থাকি সবার পাছে বাহির-দ্বারে। জীবনবীণা ঠিক সুরে আর বাজে না রে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ডাকো ডাকো ডাকো আমারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাকো ডাকো ডাকো আমারে, তোমার স্নিগ্ধ শীতল গভীর পবিত্র আঁধারে। তুচ্ছ দিনের ক্লান্তি গ্লানি দিতেছে জীবন ধুলাতে টানি, সারাক্ষণের বাক্যমনের সহস্র বিকারে। মুক্ত করো হে মুক্ত করো আমারে, তোমার নিবিড় নীরব উদার অনন্ত আঁধারে। নীরব রাত্রে হারাইয়া বাক্‌ বাহির আমার বাহিরে মিশাক, দেখা দিক মম অন্তরতম অখণ্ড আকারে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তব সিংহাসনের আসন হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তব   সিংহাসনের আসন হতে এলে তুমি নেমে, মোরবিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে। একলা বসে আপন-মনে গাইতেছিলেম গান, তোমার কানে গেল সে সুর এলে তুমি নেমে, মোর   বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে। তোমার সভায় কত-না গান কতই আছেন গুণী; গুণহীনের গানখানি আজ বাজল তোমার প্রেমে। লাগল বিশ্বতানের মাঝে একটি করুণ সুর, হাতে লয়ে বরণমালা এলে তুমি নেমে, মোর  বিজন ঘরের দ্বারের কাছে দাঁড়ালে নাথ থেমে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই  তোমার আনন্দ আমার 'পর তুমি  তাই এসেছ নীচে। আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার     প্রেম হত যে মিছে। আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা, আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা, মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে তোমার     ইচ্ছা তরঙ্গিছে। তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে তবু         আমার হৃদয় লাগি ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে প্রভু        নিত্য আছ জাগি। তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে, তোমারি প্রেম ভক্ত প্রাণের প্রেমে, মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায়       পূর্ণ প্রকাশিছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তারা তোমার নামে বাটের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারা    তোমার নামে বাটের মাঝে মাসুল লয় যে ধরি। দেখি শেষে ঘাটে এসে নাইকো পারের কড়ি। তারা তোমার কাজের তানে নাশ করে গো ধনে প্রাণে, সামান্য যা আছে আমার লয় তা অপহরি। আজকে আমি চিনেছি সেই ছদ্মবেশী-দলে। তারাও আমায় চিনেছে হায় শক্তিবিহীন ব'লে। গোপন মূর্তি ছেড়েছে তাই, লজ্জা শরম আর কিছু নাই, দাঁড়িয়েছে আজ মাথা তুলে পথ অবরোধ করি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তারা দিনের বেলা এসেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারা        দিনের বেলা এসেছিল আমার ঘরে, বলেছিল, একটি পাশে রইব প'ড়ে। বলেছিল, দেবতা সেবায় আমরা হব তোমার সহায়-- যা কিছু পাই প্রসাদ লব পূজার পরে। এমনি করে দরিদ্র ক্ষীণ মলিন বেশে সংকোচেতে একটি কোণে রইল এসে। রাতে দেখি প্রবল হয়ে পশে আমার দেবালয়ে, মলিন হাতে পূজার বলি হরণ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি আমার আপন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি আমার আপন, তুমি আছ আমার কাছে, এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও। তোমার মাঝে মোর জীবনের সব আনন্দ আছে, এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও। আমায়             দাও সুধাময় সুর, আমার             বাণী করো সুমধুর; আমার             প্রিয়তম তুমি, এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও। এই          নিখিল আকাশ ধরা এই যে      তোমায় দিয়ে ভরা, আমার      হৃদয় হতে এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও। দুখি      জেনেই কাছে আস, ছোটো   বলেই ভালোবাস, আমার   ছোটো মুখে এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি        এবার আমায় লহো হে নাথ,লহো। এবার তুমি ফিরো না হে-- হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো। যে দিন গেছে তোমা বিনা তারে আর ফিরে চাহি না, যাক সে ধুলাতে। এখন  তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন  জাগি অহরহ। কী আবেশে কিসের কথায় ফিরেছি হে যথায় তথায় পথে প্রান্তরে, এবার  বুকের কাছে ও মুখ রেখে তোমার          আপন বাণী কহো। কত কলুষ কত ফাঁকি এখনো যে আছে বাকি মনের গোপনে, আমায়      তার লাগি আর ফিরায়ো না, তারে আগুন দিয়ে দহো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি কেমন করে গান কর যে গুণী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি        কেমন করে গান কর যে গুণী, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি। সুরের আলো ভুবন ফেলে ছেয়ে, সুরের হাওয়া চলে গগন বেয়ে, পাষাণ টুটে ব্যাকুল বেগে ধেয়ে, বহিয়া যায় সুরের সুরধুনী। মনে করি অমনি সুরে গাই, কণ্ঠে আমার সুর খুঁজে না পাই। কইতে কী চাই, কইতে কথা বাধে; হার মেনে যে পরান আমার কাঁদে; আমায় তুমি ফেলেছ কোন্‌ ফাঁদে চৌদিকে মোর সুরের জাল বুনি!
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি       নব নব রূপে এসো প্রাণে। এসো       গন্ধে বরনে, এসো গানে। এসো   অঙ্গে পুলকময় পরশে, এসো   চিত্তে অমৃতময় হরষে, এসো   মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে। তুমি   নব নব রূপে এসো প্রাণে। এসো       নির্মল উজ্জ্বল কান্ত, এসো       সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত, এসো       এসো হে বিচিত্র বিধানে। এসো    দুঃখে সুখে, এসো মর্মে, এসো    নিত্য নিত্য সব কর্মে; এসো    সকল-কর্ম-অবসানে। তুমি    নব নব রূপে এসো প্রাণে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি যখন গান গাহিতে বল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি যখন গান গাহিতে বল গর্ব আমার ভ'রে ওঠে বুকে; দুই আঁখি মোর করে ছল ছল নিমেষহারা চেয়ে তোমার মুখে। কঠিন কটু যা আছে মোর প্রাণে গলিতে চায় অমৃতময় গানে, সব সাধনা আরাধনা মম উড়িতে চায় পাখির মতো সুখে। তৃপ্ত তুমি আমার গীতরাগে, ভালো লাগে তোমার ভালো লাগে, জানি আমি এই গানেরি বলে বসি গিয়ে তোমারি সম্মুখে। মন দিয়ে যার নাগাল নাহি পাই, গান দিয়ে সেই চরণ ছুঁয়ে যাই, সুরের ঘোরে আপনাকে যাই ভুলে, বন্ধু ব'লে ডাকি মোর প্রভুকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তুমি যে কাজ করছ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তুমি যে কাজ করছ, আমায় সেই কাজে কি লাগাবে না। কাজের দিনে আমায় তুমি আপন হাতে জাগাবে না? ভালোমন্দ ওঠাপড়ায় বিশ্বশালার ভাঙাগড়ায় তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যেন তোমার সাথে হয় গো চেনা। ভেবেছিলেম বিজন ছায়ায় নাই যেখানে আনাগোনা, সন্ধ্যাবেলায় তোমায় আমায় সেথায় হবে জানাশোনা। অন্ধকারে একা একা সে দেখা যে স্বপ্ন দেখা, ডাকো তোমার হাটের মাঝে চলছে যেথায় বেচাকেনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার দয়া যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি তবুও দয়া করে চরণে নিয়ো টানি। আমি যা গড়ে তুলে আরামে থাকি ভুলে সুখের উপাসনা করি গো ফলে ফুলে-- সে ধুলা-খেলাঘরে রেখো না ঘৃণাভরে, জাগায়ো দয়া করে বহ্নি-শেল হানি। সত্য মুদে আছে দ্বিধার মাঝখানে, তাহারে তুমি ছাড়া ফুটাতে কে বা জানে। মৃত্যু ভেদ করি' অমৃত পড়ে ঝরি', অতল দীনতার শূন্য উঠে ভরি' পতন-ব্যথা মাঝে চেতনা আসি বাজে, বিরোধ কোলাহলে গভীর তব বাণী।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার প্রেম যে বইতে পারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার প্রেম যে বইতে পারি এমন সাধ্য নাই। এ সংসারে তোমার আমার মাঝখানেতে তাই কৃপা করে রেখেছ  নাথ অনেক ব্যবধান-- দুঃখসুখের অনেক বেড়া ধনজনমান। আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে আভাসে দাও দেখা-- কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে রবির মৃদু রেখা। শক্তি যারে দাও বহিতে অসীম প্রেমের ভার একেবারে সকল পর্দা ঘুচায়ে দাও তার। না রাখ তার ঘরের আড়াল না রাখ তার ধন, পথে এনে নিঃশেষে তায় কর অকিঞ্চন। না থাকে তার মান অপমান, লজ্জা শরম ভয়, একলা তুমি সমস্ত তার বিশ্বভুবনময়। এমন করে মুখোমুখি সামনে তোমার থাকা, কেবলমাত্র তোমাতে প্রাণ পূর্ণ করে রাখা, এ দয়া যে পেয়েছে তার লোভের সীমা নাই-- সকল লোভে সে সরিয়ে ফেলে তোমায় দিতে ঠাঁই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার সাথে নিত্য বিরোধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না-- দিনে দিনে উঠছে জমে কতই দেনা। সবাই তোমায় সভার বেশে প্রণাম করে গেল এসে, মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই মান রহে না। কী জানাব চিত্তবেদন, বোবা হয়ে গেছে যে মন, তোমার কাছে কোনো কথাই আর কহে না। ফিরায়ো না এবার তারে লও গো অপমানের পারে, করো তোমার চরণতলে চির-কেনা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমার সোনার থালায় সাজাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমার     সোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার। জননী গো, গাঁথব তোমার গলার মুক্তাহার। চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে মালা হয়ে জড়িয়ে আছে, তোমার     বুকে শোভা পাবে আমার দুখের অলংকার। ধন ধান্য তোমারি ধন, দিতে চাও তো দিয়ো আমায়, নিতে চাও তো লও। দুঃখ আমার ঘরের জিনিস, খাঁটি রতন তুই তো চিনিস-- তোর       প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস, এ মোর অহংকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমায় আমার প্রভু করে রাখি আমার আমি সেইটুকু থাক্‌ বাকি। তোমায় আমি হেরি সকল দিশি, সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি, তোমারে প্রেম জোগাই দিবানিশি, ইচ্ছা আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি-- তোমায় আমার প্রভু করে রাখি। তোমায় আমি কোথাও নাহি ঢাকি কেবল আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি। তোমার লীলা হবে এ প্রাণ ভরে এ সংসারে রেখেছ তাই ধরে, রইব বাঁধা তোমার বাহুডোরে বাঁধন আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি-- তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর, যবে আমার জনম হবে ভোর। চলে যাব নবজীবন-লোকে, নূতন দেখা জাগবে আমার চোখে, নবীন হয়ে নূতন সে আলোকে পরব তব নবমিলন-ডোর। তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর। তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই, বারে বারে নূতন লীলা তাই। আবার তুমি জানি নে কোন্‌ বেশে পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে, আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে, লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর। তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোরা শুনিস নি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি, ওই যে      আসে, আসে, আসে। যুগে যুগে পলে পলে দিনরজনী সে যে             আসে, আসে, আসে। গেয়েছি গান যখন যত আপন-মনে খ্যাপার মতো সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী- সে যে       আসে, আসে, আসে। কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে সে যে       আসে, আসে, আসে। কত শ্রাবণ অন্ধকারে মেঘের রথে সে যে              আসে, আসে, আসে। দুখের পরে পরম দুখে, তারি চরণ বাজে বুকে, সুখে কখন্‌ বুলিয়ে সে দেয় পরশমণি। সে যে              আসে, আসে, আসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও। আমার দিকে ও মুখ ফিরাও। পাশে থেকে চিনতে নারি, কোন্‌ দিকে যে কী নেহারি, তুমি আমার হৃদ্‌বিহারী হৃদয়পানে হাসিয়া চাও। বলো আমায় বলো কথা, গায়ে আমার পরশ করো। দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমায় তুমি তুলে ধরো। যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে, যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে-- হাসি মিছে,কান্না মিছে, সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দিবস যদি সাঙ্গ হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি, ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে-- এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে, যেমন করে ঢেকেছ তুমি মুদিয়া-পড়া আঁখি, ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে। পাথেয় যার ফুরায়ে আসে পথের মাঝখানে, ক্ষতির রেখা উঠেছে যার ফুটে, বসনভূষা মলিন হল ধুলায় অপমানে শকতি যার পড়িতে চায় টুটে-- ঢাকিয়া দিক তাহার ক্ষতব্যথা করুণাঘন গভীর গোপনতা, ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন উষাপানে জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দুঃস্বপন কোথা হতে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুঃস্বপন কোথা হতে এসে জীবনে বাধায় গণ্ডগোল। কেঁদে উঠে জেগে দেখি শেষে কিছু নাই আছে মার কোল। ভেবেছিনু আর-কেহ বুঝি, ভয়ে তাই প্রাণপণে যুঝি, তব হাসি দেখে আজ বুঝি তুমিই দিয়েছ মোরে দোল। এ জীবন সদা দেয় নাড়া লয়ে তার সুখ দুখ ভয়; কিছু যেন নাই গো সে ছাড়া, সেই যেন মোর সমুদয়। এ ঘোর কাটিয়া যাবে চোখে নিমেষেই প্রভাত-আলোকে, পরিপূর্ণ তোমার সম্মুখে থেমে যাবে সকল কল্লোল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে, আপন জেনে আদর করি নে। পিতা বলে প্রণাম করি পায়ে, বন্ধু বলে দু-হাত ধরি নে। আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে আমার হয়ে এলে যেথায় নেমে সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধরে সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে। ভাই তুমি যে ভায়ের মাঝে প্রভু, তাদের পানে তাকাই না যে তবু, ভাইয়ের সাথে ভাগ ক'রে মোর ধন তোমার মুঠা কেন ভরি নে। ছুটে এসে সবার সুখে দুখে দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে, সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দয়া করে ইচ্ছা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে এসো তুমি এ ক্ষুদ্র আলয়ে। তাই তোমার মাধুর্যসুধা ঘুচায় আমার আঁখির ক্ষুধা, জলে স্থলে দাও যে ধরা কত আকার লয়ে। বন্ধু হয়ে পিতা হয়ে জননী হয়ে আপনি তুমি ছোটো হয়ে এসো হৃদয়ে। আমিও কি আপন হাতে করব ছোটো বিশ্বনাথে। জানাব আর জানব তোমায় ক্ষুদ্র পরিচয়ে?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দয়া দিয়ে হবে গো মোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে-- নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে। তোমায় দিতে পূজার ডালি বেড়িয়ে পড়ে সকল কালি, পরান আমার পারি নে তাই পায়ে থুতে। এতদিন তো ছিল না মোর কোনো ব্যথা, সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল মলিনতা। আজ ওই শুভ্র কোলের তরে ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে দিয়ো না গো, দিয়ো না আর ধুলায় শুতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়, তবু জান, মন তোমারে চায়। অন্তরে আছ হে অন্তর্যামী, আমা চেয়ে আমায় জানিছ স্বামী-- সব সুখে দুখে ভুলে থাকায় জান, মম মন তোমারে চায়। ছাড়িতে পারি নি অহংকারে, ঘুরে মরি শিরে বহিয়া তারে, ছাড়িতে পারিলে বাঁচি যে হায়-- তুমি জান, মন তোমারে চায়। যা আছে আমার সকলি কবে নিজ হাতে তুমি তুলিয়া লবে। সব ছেড়ে সব পাব তোমায়, মনে মনে মন তোমারে চায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু,       তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে। যায় যেন মোর সকল গভীর আশা প্রভু,       তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে। চিত্ত মম যখন যেথায় থাকে, সাড়া যেন দেয় সে তোমার ডাকে, যত বাধা সব টুটে যায় যেন প্রভু,       তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে। বাহিরের এই ভিক্ষাভরা থালি এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি, অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে প্রভু,       তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে। হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর, এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর সকলি আজ বেজে উঠুক সুরে প্রভু,       তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নদীপারের এই আষাঢ়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নদীপারের এই আষাঢ়ের প্রভাতখানি নে রে, ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি। সবুজ নীলে সোনায় মিলে যে সুধা এই ছড়িয়ে দিলে, জাগিয়ে দিলে আকাশতলে গভীর বাণী-- নে রে, ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি। এমনি করে চলতে পথে ভবের কূলে দুই ধারে যা ফুল ফুটে সব নিস রে তুলে। সেগুলি তোর চেতনাতে গেঁথে তুলিস দিবস-রাতে, প্রতি দিনটি যতন করে ভাগ্য মানি, নে রে, ও মন, নে রে আপন প্রাণে টানি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নামটা যেদিন ঘুচাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামটা যেদিন ঘুচাবে, নাথ, বাঁচব সেদিন মুক্ত হয়ে-- আপনগড়া স্বপন হতে তোমার মধ্যে জনম লয়ে। ঢেকে তোমার হাতের লেখা কাটি নিজের নামের রেখা, কতদিন আর কাটবে জীবন এমন ভীষণ আপদ বয়ে। সবার সজ্জা হরণ করে আপনাকে সে সাজাতে চায়। সকল সুরকে ছাপিয়ে দিয়ে আপনাকে সে বাজাতে চায়। আমার এ নাম যাক না চুকে, তোমারি নাম নেব মুখে, সবার সঙ্গে মিলব সেদিন বিনা-নামের পরিচয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নামাও নামাও আমায় তোমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে, গলাও হে মন, ভাসাও জীবন নয়নজলে। একা আমি অহংকারের উচ্চ অচলে, পাষাণ-আসন ধুলায় লুটাও, ভাঙো সবলে। নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে। কী লয়ে বা গর্ব করি ব্যর্থ জীবনে। ভরা গৃহে শূন্য আমি তোমা বিহনে। দিনের কর্ম ডুবেছে মোর আপন অতলে সন্ধ্যাবেলার পূজা যেন যায় না বিফলে। নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিন্দা দুঃখে অপমানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিন্দা দুঃখে অপমানে যত আঘাত খাই তবু জানি কিছুই সেথা হারাবার তো নাই। থাকি যখন ধুলার 'পরে ভাবতে না হয় আসনতরে, দৈন্যমাঝে অসংকোচে প্রসাদ তব চাই। লোকে যখন ভালো বলে, যখন সুখে থাকি, জানি মনে তাহার মাঝে অনেক আছে ফাঁকি। সেই ফাঁকিরে সাজিয়ে লয়ে ঘুরে বেড়াই মাথায় বয়ে, তোমার কাছে যাব এমন সময় নাহি পাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিভৃত প্রাণের দেবতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা, ভক্ত, সেথায় খোলো দ্বার, আজ লব তাঁর দেখা। সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে, সন্ধ্যাবেলার আরতি হয় নি আমার শেখা। তব জীবনের আলোতে জীবন-প্রদীপ জ্বালি হে পূজারি, আজ নিভৃতে সাজাব আমার থালি। যেথা নিখিলের সাধনা পূজালোক করে রচনা, সেথায় আমিও ধরিব একটি জ্যোতির রেখা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিশার স্বপন ছুটল রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশার স্বপন ছুটল রে, এই ছুটল রে। টুটল বাঁধন টুটল রে। রইল না আর আড়াল প্রাণে, বেরিয়ে এলেম জগৎ-পানে, হৃদয়শতদলের সকল দলগুলি এই ফুটল রে, এই ফুটল রে। দুয়ার আমার ভেঙে শেষে দাঁড়ালে এই আপনি এসে নয়নজলে ভেসে হৃদয় চরণতলে লুটল রে। আকাশ হতে প্রভাত-আলো আমার পানে হাত বাড়ালো, ভাঙা কারার দ্বারে আমার জয়ধ্বনি উঠল রে, এই উঠল রে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পারবি না কি যোগ দিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পারবি না কি যোগ দিতে এই ছন্দে রে, খসে যাবার ভেসে যাবার ভাঙবারই আনন্দে রে। পাতিয়া কান শুনিস না যে দিকে দিকে গগনমাঝে মরণবীণায় কী সুর বাজে তপন-তারা-চন্দ্রে রে জ্বালিয়ে আগুন ধেয়ে ধেয়ে জ্বলবারই আনন্দে রে। পাগল-করা গানের তানে ধায় যে কোথা কেই-বা জানে, চায় না ফিরে পিছন-পানে রয় না বাঁধা বন্ধে রে লুটে যাবার ছুটে যাবার চলবারই আনন্দে রে। সেই আনন্দ-চরণপাতে ছয় ঋতু যে নৃত্যে মাতে, প্লাবন বহে যায় ধরাতে বরন গীতে গন্ধে রে ফেলে দেবার ছেড়ে দেবার মরবারই আনন্দে রে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভু  তোমা লাগি আঁখি জাগে; দেখা নাই পাই, পথ চাই, সেও মনে ভালো লাগে। ধুলাতে বসিয়া দ্বারে ভিখারি হৃদয় হা রে তোমারি করুণা মাগে। কৃপা নাই পাই, শুধু চাই, সেও মনে ভালো লাগে। আজি এ জগত-মাঝে কত সুখে কত কাজে চলে গেল সবে আগে। সাথি নাই পাই, তোমায় চাই, সেও মনে ভালো লাগে। চারি দিকে সুধাভরা ব্যাকুল শ্যামল ধরা কাঁদায় রে অনুরাগে। দেখা নাই নাই, ব্যথা পাই, সেও মনে ভালো লাগে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রভু, আজি তোমার দক্ষিণ হাত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভু,       আজি তোমার দক্ষিণ হাত রেখো না ঢাকি। এসেছি তোমারে, হে নাথ, পরাতে রাখী। যদি বাঁধি তোমার হাতে পড়ব বাঁধা সবার সাথে, যেখানে যে  আছে কেহই রবে না বাকি। আজি যেন ভেদ নাহি রয় আপনা পরে, তোমায় যেন এক দেখি হে বাহিরে ঘরে। তোমার সাথে যে বিচ্ছেদে ঘুরে বেড়াই কেঁদে কেঁদে, ক্ষণেক-তরে ঘুচাতে তাই তোমারে ডাকি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রভুগৃহ হতে আসিলে যেদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভুগৃহ হতে আসিলে যেদিন বীরের দল সেদিন কোথায় ছিল যে লুকানো বিপুল বল। কোথায় বর্ম, অস্ত্র কোথায়, ক্ষীণ দরিদ্র অতি অসহায়, চারি দিক হতে এসেছে আঘাত অনর্গল, প্রভুগৃহ হতে আসিলে যেদিন বীরের দল। প্রভুগৃহমাঝে ফিরিলে যেদিন বীরের দল সেদিন কোথায় লুকাল আবার বিপুল বল। ধনুশর অসি কোথা গেল খসি, শান্তির হাসি উঠিল বিকশি; চলে গেলে রাখি সারা জীবনের সকল ফল, প্রভুগৃহমাঝে ফিরিলে যেদিন বীরের দল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোক-ভূলোকে তোমার অমল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া। দিকে দিকে আজি টুটিয়া সকল বন্ধ মুরতি ধরিয়া জাগিয়া ওঠে আনন্দ; জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া। চেতনা আমার কল্যাণ-রস-সরসে শতদল-সম ফুটিল পরম হরষে সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া। নীরব আলোকে জাগিল হৃদয়প্রান্তে উদার উষার উদয়-অরুণ কান্তি, অলস আঁখির আবরণ গেল সরিয়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের দূতকে পাঠাবে নাথ কবে। সকল দ্বন্দ্ব ঘুচবে আমার তবে। আর-যাহারা আসে আমার ঘরে ভয় দেখায়ে তারা শাসন করে, দুরন্ত মন দুয়ার দিয়ে থাকে, হার মানে না, ফিরায়ে দেয় সবে। সে এলে সব আগল যাবে ছুটে, সে এলে সব বাঁধন যাবে টুটে, ঘরে তখন রাখবে কে আর ধরে তার ডাকে যে সাড়া দিতেই হবে। আসে যখন, একলা আসে চলে, গলায় তাহার ফুলের মালা দোলে, সেই মালাতে বাঁধবে যখন টেনে হৃদয় আমার নেরব হয়ে রবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রেমের হাতে ধরা দেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে; অনেক দেরি হয়ে গেল, দোষী অনেক দোষে। বিধিবিধান-বাঁধনডোরে ধরতে আসে, যাই সে সরে, তার লাগি যা শাস্তি নেবার নেব মনের তোষে। প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে। লোকে আমায় নিন্দা করে, নিন্দা সে নয় মিছে, সকল নিন্দা মাথায় ধরে রব সবার নীচে। শেষ হয়ে যে গেল বেলা, ভাঙল বেচা-কেনার মেলা, ডাকতে যারা এসেছিল ফিরল তারা রোষে। প্রেমের হাতে ধরা দেব তাই রয়েছি বসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ফুলের মতন আপনি ফুটাও গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফুলের মতন আপনি ফুটাও গান, হে আমার নাথ, এই তো তোমার দান। ওগো        সে ফুল দেখিয়া আনন্দে আমি ভাসি, আমার বলিয়া উপহার দিতে আসি, তুমি        নিজ হাতে তারে তুলে লও স্নেহে হাসি, দয়া করে প্রভু রাখো মোর অভিমান। তার পরে যদি পূজার বেলার শেষে এ গান ঝরিয়া ধরার ধুলায় মেশে, তবে        ক্ষতি কিছু নাই-- তব করতলপুটে অজস্র ধন কত লুটে কত টুটে, তারা        আমার জীবনে ক্ষণকালতরে ফুটে, চিরকালতরে সার্থক করে প্রাণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি, সে কি সহজ গান। সেই সুরেতে জাগব আমি দাও মোরে সেই কান। ভুলব না আর সহজেতে, সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে মৃত্যুমাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ। সে ঝড় যেন সই আনন্দে চিত্তবীণার তারে সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত নাচাও যে ঝংকারে। আরাম হতে ছিন্ন ক'রে সেই গভীরে লও গো মোরে অশান্তির অন্তরে যেথায় শান্তি সুমহান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিপদে মোরে রক্ষা করো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়। সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে, সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়। আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা, তরিতে পারি শকতি যেন রয়। আমার ভার লাঘব করি নাই-বা দিলে সান্ত্বনা, বহিতে পারি এমনি যেন হয়। নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে, দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা তোমারে যেন না করি সংশয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্ব যখন নিদ্রামগন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, গগন অন্ধকার; কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝংকার। নয়নে ঘুম নিল কেড়ে, উঠে বসি শয়ন ছেড়ে, মেলে আঁখি চেয়ে থাকি পাই নে দেখা তার। গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া প্রাণ উঠিল পুরে, জানি নে কোন্‌ বিপুল বাণী বাজে ব্যাকুল সুরে। কোন্‌ বেদনায় বুঝি না রে হৃদয় ভরা অশ্রুভারে, পরিয়ে দিতে চাই কাহারে আপন কণ্ঠহার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারো। নয়কো বনে, নয় বিজনে নয়কো আমার আপন মনে, সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারো। সবার পানে যেথায় বাহু পসারো, সেইখানেতেই প্রেম জাগিবে আমারো। গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে, সবার তুমি আনন্দধন,হে প্রিয়, আনন্দ সেই আমারো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভজন পূজন সাধন আরাধনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভজন পূজন সাধন আরাধনা সমস্ত থাক্‌ পড়ে। রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে। অন্ধকারে লুকিয়ে আপন মনে কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে, নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে দেবতা নাই ঘরে। তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে করছে চাষা চাষ-- পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ, খাটছে বারো মাস। রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে, ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে; তাঁরি মতন শুচি বসন ছাড়ি আয় রে ধুলার 'পরে। মুক্তি?        ওরে মুক্তি কোথায় পাবি, মুক্তি কোথায় আছে। আপনি প্রভু সৃষ্টিবাঁধন 'পরে বাঁধা সবার কাছে রাখো রে ধ্যান, থাক্‌ রে ফুলের ডালি, ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি, কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে ঘর্ম পড়ুক ঝরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভেবেছিনু মনে যা হবার তারি শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভেবেছিনু মনে যা হবার তারি শেষে যাত্রা আমার বুঝি থেমে গেছে এসে। নাই বুঝি পথ, নাই বুঝি আর কাজ, পাথেয় যা ছিল ফুরায়েছে বুঝি আজ, যেতে হবে সরে নীরব অন্তরালে জীর্ণ জীবনে ছিন্ন মলিন বেশে। কী নিরখি আজি, এ কী অফুরান লীলা, এ কী নবীনতা বহে অন্তঃশীলা। পুরাতন ভাষা মরে এল যবে মুখে, নবগান হয়ে গুমরি উঠিল বুকে, পুরাতন পথ শেষ হয়ে গেল যেথা সেথায় আমারে আনিলে নূতন দেশে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনকে, আমার কায়াকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনকে, আমার কায়াকে, আমি  একেবারে মিলিয়ে দিতে চাই এ কালো ছায়াকে। ওই আগুনে জ্বালিয়ে দিতে, ওই সাগরে তলিয়ে দিতে, ওই চরণে গলিয়ে দিতে, দলিয়ে দিতে মায়াকে-- মনকে, আমার কায়াকে। যেখানে যাই সেথায় একে আসন জুড়ে বসতে দেখে লাজে মরি, লও গো হরি এই সুনিবিড় ছায়াকে মনকে, আমার কায়াকে। তুমি আমার অনুভাবে কোথাও নাহি বাধা পাবে, পূর্ণ একা দেবে দেখা সরিয়ে দিয়ে মায়াকে। মনকে, আমার কায়াকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে করি এইখানে শেষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করি এইখানে শেষ কোথা বা হয় শেষ আবার তোমার সভা থেকে আসে যে আদেশ। নূতন গানে নূতন রাগে নূতন করে হৃদয় জাগে, সুরের পথে কোথা যে যাই না পাই সে উদ্দেশ। সন্ধ্যাবেলার সোনার আভায় মিলিয়ে নিয়ে তান পূরবীতে শেষ করেছি যখন আমার গান-- নিশীথ রাতের গভীর সুরে আবার জীবন উঠে পুরে, তখন আমার নয়নে আর রয় না নিদ্রালেশ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মরণ যেদিন দিনের শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মরণ যেদিন দিনের শেষে আসবে তোমার দুয়ারে সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে। ভরা আমার পরানখানি সম্মুখে তার দিব আনি, শূন্য বিদায় করব না তো উহারে-- মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে। কত শরৎ-বসন্ত-রাত, কত সন্ধ্যা, কত প্রভাত জীবনপাত্রে কত যে রস বরষে; কতই ফলে কতই ফুলে হৃদয় আমার ভরি তুলে দুঃখসুখের আলোছায়ার পরশে। যা-কিছু মোর সঞ্চিত ধন এতদিনের সব আয়োজন চরমদিনে সাজিয়ে দিব উহারে-- মরণ যেদিন আসবে আমার দুয়ারে।